Normal view
Book Lang.: বাংলা
English
संस्कृता वाक्
Translation
Gaudīya Base»Books»জৈবধর্ম»তৃতীয় অধ্যায় - নৈমিত্তিক ধর্ম অসম্পূর্ণ, হেয়, মিশ্র ও অচিরস্থায়ী

তৃতীয় অধ্যায় - নৈমিত্তিক ধর্ম অসম্পূর্ণ, হেয়, মিশ্র ও অচিরস্থায়ী

Language: বাংলা
Language: English Translation
  • (সন্ন্যাসীর অপ্রাকৃত-মায়াপুর-দর্শন—মায়াপুর-বৈভবদর্শনে সন্ন্যাসীর বৈষ্ণব বেশ-গ্রহণ-প্রতিষ্ঠাভয়―সন্ন্যাসীর বৈষ্ণবদাস নামপ্রাপ্তি―বৈষ্ণবদিগের নিকট বৈষ্ণবদাসের দৈন্যোক্তি―বৈষ্ণব-সঙ্গই ভক্তির মূল―কালিদাস লাহিড়ীর পরিচয়----কালিদাসের প্রশ্ন--বৈষ্ণবদাসের কথারম্ভ―মানব-প্রকৃতি বৈধী ও রাগানুগা―স্বরূপতঃ মুক্তি ও বস্তুতঃ মুক্তি--সংসার-রাগাত্মিকা প্রকৃতি--শাস্ত্রমূলতত্ত্ব,―কর্মাধিকার, জ্ঞানাধিকার, প্রেমাধিকার—একাঙ্গ মীমাংসকের দোষ―অধিকার-সোপান-অকর্ম, বিকর্ম ও কুকর্ম—শুভকর্ম—নিত্য-নৈমিত্তিক কর্ম-বর্ণব্যবস্থা—পৃথক্‌ পৃথক্‌ বর্ণলক্ষণ—বর্ণাশ্রম-ব্যবস্থাই বৈধ-জীবন-কর্মকাণ্ডে নিত্যনৈমিত্তিক শব্দগুলি কেবল ঔপচারিক মাত্র-ভক্তিহীন ব্রাহ্মণের ধিক্কার---অনুদিত-বিবেক ও উদিত-বিবেক মানব উপায় ও উপেয়--চিত্তত্বই উপাদেয়―নৈমিত্তিক ধর্ম অসম্পূর্ণ, হেয়, মিশ্র ও অচিরস্থায়ী—জিজ্ঞাসু ব্রাহ্মণের পরিচয়—তাঁহার বৈষ্ণবদাসের প্রতি শ্রদ্ধা―মাধবদাস বাবাজীর কথা―লাহিড়ী মহাশয়ের তাঁহার কথা শ্রবণ---মাধবদাসের বাটী পরিত্যাগপূর্বক লাহিড়ী মহাশয়ের প্রদ্যুম্নকুঞ্জে অবস্থান।)

    একদিবস একপ্রহর রাত্রের পর সন্ন্যাসী ঠাকুর হরিনাম-গান করিতে করিতে শ্রীগোদ্রুমের উপবনের একান্তে একটী উচ্চভূমিতে বসিয়া উত্তরদিকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। তখন পূর্ণচন্দ্রের উদয় হইয়া শ্রীনবদ্বীপমণ্ডলের একটী অপূর্ব শোভা বিস্তার করিয়াছিল, অনতিদূরে শ্রীমায়াপুর নয়নগোচর হইতে লাগিল। সন্ন্যাসী ঠাকুর বলিতে লাগিলেন,―“আহা! ঐ যে একটি আশ্চর্য আনন্দময় ধাম দেখিতেছি। বৃহৎ বৃহৎ রত্নময় অট্টালিকা, মন্দির ও তোরণসমূহ কিরণমালা বিস্তার করিয়া জাহ্নবীর তীরমণ্ডলকে উজ্জ্বলিত করিতেছে। অনেক স্থানে হরিনাম-সংকীর্তনের শব্দ তুমুল হইয়া গগনমণ্ডলকে বিদারিত করিতেছে। নারদের ন্যায় কত শত ভক্তগণ বীণাযন্ত্রে নামগান করিতে করিতে নৃত্য করিতেছেন। কোন দিকে শ্বেতকলেবর দেবদেব মহাদেব ডম্বরু ধরিয়া “হা বিশ্বম্ভর, দয়া কর”—বলিয়া উদ্দণ্ড নৃত্য করিতে করিতে পতিত হইতেছেন। চতুর্মুখ ব্রহ্মা কোন স্থলে বসিয়া বেদবাদী ঋষিদিগের সভায় “মহান্‌ প্রভুর্বৈ পুরুষঃ সত্তস্যৈষঃ প্রবর্তকঃ। সুনির্মলামিমাং প্রাপ্তিমীশানো জ্যোতিরব্যয়ঃ॥”[1] এই বেদমন্ত্র পাঠ করিয়া ইহার নির্মল ব্যাখ্যা করিতেছেন। কোন স্থলে ইন্দ্রাদি দেবতাগণ “জয় প্রভু গৌরচন্দ্র, জয় নিত্যানন্দ” বলিয়া লম্ফ ঝম্প প্রদান করিতেছেন। পক্ষিসকল ডালে বসিয়া ‘গৌর নিতাই’ বলিয়া রব করিতেছে। ভ্রমরসকল গৌর-নাম রসপানে মত্ত হইয়া চতুর্দিকে পুষ্পোদ্যানে গুণ্‌ গুণ্‌ শব্দ করিতেছে। প্রকৃতি- দেবী সর্বত্র গৌর-রসে উন্মত্ত হইয়া আপন শোভা বিস্তার করিতেছেন। আহা! আমি দিবসে যখন শ্রীমায়াপুর দর্শন করি, তখন ত’ এ ব্যাপার দেখিতে পাইনা! আজ বা কি দেখিতেছি।” তখন শ্রীগুরুদেবকে স্মরণ করিয়া বলিতেছেন,―“প্রভো, আজ জানিলাম, আপনি আমাকে কৃপা করিয়া অপ্রাকৃত মায়াপুর দর্শন করাইলেন। আজ হইতে আমি শ্রীগৌরচন্দ্রের নিজজন বলিয়া পরিচয় দিবার একটী উপায় সৃজন করিব। আমি দেখিতেছি যে, অপ্রাকৃত নবদ্বীপে সকলেই তুলসীমালা, তিলক ও নামাক্ষর ধারণ করিয়াছেন। আমিও তাহা করিব।”—বলিতে বলিতে সন্ন্যাসী ঠাকুরের একপ্রকার অচেতন অবস্থা উপস্থিত হইল।

    অতি অল্পক্ষণের মধ্যেই আবার ঠাকুরের জ্ঞান হইল। জ্ঞান হইল বটে, কিন্তু সে অপূর্ব চিন্ময় ব্যাপারসকল আর নয়নগোচর হইল না। তখন সন্ন্যাসী ঠাকুর কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন,―“আমি বড় সৌভাগ্যবান্ যেহেতু শ্রীগুরুকৃপা লাভ করিয়া ক্ষণকাল শ্রীনবদ্বীপধাম দর্শন করিলাম।”

    পরদিন সন্ন্যাসী ঠাকুর স্বীয় দণ্ডটী জলে বিসর্জন দিয়া গলদেশে ত্রিকণ্ঠি তুলসী-মালা ললাটে ঊর্ধ্বপুন্ড্র ধারণ করিয়া ‘হরি হরি’ বলিয়া নাচিতে লাগিলেন। গোদ্রুমবাসী বৈষ্ণববর্গ তাঁহার অপূর্ব নূতন বেশ ও ভাব দর্শন করিয়া তাঁহাকে ধন্য ধন্য বলিয়া দণ্ডবৎ-প্রণাম করিতে লাগিলেন। সন্ন্যাসী ঠাকুর ঐ সময়ে একটু লজ্জিত হইয়া বলিলেন,―ভাল আমি বৈষ্ণবদিগের কৃপাপাত্র হইবার জন্য বৈষ্ণব- বেশ গ্রহণ করিলাম, কিন্তু এ আবার একটি দায় উপস্থিত হইল। আমি শ্রীগুরুদেবের মুখে বারম্বার একথাটী শুনিয়াছি,――

    তৃণাদপি সুনীচেন তরোরপি সহিষ্ণুনা।
    অমানিনা মানদেন কীর্তনীয়ঃ সদা হরিঃ॥”

    (চৈঃ চঃ অন্ত্য ২০।২১) [2]

    তখন, যে-বৈষ্ণবগণকে গুরু বলিয়া মনে করি, তাঁহারা আমাকে প্রণাম করিতেছেন, আমার কি গতি হইবে? এইরূপ চিত্তে আলোচনা করিতে করিতে পরমহংস বাবাজীর নিকট গমন করতঃ তাঁহাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিলেন। মাধবীমণ্ডপে আসীন হইয়া বাবাজী মহাশয় হরিনাম করিতেছিলেন। সন্ন্যাসী ঠাকুরের সম্পূর্ণ বেশপরিবর্তন ও নামে ভাবোদয় দেখিয়া প্রেমাবর্ষণদ্বারা স্বীয় শিষ্যকে স্নাত করাইতে করাইতে তাঁহাকে আলিঙ্গন করিলেন। বলিলেন,―“ওহে বৈষ্ণবদাস, আজ তোমার মঙ্গলপূর্ণ দেহ স্পর্শ করিয়া আমি কৃতার্থ হইলাম।” এই কথা বলিবামাত্র সন্ন্যাসী ঠাকুরের পূর্ব নাম দূর হইল। এখন বৈষ্ণবদাস’-নামে পরিচিত হইলেন। সন্ন্যাসী ঠাকুর আজ হইতে একটী অপূর্ব জীবন লাভ করিলেন। মায়াবাদি-সন্ন্যাসিবেশ, সন্ন্যাস-আশ্রমের অহঙ্কারপূর্ণ নাম এবং আপনাকে মহদ্বুদ্ধি,—এ সমস্ত দূর হইল।

    অপরাহ্ণে শ্রীপ্রদ্যুম্নকুঞ্জে শ্রীগোদ্রুম ও শ্রীমধ্যদ্বীপবাসী অনেকগুলি বৈষ্ণব পরমহংস বাবাজী মহাশয়কে দর্শন করিতে অসিয়াছিলেন। পরমহংস বাবাজী মহাশয়কে পরিবেষ্টন করিয়া সকলে বসিয়াছেন। সকলেই তুলসী-মালায় হরিনাম জপ করিতেছেন। কেহ কেহ “হা গৌরাঙ্গ নিত্যানন্দ”, কেহ কেহ “হা সীতানাথ” এবং কেহ কেহ “হে জয় শচীনন্দন” এইরূপ বলিতে বলিতে চক্ষের জলে ভাসিতেছেন। বৈষ্ণবসকল পরস্পর ইষ্টগোষ্ঠী করিতেছেন। সমাগত বৈষ্ণবসকল তুলসীপরিক্রমা করিয়া বৈষ্ণবদিগকে দণ্ডবৎ প্রণাম করিতেছেন। এমন সময় বৈষ্ণবদাস আসিয়া শ্রীবৃন্দাদেবীকে পরিক্রমা করিয়া বৈষ্ণবগণের পদরজে গড়াগড়ি দিতে লাগিলেন। কোন কোন মহাত্মা কর্ণাকর্ণী করিয়া বলিতে লাগিলেন,―“ইনিই না সেই সন্ন্যাসী ঠাকুর! আজ হঁহার কি আশ্চর্যমূর্তি হইয়াছে।”

    বৈষ্ণবগণের সম্মুকে গড়াগড়ি দিতে দিতে বৈষ্ণবদাস বলিতেছেন,—“অদ্য আমি বৈষ্ণবপদরজঃ লাভ করিয়া কৃতার্থ হইলাম। শ্রীগুরু দেবের কৃপায় আমি ভালরূপে জানিয়াছি যে, জীবের বৈষ্ণবপদরজঃ ব্যতীত আর গতি নাই। বৈষ্ণবের পদরজঃ, বৈষ্ণবের চরণামৃত ও বৈষ্ণবের অধরামৃত-এই তিন বস্তু ভবরোগের ঔষধ ও ভবরোগীর পথ্য। ইহাতে কেবল ভবরোগ বিগত হয় এরূপ নয়, কিন্তু বিগতরোগ-পুরুষের পরম ভোগ লাভ হয়। হে বৈষ্ণবগণ, আমি যে নিজের পাণ্ডিত্য-অহঙ্কার প্রকাশ করিতেছি, এরূপ মনে করিবেন না। আমার হৃদয় আজকাল সমস্ত-অহঙ্কারশূন্য হইয়াছে। ব্রাহ্মণকুলে জন্ম হইয়াছিল, সর্বশাস্ত্র পাঠ করিয়াছিলাম, চতুর্থাশ্রমে প্রবেশ করিয়াছিলাম। তখন আর আমার অহঙ্কারের ইয়ত্তা ছিল না। যদবধি আমি বৈষ্ণবতত্ত্বে আকৃষ্ট হইয়াছি, ততদিন আমার হৃদয়ে একটী দৈন্যবীজ রোপিত হইয়াছে। আমি ক্রমে ক্রমে আপনাদের কৃপায় জন্মাহঙ্কার, বিদ্যামদ ও আশ্রমগৌরব দুর করিয়াছি। এখন আমার মনে হয় যে, আমি একটি নিরাশ্রিত ক্ষুদ্র জীব। বৈষ্ণব-চরণাশ্রয় ব্যতীত আমার আর কোনপ্রকার গতি নাই। ব্রাহ্মণত্ব, বিদ্যা ও সন্ন্যাস—ইহারা আমাকে ক্রমশঃ অধঃপাতিত করিতেছিল। আমি সরলভাবে আপনাদের চরণে সকল কথা বলিলাম। এখন আপনাদের দাসকে যাহা করিতে হয় করুন।”

    বৈষ্ণবদাসের দৈন্যোক্তি শ্রবণ করিয়া অনেকেই বলিয়া উঠিলেন,―“হে ভাগবত প্রবর, আপনার ন্যায় বৈষ্ণবের চরণরেণুর জন্য আমরা লালায়িত। কৃপা করিয়া আমাদিগকে পদধূলি দিয়া কৃতার্থ করুন। আপনি পরমহংস বাবাজী মহাশয়ের কৃপাপাত্র। আমাদিগকে সঙ্গী করিয়া পবিত্র করুন। বৃহন্নারদীয়-পুরাণে লিখিয়াছেন যে, আপনার ন্যায় সঙ্গী লাভ করিলে ভক্তি হয়, যথা―

    “ভক্তিস্তু ভগবদ্ভক্তসঙ্গেন পরিজায়তে।
    সৎসঙ্গঃ প্রাপ্যতে পুংভিঃ সুকৃতৈঃ পূর্বর্সঞ্চিতৈঃ॥”[3]

    আমাদের পুঞ্জ পুঞ্জ ভক্তি-পোষক-সুকৃতি ছিল, সেই বলেই আপনার সৎসঙ্গ আমরা লাভ করিলাম। এখন আপনার সঙ্গ-বলে আমরা হরিভক্তি লাভ করিবার আশা করিতেছি।

    বৈষ্ণবদিগের পরস্পর দৈন্য ও প্রণতি সমাপ্ত হইলে সেই ভক্তগোষ্ঠীতে বৈষ্ণবদাস মহাশয় এক পার্শ্বে বসিয়া গোষ্ঠীর শোভা বর্ধন করিলেন। তাঁহার হস্তে নূতন হরিনামের মালা দীপ্তি লাভ করিয়াছিল।

    সেই গোষ্ঠীতে সে দিবস আর একটি ভাগ্যবান্ লোক বসিয়াছিলেন। তিনি বাল্যকাল হইতে যাবনিক ভাষা পাঠ করতঃ অনেকটা মুসলমান রাজাদিগের ব্যবহার অনুকরণ করিয়া দেশের মধ্যে একটি গণ্যমান্য লোক বলিয়া পরিচয় লাভ করিয়াছিলেন। নিবাস শান্তিপুর, ব্রাহ্মণজাতির মধ্যে কুলীন, অনেক ভূ-সম্পত্তির অধিকারী এবং দলাদলি কার্য্যে বিশেষ পটু। বহুদিন ঐসকল পদ ভোগ করিয়া, তাহাতে সুখ লাভ করেন নাই। অবশেষে হরিনাম-সংকীর্তন করিতে আরম্ভ করেন। অল্প বয়সে তিনি দিল্লীর কালোয়াতদিগের নিকট রাগ-রাগিণীর শিক্ষা করেন। সেই শিক্ষাবলে তিনি হরিনাম-সংকীর্তনেও মণ্ডল হইয়া পড়িলেন। যদিও বৈষ্ণবগণ তাঁহার কালোয়াতি সুর ভালবাসিতেন না, তথাপি সংকীর্তনে একটু একটু কালোয়াতি টান দিয়া নিজের মাহাত্ম্য প্রকাশ করিতে করিতে অপরের মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতেন। কিছুদিন এইরূপ করিতে করিতে তাঁহার একটু নামে সুখবোধ হইল। তদনন্তর তিনি শ্রীনবদ্বীপে বৈষ্ণবদিগের নিকট গানকীর্তনে যোগ দিবার জন্য শ্রীগোদ্রুমে আসিয়া একটী বৈষ্ণবাশ্রমে বাসা গ্রহণ করেন। সেই বৈষ্ণবের সহিত প্রদ্যুম্নকুঞ্জে আসিয়া মালতী-মাধবী মণ্ডপে বসিয়াছিলেন। বৈষ্ণবদিগের পরস্পর ব্যবহার ও দৈন্য এবং বৈষ্ণবদাসের কথাগুলি শুনিয়া তাঁহার মনে কয়েকটী সন্দেহ হইল। তিনি বাগ্মিতায় পটু ছিলেন বলিয়া সাহসপূর্বক সেই বৈষ্ণব-সভায় এই বিষয়টী জিজ্ঞাসা করিলেন। তাঁহার প্রশ্ন, যথা―

    “মম্বাদি ধর্মশাস্ত্রে ব্রাহ্মণবর্ণকে সর্বোত্তম বলিয়াছেন। নিত্যকর্ম বলিয়া ব্রাহ্মণের পক্ষে সন্ধ্যা-বন্দনাদি নির্ণয় করিয়াছেন। যদি সেই কার্য নিত্য হয়, তবে বৈষ্ণবব্যবহারসকল কেন তাঁহার বিরুদ্ধ হয়?”

    বৈষ্ণবগণ বিতর্ক ভালবাসেন না। কোন তার্কিক ব্রাহ্মণ এরূপ প্রশ্ন করিলে, তাঁহারা কলহের ভয়ে কোন উত্তর দিতেন না, কিন্তু সমাগত প্রশ্নকর্তা হরিনাম-গান করেন বলিয়া সকলে কহিলেন,―“শ্ৰীযুত পরমহংস বাবাজী মহাশয় এই প্রশ্নের উত্তর দিলে আমরা সকলে সুখী হইব!” পরমহংস বাবাজী মহাশয় বৈষ্ণববর্গের আদেশ শ্রবণ করিয়া দণ্ডবৎপ্রণতিপূর্বক কহিলেন,―“মহোদয়গণ, যদি আপনাদের ইচ্ছা হয়, তাহা হইলে ভক্তপ্রবর শ্রীবৈষ্ণবদাস উক্ত প্রশ্নের সম্যক্‌ উত্তর দিবেন।” সে-কথায় সকলেই অনুমোদন করিলেন।

    বৈষ্ণবদাস শ্রীগুরুদেবের বাক্য শ্রবণ করতঃ আপনাকে ধন্য জানিয়া দৈন্যপূর্বক কহিতে লাগিলেন, ‘আমি অতি অধম ও অকিঞ্চন। এরূপ মহামান্য বিদ্বৎসভায় আমার কিছু বলা নিতান্ত অন্যায়, তবে গুরু-আজ্ঞা সর্বদা শিরোধার্য্য। আমি গুরুদেবের মুখপদ্মনিঃসৃত যে তত্ত্ব-উপদেশরূপ মধুপান করিয়াছি, তাহাই স্মরণপূর্বক যথাসাধ্য বক্তৃতা করিতে প্রবৃত্ত হইলাম।’ ইহা বলিয়া বৈষ্ণবদাস পরমহংস বাবাজী মহাশয়ের পদধূলি সর্বাঙ্গে মৃক্ষণ করতঃ দণ্ডায়মান হইয়া বলিতে লাগিলেন―

    “যিনি সাক্ষাৎ পরমানন্দময় ভগবান্‌, ব্রহ্ম যাঁহার অঙ্গকান্তি এবং পরমাত্মা যাঁহার অংশ, সেই সমস্ত প্রকাশ ও বিলাসের আধাররূপ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য আমাদিগকে বুদ্ধিবৃত্তি প্রেরণ করুন। মন্বাদি-ধর্মশাস্ত্র বেদশাস্ত্রের অনুগত বিধিনিষেধনির্ণায়ক শাস্ত্র বলিয়া জগতের সর্বত্র গণ্যমান্য হইয়াছেন। মানব-প্রকৃতি দুই প্রকার― বৈধী ও রাগানুগা। যতদিন মানব-বুদ্ধি মায়ার অধীন, ততদিন মানব-প্রকৃতি অবশ্যই বৈধী থাকিবে। মায়াবন্ধ হইতে মানববুদ্ধি পরিমুক্ত হইলে আর বৈধী প্রবৃত্তি থাকে না, ―রাগানুগা প্রবৃত্তি প্রকটিতা হয়। রাগানুগা প্রকৃতিই জীবের শুদ্ধা প্রকৃতি― স্বভাবসিদ্ধা, চিন্ময়া ও জড়মুক্তা। শ্রীকৃষ্ণ ইচ্ছায় শুদ্ধ-চিন্ময় জীবের জড়সম্বন্ধ দূরীভূত হয়; কিন্তু যতদিন কৃষ্ণের ইচ্ছা না হয়, ততদিন জড়সম্বন্ধ কেবল ক্ষয়োন্মুখ হইয়া থাকে। সেই ক্ষয়োন্মুখ অবস্থায় মানববুদ্ধি স্বরূপতঃ জড়মুক্ত অর্থাৎ তখনও বস্তুতঃ জড়মুক্তি হয় নাই। বস্তুতঃ জড়মুক্ত হইলে শুদ্ধজীবের রাগাত্মিকা বৃত্তি স্বরূপতঃ ও বস্তুতঃ উদিত হয়। ব্ৰজজনের যে প্রকৃতি, তাহা রাগাত্মিকা প্রকৃতি। ক্ষয়োন্মুখ অবস্থায় সেই প্রকৃতির অনুগত হইয়া জীব সকল রাগানুগা হইয়া পড়েন। জীবের পক্ষে এ-অবস্থা বড়ই উপাদেয়। এই অবস্থা যে-পর্যন্ত না হয়, সে-পর্যন্ত মানববুদ্ধি মায়িক বস্তুতেই অনুরাগ করে। নিসর্গক্রমে মায়িক বিষয়ের অনুরাগকে মূঢ় জীব স্বীয় অনুরাগ বলিয়া মনে করে। চিদ্বিষয়ের বিশুদ্ধ অনুরাগ তখনও হয় না। মায়িক বিষয়ে ‘আমি ও আমার’―এই দুইটি বুদ্ধি গাঢ়রূপে কার্য করিতে থাকে। এই দেহ আমার ও এই দেহই আমি’―এই বুদ্ধিক্রমে এই জড় দেহের সুখসাধক ব্যক্তি ও বস্তুতে প্রীতি এবং সুখবাধক ব্যক্তি ও বস্তুতে দ্বেষ সহজে হইয়া থাকে। এই রাগ দ্বেষের বশীভূত হইয়া মূঢ় জীব অন্যের প্রতি শারীরিক, সামাজিক ও নৈতিক প্রীতি ও বিদ্বেষ প্রকাশ করতঃ অন্যকে শত্রু-মিত্র জ্ঞান করিয়া থাকে,―বিষয় লইয়া বিবাদ করে। কনক ও কামিনীতে অযথা প্রীতি করিয়া সুখ-দুঃখের অধীন হইয়া পড়ে। ইহার নাম সংসার। এই সংসারে আসক্ত হইয়া জন্ম, মরণ, কর্মফল, উচ্চ, নীচ অবস্থা লাভ করিয়া মায়াবদ্ধ জীবসকল ভ্রমণ করিতেছে। এই সকল জীবের চিদনুরাগ সহজ বলিয়া বোধ হয় না। চিদনুরাগ যে কি তাহাও উপলব্ধি হয় না। আহা! যে চিদনুরাগই জীবের স্বধর্ম ও নিত্যপ্রকৃতি, তাহা ভুলিয়া জড় অনুরাগে বিভোর হইয়া চিৎকণস্বরূপ জীব স্বীয় অধোগতি ভোগ করিতেছে। সংসারে প্রায় সকলেই এই দুর্দশাকে দুর্দশা বলিয়া মনে করে না।

    রাগাত্মিকা প্রকৃতির কথা ত’ দূরে থাকুক, মায়াবদ্ধ জীবের রাগানুগা প্রকৃতিও নিতান্ত অপরিচিত। কখনও সাধুকৃপাবলে জীবের হৃদয়ে রাগানুগা প্রকৃতির উদয় হয়। রাগানুগা প্রকৃতি, সুতরাং বিরল ও দুর্লভ। সংসার ঐ প্রকৃতি হইতে বঞ্চিত।

    কিন্তু ভগবান্ সর্বজ্ঞ ও কৃপাময়। তিনি দেখিলেন,―মায়াবদ্ধ জীব চিৎপ্রবৃত্তি হইতে বঞ্চিত হইল। কি-প্রকারে তাঁহার মঙ্গল হইবে? কি করিলেই বা মায়ামুগ্ধ জীবের কৃষ্ণস্মৃতি জ্ঞান পাইবার একটি উপায় হয়? সাধুসঙ্গ হইলে জীব আপনাকে কৃষ্ণদাস বলিয়া জানিতে পারিবে। সাধুসঙ্গের কোন নির্দিষ্ট বিধি নাই। তাহা যে সকলের প্রতি ঘটনীয় হইবে, ইহারই বা আশা কোথায়? অতএব সাধারণের জন্য একটি বিধিমার্গ না করিলে তাঁহাদের উপকার হয় না। ভগবানের এইরূপ কৃপাদৃষ্টি হইতে শাস্ত্র উদিত হইল। আর্যহৃদয়রূপ আকাশে ভগবৎ কৃপা-প্রসূত শাস্ত্র সূর্য উদিত হইয়া সর্বসাধারণের নিকট আজ্ঞাবিধি সকল প্রচার করিল।

    আদৌ বেদশাস্ত্র। বেদশাস্ত্রের কোন অংশে কর্ম, কোন অংশে জ্ঞান ও কোন অংশে প্রীতিরূপ ভক্তি আদিষ্ট হইল। মায়ামুগ্ধ জীব সকল নানা অবস্থাপন্ন। কেহ নিতান্ত মূঢ়, কেহ কিয়ৎপরিমাণে বিজ্ঞ, কেহ বা বহুবিষয়ে বিজ্ঞ। জীবের যেরূপ বুদ্ধির অবস্থা, শাস্ত্রে তাঁহার প্রতি সেইরূপ আদেশ। ইহার নাম অধিকার। অধিকার যদিও জীবের সংখ্যানুসারে অনন্ত, তথাপি সেই অনন্ত অধিকার প্রধান লক্ষণানুসারে তিনভাগে বিভক্ত হইয়াছে অর্থাৎ কর্মাধিকার, জ্ঞানাধিকার ও প্রেমাধিকার। বেদশাস্ত্রে এইপ্রকার ত্রিবিধাধিকার নির্দিষ্ট আছে। বেদ-বিধি নির্মাণপূর্বক এই তিন অধিকারে কর্তব্যাকর্তব্য নির্ণয় করিয়াছেন বলিয়া নির্দিষ্ট ধর্মের নাম বৈধ-ধর্ম। জীব যে-প্রবৃত্তিক্রমে ঐ ধর্মগ্রহণ করে, সেই প্রবৃত্তির নাম বৈধী প্রবৃত্তি। বৈধ প্রবত্তি যাঁহার নাই, তিনিই নিতান্ত অবৈধ। অবৈধ ব্যক্তি পাপাচরণে রত। তাঁহার জীবন সর্বদা অবৈধ কার্যে ন্যস্ত। তিনি বেদবহির্ভূত ম্লেচ্ছ ইত্যাদি নামে নির্দিষ্ট। বেদ-শাস্ত্র যে ত্রিবিধ অধিকার নির্ণয় করিয়াছেন, তাহাই ঋষিগণ সংহিতাশাস্ত্রে পরিবর্ধন করিয়া বেদানুগত অন্যান্য শাস্ত্র প্রকাশ করিয়াছেন। মন্বাদি পণ্ডিতগণ বিংশতি ধর্মশাস্ত্রে কর্মাধিকার লিখিয়াছেন। দর্শনবাদিগণ তর্ক ও বিচারশাস্ত্রে জ্ঞানাধিকার বিচার করিয়াছেন। পৌরাণিক ও বিশুদ্ধ তান্ত্রিক মহোদয়গণ ভক্তিতত্ত্বের অধিকারগত উপদেশ ও ক্রিয়া নির্ণয় করিয়াছেন। সকলেই বৈদিক বটে। ঐ ঐ শাস্ত্রের নবীন মীমাংসকগণ সর্বশাস্ত্ৰতাৎপর্যের প্রতি দৃষ্টি না করিয়া কোন কোন স্থলে একাঙ্গের সর্বোৎকৃষ্টতা বর্ণন করিয়া অনেককে বিতর্কে ও সন্দেহগর্তে ফেলিয়াছেন। ঐ সকল শাস্ত্রের অপূর্বমীমাংসারূপ গীতাশাস্ত্র দৃষ্টি করিলে জানা যায় যে, কর্ম জ্ঞানকে উদ্দেশ না করিলে, পাষণ্ড কর্ম বলিয়া পরিত্যাজ্য হয়। আবার কর্ম ও জ্ঞান উভয় যোগ ভক্তিকে উদ্দেশ না করিলে, কর্ম ও জ্ঞান উভয়েই পাষণ্ড হইয়া পড়ে। কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ বস্তুতঃ একই যোগ মাত্র। ইহাই বেদোদিত বৈষ্ণব-সিদ্ধান্ত।

    মায়ামুগ্ধ জীবের প্রথমেই কৰ্মাশ্রয়। পরে কর্মযোগ, পরে জ্ঞানযোগ ও অবশেষে ভক্তিযোগ। মায়ামুগ্ধ জীবকে একটি সোপান না দেখাইলে, তিনি কোন ক্রমেই ভক্তিমন্দিরে উঠিতে পারেন না।

    কর্মাশ্রয় কি? জীবনধারণপূর্বক শরীর ও মনের দ্বারা যাহা করা যায়, তাহাই কর্ম। সেই কর্ম দুইপ্রকার—শুভ ও অশুভ। শুভকর্ম দ্বারা জীবের শুভ ফল হয়। অশুভকর্মদ্বারা জীবের অশুভ ফল হয়। অশুভ কর্মকে ‘পাপ’ বা ‘বিকর্ম’ বলে। শুভকর্মের অকরণকে ‘অকর্ম’ বলে। দুই প্রকারই মন্দ। শুভকর্মই ভাল। তাহা আবার তিন প্রকার—অর্থাৎ নিত্য, নৈমিত্তিক ও কাম্য। কাম্যকর্ম নিতান্ত স্বার্থপর বলিয়া হেয়। নিত্য ও নৈমিত্তিক কর্ম শাস্ত্রে উপদিষ্ট। হেয়ত্ব ও উপাদেয়তা বিচারপূর্বক শাস্ত্রে নিত্য, নৈমিত্তিক ও কাম্যকর্মকেই ‘কর্ম’ বলেন, অকর্ম ও বিকর্মকে ‘কর্ম’ বলেন না। কাম্যকর্মও যখন হেয় বলিয়া ত্যাজ্য হইয়াছে, তখন নিত্য ও নৈমিত্তিক কর্মই কর্ম। শরীর, মন, সমাজ ও পরলোকের মঙ্গলজনক কর্মকে ‘নিত্যকর্ম’ বলেন। নিত্যকর্ম সকলেরই কর্তব্য কর্ম। যে সকল কর্ম কোন নিমিত্তকে আশ্রয় করিয়া যখন যখন নিত্যকর্মের ন্যায় কর্তব্য হয়, তখন তাহাকে নৈমিত্তিক কর্ম’ বলে। সন্ধ্যা, বন্দনা; পবিত্র উপায়দ্বারা শরীর ও সমাজ সংরক্ষণ, সত্য ব্যবহার ও পাল্যপালন―এই সকল নিত্যকর্ম। মৃত পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্যাচরণ প্রভৃতি ও পাপ উপস্থিত হইলে প্রায়শ্চিত্ত-এ সমস্তই নৈমিত্তিক।

    এই নিত্য ও নৈমিত্তিক কর্ম সুন্দররূপে যাহাতে জগতে অনুষ্ঠিত হইতে পারে, এইরূপ বিধান করিবার অভিপ্রায়ে শাস্ত্রকর্তৃগণ মানবগণের স্বভাব ও স্বাভাবিক অধিকার বিচারপূর্বক ‘বর্ণাশ্রম’-নামে একটী ধর্ম ব্যবস্থা করিয়াছেন। এই ব্যবস্থার মর্ম এই যে, কর্মানুষ্ঠানযোগ্য মানববৃন্দ স্বভাবতঃ চারিপ্রকার অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। তাঁহারা যে-অবস্থা অবলম্বনপূর্বক সংসারে অবস্থিত হ’ন, তাহা চারিপ্রকার তাঁহার নাম আশ্রম। গৃহস্থ, ব্রহ্মচারী, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাসীদিগের চারিটী আশ্রম। যাহারা অকর্ম ও বিকর্মপ্রিয়, তাঁহারা অন্ত্যজ বর্ণ ও নিরাশ্রম। বর্ণসকল স্বভাব, জন্ম, ক্রিয়া ও লক্ষণের দ্বারা নিরূপিত হয়। যেখানে কেবল জন্মের দ্বারা বর্ণনিরূপণ, সেখানে তাৎপর্য-হানিই একমাত্র ফল। বিবাহিত অবস্থা, অবিবাহিত অবস্থা ও স্ত্রীসঙ্গত্যাগের পর বিরাগের অবস্থা অনুসারে আশ্রমসকল নির্দিষ্ট হইয়াছে। বিবাহিত অবস্থায় গৃহস্থাশ্রম। অবিবাহিত অবস্থায় ব্রহ্মচারীর আশ্রয়। স্ত্রীসঙ্গবিরক্ত অবস্থায় বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। সন্ন্যাসই সর্বশ্রেষ্ঠাশ্রম। ব্রাহ্মণই সর্বশ্রেষ্ঠ বর্ণ।

    সর্বশাস্ত্রশিরোমণি শ্রীমদ্ভাগবতশাস্ত্রে এইরূপ সিদ্ধান্তিত হইয়াছে,―

    “বর্ণানামাশ্রমাণাঞ্চ জন্মভূম্যনুসারিণীঃ।
    আসন্ প্রকৃতয়ো নৃণাং নীচৈনীচোত্তমোত্তমাঃ॥

    শমো দমস্তপঃ শৌচং সন্তোষঃ ক্ষান্তিরার্জবম্।
    মদ্ভক্তিশ্চ দয়া সত্যং ব্রহ্মপ্রকৃতয়স্ত্বিমাঃ॥

    তেজো বলং ধৃতিঃ শৌর্যং তিতিক্ষৌদার্যমুদ্যমঃ।
    স্থৈং ব্রহ্মণ্যমৈশ্বর্যং ক্ষত্রপ্রকৃতয়স্ত্বিমিাঃ॥

    আস্তিক্যং দাননিষ্ঠা চ অদম্ভো ব্রহ্মসেবনম্।
    অতুষ্টিরর্থোপচয়ৈর্বৈশ্যপ্রকৃতয়ত্ত্বিমাঃ।

    শুশ্রূষণং দ্বিজগবাং দেবানাঞ্চাপ্যমায়য়া।
    তত্র লব্ধেন সন্তোষঃ শূদ্রপ্রকৃতয়স্ত্বিমাঃ॥

    অশৌচমনৃতং স্তেয়ং নাস্তিক্যং শুষ্কবিগ্রহঃ।
    কামঃ ক্রোধশ্চ তর্ষশ্চ স্বভাবোঽন্ত্যাবসায়িনাম্‌॥

    অহিংসা সত্যমস্তেয়মকাম-ক্রোধ-লোভতা।
    ভূত-প্রিয় হিতেহা চ ধর্মোঽয়ং সার্ববর্ণিকঃ॥”
    (১১।১৭।১৫-২১)[4]

    এই বিদ্বৎসভায় শাস্ত্রবাক্য বলিবামাত্র সকলেই অর্থ অনুভব করিতেছেন, অতএব আমি শ্লোকগুলির অনুবাদ করিতেছি না। আমি কেবল এইমাত্র বলিতেছি যে, বর্ণ এবং আশ্রম-ব্যবস্থাই বৈধজীবনের মূল। যে-দেশে যতদূর বর্ণাশ্রম-ব্যবস্থার অভাব, সে-দেশে ততদুরই অধার্মিকতা প্রবল।

    এখন বিচার্য এই যে, কর্মবিচারে যে ‘নিত্য’ও ‘নৈমিত্তিক’-শব্দ দুইটীর ব্যবহার হয়, তাহা কি প্রকার? শাস্ত্রের নিগূঢ় তাৎপর্য বিচার করিয়া দেখিলে, কর্মসম্বন্ধে ঐ দুইটী শব্দ পারমার্থিকভাবে ব্যবহৃত হয় না, কেবল ব্যবহারিক বা ঔপচারিকভাবে ব্যবহৃত হয়। ‘নিত্যধর্ম’, ‘নিত্যকর্ম’,নিত্যতত্ত্ব’, ‘নিত্যসত্য’ প্রভৃতি শব্দগুলি কেবল জীবের বিশুদ্ধচিন্ময় অবস্থা ব্যতীত আর কিছুতেই ব্যবহৃত হইতে পারে না। তবে যে উপায়-বিচারে কর্মকে লক্ষ্য করিয়া ‘নিত্য’-শব্দ প্রয়োগ করা হয়, সে কেবল সংসারে নিত্যতত্ত্বের দূরউদ্দেশক বলিয়া ঔপচারিক ভাবে কর্মকে নিত্য বলা যায়। কর্ম কখনই নিত্য নয়। কর্ম যখন কর্মযোগদ্বারা জ্ঞানকে অনুসন্ধান করে এবং জ্ঞান ভক্তিকে উদ্দেশ করে; তখনই কর্মও জ্ঞান ঔপচারিকভাবে নিত্য বলিয়া অভিহিত হয়। ব্রাহ্মণের সন্ধ্যাবন্দনাকে নিত্যকর্ম বলিলে এইমাত্র বুঝায় যে, শারীরিক ভৌতিক ক্রিয়ার মধ্যে ভক্তিকে দূর হইতে উদ্দেশ করিবার যে-পন্থা হইয়াছে, তাহা নিত্য-সাধক বলিয়া নিত্য, বস্তুতঃ নিত্য নয়। ইহার নাম উপচার।

    *বস্তুতঃ বিচার করিলে জীবের পক্ষে কৃষ্ণপ্রেমই একমাত্র নিত্যকর্ম। ইহার তাত্ত্বিক নাম বিশুদ্ধ চিদনুশীলন। সেই কার্য সাধিবার জন্য যে জড়ীয় কার্য অবলম্বন করা যায়, তাহা নিত্যকর্মের সহায়, অতএব নিত্য বলিয়া যে অভিধান হইয়াছে, তাহাতে দোষ নাই। তাত্ত্বিকভাবে দেখিলে তাহাকে ‘নিত্য’ না বলিয়া ‘নৈমিত্তিক’ বলাই ভাল। কর্মব্যাপারে যে নিত্য-নৈমিত্তিক-বিভাগ, তাহা ব্যবহারিক মাত্র, তাত্ত্বিক নয়।

    *বস্তু-বিচার করিলে শুদ্ধচিদনুশীলনই কেবল জীবের নিত্যধর্ম হয়, আর যতপ্রকার ধর্ম, সকলই নৈমিত্তিক। বর্ণাশ্রমধর্ম, অষ্টাঙ্গযোগ, সাঙ্খ্যজ্ঞান ও তপস্যা সমুদয়ই নৈমিত্তিক। জীব যদি বদ্ধ না হইত, তবে ঐ সকল ধর্মের আবশ্যকতা থাকিত না। জীব বদ্ধহওয়ায় মায়ামুগ্ধ অবস্থাই এক ‘নিমিত্ত।’ সেই নিমিত্তজনিত ঐ সকল ধর্ম, ধর্ম হইয়াছে; অতএব তাত্ত্বিক বিচারে সমস্তই নৈমিত্তিক ধর্ম।

    *ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব, সন্ধ্যাবন্দনাদি কর্ম ও তাঁহার কর্মত্যাগপূর্বক সন্ন্যাসগ্রহণ—এ সমস্তই নৈমিত্তিক ধর্ম। এই সমস্ত কর্ম ধর্মশাস্ত্রে প্রশস্ত ও অধিকারভেদে নিতান্ত উপাদেয়, তথাপি নিত্যকর্মের নিকট ইহার কোন সম্মান নাই; যথা (ভাঃ ৭/৯/১০)―

    “বিপ্রাদ্দ্বিষড়্‌ গুণযুতাদরবিন্দনাভ পাদারবিন্দবিমুখাৎ শ্বপচং বরিষ্ঠম্‌।
    মন্যে তদর্পিতমনোবচনেহিতার্থপ্রাণং পুণাতি স কুলং ন তু ভূরিমানঃ॥”[5]

    সত্য, দম, তপঃ, অমাৎসর্য্য, হ্রী, তিতিক্ষা, অনুসূয়া, যজ্ঞ, দান, ধৃতি, বেদশ্রবণ ও ব্রত-এই দ্বাদশটী ব্রাহ্মণধর্ম। এবম্ভূত দ্বাদশগুণবিশিষ্ট ব্রাহ্মণ জগতে পূজনীয় বটে, কিন্তু যদি ঐসকল-গুণ-যুক্ত হইয়াও কৃষ্ণভক্তি শূন্য হন, তবে সেই ব্রাহ্মণ অপেক্ষা ভক্ত চণ্ডালও শ্রেষ্ঠ। তাৎপর্য এই যে, চণ্ডালবংশে জন্মলাভ করিয়া সাধুসঙ্গরূপ সংস্কারদ্বারা যিনি জীবের নিত্যধর্মরূপ চিদনুশীলনে প্রবৃত্ত, তিনি ব্রাহ্মণবংশে জাত, শুদ্ধচিদনুশীলনরূপ নিত্যধর্মানুশীলনে বিরত, নৈমিত্তিক ধর্মে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ।

    জগতে মানব দুই প্রকার অর্থাৎ উদিত-বিবেক ও অনুদিত-বিবেক। অনুদিত বিবেক মানবই সংসারকে প্রায় পরিপূর্ণ করিয়া আছেন। উদিত-বিবেক বিরল। অনুদিত-বিবেক নরগণের মধ্যে ব্রাহ্মণ সর্বশ্রেষ্ঠ এবং তদ্বর্ণোচিত সন্ধ্যাবন্দনাদি নিত্যকর্ম সকল ব্যাপারের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। উদিত-বিবেক ব্যক্তিদিগের নামান্তর ‘বৈষ্ণব’। বৈষ্ণবদিগের ব্যবহার ও অনুদিত বিবেক ব্যক্তিদিগের ব্যবহার পরস্পর অবশ্য পৃথক্‌ হইবে। পৃথক্ হইলেও বৈষ্ণব-ব্যবহার, অনুদিত-বিবেক পুরুষদিগের শাসন-জন্য নির্মিত স্মার্তবিধানের তাৎপর্যবিরুদ্ধ নয়। শাস্ত্ৰতাৎপর্য সর্বত্রই এক। অনুদিত-বিবেক পুরুষেরা শাস্ত্রের স্থূল বাক্যেরএকদেশে আবদ্ধ থাকিতে বাধ্য আছেন। উদিত-বিবেক পুরুষেরা শাস্ত্রের তাৎপর্যকে বন্ধুভাবে গ্রহণ করেন। ক্রিয়া-ভেদেও তাৎপর্য-ভেদ নাই। অনধিকারীর চক্ষে উদিতবিবেক পুরুষদিগের ব্যবহার সাধারণ ব্যবহারের বিরুদ্ধ বলিয়া বোধ হয়, কিন্তু বস্তুতঃ পৃথক্ ব্যবহারের মূল তাৎপর্য এক।

    উদিত-বিবেক পুরুষদিগের চক্ষে সাধারণের জন্য নৈমিত্তিক-ধর্ম উপদেশ-যোগ্য; কিন্তু নৈমিত্তিক-ধর্ম বস্তুতঃ অসম্পূর্ণ, হেয়, মিশ্র ও অচিরস্থায়ী।

    নৈমিত্তিক-ধর্মে সাক্ষাৎ চিদনুশীলন নাই। চিদনুশীলনের অনুগত করিয়া জড়ানুশীলনকে গ্রহণ করায়, তাহা কেবল চিদনুশীলনরূপে উপেয়-প্রাপ্তির উপায় হইয়া থাকে। উপায় উপেয়কে দিয়া নিরস্ত হয়। অতএব উপায় কখনও সম্পূর্ণ নয়—উপেয় বস্তুর খণ্ডাবস্থামাত্র। অতএব নৈমিত্তিক ধর্ম কখনই সম্পূর্ণ নয়। উদাহরণস্থল এই যে, ব্রাহ্মণের সন্ধ্যাবন্দনা তাঁহার অন্যান্য কর্মের ন্যায় ক্ষণিক ও বিধিসাধ্য। সহজ-প্রবৃত্তি হইতে ঐ সকল কার্য হয় না। পরে বহুদিন বৈধ ব্যাপারে থাকিতে থাকিতে, যখন সাধুসঙ্গ-সংস্কারদ্বারা চিদনুশীলনরূপ হরিনামে রুচি হয়, তখন কর্মাকারে আর সন্ধ্যা-বন্দনাদি থাকে না। হরিনাম সম্পূর্ণ চিদনুশীলন। সন্ধ্যাবন্দনাদি কেবল উক্ত প্রধান কার্যের উপায় মাত্র। ইহা কখন সম্পূর্ণ তত্ত্ব হয় না।

    নৈমিত্তিক-ধর্ম সদুদ্দেশক বলিয়া আদৃত হইলেও উহা হেয়, মিশ্র। চিত্তত্ত্বই উপাদেয়। জড় ও জড়সঙ্গই জীবের পক্ষে হেয়! নৈমিত্তিক-ধর্মে অধিক জড়ত্ব আছে। আবার তাহাতে এত অবান্তর ফল আছে যে, জীব সেই সকল ক্ষুদ্র ফলে না পড়িয়া থাকিতে পারে না; যথা―ব্রাহ্মণের ঈশোপাসনা ভাল বটে, কিন্তু ‘আমি ব্রাহ্মণ, অন্য জীব আমা অপেক্ষা হীন’—এইরূপ মিথ্যা অহঙ্কার ব্রাহ্মণের উপাসনাকে হেয়ফলজনক করিয়া তুলে। অষ্টাঙ্গযোগাদিতে ‘বিভূতি’ নামক একটী অপকৃষ্ট ফল জীবের পক্ষে অত্যন্ত অমঙ্গলজনক। ‘ভুক্তি’, ‘মুক্তি’ এই দুইটী নৈমিত্তিক-ধর্মের অনিবার্য সহচরী। ইহাদের হাত হইতে বাঁচিতে পারিলে তবে মূল উদ্দেশ্য যে চিদনুশীলন, তাহা হইতে পারে। অতএব নৈমিত্তিক-ধর্মে জীবের পক্ষে হেয়ভাগ অধিক।

    নৈমিত্তিক-ধর্ম অচিরস্থায়ী। নৈমিত্তিক ধর্ম জীবের সর্বাবস্থায় সর্বকালে থাকে না; যথা―ব্রাহ্মণের ব্রহ্মধর্ম, ক্ষত্রিয়ের ক্ষাত্রধর্ম ইত্যাদি নৈমিত্তিক-ধর্ম, নিমিত্ত শেষ হইলেই বিগত হয়। এক ব্যক্তি ব্রাহ্মণ-জন্মের পর চণ্ডাল-জন্ম লাভ করিলেন, তখন তাঁহার ব্রাহ্মণবর্ণাগত নৈমিত্তিক-ধর্ম আর স্বধর্ম নয়। ‘স্বধর্ম’-শব্দটীও এস্থলে ঔপচারিক। জন্মে জন্মে জীবের স্বধর্মের পরিবর্তন হয়, কিন্তু কোন জন্মেই জীবের নিত্যধর্মের পরিবর্তন হয় না। নিত্যধর্মই বস্তুতঃ জীবের স্বধর্ম, নৈমিত্তিক ধর্ম অচিরস্থায়ী।

    তবে যদি বলেন, বৈষ্ণবধর্ম কি? উত্তর—এই ধর্ম জীবের নিত্যধর্ম। বৈষ্ণব-জীব জড়মুক্ত অবস্থায় বিশুদ্ধ চিদাকারে কৃষ্ণপ্রেমের অনুশীলন করেন এবং জড়বদ্ধ অবস্থায় উদিত-বিবেক হইয়া জড় ও জড়সম্বন্ধের মধ্যে চিদনুশীলনের সমস্ত অনুকূলবিষয় আদরপূর্বক গ্রহণ করেন এবং প্রতিকূল সমস্তই বর্জন করেন। শাস্ত্রের বিধিনিষেধের বশীভূত হইয়া কার্য করেন না। যে-বিধি যখন হরিভজনের অনুকূল, তখনই তাহাকে আদর করেন। যখন প্রতিকূল, তখনই তাহাকে অনাদর করেন। নিষেধ সম্বন্ধেও বৈষ্ণবের ব্যবহার তদ্রূপ। বৈষ্ণবই জগতের সার পদার্থ। বৈষ্ণবই জগতের বন্ধু। বৈষ্ণবই জগতের মঙ্গল। আজ এই বৈষ্ণবসভায় আমি বিনীতভাবে আমার বক্তব্য সকল বলিলাম। আপনারা আমার সমস্ত দোষ মার্জনা করুন।

    এই বলিয়া বৈষ্ণবদাস যখন সাষ্টাঙ্গে বৈষ্ণবসভাকে প্রণাম করিয়া একপার্শ্বে বসিলেন, তখন বৈষ্ণবদিগের নয়নবারি প্রবলরূপে বহিতে লাগিল। সকলেই একবাক্যে ধন্য ধন্য বলিয়া উঠিলেন। গোদ্রুমের কুঞ্জ-সকলও চতুর্দিক হইতে ধন্য ধন্য বলিয়া উত্তর দিল।

    জিজ্ঞাসু গায়ক ব্রাহ্মণটী বিচারের অনেক স্থলে নিগূঢ় সত্য দেখিতে পাইলেন। আবার কোন কোন স্থলে কিছু সন্দেহের বিষয়ও উপস্থিত হইল। যাহা হউক, তাঁহার মনে বৈষ্ণবধর্মের শ্রদ্ধাবীজ একটু গাঢ় হইয়া উঠিল। তিনি করযোড়পূর্বক বলিলেন,― মহোদয়গণ, আমি বৈষ্ণব নই, কিন্তু হরিনাম শুনিতে শুনিতে বৈষ্ণব হইয়াছি। আপনারা কৃপা করিয়া যদি আমাকে কিছু কিছু শিক্ষা দেন, তাহা হইলে আমার অনেকগুলি সন্দেহ দূর হয়।

    শ্রীপ্রেমদাস পরমহংস বাবাজী মহাশয় কৃপা করিয়া বলিলেন,―আপনি সময়ে সময়ে শ্ৰীমান্ বৈষ্ণবদাসের সঙ্গ করিবেন। ইনি সর্বশাস্ত্রে পণ্ডিত। বেদান্তশাস্ত্র গাঢ়রূপে পাঠ করিয়া সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া বারাণসীতে ছিলেন; আমাদের প্রাণপতি শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য অসীম কৃপা প্রকাশ করিয়া ইঁহাকে এই শ্রীনবদ্বীপে আকর্ষণ করিয়াছেন। এখন ইনি বৈষ্ণবতত্ত্বে সম্পূর্ণ বিজ্ঞ। শ্রীহরিনামে হঁহার গাঢ় প্রীতি জন্মিয়াছে।

    জিজ্ঞাসু মহাশয়ের নাম শ্রীকালিদাস লাহিড়ী। তিনি বাবাজী মহাশয়ের ঐ বাক্য শ্রবণ করিয়া বৈষ্ণবদাসকে মনে মনে গুরু বলিয়া বরণ করিলেন। তা

Page execution time: 0.03968501091 sec