শ্রীজীবগোস্বামিপাদ ষট্সন্দর্ভের অন্যতম ভক্তিসন্দর্ভ গ্রন্থে ১৯৮ সংখ্যায় অর্থ-পঞ্চকের যে ব্যাখ্যা লিখিয়াছেন, তাহা শ্রীলোকাচার্য্যের বিবরণ হইতে পৃথক্। শ্রীজীব-গোস্বামী ‘হয়শীর্ষ পঞ্চরাত্র’ হইতে অর্থপঞ্চকের বিস্তৃত-ব্যাখ্যায় এরূপ সংক্ষিপ্ত-সার গ্রহণ করিয়াছেন। উপাস্য শ্রীভগবান্, তাঁহার পরমপদ,তাঁহার দ্রব্য, তাঁহার মন্ত্র এবং জীবাত্মা―এই পাঁচটী তত্ত্বের জ্ঞাতাকেই অর্থপঞ্চকবিৎ বলে।
১। একমাত্র পরমেশ্বর সচ্চিদানন্দবিগ্ৰহ কৃষ্ণ। তিনি কৃষ্ণচ্ছুরিত কেশ, পুণ্ডরীক-বিশাল-দৃষ্টিসম্পন্ন, বৈকুণ্ঠাধিপতি লীলা প্রভাবে চিৎস্বরূপ, স্বর্ণকান্তি বিশালনয়নী দেবীর সহিত স্বভাবতঃ গাঢ়ালিঙ্গিত। তিনি নিত্য, সর্ব্বগত, পূর্ণ, ব্যাপক এবং সকলের কারণ। তিনি বেদগোপ্য, গভীরাত্মা এবং নানা নব শক্তিতে অভ্যুদিত।
২। তাঁহার স্থান প্রকৃতির পরপারে অবস্থিত; তাহা অব্যয়, শুদ্ধসত্ত্বময়, কোটিসূৰ্য্যচন্দ্রসম জ্যোতির্ম্ময়, সচ্চিদানন্দলক্ষণ-বিশিষ্ট সাক্ষাৎ চিন্তামণিময়। সেইস্থান সর্ব্বভূতের আধার, এবং তাহা সর্ব্বপ্রলয় বর্জ্জিত। ইহাই পরমপদতত্ত্ব বা স্থান-তত্ত্ব।
৩। সেইস্থানে কল্পতরুসমূহ সর্ব্বভোগপ্রদ, বল্লীসমূহও তাদৃশ এবং তদুৎপন্ন দ্রব্যও সেইরূপ। যাহা কিছু পুষ্পাদি দ্রব্য গন্ধরূপ ও তাদৃশ স্বাদুরূপ। তাহাতে হেয়াংশের অধিষ্ঠান না থাকায় তাহাই রসরূপ। তাহার যাহা কিছু হেয়াংশ—ত্বক্, বীজ ও কঠিনাংশ সকলগুলিই অপ্রাকৃত ভৌতিক জানিবে, অভূতময় নহে। রসযোগে ভৌতিক হইলেও স্বাদবিশিষ্ট। তজ্জন্য স্বাদযুক্তসাধ্যরস শ্রেষ্ঠ ব্যাপক রস। এ স্থানের ভৌতিকরসবিশিষ্ট দ্রব্যসমূহ রসরূপ।
৪. দেবতা এবং তন্মন্ত্র বাচ্য ও বাচকরূপে ভিন্ন দেখা গেলেও তত্ত্ববিদ্গণ উভয়ের অভেদই বিচার করিয়াছেন।
৫। সাগর-জলে বায়ুর সংযোগে যেরূপ তরঙ্গ হইতে কণিকা উত্থিত হয়, সেইরূপ সেব্য ভগবানের লীলাপুষ্টিবৈচিত্র-জন্য জীবস্বরূপ-বৈশিষ্ট্য প্রকটিত হয়। উভয়ের সেব্যসেবক সম্মেলনে সহস্র সহস্র জীবাত্মা মূৰ্ত্তামূর্ত্ত স্বরূপ ভগবান্ হইতে নিত্য প্রাকট্যবিশিষ্ট্য শ্রীভগবানের লীলা পরিকরগণের বিশেষ নিজ নিজ সেবাপ্রকারাদি শাস্ত্রানুসারে জানিবে। বিষ্ণুশক্তিকে পরা শক্তি, স্বীয় স্বতন্ত্র সেবক-পরিচয়জ্ঞানবিশিষ্ট নিত্যসত্তাকে জীবশক্তি এবং তৃতীয় অচিজজ্ঞানরূপ অজ্ঞানাশ্রিত বন্ধোপযোগী ভোক্তৃভাবাশ্রয়-যোগ্য কৰ্ম্ম-সংজ্ঞিত অবিদ্যা-শক্তি বিষ্ণুপুরাণে কথিত হইয়াছে। গীতায়ও ক্ষিত্যপ্তেজমরুদ্ব্যোমাদি এবং মন-বুদ্ধি-অহঙ্কারাত্মক আট প্রকার প্রাকৃত ব্যাপারকে অপরা বলিয়া তদতিরিক্ত পরা প্রকৃতির অন্তর্গত জীবকে নিরশ করা হইয়াছে। “এই জীব তটস্থধৰ্ম্মক্রমে অপরা প্রকৃতির সহিত অভেদ মনে করিয়া জড়ভোগে আবদ্ধ হয়। জীবভূত আমার অংশই জীববিচারকালে শক্তিপরিণত হইয়া নিত্য প্রকাশ।” তটস্থ অবস্থায় নিজানুভূতি হইতে স্বতঃকর্ত্তৃত্ব চিদ্ধৰ্ম্ম বা চিদ্রূপত্ব নির্গত হইয়া গুণান্তৰ্গত হইয়া বদ্ধ হয়। এই সকল জীব-স্বরূপের কথা নারদপঞ্চরাত্র হইতে জ্ঞাতব্য।