Normal view
Book Lang.: বাংলা
English
संस्कृता वाक्
Translation
Gaudīya Base»Books»জৈবধর্ম»পঞ্চম অধ্যায় - বৈধী ভক্তি—নিত্যধর্ম, নৈমিত্তক নয়

পঞ্চম অধ্যায় - বৈধী ভক্তি—নিত্যধর্ম, নৈমিত্তক নয়

Language: বাংলা
Language: English Translation
  • (লাহিড়ী মহাশয়ের পুত্র দেবীদাস ও চন্দ্রনাথ—–শান্তিপুরে নানাকথা―দেবী, চন্দ্রনাথ ও তদুভয়ের মাতার পরামর্শ—দেবীদাস ও শম্ভুনাথের গোদ্রুমগমন ও লাহিড়ী মহাশয়কে দর্শন-- বৈষ্ণবদিগের প্রার্থনা ও লাহিড়ী মহাশয়ের পদ—শান্তিপুর-বাসের অসুখ-বর্ণন―বর্ণাশ্রমের সন্ধ্যা-বন্দনাদি, বৈধভক্তির সাধন হইতে পৃথক্‌-রাজসিক, সাত্ত্বিক ও তামসিক ভেদে শাস্ত্র তিনপ্রকার—সারগ্রাহী অধিকারী―মুক্তি-বিচার―ন্যায় ও বেদান্ত—শাঙ্কর-ভাষ্য, ব্রহ্মসূত্র ও বৈষ্ণবভাষ্য লইয়া কথা―কবিকর্ণপুর―গোপীনাথাচার্য―স্মার্তসংসার ও বৈষ্ণবসংসারে প্রভেদ―দেবীর প্রশ্ন—ঐহিক ও পারমার্থিক ভেদ―সিদ্ধিকামী, জ্ঞাননিষ্ঠ ও ঈশানুগত—নিত্যমূর্তি ও কাল্পনিকমূর্তির ভেদ—শ্রীবিগ্রহ―কাজী―রু―মুজরর্‌দ, জিসম্‌, ইস্ক্‌,মুক্তি, সুফী, বিহিস্ত—এবাদত-বন্দা―সুফিগণ অদ্বৈতবাদী—কাজী বংশধরের নিজমত-শুদ্ধভক্তি।)

    লাহিড়ী মহাশয়ের শান্তিপুরের বাড়িতে অনেক লোক জন। দুইটী সন্তান লেখাপড়া শিখিয়া মানুষ হইয়াছেন। একটির নাম চন্দ্রনাথ; তাঁহার বয়স প্রায় ৩৫ বৎসর। তিনি জমিদারী ও গৃহের সমস্ত কার্য নির্বাহ করেন, চিকিৎসাশাস্ত্রে পণ্ডিত; ধর্মের সম্বন্ধে কোন ক্লেশ স্বীকার করেন না, কিন্তু ব্রাহ্মণ সমাজে প্রভূত সম্মান; দাসদাসী, দ্বারবান্‌ প্রভৃতি রাখিয়া গৃহকার্য সম্মানের সহিত নির্বাহ করিতেছেন। দ্বিতীয় পুত্রের নাম দেবীদাস। ইনি বাল্যকাল হইতে ন্যায়শাস্ত্র ও স্মৃতিশাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া বাটির সম্মুখে একটি চতুস্পাঠী স্থাপনপূর্বক ১০।১৫ টি ছাত্র পড়াইয়া থাকেন; ইঁহার উপাধি বিদ্যারত্ন।

    এক দিবস শান্তিপুরে একটি রব উঠিল যে, কালিদাস লাহিড়ী ভেক লইয়া বৈষ্ণব হইয়াছেন। ঘাটে বাজারে পথে সর্বত্র এই কথা। কেহ কেহ কহিতেছে যে, বুড়ো বয়সে ধেড়ে রোগ; এতদিন মানুষের মত থাকিয়া এখন বুড়ো ক্ষিপ্ত হইয়াছে। কেহ বলিতে লাগিল,―“ভাল এ আবার কি রোগ―ঘরে সুখ আছে, জাতিতে ব্রাহ্মণ, পুত্র পরিবার স্ববশে,—এমন লোক কেন, কোন্‌ দুঃখে ভেক নেয়? কেহ বলিল,―“ধর্ম ধর্ম করিয়া এখানে সেখানে বেড়াইলে, এইরূপ দুর্গতিই শেষে হয়।” কোন কোন শিষ্ট লোক বলিলেন যে, কালিদাস লাহিড়ী মহাশয় পুণ্যাত্মা বটে; সংসারে সমস্তই আছে, অথচ হরিনামে শেষে রতি হইল। এইরূপ কথোপকথন হইতেছে, কোন ব্যক্তি এই সকল কথা শুনিয়া দেবী বিদ্যারত্ন মহাশয়কে কহিলেন।

    বিদ্যারত্ন বিশেষ চিন্তান্বিত হইয়া দাদার নিকট গমনপূর্বক কহিলেন,―“দাদা, বাবার ত বড়ই মুস্কিল দেখিতেছি; তিনি শরীর ভাল থাকে বলিয়া নদীয়া-গোদ্রুমে থাকেন, কিন্তু সেখানে তাঁহার সঙ্গদোষ হইয়াছে। গ্রামে ত’ আর কান পাতা যায় না।”

    চন্দ্রনাথ বলিলেন,—“ভাই! আমিও কিছু কিছু কথা শুনিয়াছি। আমাদের ঘরটা এত বড়, কিন্তু বাবার কথা শুনিয়া আর মুখ দেখাইতে পারি না। অদ্বৈতপ্রভুর বংশকে আমরা অনাদর করিয়া আসিয়াছি—এখন নিজের ঘরে কি হইল? এস অন্দরে চল, মাতা ঠাকুরাণীর সহিত এ বিষয়ে আলোচনা করিয়া যাহা হয়, কর।”

    দোতলা বারান্দায় চন্দ্রনাথ ও দেবীদাস আহার করিতে বসিয়াছেন। একটী বিধবা ব্রাহ্মণের কন্যা পরিবেশন করিতেছেন। গৃহিণী ঠাকুরাণী বসিয়া তাঁহাদিগকে ভোজন করাইতেছেন। চন্দ্রনাথ কহিলেন—“মা, বাবার কথা কিছু শুনিয়াছ?”

    মাতাঠাকুরাণী কহিলেন,—“কেন, কর্তা ভাল আছেন ত’? তিনি হরিনামে মত্ত হইয়া শ্রীনবদ্বীপে আছেন। তোমরা কেন তাঁহাকে এখানে আন না?”

    দেবীদাস কহিলেন,―“মা, কর্তা ভাল আছেন; কিন্তু যেরূপ শুনিতেছি, তাহাতে তাঁহার ভরসা আর নাই। বরং তাঁহাকে এখানে আনিলে আমাদেরই সমাজে পতিত হইতে হইবে।”

    মাতাঠাকুরাণী জিজ্ঞাসা করিলেন,―“কর্তার কি হইয়াছে? আমি সেদিন বড় গোস্বামীদের বধূর সহিত গঙ্গাতীরে অনেক কথাবার্তা কহিয়াছিলাম।” তিনি কহিলেন,―“আপনার কর্তার বিশেষ সুমঙ্গল হইয়াছে―তিনি বৈষ্ণবদের মধ্যে বিশেষ সম্মান লাভ করিয়াছেন।”

    দেবীদাস কহিলেন,—“সম্মানলাভ করিয়াছেন, না, আমাদের মাথা করিয়াছেন; এই বৃদ্ধবয়সে ঘরে থাকিয়া আমাদের সেবা গ্রহণ করিবেন, না, এখন তিনি কৌপীনধারীদের উচ্ছিষ্ট খাইয়া উচ্চবংশে কলঙ্ক আরোপ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। হায় রে কলি! এত দেখিয়া-শুনিয়া বাবার কি বুদ্ধি হইল?”

    মাতাঠাকুরাণী কহিলেন,—“তবে তাঁহাকে এখানে আনিয়া একটী গুপ্তস্থানে রাখ এবং বুঝাইয়া সুঝাইয়া মত ফিরাইয়া দেও।”

    চন্দ্রনাথ বলিলেন,—“ইহা বই আর কি করা যাইতে পারে? দেবী দুই-চারিটী লোকসঙ্গে গোদ্রুমে গোপনে গোপনে গিয়া কর্তা মহাশয়কে এখানে আনুন।”

    দেবী কহিলেন,-“আপনারা ত’ জানেন, কর্তা মহাশয় আমাকে নাস্তিক বলিয়া অনাদর করেন। আমি গেলে পাছে কোন কথা না ক’ন, তাহাই ভাবিতেছি।

    দেবীদাসের মামাত ভাই শম্ভুনাথ কর্তার প্রিয়। শম্ভুনাথ কর্তার সঙ্গে সঙ্গে থাকিয়া অনেকদিন সেবা করিয়াছে। স্থির হইল যে, দেবীদাস ও শম্ভুনাথ দুইজনে গোদ্রুমে যাইবেন। গোদ্রুমে একটী ব্রাহ্মণ-বাটীতে বাসা স্থির করিবার জন্য একটি চাকর সেই দিবসেই প্রেরিত হইল।

    পরদিবস আহারান্তে শম্ভুনাথ ও দেবীদাস গোদ্রুম যাত্রা করিলেন। নিরূপিত বাটীতে শিবিকাদ্বয় হইতে তাঁহারা নামিয়া বেহারাদিগকে বিদায় করিলেন। তথায় একজন পাচকব্রাহ্মণ ও দুইটী সেবক রহিল।

    সন্ধ্যার সময় দেবীদাস ও শম্ভুনাথ ধীরে ধীরে শ্রীপ্রদ্যুম্নকুঞ্জে যাত্রা করিলেন। দেখিলেন যে, শ্রীসুরভি-চবুতরার উপর একটী পত্ৰাসনে কর্তা মহাশয় বসিয়া, চক্ষু মুদ্রিত করতঃ মালা লইয়া হরিনাম করিতেছেন। দ্বাদশ তিলক সর্বাঙ্গে শোভা পাইতেছে। শম্ভুনাথ ও দেবীদাস ধীরে ধীরে চবুতরার উপর উঠিয়া কর্তা মহাশয়ের চরণে দণ্ডবৎ প্রণাম করিলেন। লাহিড়ী মহাশয় সচকিত হইয়া নয়ন উন্মীলন করতঃ কহিলেন,—“কেন রেশম্ভু, এখানে কি মনে করিয়া আসিয়াছিস্? দেবী, ভাল আছ ত?”

    উভয়েই নম্রভাবে কহিলেন—“আপনার আশীর্বাদে আমরা সকলেই ভাল আছি।”

    লাহিড়ী মহাশয় জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমরা কি আহারাদি করিবে? তাঁহারা উভয়ে বলিলেন,—আমরা বাসা করিয়াছি, সে বিষয়ে আপনি কিছু চিন্তা করিবেন না।”

    এমন সময়ে শ্রীপ্রেমদাস বাবাজীর মাধবীমালতীমণ্ডপে একটী হরিধ্বনি হইল। শ্রীবৈষ্ণবদাস বাবাজী নিজ কুটীর হইতে বাহির হইয়া লাহিড়ী মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, –“শ্রীপরমহংস বাবাজী মহাশয়ের মণ্ডপে হরিধ্বনি কেন হইল?” লাহিড়ী মহাশয় ও বৈষ্ণবদাস অগ্রসর হইয়া দেখিতে লাগিলেন। দেখেন যে, অনেকগুলি বৈষ্ণব আসিয়া হরিধ্বনি দিয়া বাবাজী মহাশয়কে প্রদক্ষিণ করিতেছেন। ইঁহারাও তথায় উপস্থিত হইলেন। সকলেই পরমহংস বাবাজী মহাশয়কে দণ্ডবৎ প্রণাম করিয়া মণ্ডপের উপর বসিলেন। দেবীদাস ও শম্ভুনাথ মণ্ডপের একপার্শ্বে ‘হংসমধ্যে বকো যথা’ বসিয়া থাকিলেন।

    একজন বৈষ্ণব বলিয়া উঠিলেন,―“আমরা কন্টক-নগর হইতে আসিয়াছি। শ্রীনবদ্বীপ-মায়াপুরদর্শন এবং পরমহংস বাবাজী মহাশয়ের চরণরেণু গ্রহণ করা আমাদের মুখ্য তাৎপর্য্য।” পরমহংস বাবাজী মহাশয় লজ্জিত হইয়া বলিলেন,―“আমি অতি পামর, আমাকে পবিত্র করিবার জন্য আপনাদের আগমণ।” অতি অল্পকালের মধ্যেই প্রকাশ হইল যে, তাঁহারা সকলেই হরিগুণগানে পটু। তৎক্ষণাৎ মৃদঙ্গ, করতাল আনীত হইল। সমাগত বৈষ্ণবদিগের মধ্যে একটি প্রাচীন ব্যক্তি নিম্নলিখিত প্রার্থনা-পদটি গান। করিতে লাগিলেন :-

    শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ।
    গদাই অদ্বৈতচন্দ্র গৌরভক্তবৃন্দ॥

    অপার করুণাসিন্ধু বৈষ্ণব ঠাকুর।
    মো হেন পামরে দয়া করহ প্রচুর॥

    জাতি-বিদ্যা-ধন-জন-মদে মত্ত জনে।
    উদ্ধার কর হে নাথ, কৃপাবিতরণে॥

    কনক-কামিনী-লোভ, প্রতিষ্ঠা-বাসনা।
    ছাড়াইয়া শোধ মোরে, এ মোর প্রার্থনা॥

    নামে রুচি, জীবে দয়া, বৈষ্ণবে উল্লাস।
    দয়া করি’ দেহ মোরে, ওহে কৃষ্ণদাস॥

    তোমার চরণছায়া একমাত্র আশা।
    জীবনে মরণে মাত্র আমার ভরসা॥

    এই পদটি সমাপ্ত হইলে লাহিড়ী মহাশয়ের রচিত একটী প্রার্থনা-পদ তিনি গান করিলেন;―

    মিছে মায়াবশে, সংসার-সাগরে, পড়িয়াছিলাম আমি।
    করুণা করিয়া, দিয়া পদছায়া, আমারে তারিলে তুমি॥

    শুন, শুন, বৈষ্ণব ঠাকুর।

    তোমার চরণে, সঁপিয়াছি মাথা, মোর দুঃখ কর দুর॥

    জাতির গৌরব, কেবল রৌরব, বিদ্যা সে অবিদ্যাকলা।
    শোধিয়া আমায়, নিতাই চরণে, সঁপহে,―যাউক জ্বালা॥

    তোমার কৃপায়, আমার জিহ্বায়, স্ফুরুক যুগলনাম।
    কহে কালিদাস, আমার হৃদয়ে, জাগুক শ্রীরাধাশ্যাম॥

    —এই পদটী সকলে মিলিয়া গান করিতে করিতে উন্মত্ত হইয়া উঠিলেন। অবশেষে “জাগুক শ্রীরাধাশ্যাম’―এই অংশটি পুনঃ পুনঃ উচ্চারণ করিতে করিতে উদ্দণ্ড নৃত্য হইতে লাগিল। নাচিতে নাচিতে কয়েকটি ভাবুক বৈষ্ণব প্রেমে অচেতন হইয়া পড়িলেন। তখন একটি কি অপূর্ব ব্যাপার হইল, তাহা দেখিয়া দেবীদাস মনে মনে বিচার করিলেন। যে, তাঁহার পিতা এখন পরমার্থে মগ্ন হইয়াছেন। তাঁহাকে বাটি লইয়া যাওয়া কঠিন হইবে। প্রায় মধ্যরাত্রে ঐ সভা-ভঙ্গ হইল। সকলেই পরস্পর অভ্যর্থনাপূর্বক নিজ নিজ স্থানে গমন করিলেন। দেবী ও শম্ভু কর্তার আজ্ঞা লইয়া নিজ বাসায় গমন করিতে লাগিলেন।

    পরদিবস আহারান্তে দেবী ও শম্ভু, লাহিড়ী মহাশয়ের কুটীরে প্রবেশ করিলেন। লাহিড়ী মহাশয়কে দণ্ডবৎ করিয়া দেবীদাস বিদ্যারত্ন নিবেদন করিলেন।

    আমার প্রার্থনা এই যে, আপনি এখন শান্তিপুরের বাটীতে থাকুন। এখানে বহুবিধ কষ্ট হইতেছে। বাটীতে আমরা সকলে আপনার সেবা করিয়া সুখী হইব। আজ্ঞা করেন ত’ একটি নির্জন খণ্ড আপনার জন্য প্রস্তুত করা যায়।

    লাহিড়ী মহাশয় কহিলেন,―তাহা মন্দ নয়, কিন্তু এখানে যেরূপ সাধুসঙ্গে আছি, শান্তিপুরে সেরূপ হইবে না। দেবি! তুমি জান, শান্তিপুরের লোকেরা যেরূপ নিরীশ্বর ও নিন্দাপ্রিয়, সে স্থানে মনুষ্যের বাসে সুখ নাই। অনেকগুলি ব্রাহ্মণ আছেন বটে, কিন্তু তন্তুবায়ের সংসর্গে তাঁহাদের বুদ্ধি অসরল হইয়া পড়িয়াছে। পাতলা কাপড়, লম্বা লম্বা কথা ও বৈষ্ণবনিন্দা—এই তিনটি শান্তিপুরবাসীদিগের লক্ষণ। প্রভু অদ্বৈতের বংশধরেরা তথায় কত কষ্টে আছেন। সঙ্গদোষে তাঁহারাও প্রায় মহাপ্রভুর বিরোধী। অতএব আমাকে তোমরা এই গোদ্রুমধামেই যত্ন করিয়া রাখ, আমার এই ইচ্ছা।

    দেবীদাস কহিলেন, পিতঃ! আপনি যাহা বলিতেছেন, সত্য। আপনি শান্তিপুরের লোকের সহিত কেন ব্যবহার করিবেন? নির্জন খণ্ডে আপনার স্বধর্ম-আচরণপূর্বক সন্ধ্যাবন্দনাদি করিয়া দিনযাপন করিবেন। ব্রাহ্মণের নিত্যকর্মই ব্রাহ্মণের নিত্যধর্ম। তাহাতেই মগ্ন থাকা আপনার ন্যায় মহাত্মা লোকের কর্তব্য।

    লাহিড়ী মহাশয় কহিলেন,“বাবা! সে দিন আর নাই। কয়েক মাস সাধুসঙ্গ করিয়া ও শ্রীগুরুদেবের নিকট উপদেশ পাইয়া আমার মত অনেকটা পরিবর্তিত হইয়াছে। তোমরা যাহাকে নিত্যধর্ম বল আমি তাহাকে নৈমিত্তিক-ধর্ম বলি। হরিভক্তিই জীবের একমাত্র নিত্যধর্ম। সন্ধ্যা বন্দনাদি বস্তুতঃ নৈমিত্তিক-ধর্ম।

    দেবীদাস কহিলেন,―পিতঃ! আমি কোন শাস্ত্রে এরূপ দেখি নাই। সন্ধ্যা-বন্দনাদি কি হরিভজন নয়? যদি হরিভজন হয়, তবে তাহাও নিত্যধর্ম। সন্ধ্যা-বন্দনাদির সহিত কি শ্রবণ কীর্তনাদি-বৈধী ভক্তির কোন প্রভেদ আছে?

    লাহিড়ী মহাশয় বলিলেন,―বাপু! কর্মকাণ্ডের সন্ধ্যা-বন্দনাদি ও বৈধী ভক্তিতে বিশেষ ভেদ আছে। কর্মকাণ্ডে সন্ধ্যা-বন্দনাদি মুক্তিলাভের জন্য অনুষ্ঠিত হয়। হরিভজনের শ্রবণ কীর্তনাদির কোন নিমিত্ত নাই। তবে যে সকল শ্রবণ কীর্তনাদির ফল শাস্ত্রে দেখিতে পাও, সে সকল কেবল বহির্মুখ লোকের রুচি উৎপত্তি করিবার জন্য। হরিভজনের হরিসেবা ব্যতীত অন্য ফল নাই। হরিভজনের রতি উৎপত্তি করাই বৈধ অঙ্গের মুখ্য ফল।

    দেবীদাস কহিলেন,—পিতঃ! তবে হরিভজনের অঙ্গসকলের গৌণ ফল আছে, বলিয়া মানিতে হইবে।

    লা। সাধক-ভেদে গৌণ ফল আছে। বৈষ্ণবের সাধনভক্তি কেবল সিদ্ধভক্তির উদয় করাইবার জন্য। অবৈষ্ণবের সেই সকল অঙ্গ-সাধনে দুইটি তাৎপর্য আছে অর্থাৎ ভোগ ও মোক্ষ। সাধনক্রিয়ার আকার ভেদ দেখা যায় না, কিন্তু নিষ্ঠাভেদই মূল। কর্মাঙ্গে কৃষ্ণপূজা করিয়া চিত্ত-শোধন ও মুক্তি অথবা রোগশান্তি বা পার্থিব ফল পাইয়া থাকে। ভক্ত্যঙ্গে সেই পূজাদ্বারা কেবল কৃষ্ণনামে রতি উৎপত্তি করায়। কর্মীদিগের একাদশী ব্রতে পাপ নষ্ট হয়। ভক্তদিগের একাদশী ব্রতের দ্বারা হরিভক্তি বৃদ্ধি হয়। দেখ, কত ভেদ। কর্মাঙ্গ ও ভক্ত্যঙ্গের যে সূক্ষ্ম ভেদ, তাহা কেবল ভগবৎকৃপা হইলেই জানা যায়। কর্মিগণ গৌণ ফলে আবদ্ধ হয়। ভক্তগণ মুখ্য ফল লাভ করেন। যতপ্রকার গৌণ ফল আছে, সে-সকল দুইপ্রকার মাত্র; ―ভুক্তি ও মুক্তি।

    দে। তবে শাস্ত্রে কেন গৌণ ফলের মাহাত্ম্য বর্ণন করিয়াছেন? লা। জগতে দুইপ্রকার লোক অর্থাৎ উদিত-বিবেক ও অনুদিত-বিবেক। অনুদিতবিবেক ব্যক্তিগণ একটা উপস্থিত ফল না দেখিলে কোন সৎকার্য করে না। তাঁহাদের জন্য গৌণ ফলের মাহাত্ম্য-বর্ণন। শাস্ত্রের ও তাৎপর্য নয় যে, তাঁহারা গৌণ ফলে সন্তুষ্ট থাকুক। শাস্ত্রের তাৎপর্য এই যে, গৌণ ফল দেখিয়া আকৃষ্ট হইলে, স্বল্পকালের মধ্যেই সাধু কৃপায় মুখ্যফলের পরিচয় ও ক্রমে তাহাতে রুচি হইবে।

    দে। স্মার্ত রঘুনন্দন প্রভৃতি কি অনুদিত-বিবেক?

    লা। না, তাঁহারা স্বয়ং মুখ্যফলের অনুসন্ধান করিয়া থাকেন, কেবল অনুদিত-বিবেক লোকের জন্য তাঁহারা ব্যবস্থা করিয়াছেন।

    দে। কোন কোন শাস্ত্রে কেবল গৌণ ফলের কথা দেখা যায়, মুখ্যফলের উল্লেখ নাই। ইহার তাৎপর্য কি?

    লা। শাস্ত্র মানবদিগের ত্রিবিধ অধিকারভেদে―ত্রিবিধ। সত্ত্বগুণবিশিষ্ট মানবের জন্য সাত্ত্বিক শাস্ত্র। রজোগুণবিশিষ্ট মানবের জন্য রাজসিক শাস্ত্র। তমোগুণবিশিষ্ট মানবের জন্য তামসিক শাস্ত্র।

    দে। তাহা হইলে শাস্ত্রের কোন কথায় বিশ্বাস করা যায় এবং কি উপায়দ্বারা নিম্নাধিকারীর উচ্চগতি হইতে পারে?

    লা। মানবগণের অধিকারভেদে স্বভাব-ভেদ ও শ্রদ্ধা-ভেদ। তামসিক মানবের স্বভাবতঃ তামসিক শাস্ত্রে শ্রদ্ধা, রাজসিক মানবের স্বভাবশতঃ রাজসিক শাস্ত্রে শ্রদ্ধা। সাত্ত্বিকজনের স্বভাবতঃ সাত্ত্বিক শাস্ত্রে শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধানুসারে সহজেই বিশ্বাস হইয়া থাকে। শ্রদ্ধার সহিত নিজ অধিকার মত কর্ম করিতে সাধুসঙ্গবলে উচ্চাধিকার জন্মে। উচ্চাধিকার জন্মিলেই স্বভাব পুনরায় উচ্চ হয় ও তদুদিত শাস্ত্রে শ্রদ্ধা হয়। শাস্ত্র কারেরা অভ্রান্ত পণ্ডিত ছিলেন। শাস্ত্র এরূপ গঠন করিয়াছেন যে, স্বীয় অধিকার-নিষ্ঠাতেই ক্রমশঃ উচ্চ অধিকার জন্মে। পৃথক্‌ পৃথক্ শাস্ত্রে এই জন্যই পৃথক্‌ পৃথক্‌ ব্যবস্থা। শাস্ত্রীয় শ্রদ্ধাই সমস্ত মঙ্গলের হেতু। শ্রীমদ্‌ভগবদগীতাশাস্ত্রই সকলপ্রকার শাস্ত্রের মীমাংসা; তাহাতে এই সিদ্ধান্ত স্পষ্ট আছে।

    দে। আমি বাল্যকাল হইতে অনেক শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়াছি; কিন্তু অদ্য আপনার কৃপায় একটী অপূর্ব তাৎপর্য বোধ হইল।

    লা! শ্রীমদ্ভাগবতে লিখিত আছে—

    “অনুভ্যশ্চ মহদ্ভ্যশ্চ শাস্ত্রেভ্যঃ কুশলো নরঃ।
    সর্বতঃ সারমাদদ্যাৎ পুষ্পেভ্য ইব ষট্‌পদঃ॥”
    (ভাঃ ১১।৮।১০)[1]

    বাপু, আমি তোমাকে নাস্তিক বলিতাম। এখন আর কোন লোকের নিন্দা করি না, কেননা অধিকারনিষ্ঠাতে কোন নিন্দা নাই। সকলেই আপন আপন অধিকারে থাকিয়া কার্য করেন। সময় হইলে ক্রমশঃ উন্নত হইবেন। তুমি তর্কশাস্ত্র ও কর্মশাস্ত্রে পণ্ডিত আছ। এতএব, তোমার অধিকারগত-বাক্যে তোমার দোষ নাই।

    দে। আমার যতদুর জানা ছিল, তাহাতে বোধ হইত যে বৈষ্ণবসম্প্রদায়ে পণ্ডিত নাই। বৈষ্ণবগণ কেবল শাস্ত্রের একাংশ দেখিয়া গোঁড়ামি করিয়া থাকেন। কিন্তু আপনি আজ যাহা বলিলেন, ইহাতে বোধ হয় যে, বৈষ্ণবদিগের মধ্যে সারগ্রাহী লোক আছেন। আপনি কি ইদানীং কোন মহাত্মার নিকট শাস্ত্র অধ্যায়ন করিতেছেন?

    লা। বাপু, আমাকে আজকাল গোঁড়া বৈষ্ণব বা যাহা বলিতে ইচ্ছা হয় বল। আমার গুরুদেব ঐ অপর কুটীরে ভজন করেন। তিনি সর্বশাস্ত্রের তাৎপর্য আমাকে বলিয়াছেন; তাহাই তোমাকে বলিলাম। তুমি যদি তাঁহার চরণে কিছু শিক্ষা করিতে চাও, ভক্তিভাবে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা কর। চল, আমি তোমাকে তাঁহার নিকট পরিচিত করিয়া দিই। এই কথা বলিয়া লাহিড়ী মহাশয় দেবী বিদ্যারত্নকে শ্রীবৈষ্ণবদাসের কুটীরে লইয়া তাঁহাকে পরিচিত করিয়া দিলেন। লাহিড়ী মহাশয় দেবীকে তথায় রাখিয়া নিজ কুটীরে আসিয়া নাম করিতে লাগিলেন।

    শ্রীবৈ। বাবা, তোমার পড়াশুনা কি হইয়াছে?

    দে। ন্যায়শাস্ত্রের মুক্তিপাদ’ও ‘সিদ্ধান্তকুসুমাঞ্জলী’ পর্যন্ত পড়িয়াছি। স্মৃতিশাস্ত্রের সমস্ত গ্রন্থই পড়িয়াছি।

    শ্রীবৈ। তুমি তবে শাস্ত্রে অনেক পরিশ্রম করিয়াছ। শাস্ত্রে যে পরিশ্রম করিয়াছ, তাঁহার,ফলের পরিচয় দেও।

    দে। ‘অত্যন্তদুঃখনিবৃত্তিরেব মুক্তিঃ’― এই মুক্তির জন্য সর্বদা প্রয়াস করা উচিত। আমি স্বধর্মনিষ্ঠার সহিত সেই মুক্তিই অন্বেষণ করিতেছি।

    শ্রীবৈ। হাঁ, এককালে আমিও ঐসকল গ্রন্থ পড়িয়া তোমার ন্যায় মুমুক্ষু ছিলাম।

    দে। মুমুক্ষুতা কি পরিত্যাগ করিয়াছেন?

    শ্রীবৈ। বাবা, বল দেখি, মুক্তির আকার কি?

    দে। ন্যায়শাস্ত্রের মতে জীব ও ব্রহ্মে নিত্য ভেদ আছে। অতএব ন্যায়ের মত কি প্রকারে অত্যন্ত দুঃখ নিবৃত্তি হয়, তাহা স্পষ্ট নাই। বেদান্তমতে অভেদব্রহ্মানুসন্ধানকে ‘মুক্তি’ বলে। তাহাই একপ্রকার স্পষ্ট বুঝা যায়।

    শ্রীবৈ। বাবা, আমি ১৫ বৎসর শাঙ্কর বেদান্তগ্রন্থ পাঠ করিয়া কয়েক বৎসর সন্ন্যাস করিয়াছিলাম। মুক্তির জন্য অনেক যত্ন করিয়াছি। শঙ্করের মতে যে চারিটী মহাবাক্য, তাহা অবলম্বনপূর্বক অনেকদিন নিদিধ্যাসন করিয়াছিলাম। পরে সে-পন্থা অর্বাচীন বলিয়া পরিত্যাগ করিয়াছি।

    বৈধীভক্তি নিত্যধর্ম, নৈমিত্তিক নয়। দে। কিসে অর্বাচীন বলিয়া জানিলেন?

    শ্রীবৈ। বাবা, কৃতকর্মা লোক নিজের পরীক্ষা সহজে অপরকে বলিতে পারে না। অপরে তাহাই বা কিরূপে বুঝিবে?

    দেবীদাস দেখিলেন যে, শ্রীবৈষ্ণবদাস মহাপণ্ডিত, সরল ও মহাবিজ্ঞ; দেবীদাস বেদান্ত পড়েন নাই। মনে করিলেন, যদি ইনি কৃপা করেন, তবে আমার বেদান্ত-অধ্যয়ন হয়। এই মনে করিয়া বলিলেন আমি কি বেদান্ত পড়িবার যোগ্য?

    শ্রীবৈ। তোমার যেরূপ সংস্কৃত ভাষায় অভিজ্ঞতা জন্মিয়াছে, তাহাতে তুমি অনায়াসে শিক্ষক পাইলে বেদান্ত পড়িতে পার।

    দে। আপনি কৃপা করিয়া যদি আমাকে পড়ান, তবে আমি পড়ি।

    শ্রীবৈ। আমার কথা এই যে—আমি অকিঞ্চন বৈষ্ণবদাস। পরমহংস বাবাজী মহাশয় আমাকে কৃপা করিয়া সর্বদা হরিনাম করিতে বলিয়াছেন, আমি তাহাই করিয়া থাকি। সময় অল্প। বিশেষতঃ জগদ্‌গুরু শ্রীস্বরূপ গোস্বামী বৈষ্ণবদিগকে শারীরক-ভাষ্য পড়িতে বা শুনিতে নিষেধ করিয়াছেন, শুনিয়া আমি আর শাঙ্কর-ভাষ্য পড়ি না বা পড়াই না; তবে জীবলোকের আদি গুরু শ্রীশচীনন্দন শ্ৰীসার্বভৌমকে যে বেদান্তসূত্র-ভাষ্য বলিয়াছেন; তাহা এখনও অনেক বৈষ্ণবের নিকট কড়চা-আকারে লেখা আছে। তাহা তুমি নকল করিয়া লইয়া পড় ত’ আমি তোমার সাহায্য করিতে পারি। তুমি কাঞ্চনপল্লীবাসী শ্রীমৎকবিকর্ণপুরের গৃহ হইতে উক্ত কড়চা আনাইয়া লও।

    দে। আমি যত্ন করিব। আপনি বেদান্তে মহাপণ্ডিত। আপনি সরলতার সহিত আমাকে বলুন, বৈষ্ণব-ভাষ্য পড়িয়া বেদান্তের যথার্থ অর্থ পাইব কি না?

    শ্রীবৈ। আমি শাঙ্কর-ভাষ্য পড়িয়াছি ও পড়াইয়াছি। শ্রীভাষ্য প্রভৃতি কয়েকখানি ভাষ্য পড়িয়াছি। গৌড়ীয়-বৈষ্ণবগণ যে শ্রীগোপীনাথ আচার্যের প্রদত্ত মহাপ্রভুর সূত্রার্থ ব্যাখ্যা পড়িয়া থাকেন, তাহা অপেক্ষা আর উৎকৃষ্ট আমি কিছু দেখি নাই। ভগবৎকৃত সূত্রার্থে কোন মতবাদ নাই। উপনিষদ্‌-বাক্যে যে সকল অর্থ সংগ্রহ করা যায়, সে সমুদয় যথাযথ ঐ সূত্ৰ-ব্যাখ্যায় পাওয়া যায়। সূত্র ব্যাখ্যাটী কেহ যদি রীতিমত গ্রথিত করেন, তাহা হইলে আর কোন ভাষ্য বিদ্বৎসুভায় আদৃত হইবে না।

    এই কথা শুনিয়া দেবী বিদ্যারত্ন উল্লসিতচিত্তে শ্রীবৈষ্ণবদাসকে দণ্ডবৎ প্রণাম করিয়া পিতার কুটীরে পুনরায় প্রবেশ করিয়া পিতার চরণে সমস্ত কথা নিবেদন করিলেন। পিতা আহ্লাদিত হইয়া বলিলেন,―দেবি, অনেক পড়িয়াছ শুনিয়াছ বটে, এখন জীবের সদগতি অন্বেষণ কর।

    দে। পিতঃ, আমি অনেক আশার সহিত আপনাকে শ্রীগোদ্রুম হইতে লইয়া যাইবার জন্য আসিয়াছি। কৃপা করিয়া একবার বাটী গেলে সকলেই চরিতার্থ হ’ন। বিশেষতঃ জননী ঠাকুরাণীর ইচ্ছা যে, আপনার চরণ একবার দর্শন করেন।

    লা। আমি বৈষ্ণবচরণ-আশ্রয় করিয়াছি। প্রতিজ্ঞা করিয়াছি যে, ভক্তিপ্রতিকূল গৃহে আর গমন করিব না। তোমরা সকলে আগে বৈষ্ণব হও, তবে আমাকে লইয়া যাইবে।

    দে। পিতঃ, এ কথাটা কিরূপ আজ্ঞা করিলেন? আমাদের গৃহে ভগবৎসেবা আছে। আমরা হরিনামের অনাদর করি না। অতিথি, বৈষ্ণব-সেবা করিয়া থাকি আমরা কি বৈষ্ণব নই?

    লা। যদিও বৈষ্ণবদের ক্রিয়া ও তোমাদের ক্রিয়াতে ঐক্য আছে, তথাপি তোমরা বৈষ্ণব নহ।

    দে। পিতঃ, কি হইলে বৈষ্ণব হইতে পারি?

    লা। নৈমিত্তিকভাব ত্যাগ করিয়া নিত্যধর্ম আশ্রয় করিলে বৈষ্ণব হইতে পার।

    দে। আমার একটী সংশয় আছে। আপনি ভাল করিয়া মীমাংসা করিয়া দিন। বৈষ্ণবেরা যে শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, পাদসেবন, অর্চন, বন্দন, দাস্য, সখ্য ও আত্মনিবেদন করেন, তাহাতেও যথেষ্ট জড়-মিশ্র কর্ম আছে। সে-সকল বা কেন নৈমিত্তিক হয় না? এ-বিষয়ে আমি কিছু পক্ষপাতিত্ব দেখিতেছি। শ্রীমূর্তিসেবা, উপবাস, জড় দ্রব্যের দ্বারা পূজা, এ সমস্তই স্থূল, কিরূপে নিত্য হইতে পারে?

    লা। বাপু, এ কথাটা বুঝিতে আমারও অনেক দিন লাগিয়াছিল। তুমি ভাল করিয়া বুঝিয়া লও। মনুষ্য দুইপ্রকার—ঐহিক ও পারমার্থিক। ঐহিক মানবগণ কেবল ঐহিক সুখ, ঐহিক মান ও ঐহিক উন্নতি অনুসন্ধান করেন। পারমার্থিক মানবগণ তিনপ্রকার অর্থাৎ ঈশানুগত, জ্ঞাননিষ্ঠ ও সিদ্ধিকামী। সিদ্ধিকামী লোকগণ কর্মকাণ্ডের ফলভোগে নিরত। কর্মের দ্বারা অলৌকিক ফলের উদয় করিতে চায়। যাগ, যজ্ঞ ও যোগই ইহাদের ফলোদয়ের উপায়। ইহাদের মতে ঈশ্বর থাকিলেও তিনি কর্মবশ। বৈজ্ঞানিক ব্যক্তিগণ ঐ শ্রেণীভুক্ত। জ্ঞান-নিষ্ঠ ব্যক্তিগণ জ্ঞানচর্চার দ্বারা আপনাদের ব্রহ্মতা উদয় করিতে যত্ন করেন। ঈশ্বর বলিয়া কেহ থাকুন না থাকুন, উপায়কালে একটী ঈশ্বর কল্পনা করতঃ তাঁহার ভক্তি করিতে করিতে, ক্রমশঃ জ্ঞান-ফল পাইয়া থাকেন। জ্ঞান-ফল পাইলে আর উপায়কালীয় ঈশ্বরের আবশ্যকতা থাকে না। ঈশভক্তি ফলকালে জ্ঞানাকারে পরিণত। এই মতে ঈশ্বরের ও ঈশভক্তির নিত্যতা নাই। ঈশানুগত পুরুষেরা তৃতীয় শ্রেণীর পারমার্থিক। ইঁহারাই বস্তুতঃ পরমার্থ অনুসন্ধান করেন। ইঁহাদের মতে একটী অনাদি অনন্ত ঈশ্বর আছেন। তিনি স্বীয় শক্তিক্রমে জীব ও জড় সৃষ্টি করিয়াছেন। জীবসকল তাঁহার নিত্যদাস। তাঁহার প্রতি নিত্য আনুগত্য-ধর্মই জীবের নিত্য ধর্ম। জীব নিজ বলে কিছু করিতে পারে না। কর্মদ্বারা জীবের কোন নিত্য ফল হয় না। জ্ঞানদ্বারা জীবের নিত্য ফল বিকৃত হয়। অনুগত হইয়া ঈশ্বরকে সেবা করিলে ঈশ্বরের কৃপাতেই জীবের সর্বার্থসিদ্ধি। পূর্বকার দুই শ্রেণীর নাম কর্মকাণ্ডী ও জ্ঞানকাণ্ডী। তৃতীয় শ্রেণী কেবল ঈশভক্ত। জ্ঞানকাণ্ডী ও কর্মকাণ্ডী কেবল আপনাদিগকে পারমার্থিক বলিয়া অভিমান করে। বস্ততঃ তাঁহারা ঐহিক; অতএব নৈমিত্তিক। তাঁহাদের যতপ্রকার ধর্ম-চর্চা, সমস্তই নৈমিত্তিক।

    সম্প্রতি শৈব, শাক্ত, গাণপত্য ও সৌর―ইহারা জ্ঞানকাণ্ডের অধীন। ইহারা যে শ্রবণ কীর্তনাদি করে, সে কেবল মুক্তি ও অবশেষে অভেদব্রহ্ম সম্পত্তি পাইবার আশায় করিয়া থাকে। যাঁহাদের শ্রবণ-কীর্তনাদিতে ভুক্তি মুক্তি আশা নাই, তাঁহারা সেই সেই মূর্তিতে বিষ্ণু সেবাই করিয়া থাকেন। ভগবন্মুর্তি নিত্য, চিন্ময় ও সর্বশক্তিসম্পন্ন। উপাস্যতত্ত্বকে যদি ভগবান না বলা যায়, তবে অনিত্যের উপাসনা হয়। বাপু, তোমাদের যে ভগবন্মুর্তি-সেবা, তাহাও পারমার্থিক নয়। কেননা, তোমরা ভগবানের নিত্যমূর্তি স্বীকার কর না। অতএব ঈশানুগত নও। এখন বোধ হয়, তুমি নিত্য ও নৈমিত্তিক উপাসনার ভেদ জানিতে পারিলে?

    দে। হাঁ, যদি ভগবদ্বিগ্রহকে নিত্য না বলা যায় এবং শ্রীবিগ্রহের অর্চন করা যায়, তাহা হইলে নিত্য বস্তুর উপাসনা হয় না। অনিত্য উপাসনাদ্বারা অন্যপ্রকার নিত্যতত্ত্বের কি অনুসন্ধান হয় না?

    লা। হইলেও তোমার উপাসনাকে আর নিত্যধর্ম বলিতে পার না। বৈষ্ণব ধর্মের নিত্যবিগ্রহে অৰ্চনাদি নিত্যধর্ম।

    দে। যে শ্রীবিগ্রহ পূজা করা যায়, তাহা মানবকৃত-মূর্তি। তাহাকে কিরূপে নিত্যমূর্তি বলিব?

    লা। বৈষ্ণবপূজ্য বিগ্রহ সেরূপ নয়। আদৌ ভগবান্ ব্রহ্মের ন্যায় নিরাকার ন’ন। তিনি সচ্চিদানন্দঘনবিগ্রহ, সর্বশক্তিবিশিষ্ট। সেই শ্রীমূর্তি পূজনীয়। সেই শ্রীমূর্তি প্রথমে জীবের চিদ্বিভাগে প্রতিভাত হইয়া মনে উদিত হয়। মন হইতে নির্মিত শ্রীমূর্তিতে ভক্তিযোগে তাহা আবির্ভূত হইয়া পড়ে। তখন ভক্ত তদ্দর্শনে হৃদয়ে যে চিন্ময়-মূর্তি দেখেন, তাঁহার সহিত শ্ৰীমূর্তির একতা করিয়া থাকেন। জ্ঞানবাদীদিগের পুজিতবিগ্রহ সেরূপ নয়। তাঁহাদের মতে একটি পার্থিব তত্ত্বে ব্রহ্মতা কল্পিত হইয়া পূজা-কাল পৰ্য্যন্ত উপস্থিত থাকে। পরে সে মূর্তি পার্থিব বস্তু বই আর কিছুই নয়। এখন গাঢ়রূপে উভয় মতের অর্চনাদির ভেদ আলোচনা কর। গুরুদেবের কৃপায় যখন বৈষ্ণবী দীক্ষা পাওয়া যায় তখন ফলদৃষ্টে এই পার্থক্যের বিশেষ উপলব্ধি হইয়া পড়ে।

    দে। আমি এখন দেখিতেছি, বৈষ্ণবদের কেবল, গোঁড়ামি নয়, তাঁহারা অত্যন্ত সুক্ষুদর্শী। ‘শ্রীমূর্তি-উপাসনা’ ও পার্থিব বস্তুতে ঈশ্বর জ্ঞান পরস্পর অত্যন্ত পৃথক্‌। কার্যে ভেদ কিছুই দেখি না। নিষ্ঠাতে বিশেষ ভেদ আছে। এবিষয়ে আমি কিছু দিন চিন্তা করিব। পিতঃ, আমার একটা প্রধান খট্‌কা মিটিয়া গেল। এখন আমি জোর করিয়া বলিতে পারি যে, জ্ঞানবাদীদিগের উপাসনা কেবল ঈশ্বরের সহিত তঞ্চকতা মাত্র। ভাল, একথা আবার আপনার শ্রীচরণে নিবেদন করিব। এই বলিয়া তখন দেবী বিদ্যারত্ন ও শম্ভু নিজ বাসায়। চলিয়া গেলেন। অপরাহ্ণে উভয়ে আসিয়াছিলেন বটে কিন্তু সে সব কথার অবকাশ ছিল না। নামগানে সুখলাভ করিয়াছিলেন।

    পরদিন অপরাহ্ণে পরমহংস বাবাজীর মণ্ডপে সকলেই বসিয়াছেন। দেবী বিদ্যারত্ন ও শম্ভু, লাহিড়ী মহাশয়ের নিকটে আছেন। এমত সময় ব্রাহ্মণ পুষ্করিণীর কাজী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কাজীকে দেখিয়া বৈষ্ণবগণ সম্মান করিয়া উঠিলেন। কাজীও পরমানন্দে বৈষ্ণবদিগকে অভ্যর্থনা করিয়া মণ্ডপে বসিলেন। পরমহংস বাবাজী বলিলেন—“আপনারা ধন্য, যেহেতু আপনারা শ্রীশ্রীমহাপ্রভুর কৃপাপাত্র চাঁদকাজীর বংশধর। আমাদিগকে কৃপা করিবেন।” কাজী বলিলেন―“শ্রীশ্রীমহাপ্রভুর প্রসাদে আমরা বৈষ্ণবগণের কৃপাপাত্র হইয়াছি। আমাদের গৌরাঙ্গই প্রাণপতি। তাঁহাকে দণ্ডবৎপ্রণাম না করিয়া আমরা কোন কার্য করি না।”

    লাহিড়ী মহাশয় মুসলমানদিগের ভাষায় বড় পণ্ডিত ছিলেন। তিনি কোরাণ সরিফের ৩০ সেফারা সমুদায় পড়িয়াছেন। সুফীদিগের অনেক গ্রন্থ আলোচনা করিয়াছেন। তিনি কাজী মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন,―“আপনাদের মতে মুক্তি কি?”

    কাজী কহিলেন,―“আপনারা যাহাকে জীব বলেন, তাহাকে আমরা ‘রু’ বলি। সেই ‘রু’ দুই অবস্থায় থাকে অর্থাৎ রু-মুজর্‌রদী ও রু-তর্‌কীবী। যাহাকে আপনারা চিৎ বলেন, তাহাকেই আমরা মুজর্‌রদ্ বলি। যাহাকে আপনারা অচিৎ বলেন, তাহাকে আমরা জিসম্ বলি। মুজর্‌রদ্ দেশ ও কালের অতীত। জিসম্ দেশ ও কালের অধীন। তর্‌কীবী-রু বা বদ্ধজীব বাসনা, মন ও মলফুৎ অর্থাৎ জ্ঞানপূর্ণ। মুজর্‌রদী-রু এই সমস্ত হইতে শুদ্ধ ও পৃথক্‌। আলম মিসাল বলিয়া যে চিন্ময়ভুমি আছে, তথায় মুজর্‌রদী-রু থাকিতে পারেন। এস্ক অর্থাৎ প্রেম সমৃদ্ধিক্রমে ‘রু’ শুদ্ধ হয়। পয়গম্বর সাহেবকে খোদা যে স্থানে লইয়া যান, সেই স্থানে জিসম্ নাই, কিন্তু সেখানেও ‘রু’ বন্দা অর্থাৎ দাস এবং ঈশ্বর খোদা অর্থাৎ প্রভু। অতএব বান্দা ও খোদার সম্বন্ধ নিত্য। শুদ্ধভাবে এই সম্বন্ধ লাভ করার নাম মুক্তি। কোরাণে এবং সুফীদিগের কেতাবে এই সকল আছে বটে, কিন্তু সকলেই তাহা বুঝিতে পারে না। গৌরাঙ্গ প্রভু কৃপা করিয়া চাঁদকাজী সাহেবকে এই কথা শিক্ষা দিয়াছেন; তদবধি আমরা শুদ্ধভক্ত হইয়াছি।

    লা। কোরাণের মূল মত কি?

    কা। কোরাণের যে বিহিস্ত্‌ বর্ণিত আছে, তথায় কোন এবাদতের কথা নাই বটে কিন্তু তথায় জীবনই এবাদত। খোদাকে দর্শন করিয়া পরমসুখে তত্রস্থ লোকসকল সুখে মগ্ন থাকেন। একথা শ্রীগৌরাঙ্গদেব বলিয়াছেন।

    লা। খোদার কি মূর্তি কোরাণে পাওয়া যায়।

    কা। কোরাণ বলেন, খোদার মূর্তি নাই। শ্রীগৌরাঙ্গ চাঁদকাজীকে বলিয়াছেন যে, কোরাণে কেবল জিসমানি মূর্তি নিষেধ; শুদ্ধমুজর্‌বদী মূর্তির নিষেধ নাই। সেই প্রেমময়-মূর্তি পয়গম্বর সাহেব নিজ অধিকার মতে দেখিয়াছিলেন। অনান্য রসের ভাবসকল অবগুণ্ঠিত ছিল।

    লা। সুফীরা কি বলেন?

    কা। তাঁহাদের মতে অনল্‌ হক্‌ অর্থাৎ আমি খোদা। আপনাদের অদ্বৈতবাদ ও মুসলমানের আসওয়াফ মত একই বটে।

    লা। আপনারা কি সুফী?

    কা। না, আমরা শুদ্ধভক্ত—গৌরগতপ্রাণ।

    অনেক কথোপকথনের পর কাজী মহাশয় বৈষ্ণবদিগকে সম্মান করিয়া চলিয়া গেলেন। পরে হরিসংকীর্তনের পর সভা-ভঙ্গ হইল।

    [1] ভ্রমর যেমন ফুলসমূহ হইতে মধু আহরণ করে, সারগ্রাহী-ব্যাক্তিও তদ্রূপ ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সকল শাস্ত্র হইতে সার গ্রহণ করিবেন।)

Page execution time: 0.033154964447 sec