কৃষ্ণসেবাবিহীন কর্ণের গহণ :—
এই শব্দামৃত চারি, যার হয় ভাগ্য ভারি,
সেই কর্ণে ইহা করে পান ।
ইহা যেই নাহি শুনে, সে কাণ জন্মিল কেনে,
কাণাকড়ি-সম সেই কাণ ॥’’৪৮॥
৪১-৪৮।নবীনমেঘের ধ্বনিকে পরাজয় করিয়া যাঁহার কণ্ঠের গভীর ধ্বনি বিরাজমান ; যাঁহার মিষ্ট গানে কোকিল লজ্জা পায়,—যাঁহার সামান্য কিছুমাত্র কর্ণগত হইলেই জগতের (অন্যান্য) কাণকে (শব্দকে) এমন নিমগ্ন (পরাভূত) করে, যে সেই কাণ আর ফিরিয়া আসিতে পারে না ; হে সখি, কৃষ্ণের সেই শব্দগুণে আমার কর্ণ অপহৃত হইয়াছে, এখন তাহা না পাইয়া আমাকে তৃষ্ণায় মরিতে হইতেছে। তাঁহার নূপুর-কিঙ্কিণী- ধ্বনি হংস-সারস-স্বরকে পরাজয় করে, তাঁহার কঙ্কণধ্বনি চটক পক্ষীকে লজ্জা দেয়। যাহার কাণে একবার উহা প্রবেশ করে, সে অন্য কোন শব্দকেই কাণে প্রবেশ করিতে দেয় না। কৃষ্ণের বচন-মাধুরী-অমৃত অপেক্ষাও পরম অমৃতময়ী; তাহা আবার হাস্যরূপ কর্পূর মিশ্রিত ; তাহা শব্দশক্তি, অর্থশক্তি ও শৃঙ্গারাদি নানারসের ব্যঞ্জনা করে এবং তাহার প্রতি-অক্ষর-নৰ্ম্ম অর্থাৎ পরিহাস-ভূষিত। সেই অমৃতের এককণ (বিন্দু)—কর্ণরূপ চকোরের জীবনস্বরূপ ; তাহার আশাতেই কর্ণচকোর জীবিত থাকে ; কখনও ভাগ্যবশতঃ উহা প্রাপ্ত হয়, কখনও অভাগ্যবশে উহা পায় না ; যখন পায় না, তখন পিপাসায় সে মরণাপন্ন হয়; আবার তাঁহার বেণুকলধ্বনি একবার শুনিলে জগন্নারীর চিত্ত এলাইয়া (শিথিল হইয়া) পড়ে, নীবিবন্ধ খসিয়া পড়ে এবং তাহারা বিনামূল্যের দাসী হইয়া বাতুলিনীর ন্যায় কৃষ্ণের নিকট ধাবমানা হয়। আবার লক্ষ্মীঠাকুরাণী তাঁহার কাকলী-রব শ্রবণ করত প্রত্যাশাপূৰ্ব্বক কৃষ্ণের নিকট আসিয়াও কৃষ্ণসঙ্গ না পাওয়ায় তাঁহার তৃষ্ণা-তরঙ্গ বৃদ্ধি পায় ; সেই আশায় তিনি তপস্যা করিয়াও কৃষ্ণকে লাভ করিতে পারেন না। এই চারি প্রকার শব্দামৃত অর্থাৎ বচন, নূপুরকঙ্কন-শব্দ, কণ্ঠধ্বনি ও মুরলীধ্বনি ভাগ্যবান্ লোকেরই কর্ণে প্রবেশ করে। যাঁহার কর্ণে এই শব্দামৃতচতুষ্টয় প্রবেশ করে নাই, সেই কাণের জন্মই বৃথা ; কাণাকাড়ির ন্যায় তাহা— নিরর্থক।