শ্রীগৌরসুন্দরের জয়গান
জয় জয় জয় বিশ্বম্ভর দ্বিজরাজ ।
জয় বিশ্বম্ভর-প্রিয় বৈষ্ণব-সমাজ ।।৩।।
বিশ্বম্ভর ‘দ্বিজরাজ’ এবং বিশ্বম্ভরপ্রিয় ‘বৈষ্ণব-সমাজ’—শ্রীগৌরসুন্দর স্বয়ং পরিপূর্ণতম ব্রহ্মণ্যদেব হইয়াও ব্রাহ্মণকুলোত্তম এবং তাহার প্রিয়বর্গই নিখিল-বর্ণাশমি-গুরু পরমহংস বা ‘বৈষ্ণব-সমাজ’। সংস্কার-বর্জিত মানবের ‘একজন্মা শূদ্র’ এবং সংস্কার সম্পন্ন মানবেরই ‘দ্বিজ’-সজ্ঞা। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য যদিও ‘দ্বিজ’-শব্দবাচ্য, তথাপি ‘দ্বিজরাজ’-শব্দ একমাত্র ‘ব্রাহ্মণ’কেই নির্দেশ করে। ইহজগতে বন্ধনাবস্থায় জীব বীজগর্ভ-সমুদ্ভব-পাপে সংস্পৃষ্ট হইবার যোগ্য, সুতরাং শরীরধারী জীবের নৈসর্গিকপাপ-প্রশমনার্থ সংস্কার আবশ্যক। ভগবান্ বিশ্বম্ভর সংস্কারের প্রতি ঔদাসীন্য, উহার অপ্রয়োজনীয়তা ও রাহিত্য বা বিরোধ কোনদিনই অনুমোদন করেন নাই। তিনি ভক্ত্যনুকূল দৈব বর্ণাশ্রমাচারেরই পক্ষপাতী ছিলেন; অবৈষ্ণবপর বা অদৈব-বর্ণাশ্রমবিচার কোন দিনই তাঁহার প্রিয় ছিল ন। বিষ্ণুভক্ত্যনুকূল বৃত্তবর্ণ বা প্রকৃত আশ্রম-বিচারকেই তিনি দৈববর্ণাশ্রম ধর্ম বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন; তজ্জন্যই বৈষ্ণব-সমাজ তাহার প্রিয়। অবৈষ্ণবসমাজে কর্মকাণ্ডের বিশেষ আদর এবং কেবলাদ্বৈতপরতা লক্ষিত হইত, কিন্তু তাহার প্রকটকালের বহুপূর্বে শ্রীবৈষ্ণবসমাজ ও তত্ত্ববাদি-বৈষ্ণবসমাজ দাক্ষিণাত্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছেন। তিনি সদ্-বৈষ্ণব-সমাজ বা শ্রীমাধ্বগৌড়ীয়সমাজকে অত্যন্ত প্রিয় জ্ঞান করিতেন। সদ্বৈষ্ণব-সমাজের অন্তর্গত কর্ণাটদেশীয় বিপ্রকুলোদ্ভূত শ্রীসনাতন ও শ্রীরূপপ্রভু প্রভৃতি শ্ৰীমাধ্বগৌড়ীয়-ব্রাহ্মণগণকে তিনি নিজ প্রিয়তম বৈষ্ণবাচার্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। আবার শ্রীবৈষ্ণবসমাজ হইতে শ্রীপাদ প্রবোধানন্দ ও শ্রীপাদ গোপালভট্ট প্রভুদ্বয়কেও তিনি নিজ প্রিয়বরত্বে গ্রহণ করিয়াছেন। দক্ষিণ-দেশীয় শ্রী-সম্প্রদায় ও ব্রহ্ম সম্প্রদায় শ্রীগৌরসুন্দরের প্রিয় হইলেও নিজ-প্রিয় শ্রীগৌড়ীয়-বৈষ্ণব-সমাজই তাঁহার অত্যন্ত আদরের। কালক্রমে গৌড়ীয়-বৈষ্ণব-সমাজের ধারা ও পদ্ধতি স্মার্ত-বিচারানুসারে পঞ্চোপাসকগণের উপদ্রবফলে বিশেষরূপে বিশৃঙ্খল হইয়া পড়িয়াছিল, তজ্জন্য তিনি শ্রীমাধ্ববি-সমাজোত শ্রীমৎসনাতন গোস্বামিপাদকে শ্রীহরিভক্তিবিলাসনামক বৈষ্ণব-স্মৃতি-সঙ্কলনের আদেশ প্রদান করেন। শ্রীরামানুজীয় বৈষ্ণব-সমাজে আবির্ভূত শ্রীপাদ গোপালভট্ট গোস্বামী শ্রীমৎসনাতন-রূপপ্রভুদ্বয়ের অত্যন্ত প্রিয় বলিয়া শ্রীমৎসনাতন গোস্বামীপ্রভু নিজ-সঙ্কলিত হরিভক্তিবিলাস-গ্রন্থ স্বীয় অনুগত দাস শ্রীগোপাল ভট্টগোস্বামীর দ্বারা সম্বর্ধন করেন। সুতরাং গৌড়ীয়-বৈষ্ণবস্মৃতি ও গৌড়ীয়-বৈষ্ণব-সমাজিক বিধি-শাস্ত্র ‘শ্রীহরিভক্তিবিলাস’ ও তদনুকূল সৎক্রিয়াসার-দীপিকা’ ও ‘সংস্কারদীপিকা’রূপেই গৃহীত হয়। শ্রীগৌরসুন্দরের অনুগত বৈষ্ণবসমাজে আমরা ক-একটী বিষয়ের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করি। স্মার্তগণের পদ্ধতি বৈষ্ণব-স্মৃতিকে নানাপ্রকারে বাধা দেওয়ায় শ্রীধ্যানচন্দ্র, শ্রীরসিকানন্দ এবং অধুনাতম শ্রীশ্রীমদ্ভক্তিবিনোদ ঠাকুর মহাশয় শ্রীগৌরানুগত গৌড়ীয় বৈষ্ণব-সমাজের প্রকৃত শাশ্বত মঙ্গল আকাঙ্ক্ষা করিয়াছেন।
শ্রীমদ্ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের স্থাপিত গৌড়ীয়-বৈষ্ণব-সমাজ শ্রীচৈতন্যাব্দের পঞ্চম শতাব্দীর প্রারম্ভে কলিকাতা মহানগরীতে স্থাপিত হয়। তখনও গৌড়দেশে গৌড়ীয়-ব্রুবগণ নিজ-সম্প্রদায়ের কোন কথাই আলোচনা করিতে আরম্ভ করে নাই। ইহার কিছু পরেই কলিকাতায় গৌরাঙ্গ-সমাজ নামক একটী নব্য সম্প্রদায় সনাতন বৈদিকাচারের আনুগত্য পরিহারপূর্বক মনঃকল্পিত নবীন-স্মৃতির সহায়তায় স্থাপিত হইয়াছিল। গৌড়ীয় বৈষ্ণব-সমাজ-শ্রীবিশ্ববৈষ্ণব-রাজসভার শাখাবিশেষ। আধুনিক তার্কিকসম্প্রদায় অদূরদর্শিতাক্রমে বলিয়া থাকেন যে, প্রাচীন গ্রন্থের মধ্যে বৈষ্ণব-সমাজ’-শব্দটীর ব্যবহার নাই’; বক্ষ্যমাণ মহাগ্রন্থস্থিত এই অংশটী পাঠ করিলে তাহাদের নিজ অনভিজ্ঞতা উপলব্ধ ও অপসারিত হইবে। গৌড়ীয়-বৈষ্ণবতাঁহারা পূর্ব পূর্ব আচার্য-চতুষ্টয়ের ‘ঐকান্তিকতা’, ‘কাষ্ণাচার’, ‘সশক্তিক-শক্তিমদবিগ্রহানুগত্য’ও ‘তদীয়তা’সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করিয়া অহৈতুক-ভজন-সৌন্দর্য জগতে প্রচার করিয়াছেন। কেবলাদ্বৈত-মায়াবাদ-মূলক নিত্য-ঈশ-সেবন-বর্জিত নীরস শুষ্ক নির্বিশেষজ্ঞান-বিরুদ্ধতা, শৌক্রবিচারের পরিবর্তে বৃত্তবিচারমুখে বৈষ্ণবত্বের উপ-যোগিতা, ভক্তিশাস্ত্রের সর্বোত্তমতা, কর্মজ্ঞানাবৃত বিদ্ধপঞ্চোপাসনা-পরিবর্জন প্রভৃতি অনেকগুলি বৈশিষ্ট্য—যাহা মধ্যযুগীয় আচার্যগণের প্রচার্য বিষয়ের মধ্যে বিস্তারিত হয় নাই, সেইগুলি গৌড়ীয়-বৈষ্ণবের বিচার-প্রণালীর মধ্যে লক্ষিত হয়। কিন্তু গভীর দুঃখের বিষয় এই যে, শুদ্ধভক্তিবিরোধিগণের দম্ভ ও মাৎসর্য শুদ্ধবৈষ্ণবাচারকে ন্যূনাধিক বাধা দিয়াছে। | বৈষ্ণব-সম্রাট শ্রীল জগন্নাথদাস ও তদনুগ শ্রীশ্রীমদ্ভক্তি বিনোদঠাকুর মহাশয় গৌড়ীয়-বৈষ্ণব-সমাজে প্রবিষ্ট বহু কয়রাশি ভাবে বিদূরিত করিয়াছেন। সুতরাং বর্তমান যুগে এই শুদ্ধ-বৈষ্ণবরাজগণ ও তাহাদের নিষ্কপট, প্রিয় অনুগগণকেই বিশ্বম্ভরপ্রিয় বৈষ্ণব-সমাজ বলা যাইতে পারে। হঁহাদের প্রতিকূল-চেষ্টাপরায়ণ প্রতীপগণ—গৌড়ীয়-বৈষ্ণব-সমাজের অশেষ অমঙ্গল-সাধনকারী অর্থাৎ তাহারাই-শ্রীগৌরসুন্দরের প্রিয়-বিরোধী অপ্রিয়।