(লাহিড়ী মহাশয়ের সর্পভয়-নিবারণ-মরণচিন্তায় কালক্ষেপ না করিয়া হরিভজন করা উচিত―বৈষ্ণবকে সকল জীবই অনুরাগ করেন—-শুদ্ধবৈষ্ণবধর্ম ও বিদ্ধবৈষ্ণবধর্ম―কর্মবিদ্ধ ও জ্ঞানবিদ্ধ-ভেদে দুই প্রকার বিদ্ধবৈষ্ণবধর্ম―প্রকৃত বৈষ্ণবধর্ম শুদ্ধ—ব্রহ্ম ও পরমাত্মা নৈমিত্তিক-ধর্মের বিষয়―ভগবান্ ভক্তি দ্বারা নিত্যধর্মে উপাসিত―শুদ্ধবৈষ্ণবধর্মে সম্বন্ধ, অভিধেয় ও প্রয়োজন-জ্ঞানের আবশ্যকতা-সম্বন্ধ-তত্ত্বব্যাখ্যা―সাকার-নিরাকার বিচার―ভগবানে দুই স্বরূপই আছে―ব্রহ্মে কেবল একটি—নিত্যরূপস্থাপন―নিত্যরূপাদি-ধ্যান-প্রক্রিয়া--নামরসে-নিত্যরূপাদি―জীবতত্ত্ব―তটস্থশক্তি-জীবগণের প্রকার ভেদ―মায়া-শক্তি-মায়া, জীব ও কৃষ্ণের পরস্পর-সম্বন্ধ--দীক্ষা ও শিক্ষা---অভিধেয়তত্ত্ব---অভিধেয়-সাধন-ভক্তির প্রকার―তাঁহার অধিকার-নামদান— নিরপরাধে নাম করিবার উপদেশ—লাহিড়ী মহাশয়ের পরিবর্তন―প্রয়োজন-জিজ্ঞাসা―শ্রীগুরুমাহাত্ম্য।)
লাহিড়ী মহাশয়ের কুটিরও শ্রীবৈষ্ণবদাসের কুটির পরস্পর পার্শ্ববর্তী। নিকটে কয়েকটি আম্র ও কাঁঠাল বৃক্ষ। চতুর্দিক ছোট ছোট পূগবৃক্ষে সুশোভিত। অঙ্গনে একটি প্রশস্ত চক্রাকার চবুতরা। যেকালে শ্রীপ্রদ্যুম্ন ব্রহ্মচারী ঐ কুঞ্জে বাস করিতেন, সেই সময় হইতে ঐ চবুতরাটি আছে। অনেকদিন হইতে বৈষ্ণবগণ ঐ চবুতরাকে ‘সুরভি চবুতরা’ বলিয়া প্রদক্ষিণ করিয়া দণ্ডবৎ প্রণাম করিয়া থাকেন।
সন্ধ্যার পর শ্রীবৈষ্ণবদাস নিজ কুটিরে একটী পত্ৰাসনের উপর উপবিষ্ট হইয়া হরিনাম করিতেছেন। কৃষ্ণপক্ষ, রাত্রি ক্রমশঃ অধিক অন্ধকার হইয়া উঠিল। লাহিড়ী মহাশয়ের কুটীরে একটী প্রদীপ মিট্ মিট্ করিয়া জ্বলিতেছে। তাঁহার দ্বারের নিকটে একটি সর্পের আকৃতি দেখা গেল। লাহিড়ী মহাশয় তৎক্ষণাৎ একটি লগুড় লইয়া ঐ সর্পটি মারিবার উদ্যোগে অলোটি প্রদীপ্ত করিলেন। আলোক লইয়া বাহিরে আসিতে আসিতে সপটী অদর্শন হইল। লাহিড়ী মহাশয় শ্রীবৈষ্ণবদাসকে বলিলেন,― আপনি একটু সাবধানে থাকিবেন, একটী সর্প আপনার কুটীরে প্রবেশ করিয়াছে। বৈষ্ণবদাস বলিলেন; লাহিড়ী মহাশয়, আপনি কেন সর্পের জন্য ব্যস্ত হইতেছেন? আসুন, আমার কুটিরে নির্ভয়ে বসুন। লাহিড়ী মহাশয় তাঁহার কুটিরে প্রবেশূর্বক একটী পত্ৰাসনে বসিলেন বটে, কিন্তু তাঁহার মন সর্পবিষয়ে বিশেষ চঞ্চল ছিল। তিনি বলিলেন--মহাশয়, আমাদের শান্তিপুর এ বিষয়ে ভাল। সহর স্থান—সাপ টাপের ভয় নাই। নদীয়ায় সর্বদাই সপর্ভয়, বিশেষতঃ গোদ্রুমাদি বনময় স্থানে ভদ্রলোকের বাস করা কঠিন।
শ্রীবৈষ্ণবদাস বাবাজী মহাশয় বলিলেন,―লাহিড়ী মহাশয়, এই সকল বিষয়ে চিত্ত চঞ্চল করা নিতান্ত মন্দ। আপনি শ্রীমদ্ভাগবতগ্রন্থে পরীক্ষিৎ মহারাজের কথা অবশ্য শ্রবণ করিয়াছেন। তিনি সর্পভয় পরিত্যাগপূর্বক শ্রীহরিকথামৃত অচঞ্চলচিত্তে শ্রীমৎ শুকদেবের মুখে শ্রবণ করতঃ পরমানন্দ লাভ করিয়াছিলেন। মানবের চিদ্দেহে এই সকল সর্প আঘাত করিতে পারে না। কেবল ভগবৎকথা-বিরহরূপ সর্পই সে দেহের ব্যাঘাত-জনক সৰ্প। জড়দেহ নিত্য নয়, অবশ্য একদিন পরিত্যক্ত হইবে। জড়দেহের জন্য কেবল শারীর কর্মসকল বিহিত। কৃষ্ণের ইচ্ছায় যখন এই দেহের পতন হইবে, তখন কোন চেষ্টাদ্বারা ইহাকে রক্ষা করা যাইতে পারিবে না। যতদিন শরীরের ভঙ্গকাল উপস্থিত হয় নাই, ততদিন সর্পের পার্শ্বে শয়ন করিলেও সর্প কিছু বলিবে না। অতএব সর্পভয়াদি ত্যাগ করিলে বৈষ্ণব বলিয়া পরিচয় হইতে পারে। এই সকল ভয়ে চিত্ত যদি সর্বদা চঞ্চল রহিল, তবে কিরূপে হরিপাদপদ্মে নিযুক্ত হইবে? সর্পভয় ও তজ্জনিত সর্পবধের চেষ্টা অবশ্যই পরিত্যাগ করা কর্তব্য।
লাহিড়ী মহাশয় একটু সশ্রদ্ধ হইয়া কহিলেন,--মহাশয়, আপনার সাধুবাক্যে আমার হৃদয় নির্ভয় হইল। আমি জানিলাম যে, হৃদয় উচ্চ করিতে পারিলেই পরমার্থলাভের যোগ্য হওয়া যায়। গিরিকন্দরে যে সকল মহাত্মা ভগবদ্ভজন করেন, তাঁহারা কখনই বন্যজন্তুর ভয় করেন না, বরং অসাধুসঙ্গকে ভয় করিয়া বন্যজন্তুদিগের সহিত বনে বাস করেন।
বাবাজী মহাশয় কহিলেন,―ভক্তিদেবী হৃদয়ে আবির্ভূতা হইলে হৃদয় সহজে উন্নত হয়---জগতের সমস্ত জীবের প্রিয় হওয়া যায়। সাধু ও অসাধু জীব, সকলেই ভক্তকে অনুরাগ করেন। অতএব মানবমাত্রেরই বৈষ্ণব হওয়া কর্তব্য।
লাহিড়ী মহাশয় এই কথা শুনিবামাত্র কহিলেন,--আপনি নিত্যধর্মের প্রতি আমার শ্রদ্ধা উদয় করাইয়াছেন এবং নিত্যধর্মের সহিত বৈষ্ণব ধর্মের কিছু নিকট-সম্বন্ধ আছে—এরূপ আমার মনে প্রতীতি হইয়াছে। কিন্তু নিত্যধর্ম ও বৈষ্ণবধর্মের একতা আমার এখনও বোধ হয় নাই। প্রার্থনা করি, আপনি এই কথাটা আমাকে ভালরূপে বুঝাইয়া দিবেন। বৈষ্ণবদাস বাবাজী কহিতে লাগিলেন—
“জগতে বৈষ্ণবধর্ম নামে দুইটি পৃথক্ পৃথক্ ধর্ম চলিতেছে। একটী শুদ্ধবৈষ্ণবধর্ম আর একটী বিদ্ধবৈষ্ণবধর্ম। শুদ্ধবৈষ্ণবধর্ম তত্ত্বতঃ এক হইলেও রসভেদে চারিপ্রকার―অর্থাৎ দাস্যগত বৈষ্ণবধর্ম, সখ্যগত বৈষ্ণব ধর্ম, বাৎসল্যগত বৈষ্ণবধর্ম ও মধুররসগত বৈষ্ণবধর্ম। বস্তুতঃ শুদ্ধবৈষ্ণব ধর্ম এক ও অদ্বিতীয়, ইহার অন্যতম নাম নিত্যধর্ম বা পরধর্ম। “যজ্জ্ঞাতে সর্বং বিজ্ঞাতং ভবতি”--এই শ্রুতিবাক্যে শুদ্ধবৈষ্ণবধর্মকে লক্ষ্য করেন। ইহার বিবৃতি আপনি ক্রমশঃ জানিবেন।
বিদ্ধ-বৈষ্ণবধর্ম দুই প্রকার অর্থাৎ কর্মবিদ্ধ-বৈষ্ণবধর্ম ও জ্ঞানবিদ্ধ-বৈষ্ণবধর্ম। স্মাৰ্তমতে যে-সকল বৈষ্ণবধর্মের পদ্ধতি আছে, সে-সমস্তই কর্মবিদ্ধ বৈষ্ণবধর্ম। সেই বৈষ্ণবধর্মে বৈষ্ণবমন্ত্র-দীক্ষা থাকিলেও বিশ্বব্যাপী পুরুষরূপ-বিষ্ণুকে কর্মাঙ্গরূপে স্থাপন করা হয়। সেই মতে বিষ্ণু সকল দেবতার নিয়ন্তা হইলেও তিনি স্বয়ং কর্মাঙ্গ ও কর্মাধীন; বিষ্ণুর ইচ্ছাধীন কর্ম নয়, কর্মের ইচ্ছাধীন বিষ্ণু। এই মতে উপাসনা ভজন ও সাধন―সমস্তই কর্মাঙ্গ, যেহেতু কর্ম অপেক্ষা উচ্চতত্ত্ব আর নাই। জড়ন্মীমাংসকদিগের বৈষ্ণবধর্ম এইরূপ বহুদিন হইতে চলিতেছে। ভারতে ঐ মতের অনেকেই আপনাদিগকে বৈষ্ণব বলিয়া অভিমান করেন। শুদ্ধবৈষ্ণবকে বৈষ্ণব বলিয়া স্বীকার করিতে চা’ন না। সে কেবল তাঁহাদের দুর্ভাগ্য মাত্র।
ভারতে জ্ঞানবিদ্ধ-বৈষ্ণবধর্মও প্রচুররূপে চলিতেছে। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের মতে অজ্ঞেয়ব্রহ্মতত্ত্বই সর্বোচ্চ তত্ত্ব। সেই মতে নির্বিশেষ ব্রহ্ম পাইবার জন্য সাকার সূর্য, গণেশ, শক্তি, শিব ও বিষ্ণুকে উপাসনা করা আবশ্যক। জ্ঞান পূর্ণ হইলে সাকার-উপাস্য দূর হয়। শেষে নির্বিশেষ-ব্রহ্মতা লাভ হয়। এই মতে অনেক মনুষ্য অবস্থিত হইয়া শুদ্ধবৈষ্ণবকে অনাদর করেন। পঞ্চ-উপসনার মধ্যে যে বিষ্ণুর উপাসনা আছে, তাহাতে দীক্ষা, পূজাদি সমস্ত বিষ্ণু-বিষয়ক, কখন রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক হইলেও, তাহা শুদ্ধবৈষ্ণবধর্ম নয়।
এবম্ভূত বিদ্ধবৈষ্ণবধর্মকে পৃথক্ করিলে যে শুদ্ধবৈষ্ণবধর্মের উদয় হয়, তাহাই প্রকৃত বৈষ্ণবধর্ম। কলিদোষে অনেকেই শুদ্ধবৈষ্ণবধর্ম বুঝিতে না পারিয়া বিদ্ধবৈষ্ণবধর্মকেই বৈষ্ণবধর্ম বলেন।
শ্রীমদ্ভাগবত সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, মানবের পরমার্থ-প্রবৃত্তি তিন-প্রকার—অর্থাৎ ব্রহ্মা-প্রবৃত্তি, পরমাত্ম-প্রবৃত্তি ও ভাগবত-প্রবৃত্তি। ব্রহ্মা প্রবৃত্তিক্রমে নির্বিশেষ-ব্রহ্মতত্ত্বে কাহারও কাহারও রুচি হয়। তাঁহারা যে উপায় অবলম্বন করিয়া নির্বিশেষ হইতে চেষ্টা করেন, কালে সে-সকল উপায় পঞ্চদেবতার উপাসনা বলিয়া পরিচিত হয়। তন্মধ্যেই জ্ঞানবিদ্ধ বৈষ্ণবধর্ম উদিত হইয়া থাকে।
পরমাত্ম প্রবৃত্তিক্রমে সূক্ষ্ম-পরমাত্মস্পর্শী যোগতত্ত্বে কাহারও কাহারও রুচি হয়। তাঁহারা যে উপায় অবলম্বন করিয়া পরমাত্মাসমাধি আশা করেন, সে-সকল ক্রিয়াকর্মযোগও অষ্টাঙ্গাদি-যোগ বলিয়া পরিচিত। এই মতে বিষ্ণুমন্ত্রদীক্ষা, বিষ্ণুপূজা ও ধ্যানাদি সমস্তই কর্মাঙ্গ। তন্মধ্যে কর্মবিদ্ধ-বৈষ্ণবধর্ম উদিত হইয়া থাকে।
ভাগবত প্রবৃত্তিক্রমে শুদ্ধ-সবিশেষ-ভগবৎ স্বরূপানুগত ভক্তিতত্ত্বে সমস্ত ভাগ্যবান্ জীবের রুচি হয়। ইঁহারা যে ভগবদারাধনাদি করেন, সে-সকল ক্রিয়া কর্ম বা জ্ঞানাঙ্গ নয়— শুদ্ধভক্তির অঙ্গ। এই মতের বৈষ্ণবধর্মই শুদ্ধবৈষ্ণবধর্ম। শ্রীমদ্ভাগবত বচন―যথা (১/২/১১)—–
বদন্তি তত্তত্ত্ববিদস্তত্ত্বং যজ্জ্ঞানমদ্বয়ম্।
ব্রহ্মেতি পরমাত্মেতি ভগবানিতি শব্দ্যতে॥
দেখুন, ব্রহ্মপরমাত্মাভেদী ভগবত্তত্ত্বই সমস্ত তত্ত্বের চরম। ভগবত্তত্ত্বই শুদ্ধ বিষ্ণুতত্ত্ব। সেই তত্ত্বের অনুগত জীবই শুদ্ধজীব। তাঁহার প্রবৃত্তির নাম ‘ভক্তি’। হরিভক্তিই শুদ্ধবৈষ্ণবধর্ম, নিত্যধর্ম, জৈবধর্ম, ভাগবতধর্ম, পরমার্থধর্ম, পরধর্ম বলিয়া বিখ্যাত। ব্রাহ্মপ্রবৃত্তি ও পরমাত্মপ্রবৃত্তি হইতে যতপ্রকার ধর্ম হইয়াছে, সে সমস্তই নৈমিত্তিক। নির্বিশেষব্রহ্মানুসন্ধানে নিমিত্ত আছে, অতএব নৈমিত্তক অর্থাৎ নিত্য নয়। জড়বিশেষে আবদ্ধ হইয়া যে জীব বন্ধন-মোচনের জন্য ব্যতিব্যস্ত, সে জড়বন্ধনকে নিমিত্ত করিয়া নির্বিশেষগতির অনুসন্ধানরূপ নৈমিত্তিক ধর্মকে আশ্রয় করে। অতএব ব্রাহ্মধর্ম নিত্য নয়। যে জীব সমাধি-সুখবাঞ্ছায় পরমাত্ম-ধর্ম অবলম্বন করে, সে জড় সূক্ষ্মভূক্তিকে নিমিত্ত করিয়া নৈমিত্তিক ধর্মকে অবলম্বন করিয়াছে। অতএব পরমাত্মধর্ম নিত্য নয়, কেবল বিশুদ্ধ ভাগবতধর্মই নিত্য।
এই পর্যন্ত শ্রবণ করিয়া লাহিড়ী মহাশয় কহিলেন মহোদয়,—যাহাকে শুদ্ধবৈষ্ণবধর্ম বলে, তাহা আমার নিকট বর্ণন করুন্। আমি এই অধিক বয়সে আপনার চরণাশ্রয় করিলাম, আপনি কৃপা করিয়া আমাকে গ্রহণ করুন। আমি শুনিয়াছি যে, অপাত্রের দ্বারা পূর্বে দীক্ষা ও শিক্ষা হইয়া থাকিলেও, সুপাত্র লাভ করিলে পুনরায় দীক্ষিত ও শিক্ষিত হওয়া উচিত। আমি কয়েকদিবস হইতে আপনার সাধু উপদেশ শ্রবণ করিয়া বৈষ্ণবধর্মে জাত-শ্রদ্ধ হইয়াছি, এখন আপনি কৃপা করিয়া প্রথমে বৈষ্ণবধর্মে শিক্ষা এবং অবশেষে দীক্ষা দিয়া আমাকে পবিত্র করুন।
বাবাজী মহাশয় একটু ব্যস্ত হইয়া কহিলেন,—দাদা ঠাকুর, আমার সাধ্যমত আমি আপনাকে শিক্ষা দিব। আমি দীক্ষাগুরু হইবার যোগ্য নই। সে যাহা হউক, আপনি এখন শুদ্ধবৈষ্ণবধর্ম শিক্ষা করুন।
জগতের আদিগুরু শ্রীশ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু বলিয়াছেন যে, বৈষ্ণবধর্মে তিনটি তত্ত্ব আছে। সম্বন্ধতত্ত্ব, অভিধেয়তত্ত্ব ও প্রয়োজনতত্ত্ব। এই তিন তত্ত্ব অবগত হইয়া যিনি যথাযথ আচরণ করেন, তিনিই শুদ্ধবৈষ্ণব বা শুদ্ধভক্ত।
সম্বন্ধতত্ত্বে তিনটি বিষয়ের পৃথক্ পৃথক্ শিক্ষা আছে-- জড় জগৎ বা মায়িক তত্ত্ব, জীব বা অধীনতত্ত্ব ও ভগবান বা প্রভুতত্ত্ব। ভগবান্ এক ও অদ্বিতীয়, সর্বশক্তিসম্পন্ন, সর্বাকর্ষক, ঐশ্বৰ্য্য ও মাধুর্য্যের একমাত্র নিলয়, মায়া ও জীবশক্তির একমাত্র আশ্রয়। তিনি মায়া ও জীবের আশ্রয় হইয়াও সর্বদা সুন্দররূপে একটি স্বতন্ত্রস্বরূপ। তাঁহার অঙ্গ কান্তি সুদূরবর্তী হইয়া নির্বিশেষ-ব্রহ্মরূপে প্রতিভাত। তাঁহার ঐশী শক্তি জগৎ ও জীব সৃষ্টি করিয়া অংশে পরমাত্মস্বরূপে জগৎপ্রবিষ্ট ঈশ্বরতত্ত্ব। ঐশ্বৰ্য্যপ্রধান প্রকাশে তিনি পরব্যোমে নারায়ণ। মাধুর্য প্রকাশে তিনি গোলোক-বৃন্দাবনে গোপীজনবল্লভ শ্ৰীশ্ৰীকৃষ্ণচন্দ্র। তাঁহার প্রকাশ ও বিলাসসমুদয় নিত্য ও অনন্ত। তাঁহার সমান কেহ বা কিছুই নাই;--- তাঁহার অধিকের ত’ কথাই নাই। তাঁহার পরাশক্তিক্রমে সমস্ত প্রকাশ ও বিলাস। পরাশক্তির বিবিধ বিক্রমের মধ্যে জীবের নিকট তিনটী বিক্রমের পরিচয় মাত্র আছে। একটির নাম চিদ্বিক্রম-যদ্দ্বারা তাঁহার লীলা-সম্বন্ধে সমস্তই সিদ্ধ হইয়াছে; আর একটির নাম জীববিক্রম বা তটস্থবিক্রম—যদ্দ্বারা অনন্ত জীবের উদয় ও অবিস্থিতি। তৃতীয় বিক্রমের নাম মায়াবিক্রম,―যদ্দ্বারা জগতের সমস্ত মায়িক বস্তু, কাল ও কর্মের সৃষ্টি হইয়াছে। জীবের সহিত ভগবানের যে সম্বন্ধ, ভগবানের সহিত জীবের ও জড়ের যে সম্বন্ধ এবং জড়ের সহিত ভগবান ও জীবের যে সম্বন্ধ―এই সম্বন্ধের নাম সম্বন্ধতত্ত্ব। সম্বন্ধতত্ত্ব সম্যক্জানিতে পারিলে সম্বন্ধজ্ঞান হয়। সম্বন্ধজ্ঞানহীন ব্যক্তিগণ কোন প্রকারেই শুদ্ধবৈষ্ণব হইতে পারেন না।
লাহিড়ী মহাশয় কহিলেন,―আমি বৈষ্ণবদিগের নিকট শুনিয়াছি যে, বৈষ্ণবগণ কেবল ভাবুকতার অধীন, তাঁহাদের কোন জ্ঞানের প্রয়োজন নাই। এ কথা কিরূপ? আমি এ পর্যন্ত হরিনামকীর্তনে ভাব সংগ্রহ করিবারই যত্ন করিয়াছি, সম্বন্ধ-জ্ঞান জানিতে চেষ্টা করি নাই।
বাবাজী কহিলেন,― বৈষ্ণবের ভাবোদয়ই চরম ফল বটে; কিন্তু শুদ্ধ হওয়া আবশ্যক। যাঁহারা অভেদব্রহ্মানুসন্ধানকে চরম ফল জানিয়া সাধন-মধ্যে ভাব শিক্ষা করেন, তাঁহাদের ভাব ও চেষ্টা শুদ্ধ ভাব নয় অর্থাৎ শুদ্ধভাবের ভাণ মাত্র। শুদ্ধভাব একবিন্দু হইলেও জীবকে চরিতার্থ করে, কিন্তু জ্ঞানবিদ্ধ-ভাবুকতা কেবল জীবের পক্ষে উৎপাত বলিয়া জানিবেন। হৃদয়ে যাঁহার অভেদ-ব্রহ্মভাব, তাঁহার ভক্তিভাব কেবল লোকবঞ্চনা মাত্র। অতএব শুদ্ধভক্তদিগের সম্বন্ধজ্ঞান নিতান্ত আবশ্যক।
লাহিড়ী মহাশয় সশ্রদ্ধ হইয়া বলিলেন,―ব্রহ্ম অপেক্ষা উচ্চতত্ত্ব কি আছে? ভগবান্ হইতে যদি ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা, তাহা হইলে জ্ঞানীলোক সকল কেন ব্রহ্মত্যাগ করিয়া ভগবদ্ভজন করেন না?
বাবাজী মহাশয় একটু হাস্য করিয়া কহিলেন, ব্রহ্মা, চতুঃসন, শুক, নারদ, দেবদেব মহাদেব সকলেই অবশেষে ভগবচ্চরণ আশ্রয় করিয়াছেন।
লাহিড়ী মহাশয় বলিলেন,―ভগবান্ রূপবিশিষ্ট তত্ত্ব, অতএব সীমা-বিশিষ্ট তিনি কিরূপে অসীম ব্রহ্মের আশ্রয় হইতে পারেন?
বাবাজী কহিলেন,—জড় জগতে একটি আকাশ বলিয়া বস্তু আছে, তাহাও অসীম। এমত স্থলে ব্রহ্মের অসীম হইয়া কি অধিক মাহাত্ম্য হইল? ভগবান্ নিজ অঙ্গকান্তিরূপশক্তিক্রমে অসীম হইয়াও যুগপৎ স্বরূপ-বিশিষ্ট। এমন আর কোনও বস্তু দেখিয়াছেন? এই অদ্বিতীয় স্বভাববশতঃ ভগবান ব্রহ্মতত্ত্ব অপেক্ষা সুতরাং উচ্চ। একটী অপূর্ব সর্বাকর্ষকস্বরূপ-তাঁহাতে সর্বব্যাপিত্ব, সর্বজ্ঞত্ব, সর্বশক্তিত্ব, পরমদয়া, পরমানন্দ পূর্ণরূপে বিরাজমান। এরূপ স্বরূপ ভাল, কি কোনও গুণ নাই, কোনও শক্তি নাই―একটী অজ্ঞাত সর্বব্যাপী অস্তিত্ব ভাল? বস্তুতঃ ব্রহ্ম ভগবানের নির্বিশেষ আবির্ভাব। ভগবানে নির্বিশেষত্বও সবিশেষত্ব—দুইই সুন্দররূপে যুগপৎ অবিস্থিত। ব্রহ্ম তাঁহার এক অংশ মাত্র। নিরাকার, নির্বিকার, নির্বিশেষ, অপরিজ্ঞেয় ও অপরিমেয় ভাবটী অদূরদর্শী ব্যক্তিদের প্রিয় হয়; কিন্তু যাঁহারা সর্বদর্শী, তাঁহারা পূর্ণ তত্ত্ব ব্যতীত আর কিছুতেই রতি করেন না। বৈষ্ণবেরা নিরাকার তত্ত্বকে বিশেষ শ্রদ্ধা করিতে পারেন না, যেহেতু তাহা নিত্য ধর্মের বিরোধী ও শুদ্ধপ্রেমের বিরোধী। পরমেশ্বর কৃষ্ণচন্দ্র সবিশেষ ও নির্বিশেষ উভয় তত্ত্বের আশ্রয়, পরমানন্দের সমুদ্র এবং সমস্ত শুদ্ধজীবের আকর্ষক।
লা। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম, কর্ম ও দেহত্যাগ আছে—তাঁহার মূর্তি কিরূপে নিত্য হইতে পারে?
বা। শ্রীকৃষ্ণমূর্তি সচ্চিদানন্দ―তাঁহাতে জড়সম্বন্ধীয় জন্ম, কর্ম ও দেহত্যাগাদি নাই।
লা। তবে কেন মহাভারতাদি গ্রন্থে সেরূপ বর্ণন করিয়াছেন?
বা। নিত্যতত্ত্ব বর্ণনার অতীত। শুদ্ধজীব আপন চিদ্বিভাগে কৃষ্ণমূর্তি ও কৃষ্ণলীলা পরিদর্শন করেন। বাক্যের দ্বারা বর্ণন করিতে গেলে, জড়ীয় ইতিহাসের ন্যায় কাযেকাযেই বর্ণিত হইয়া থাকে। যাঁহারা মহাভারতাদি গ্রন্থের সারগ্রহণ করিতে সমর্থ, তাঁহারা কৃষ্ণলীলাদি যেরূপ অনুভব করেন, জড়বুদ্ধি লোকেরা ঐসকল বর্ণন শুনিয়া অন্যপ্রকার অনুভব করিয়া থাকেন।
লা। কৃষ্ণমূর্তি-ধ্যান করিতে গেলে একটি দেশকাল-পরিচ্ছিন্ন ভাব হৃদয়ে উদিত হয়। তাহাকে অতিক্রম করিয়া আর কি প্রকার শ্রীমূর্তির ধ্যান হইতে পারে?
বা। ধ্যান মনের কর্ম। মন যতক্ষণ শুদ্ধ-চিন্ময় না হয়, ততক্ষণ ধ্যান কখনও চিন্ময় হইতে পারে না। ভক্তিভাবিত মন ক্রমশঃ চিন্ময় হইয়া পড়ে; সেই মনে যে ধ্যান হয়, তাহা অবশ্য চিন্ময়। ভজনানন্দী বৈষ্ণবগণ যখন কৃষ্ণনাম করেন, তখন জড়জগৎ আর তাঁহাদিগকে স্পর্শ করে না। তাঁহারা চিন্ময়। চিন্ময় জগতে বসিয়া শ্রীকৃষ্ণের দৈনন্দিন লীলা-ধ্যান করেন এবং অন্তরঙ্গসেবাসুখ ভোগ করিতে থাকেন।
লা। আপনি কৃপা করিয়া ঐ চিদনুভব আমাকে প্রদান করুন।
বা। আপনি সমস্ত জড়ীয় সন্দেহ ও বিতর্ক পরিত্যাগ করিয়া যখন অহরহ নাম আলোচনা করিবেন, তখন অতি অল্পদিনের মধ্যেই চিদনুভব উদিত হইবে। যত বিতর্ক করিবেন ততই জড়বন্ধনে মনকে আবদ্ধ করিবেন। যতই নামরস উদয় করাইবেন, ততই জড়বন্ধন শিথিল হইবে ও চিজ্জগৎ হৃদয়ে প্রকাশ পাইবে।
লা। আমি ইচ্ছা করি, আপনি কৃপা করিয়া আমাকে তাহা কি, তাহা বলিয়া দেন।
বা। মন বাক্যের সহিত সে তত্ত্বকে না পাইয়া প্রতিনিবৃত্ত হয়। কেবল চিদানন্দের অনুশীলনেই তাহা পাওয়া যায়। আপনি বিতর্ক ছাড়িয়া কিছুদিন নাম করুন, তাহা হইলে আপনা আপনি সমস্ত সন্দেহ দূর হইবে এবং আপনি আর কাহাকেও কোনও বিষয়ে প্রশ্ন করিবেন না।
লা। আমি জানিলাম যে, শ্রীকৃষ্ণে শ্রদ্ধা করিয়া তাঁহার নামরস পান করিলে সমস্ত পরমার্থ পাওয়া যায়। আমি সম্বন্ধ জ্ঞান ভাল করিয়া বুঝিয়া লইয়া নামাশ্রয় করিব।
বা। একথা সর্বোৎকৃষ্ট। আপনি সম্বন্ধজ্ঞান ভাল করিয়া অনুভব করুন।
লা। ভগবত্তত্ত্ব আমি এখন বুঝিয়াছি। ভগবানই এক পরমতত্ত্ব; ব্রহ্ম, পরমাত্মা তাঁহার অধীন। তিনি সর্বব্যাপী হইয়াও চিজ্জগতে স্বীয় অপূর্ব শ্রীবিগ্রহে বিরাজমান। তিনি ঘনীভূত-সচ্চিদানন্দ পুরুষ এবং সর্বশক্তিসমন্বিত। সকলশক্তির অধীশ্বর হইয়াও হ্লাদিনী শক্তির সঙ্গসুখে সর্বদা প্রমত্ত। এখন আমাকে জীবতত্ত্ব বলুন।
বা। শ্রীকৃষ্ণের অনন্ত শক্তির মধ্যে ‘তটস্থ’ বলিয়া একটি শক্তি আছে। চিজ্জগৎ ও জড়জগতের মধ্যবর্তী উভয় জগতের সঙ্গযোগ্য একটি তত্ত্ব সেই শক্তি হইতে নিঃসৃত হয়; তাঁহার নাম জীবতত্ত্ব। জীবের গঠন কেবল চিৎপরমাণু। লঘুতাপ্রযুক্ত তাহা জড় জগতে আবদ্ধ হইবার যোগ্য। কিন্তু শুদ্ধগঠনপ্রযুক্ত একটু চিদ্বল পাইলেই পরমানন্দে চিজ্জগতের নিত্যনিবাসী হইতে পারেন। সেই জীব দুইপ্রকার―মুক্ত অর্থাৎ চিজ্জগৎনিবাসী ও বদ্ধ অর্থাৎ জড়জগৎনিবাসী। বদ্ধজীব দুই প্রকার—উদিতবিবেক ও অনুদিতবিবেক। মানবগণের মধ্যে যাহাদের পরমার্থ-চেষ্টা নাই ও পশুপক্ষিগণ, ইহারা অনুদিতবিবেক বদ্ধজীব। যে সকল মানব বৈষ্ণবপথাবলম্বী, তাঁহারা উদিতবিবেক। যেহেতু বৈষ্ণব ব্যতীত আর কাহারও পরমার্থচেষ্টা নাই। এইজন্য বৈষ্ণবসেবাও বৈষ্ণবসঙ্গ সকল কর্মের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া শাস্ত্রে কথিত হইয়াছে। যে শাস্ত্রীয় শ্রদ্ধা অনুসারে উদিতবিবেক জীব কৃষ্ণনামানুশীলনে উদিত-প্রবৃত্তি হ’ন, তাহাতেই বৈষ্ণবসঙ্গ সহজে প্রতিষ্ঠিত হয়। অনুদিতবিবেক পুরুষেরা শাস্ত্রীয় শ্রদ্ধাদ্বারা কৃষ্ণনাম করেন না; কেবল পরম্পরা-আচার-অনুসারে কৃষ্ণমূর্তিসেবা করেন। সুতরাং বৈষ্ণবসম্মানের প্রতিষ্ঠা তাঁহাদের হৃদয়ে আরূঢ় হয় না।
লা। কৃষ্ণতত্ত্ব ও জীবতত্ত্ব বুঝিলাম। এখন মায়াতত্ত্ব বুঝাইয়া দেন।
বা। মায়া অচিৎ ব্যাপার। মায়া একটী কৃষ্ণশক্তি। ইহার নাম অপরা শক্তি বা বহিরঙ্গা শক্তি। যেমত আলোকের ছায়া আলোক হইতে দূরে থাকে, তদ্রূপ মায়া কৃষ্ণ ও কৃষ্ণভক্তি হইতে দূরে থাকে। মায়া জড়-জগতের চৌদ্দভুবন, ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও আকাশ, মন, বুদ্ধি ও জড়ীয় দেহে আমিত্বরূপ অহঙ্কার প্রকাশ করিয়াছে। বদ্ধজীবের স্থূল ও লিঙ্গ উভয় দেহই মায়িক। মুক্ত হইলে জীবের চিদ্দেহ পরিষ্কৃত হয়। জীব যতদূর মায়াবদ্ধ ততদূর কৃষ্ণবহির্মুখ। যতদূর মায়ামুক্ত, ততদূর কৃষ্ণসাম্মুখ্যপ্রাপ্ত। বদ্ধজীবের ভোগায়তনস্বরূপ মায়িক ব্রহ্মাণ্ড কৃষ্ণ-ইচ্ছায় উদ্ভূত হইয়াছে। এই মায়িক জগত জীবের নিত্যবাসস্থান নয়। এ জগৎ কেবল জীবের কারাগারমাত্র।
লা। প্রভো! আপনি এখন মায়া, জীব ও কৃষ্ণের নিত্য-সম্বন্ধ বলুন।
বা। জীব চিদণু, অতএব নিত্য-কৃষ্ণদাস। মায়িক জগৎ জীবের কারাগার। এখানে সৎসঙ্গবলে নামানুশীলন করিয়া কৃষ্ণকৃপাক্রমে জীব চিজ্জগতে নিজ সিদ্ধচিৎ স্বরূপে কৃষ্ণসেবারস ভোগ করেন। ইহাই তিন তত্ত্বের পরস্পর নিগূঢ় সম্বন্ধ। এই জ্ঞান না হইলে ভজন কিরূপে হইবে?
লা। যদি বিদ্যাচর্চাক্রমে জ্ঞানলাভ করিতে হয়, তবে বৈষ্ণব হইবার পূর্বে কি পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন আছে?
বা। বৈষ্ণব হইবার জন্য কোন বিদ্যা বা ভাষাবিশেষ আলোচনা করিতে হয় না। জীবের মায়াভ্রম দূর করিবার জন্য সদ্গুরু সদ্বৈষ্ণবের চরণাশ্রয় করা আবশ্যক। তিনি বাক্যের দ্বারা এবং স্বীয় আচরণদ্বারা সম্বন্ধজ্ঞান উদয় করিয়া দেন। ইহারই নাম দীক্ষা ও শিক্ষা।
লা। দীক্ষা-শিক্ষার পর কি করিতে হয়?
বা। সচ্চরিত্রতার সহিত কৃষ্ণানুশীলন করিতে হয়। ইহার নাম অভিধেয় তত্ত্ব। এই তত্ত্ব বেদাদি সমস্ত শাস্ত্রে প্রবলরূপে অভিহিত হইয়াছে বলিয়া শ্ৰীমন্মহাপ্রভু ইহাকে অভিধেয়তত্ত্ব বলেন।
সজল-নয়নে লাহিড়ী। গুরো! আমি আপনার শ্রীচরণ আশ্রয় করিলাম। আপনার মধুমাখা কথা শুনিয়া আমার সম্বন্ধজ্ঞান হইল এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে কি জানি, আপনার কৃপাবলে বর্ণগত, বিদ্যাগত ও শিক্ষাগত সমস্ত পূর্বসংস্কার দূর হইল। আপনি কৃপা করিয়া আমাকে অভিধেয়তত্ত্ব শিক্ষা দেন।
বা। আর চিন্তা নাই। আপনার যখন দীনতা উপস্থিত হইয়াছে, তখন শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য আপনাকে অবশ্য কৃপা করিয়াছেন। জড় জগতে আবদ্ধ হইয়া জীবের পক্ষে সাধুসঙ্গই একমাত্র উপায়। সাধুগুরু কৃপা করিয়া ভজনশিক্ষা দেন। সেই ভজনবলে ক্রমশঃ প্রয়োজনলাভ হয়। হরিভজনই অভিধেয়।
লা। আমাকে বলুন, কি করিলে হরিভজন হয়?
বা। ভক্তিই হরিভজন। ভক্তির তিনটি অবস্থা—সাধন, ভাব ও প্রেম। প্রথমে ‘সাধন’-ভক্তি সাধন করিতে করিতে ‘ভাবোদয়’ হয়। ভাব সম্পূর্ণ হইলে তাহাকে ‘প্রেম’ বলে।
লা। সাধন কতপ্রকার ও কি প্রণালীতে করিতে হয়, আজ্ঞা করুন।
বা। ‘শ্রীভক্তিরসামৃতসিন্ধু’-গ্রন্থে শ্রীরূপগোস্বামী এ সমস্ত বিষয় বিস্তৃতরূপে লিখিয়াছেন। আমি সংক্ষেপে বলি। সাধন নববিধ―
“শ্রবণং কীর্তনং বিষ্ণোঃ স্মরণং পাদসেবনম।
অর্চনং বন্দনং দাস্যং সখ্যমাত্মনিবেদনম্॥(ভাঃ ৭।৫।২৩)
শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, পাদসেবা, অর্চন, বন্দন, দাস্য, সখ্য, আত্মনিবেদন—এই নববিধ সাধনভক্তি শ্রীমদ্ভাগবতে লিখিত হইয়াছে। এই নয় প্রকারকে ইহার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ধরিয়া চৌষট্টিপ্রকার করিয়া গোস্বামিপাদ বর্ণন করিয়াছেন। ইহার মধ্যে একটু বিশেষ কথা এই যে, সাধনভক্তি বৈধী ও রাগানুগা―ভেদে দুইপ্রকার। তন্মধ্যে বৈধী ভক্তি নববিধ। রাগানুগা সাধনভক্তি কেবল ব্রজজনের অনুগত হইয়া তাঁহাদের ন্যায় মানসে কৃষ্ণসেবা। যে ব্যক্তি যে প্রকার ভক্তির অধিকারী তিনি সে প্রকার সাধন করিবেন।
লা। সাধনভক্তিতে কিরূপে অধিকার-বিচার হয়?
বা। যে শ্রদ্ধাবান্ ব্যক্তি বিধির অধীন থাকিবার অধিকারী, গুরুদেব তাঁহাকে বৈধী সাধনভক্তি প্রথমে শিক্ষা দিবেন। যিনি রাগানুগা ভক্তির অধিকারী, তাঁহাকে রাগমার্গীয় ভজনশিক্ষা দিবেন।
লা। অধিকার কিরূপে জানা যাইবে?
বা। যাঁহার আত্মায় রাগতত্বের উপলব্ধি হয় নাই এবং যিনি শাস্ত্র শাসনমতে উপাসনাদি করিতে ইচ্ছা করেন, তিনি বৈধী ভক্তির অধিকারী। যিনি হরিভজনে শাস্ত্রশাসনের বশবর্ত্তী হইতে ইচ্ছা করেন না, কিন্তু তাঁহার আত্মার হরিভজনে স্বাভাবিক রাগ উদিত হইয়াছে, তিনি রাগানুগ ভজনের অধিকারী।
লা। প্রভো! আমার অধিকার নির্ণয় করুন, তাহা হইলে আমি অধিকারতত্ত্ব বুঝিতে পারিব। বৈধী ও রাগানুগা ভক্তি আমি বুঝিতে পারিতেছি না।
বা। আপনার চিত্তকে আপনি পরীক্ষা করিলেই স্বীয় অধিকার বুঝিতে পারিবেন। আপনার মনে এমত কি আছে যে, শাস্ত্রমতে না চলিলে ভজন হয় না?
লা। আমি মনে করি যে, শাস্ত্রনির্দিষ্টমত সাধনভজন করিলে বিশেষ লাভ হয়। কিন্তু আমার মনে আজকাল ইহাও স্থান পাইতেছে যে, হরিভজনে রসের সমুদ্র আছে, তাহা ক্রমশঃ ভজনবলে পাওয়া যায়।
বা। এখন দেখুন, শাস্ত্রবিধি আপনার হৃদয়ের প্রভু। অতএব আপনি বৈধী ভক্তি অবলম্বন করুন। ক্রমশঃ রাগতত্ত্ব হৃদয়ে উদিত হইবে। এই শুনিয়া লাহিড়ী মহাশয় সজলনয়নে বাবাজীর পাদস্পর্শপূর্বক কহিলেন,--“আপনি কৃপা করিয়া আমার যাহাতে অধিকার, তাহাই প্রদান করুন। আমি এখন অনধিকারচর্চা করিতে চাই না।” বাবাজী মহাশয় তাঁহাকে আলিঙ্গন প্রদান করিয়া বসাইলেন।
লা। আমি এখন কিরূপ ভজন করিব, স্পষ্ট করিয়া আজ্ঞা করুন।
বা। আপনি হরিনাম গ্রহণ করুন। যতপ্রকার ভজন আছে, সর্বাপেক্ষা নামাশ্রয়ভজনই বলবান্। নাম ও নামীতে ভেদ নাই। নিরপরাধে নাম করিলে অতি শীঘ্র সমস্ত সিদ্ধিলাভ হয়। আপনি বিশেষ শ্রদ্ধার সহিত নাম গ্রহণ করুন। নাম করিতে করিতে নববিধ ভজনই হইয়া থাকে। নাম উচ্চারণ করিলে শ্রবণ-কীর্তন উভয়ই হয়। নামের সহিত হরিলীলা-স্মরণ ও মানসে পাদসেবা, অর্চন, বন্দন, দাস্য, সখ্য ও আত্মনিবেদন সকলই হয়। লা। আমার চিত্ত ব্যগ্র হইয়াছে। প্রভো, কৃপা করিতে বিলম্ব করিবেন না।
বা। মহোদয়, আপনি নিরপরাধে নিরন্তর এই কথা বলুন—
“হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে॥”
—এই কথা বলিতে বলিতে বাবাজী মহাশয় লাহিড়ী মহাশয়ের হস্তে একটী তুলসীমালা প্রদান করিলেন। লাহিড়ী মহাশয় সেই মালায় উক্ত নাম উচ্চারণ করিতে করিতে কাঁদিতে লাগিলেন। বলিলেন, ―“প্রভো, আজ আমি যে কি আনন্দ লাভ করিলাম, বলিতে পারি না।” আনন্দে অচেতন হইয়া বাবাজীর পদতলে পড়িলেন। বাবাজী মহাশয় তাঁহাকে যত্ন করিয়া ধরিয়া রহিলেন। অনেকক্ষণ পরে লাহিড়ী মহাশয় বলিলেন— “আমি আজ ধন্য হইলাম। এ প্রকার সুখ আমি কখনও পাই নাই।”
বা। মহোদয়, আপনি ধন্য, যেহেতু শ্রদ্ধাপূর্বক হরিনাম গ্রহণ করিলেন। আপনি আমাকেও ধন্য করিলেন।
সে দিবস লাহিড়ী-মহাশয় মালা গ্রহণ করিয়া নিজ কুটীরে নির্ভয়ে নাম করিতে লাগিলেন। এইরূপে কিছুদিন অতিবাহিত হইল। লাহিড়ী মহাশয় এখন দ্বাদশ তিলক করেন। প্রসাদান্ন ব্যতীত আর কিছুই সেবা করেন না। প্রত্যহ দুই লক্ষ হরিনাম করেন। শুদ্ধবৈষ্ণব দেখিলেই দণ্ডবৎপ্রণাম করেন। পরমহংস বাবাজীকে প্রত্যহ দণ্ডবপ্রণাম করিয়া। অন্য কার্য করেন। নিজগুরুদেবের সর্বদা সেবা করেন। বৃথা কথা ও কালোয়াতি গানে আর রুচি নাই। লাহিড়ী মহাশয় আর সে লাহিড়ী মহাশয় নাই। এখন বৈষ্ণব হইয়াছেন।
এক দিবস তিনি বৈষ্ণবদাস বাবাজী মহাশয়কে সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎপ্রণাম করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,—“প্রভো, প্রয়োজনতত্ত্ব কি?”
বা। কৃষ্ণপ্রেমাই জীবের প্রয়োজনতত্ত্ব। সাধন করিতে করিতে ‘ভাব’ হয়। ভাব পূর্ণ হইলে ‘প্রেম’-নাম হইয়া থাকে। তাহাই জীবের নিত্যধর্ম, নিত্যধন ও চরম প্রয়োজন। সেই প্রেমের অভাবেই কষ্ট, জড়বন্ধন ও বিষয়সংযোগ। প্রেম অপেক্ষা আর অধিক উৎকৃষ্ট কিছুই নাই। কৃষ্ণ কেবল প্রেমের বশ—চিন্ময় তত্ত্ব। আনন্দ ঘনীভূত হইয়া প্রেম হয়।
লা। (কাঁদিতে কাঁদিতে) আমি কি প্রেম লাভ করিবার যোগ্য হইব?
বা। (আলিঙ্গন করিয়া) দেখুন, স্বল্প দিবসের মধ্যেই আপনি সাধনভক্তিকে ভাবভক্তি করিয়াছেন। আর কিছুদিনেই কৃষ্ণ আপনাকে অবশ্য কৃপা করিবেন।
এই কথা শুনিয়া লাহিড়ী মহাশয় আনন্দে গড়াগড়ি দিয়া বলিতে লাগিলেন,—“আহা, গুরু ব্যতীত আর বস্তু নাই। আহা, আমি এতদিন কি করিতেছিলাম! গুরুদেব আমাকে অপার কৃপা করিয়া বিষয়গৰ্ত্ত হইতে উদ্ধার করিলেন”।