Normal view
Book Lang.: বাংলা
English
संस्कृता वाक्
Translation
Gaudīya Base»Books»জৈবধর্ম»দ্বিতীয় অধ্যায় - জীবের নিত্যধর্ম শুদ্ধ ও সনাতন

দ্বিতীয় অধ্যায় - জীবের নিত্যধর্ম শুদ্ধ ও সনাতন

Language: বাংলা
Language: English Translation
  • (সন্ন্যাসীর প্রশ্ন―জীব অণুবস্তু হইলেও তথাপি তাঁহার ধর্ম পূর্ণ―শুদ্ধ ও বদ্ধ অবস্থা― কৃষ্ণদাস্য-বিস্মৃতি জীবের সংসার―লিঙ্গ ও স্থূল-দেহাভিমান—জীবের স্বধর্ম-বিকৃতি―অনিত্য ধর্ম— বৈষ্ণব-ধর্মই নিত্যধর্ম―মহাভাব ও অদ্বৈত-সিদ্ধি—শঙ্করাচার্যের গৌরব―শঙ্করাবতারের প্রয়োজন―তিনি বৈষ্ণব ছিলেন―মুক্তি পৰ্য্যন্ত তাঁহার মত বৈষ্ণব―তদুত্তরে তিনি নিস্তব্ধ―অদ্বৈত-সিদ্ধি ও প্রেমের কোন্‌ বিষয়ে ঐক্য ও কোন্‌ বিষয়ে পার্থক্য—মহাভাব কি? ―বাহ্যবেশ―মর্কটবৈরাগ্যনিষেধ―ধর্ম এক বই দুই নয়―তাহাই জৈব বা বৈষ্ণব ধর্ম― জৈবধর্মকে কেন বৈষ্ণবধর্ম বলি―বিশুদ্ধ প্রেম ও এস্ক্‌―মহাপ্রভুই বিশুদ্ধ প্রেম শিক্ষা দিয়াছেন― চিৎকাল ও মায়িক কালের ভেদ―হরিনাম শ্রেষ্ঠ-সাধন―নিরপরাধে নাম করিলে প্রেম পাওয়া যায়―নামগ্রহণক্রমে কনিষ্ঠ, মধ্যম ও উত্তম বৈষ্ণববিচার―সন্ন্যাসীর নাম-গ্রহণ।)

    পরদিন প্রাতে প্রেমদাস বাবাজী মহাশয় স্বীয় ব্রজভাবে নিমগ্ন থাকায়, সন্ন্যাসী ঠাকুর তাঁহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে অবসর পান নাই। মধ্যাহ্নকালে মাধুকরী প্রাপ্ত হইয়া উভয়েই শ্রীমাধবী-মালতী-মণ্ডপে উপবিষ্ট। পরমহংস বাবাজী মহাশয় কৃপাপূর্বক কহিলেন ―“হে ভক্তপ্রবর! আপনি ধর্মবিষয়ের মীমাংসা শ্রবণ করিয়া কি স্থির করিলেন?” এই কথা শ্রবণ করতঃ সন্ন্যাসী ঠাকুর পরমানন্দে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন,―“প্রভো! জীব যদি ‘অণু’ পদার্থ হয়, তবে তাঁহার নিত্যধর্ম কিরূপে পূর্ণ ও শুদ্ধ হইতে পারে? জীবের গঠনের সহিত যদি তাঁহার ধর্মের গঠন হইয়া থাকে, তবে সে-ধর্ম কিরূপে সনাতন হয়?”

    এই প্রশ্নদ্বয় শ্রবণ করিয়া শ্রীশচীনন্দনের পাদপদ্ম ধ্যানপূর্বক সহাস্যবদনে পরমহংস বাবাজী কহিতে লাগিলেন,―“মহোদয়! জীব অণু পদার্থ হইলেও তাঁহার ধর্ম পূর্ণ, শুদ্ধ ও সনাতন। অণুত্ব কেবল বস্তুপরিচয়। বৃহদ্বস্ত একমাত্র পরব্রহ্ম বা কৃষ্ণচন্দ্র। জীবসমূহ তাঁহার অনন্ত পরমাণু। অখণ্ড অগ্নি হইতে যেরূপ অগ্নিবিস্ফুলিঙ্গসমূহ হইয়া থাকে, অখণ্ড চৈতন্যস্বরূপ কৃষ্ণ হইতে তদ্রূপ জীবসমূহ নিঃসৃত হয়। অগ্নির একটী একটী বিস্ফুলিঙ্গ যেরূপ পূর্ণ অগ্নিশক্তি ধারণ করে, প্রতি জীবও তদ্রূপ চৈতন্যের পূর্ণধর্মের বিকাশভূমি হইতে সমর্থ। একটী বিস্ফুলিঙ্গ যেরূপ দাহ্য বিষয় লাভ করিয়া ক্রমশঃ মহাগ্নির পরিচয় দিয়া জগৎকে দহন করিতে সমর্থ হয়, একটি জীবও তদ্রূপ প্রেমের প্রকৃত বিষয় যে কৃষ্ণচন্দ্র, তাঁহাকে লাভ করিয়া প্রেমের মহাবন্যা উদয় করিতে সমর্থ হ’ন। যে-পর্যন্ত স্বীয় ধর্মের প্রকৃত বিষয়কে সংস্পর্শ না করে, সে-পর্যন্ত সেই পূর্ণ ধর্মের সহজ বিকাশ দেখাইতে অণু- চৈতন্যস্বরূপ জীব অপারগ হইয়া প্রকাশ পান। বস্তুতঃ বিষয়-সংযোগেই ধর্মের পরিচয়। ‘জীবের নিত্যধর্ম কি,―ইহা ভাল করিয়া অনুসন্ধান করুন। প্রেমই জীবের নিত্যধর্ম, জীব অজড় অর্থাৎ জড়াতীত বস্তু। চৈতন্যই ইহার গঠন। প্রেমই ইহার ধর্ম। কৃষ্ণদাস্যই সেই বিমল প্রেম। অতএব কৃষ্ণদাস্যরূপ প্রেমই জীবের স্বরূপধর্ম।

    জীবের দুইটী অবস্থা অর্থাৎ শুদ্ধাবস্থা ও বদ্ধাবস্থা। শুদ্ধ অবস্থায় জীব কেবল চিন্ময়। তখন তাঁহার জড়সম্বন্ধ থাকে না। শুদ্ধ অবস্থাতেও জীব অণু-পদার্থ। সেই অণুত্ব প্রযুক্ত জীবের অবস্থান্তর-প্রাপ্তির সম্ভাবনা। বৃহচ্চৈতন্যস্বরূপ কৃষ্ণের স্বভাবতঃ অবস্থান্তর নাই। তিনি বস্তুতঃ বৃহৎ, পূর্ণ, শুদ্ধ ও সনাতন। জীব বস্তুতঃ অণু, খণ্ড, অশুদ্ধহইবার যোগ্য এবং অর্বাচীন। কিন্তু ধর্মতঃ জীব বৃহৎ, অখণ্ড, শুদ্ধ ও সনাতন। জীব যতক্ষণ শুদ্ধ, ততক্ষণই তাঁহার স্বধর্মের বিমল পরিচয়। জীব যখন মায়াসম্বন্ধে অশুদ্ধ হ’ন, তখনই তিনি স্বধর্মবিকার প্রযুক্ত অবিশুদ্ধ, অনাশ্রিত ও সুখ-দুঃখপিষ্ট। জীবের কৃষ্ণদাস্য-বিস্মৃতি হইবামাত্রই সংসার-গতি আসিয়া উপস্থিত হয়।

    জীব যতক্ষণ শুদ্ধ থাকেন, ততক্ষণ তাঁহার স্বধর্মের অভিমান। তিনি আপনাকে কৃষ্ণদাস বলিয়া অভিমান করেন। মায়াসম্বন্ধে অশুদ্ধ হইলেই সেই অভিমান সঙ্কুচিত হইয়া ভিন্ন ভিন্ন আকার ধারণ করে। মায়া সম্বন্ধে জীবের শুদ্ধস্বরূপ লিঙ্গ ও স্থূলদেহে আবৃত হয়। তখন লিঙ্গ শরীরের একটী পৃথক্‌ অভিমান উদিত হয়। সেই অভিমান আবার স্থূলদেহের অভিমানের সহিত মিশ্রিত হইয়া একটী তৃতীয় অভিমানরূপে পরিণত হয়। শুদ্ধ-শরীরে জীব কেবল কৃষ্ণদাস। লিঙ্গ-শরীরে জীব আপনাকে স্বকর্ম ফলের ভোক্তা অর্থাৎ ভোগকর্তা বলিয়া মনে করেন। তখন কৃষ্ণদাসরূপ অভিমান লিঙ্গ দেহাভিমানদ্বারা আবৃত হইয়া থাকে। আবার স্থূল দেহ লাভ করিয়া ‘আমি ব্রাহ্মণ, আমি রাজা, আমি দরিদ্র, আমি দুঃখী, আমি রোগ-শোকদ্বারা অভিভূত, আমি স্ত্রী, আমি অমুকের স্বামী’ ইত্যাদি বহুবিধ স্থূলাভিমানদ্বারা পরিচয় দিয়া থাকেন।

    এই প্রকার মিথ্যা-অভিমানযুক্ত হইয়া জীবের স্বধর্ম বিকৃত হয়। বিশুদ্ধ প্রেমই শুদ্ধ জীবের স্বধর্ম। সুখ-দুঃখ, রাগদ্বেষরূপে সেই প্রেম বিকৃতভাবে লিঙ্গ শরীরে উদিত হয়। ভোজন, পান ও জড়সঙ্গ-সুখরূপে সেই বিকার অধিকতর গাঢ় হইয়া স্থূল-শরীরে দেখা যায়। এখন দেখুন, জীবের নিত্যধর্ম কেবল শুদ্ধ অবস্থায় প্রকাশ পায়। বদ্ধ অবস্থায় যে ধর্মের উদয় হয়, তাহা নৈমিত্তিক। নিত্যধর্ম স্বভাবতঃ পূর্ণ, শুদ্ধ ও সনাতন। নৈমিত্তিক ধর্ম আর এক দিবস ভাল করিয়া ব্যাখ্যা করিব।

    শ্রীমদ্ভাগবতশাস্ত্রে যে বিশুদ্ধ বৈষ্ণব-ধর্ম লক্ষিত হয় তাহা নিত্যধর্ম। জগতে যতপ্রকার ধর্ম প্রচারিত হইয়াছে, সে-সমূদয় ধর্মকে তিন ভাগে বিভক্ত করিতে পারেন―নিত্য-ধর্ম, নৈমিত্তিক-ধর্ম ও অনিত্য-ধর্ম। যেসকল ধর্মে ঈশ্বরের আলোচনা নাই ও আত্মার নিত্যত্ব নাই, সে-সকল অনিত্য-ধর্ম। যে-সকল ধর্মে ঈশ্বর ও আত্মার নিত্যত্বস্বীকার আছে কিন্তু কেবল অনিত্য উপায়দ্বারা ঈশ্বরপ্রসাদ লাভ করিতে চায়, সে-সকল নৈমিত্তিক। যাহাতে বিমল-প্রেমদ্বারা কৃষ্ণদাস্য লাভ করিবার যত্ন আছে, সেইসব ধর্ম নিত্য। নিত্যধর্ম দেশভেদে, জাতিভেদে, ভাষাভেদে পৃথক্‌ পৃথক্‌ নামে পরিচিত হইলেও তাহা এক ও পরম উপাদেয়। ভারতে যে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচলিত আছে, তাহাই নিত্যধর্মের আদর্শ। আবার আমাদের হৃদয়নাথ ভগবান্ শচীনন্দন যে-ধর্ম জগৎকে শিক্ষা দিয়াছেন, তাহাই বৈষ্ণবধর্মের বিমল অবস্থা বলিয়া প্রেমানন্দী মহাজনগণ স্বীকার ও অবলম্বন করেন।”

    এইস্থলে সন্ন্যাসী ঠাকুর করযোড়ে বলিলেন,― “প্রভো, আমি শ্রীশচীনন্দনের প্রকাশিত বিমল বৈষ্ণব ধর্মের সর্ব উৎকর্ষ সর্বক্ষণ দেখিতেছি। শঙ্করাচার্য প্রকাশিত অদ্বৈতমতের হেয়ত্ব অনুভব করিতেছি বটে, কিন্তু আমার মনে একটি কথা উদিত হইতেছে, তাহা ভবদীয় শ্রীচরণে জ্ঞাপন না করিয়া রাখিতে চাহি না। সে কথাটি এই―প্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য যে ঘনীভূত প্রেমের মহাভাব-অবস্থা দেখাইয়াছেন, তাহা কি অদ্বৈতসিদ্ধি হইতে পৃথক্‌ অবস্থা?”

    পরমহংস বাবাজী মহাশয় শ্রীশঙ্করাচার্যের নাম শুনিয়া দণ্ডবৎপ্রণামপূর্বক কহিলেন,―মহোদয়, ‘শঙ্কর শঙ্করঃ সাক্ষাৎ’, একথা সর্বদা স্মরণ রাখিবেন। শঙ্কর বৈষ্ণবদিগের গুরু, এইজন্য মহাপ্রভু তাঁহাকে আচার্য বলিয়া উল্লেখ করেন। শঙ্কর স্বয়ং পূর্ণ বৈষ্ণব। যে সময়ে তিনি ভারতে উদিত হইয়াছিলেন, সে সময়ে তাঁহার ন্যায় একটী গুণাবতারের নিতান্ত প্রয়োজন ছিল। ভারতে বেদশাস্ত্রের আলোচনা ও বর্ণাশ্রম-ধর্মের ক্রিয়াকলাপ বৌদ্ধদিগের শূন্যবাদে শূন্যপ্রায় হইয়াছিল। শূন্যবাদ নিতান্ত নিরীশ্বর। তাহাতে জীবাত্মার তত্ত্ব কিয়ৎপরিমাণে স্বীকৃত থাকিলেও, ঐ ধর্ম নিতান্ত অনিত্য। সে-সময় ব্রাহ্মণগণ প্রায়ই বৌদ্ধ হইয়া বৈদিক ধর্ম প্রায় পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। অসাধারণ-শক্তিসম্পন্ন শঙ্করাবতার উদিত হইয়া বেদশাস্ত্রের সম্মান স্থাপনপূর্বক শূন্যবাদকে ব্রহ্মবাদে পরিণত করেন। এই কার্যটী অসাধারণ। ভারতবর্ষ শ্ৰীশঙ্করের নিকট এই বৃহৎ-কার্যের নিমিত্ত চিরঋণী থাকিবেন। কাৰ্যসকল জগতে দুই প্রকারে বিচারিত হয়। কতকগুলি কার্য তাৎকালিক ও কতকগুলি কার্য সার্বকালিক। শঙ্করাবতারের সেই বৃহৎ কার্য তাৎকালিক। তদ্দ্বারা অনেক সুফল উদয় হইয়াছে। শঙ্করাবতার যে-ভিত্তি পত্তন করিলেন, সেই ভিত্তির উপর পরে শ্রীরামানুজাবতার ও শ্রীমধ্বাদি আচার্যগণ বিশুদ্ধ বৈষ্ণধর্মের প্রাসাদ নির্মাণ করিয়াছেন। অতএব শঙ্করাবতার বৈষ্ণব-ধর্মের পরম বন্ধু ও একজন প্রাগুদিত আচার্য।

    শ্ৰীশঙ্কর যে-বিচারপথ প্রদর্শন করিয়াছেন, তাঁহার সম্পত্তি বৈষ্ণবগণ এখন অনায়াসে ভোগ করিতেছেন। জড়বদ্ধ জীবের পক্ষে সম্বন্ধজ্ঞানের নিতান্ত প্রয়োজন। এই জড়জগতে স্থূল ও লিঙ্গদেহ হইতে চিদ্বস্তু পৃথক্‌ ও অতিরিক্ত, তাহা বৈষ্ণবগণ ও শঙ্করাচার্য উভয়েই বিশ্বাস করেন। জীবের সত্তাবিচারে তাঁহাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। জড়-জগতের সম্বন্ধ-ত্যাগের নাম মুক্তি, তাহা উভয়েই মানেন। মুক্তিলাভ করা পর্যন্ত শ্ৰীশঙ্করও বৈষ্ণবাচার্যগণের অনেক প্রকার ঐক্য আছে। হরিভজনদ্বারা চিত্তশুদ্ধি ও মুক্তিলাভ ইহাও শঙ্করাচার্যের শিক্ষা। কেবল মুক্তিলাভের পর যে জীবের কি অপূর্ব গতি হয়, তদ্বিষয়ে শঙ্কর নিস্তব্ধ। শঙ্কর একথা ভালরূপ জানিতেন যে, হরিভজনদ্বারা জীবকে মুক্তিপথে চালাইতে পারিলেই ক্রমশঃ ভজন-সুখে আবদ্ধ হইয়া জীব শুদ্ধভক্ত হইবেন। এই জন্যই শঙ্কর পথ দেখাইয়া আর অধিক কিছু বৈষ্ণব-রহস্য প্রকাশ করেন নাই। তাঁহার ভাষ্যসকল যাঁহারা বিশেষ বিচার করিয়া পড়িয়াছেন, তাঁহারা শঙ্করের গৃঢ় মত বুঝিতে পারেন। যাঁহারা কেবল তাঁহার শিক্ষার বাহ্য অংশ লইয়া কালযাপন করেন, তাঁহারাই কেবল বৈষ্ণব-ধর্ম হইতে বিদূরিত হ’ন।

    অদ্বৈতসিদ্ধি ও প্রেম একপ্রকার বিচারে একই বলিয়া বোধ হয়। অদ্বৈতসিদ্ধির যে সঙ্কুচিত অর্থ করা যায়, তাহাতে তাঁহার ও প্রেমের পার্থক্য হইয়া পড়ে। প্রেম কি পদার্থ, তাহা বিচার করুন। একটী চিৎপদার্থ অন্য চিৎপদার্থের সহিত যে-ধর্মের দ্বারা স্বভাবতঃ আকৃষ্ট হ’ন তাঁহার নাম প্রেম। দুইটি চিৎপদার্থের পৃথক্‌ অবস্থান ব্যতীত প্রেম সিদ্ধ হয় না। সমস্ত চিৎপদার্থ যে-ধর্মদ্বারা পরম-চিৎপদার্থ কৃষ্ণচন্দ্রে নিত্য আকৃষ্ট, তাঁহার নাম কৃষ্ণ-প্রেম। কৃষ্ণচন্দ্রের নিত্য পথক্‌ অবস্থান ও জীবনিচয়ের তাঁহার প্রতি যে অনগত ভাবের সহিত নিত্য পৃথক্‌ অবস্থান, তাঁহার প্রেমতত্ত্বে নিত্যসিদ্ধ তত্ত্ব। আস্বাদক, আস্বাদ্য ও আস্বাদন —এই তিনটী পৃথক্‌ভাবের অবস্থিতি সত্য। যদি প্রেমের আস্বাদক ও আস্বাদ্যের একত্ব হয়, তবে প্রেম নিত্যসিদ্ধ হইতে পারে না। যদি অচিৎ-সম্বন্ধশূন্য চিৎপদার্থের শুদ্ধ অবস্থাকে অদ্বৈতসিদ্ধি বলা যায়, তবে প্রেম ও অদ্বৈতসিদ্ধি এক হয়। কিন্তু অধুনাতন শাঙ্কর পণ্ডিতগণ চিদ্ধর্মের অদ্বৈতসিদ্ধিতে সন্তুষ্ট না হইয়া চিদ্ববস্তুর একতা-সাধনের যত্নদ্বারা বেদোদিত অদ্বয়তত্ত্বসিদ্ধির বিকার প্রচার করিয়া থাকেন। তাহাতে প্রেমের নিত্যত্বহানি হওয়ায় বৈষ্ণবগণ সে-সিদ্ধান্তকে নিতান্ত অবৈদিক সিদ্ধান্ত বলিয়া স্থির করিয়াছেন। শঙ্করাচার্য্য কেবল চিত্তত্ত্বের বিশুদ্ধ অবস্থানকে অদ্বৈত অবস্থা বলেন, কিন্তু তাঁহার অর্ব্বাচীন চেলাগণ তাঁহার গূঢ়ভাব বুঝিতে না পারিয়া তাঁহাকে ক্রমশঃ অপদস্থ করিয়া ফেলিতেছেন। বিশুদ্ধ প্রেমের অবস্থা সকলকে মায়িক বলিয়া, মায়াবাদ-নামক একটী সর্বাধম মত জগতে প্রচার করেন। মায়াবাদিগণ আদৌ একটী বই আর অধিক চিদ্বস্তু স্বীকার করেন না॥ চিদ্বস্তুতে যে প্রেমধর্ম আছে, তাহাও স্বীকার করেন না। তাঁহারা বলেন যে, ব্রহ্ম যতক্ষণ একাবস্থা-প্রাপ্ত, ততক্ষণ তিনি মায়াতীত। যখন তিনি কোন স্বরূপ গ্রহণ করেন ও জীবরূপে নানা আকার প্রাপ্ত হ’ন, তখন তিনি মায়াগ্রস্ত। সুতরাং ভগবানের নিত্য-শুদ্ধ চিদঘনবিগ্রহকে মায়িক বলিয়া মনে করেন। জীবের পৃথক্‌ সত্ত্বাকেও মায়িক মনে করেন। কাজে কাজেই প্রেম ও প্রেমবিকারকে মায়িক মনে করিয়া অদ্বৈত-জ্ঞানকে নির্মায়িক বলিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁহাদের ভ্রান্তমতের অদ্বৈতসিদ্ধি ও প্রেম কখনই এক পদার্থ হয় না।

    কিন্তু ভগবান্ চৈতন্যদেব যে-প্রেম আস্বাদন্‌ করিতে উপদেশ করিয়াছেন এবং স্বীয় লীলাচরিতদ্দ্বারা যাহা জগৎকে শিক্ষা দিয়াছেন, তাহা সম্পূর্ণ মায়াতীত—বিশুদ্ধ অদ্বৈতসিদ্ধির চরম ফল। মহাভাব সেই বিশুদ্ধ প্রেমের বিকারবিশেষ। তাহাতে কৃষ্ণ-প্রেমানন্দ অত্যন্ত প্রবল; সুতরাং সংবেদক ও সংবেদ্যের পার্থক্য ও নিগূঢ় সম্বন্ধ একটি অপূর্ব অবস্থায় নীত হয়। তুচ্ছ মায়াবাদ এই প্রেমের কোন অবস্থায় কোন কাৰ্য্য করিতে পারে না।”

    সন্ন্যাসী ঠাকুর সসন্ত্ৰমে কহিলেন, “প্রভো! মায়াবাদ যে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর তাহা আমার হৃদয়ে সম্পূর্ণ প্রতীত হইয়াছে এবং তৎসম্বন্ধে যে আমার সংশয় ছিল, অদ্য আপনার কৃপায় তাহা দূর হইল। আমার যে মায়াবাদী-সন্ন্যাসী বেশ, তাহা পরিত্যাগ করিতে আমার নিতান্ত স্পৃহা হইতেছে।”

    বাবাজী মহাশয় কহিলেন,―“মহাত্মন, আমি বেশের প্রতি কোন প্রকার রাগ-দ্বেষ রাখিতে উপদেশ করি না। অন্তঃকরণের ধর্ম পরিষ্কৃত হইলে, বেশ সহজেই পরিষ্কার হইয়া পড়ে। যেখানে বাহ্য বেশের বিশেষ আদর সেখানে অন্তরের ধর্মের প্রতি বিশেষ অমনোযোগ। আমার বিবেচনায় প্রথমে অন্তঃশুদ্ধি করিয়া যখন সাধুদিগের বাহ্যাচারে অনুরাগ হয়, তখন বাহ্য বেশাদি নির্দোষ হয়। আপনি স্বীয় হৃদয়কে সম্পূর্ণরূপে শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যের অনুগত করুন্। তাহা হইলে যে-সকল বাহ্য সম্বন্ধে রুচি হইবে, তাহা আচরণ করিবেন। শ্ৰীমন্মহাপ্রভুর বাক্যটি সর্বদা স্মরণ রাখিবেন―

    ‘মর্কট-বৈরাগ্য না কর’ লোক দেখাঞা।
    যথাযোগ্য বিষয় ভুঞ্জ’ অনাসক্ত হঞা॥
    অন্তরে নিষ্ঠা কর, বাহ্যে লোক-ব্যবহার।
    অচিরাৎ কৃষ্ণ তোমায় করিবেন উদ্ধার॥”

    (চৈঃ চঃ মধ্য ১৬শ ২৩৮-৩৯)

    সন্ন্যাসী ঠাকুর সে বিষয়ের ভাব বুঝিয়া আর বেশ-পরিবর্তনের কথা উত্থাপন করিলেন না। করযোড়ে কহিতে লাগিলেন,—“প্রভো, আমি যখন আপনার শিষ্য হইয়া চরণাশ্রয় করিয়াছি, তখন আপনি যে উপদেশ করিবেন, আমি তাহা বিনা তর্কে মস্তকে ধারণ করিব। আপনার উপদেশ শ্রবণ করিয়া আমি বুঝিতে পারিলাম যে, বিমল কৃষ্ণ-প্রেমই একমাত্র বৈষ্ণবধর্ম। তাহাই জীবের নিত্য-ধর্ম। সেই ধর্ম পূর্ণ, শুদ্ধ ও সহজ। নানা দেশে যে নানাপ্রকার ধর্ম প্রচলিত আছে, সে-সব ধর্মের বিষয় কিরূপ ভাবনা করিব?”

    বাবাজী মহাশয় বলিলেন,―“মহাত্মন, ধর্ম এক—দুই বা নানা নহে। জীবমাত্রেরই একটি ধর্ম। সেই ধর্মের নাম বৈষ্ণব-ধর্ম। ভাষাভেদে, দেশভেদে ও জাতিভেদে ধর্ম ভিন্ন হইতে পারে না। অনেকে নানা নামে জৈবধর্মকে অভিহিত করেন; কিন্তু পৃথক্‌ ধর্মের সৃষ্টি করিতে পারেন না। পরম-বস্তুতে অণু-বস্তুর যে নির্মল চিন্ময় প্রেম, তাহাই জৈবধর্ম অর্থাৎ জীব-সম্বন্ধীয় ধর্ম। জীবসকল নানা-প্রকৃতি-সম্পন্ন হওয়ায় জৈব-ধর্মটী কতকগুলি প্রাকৃত আকারের দ্বারা বিকৃতরূপে লক্ষিত হয়। এইজন্য বৈষ্ণবধর্ম নাম দিয়া জৈবধর্মের শুদ্ধাবস্থাকে অভিহিত করা হইয়াছে। অন্যান্য ধর্মে যে- পরিমাণে বৈষ্ণব-ধর্ম আছে, সেই পরিমাণে সে ধর্ম শুদ্ধ।

    কিছু দিবস পূর্বে আমি শ্ৰীব্রজধামে ভগবৎপার্ষদ শ্রীল সনাতন গোস্বামীর শ্রীচরণে একটি প্রশ্ন করিয়াছিলাম। যাবনিক ধর্মে যে ‘এস্ক্‌’ বলিয়া শব্দ আছে, তাঁহার অর্থ কি নির্মল প্রেমা, না আর কিছু—এই আমার প্রশ্ন ছিল। গোস্বামী মহোদয় সর্বশাস্ত্রে পণ্ডিত, বিশেষতঃ যাবনিক ভাষায় তাঁহার পাণ্ডিত্যের অবধি নাই। শ্রীরূপ, শ্রীজীব প্রভৃতি অনেক মহামহোপাধ্যায় সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। শ্রীল সনাতন গোস্বামী মহোদয় কৃপা করিয়া এই কথাগুলি বলিয়াছিলেন―

    “হাঁ, ‘এস্ক’ শব্দের অর্থ প্রেম বটে। যাবনিক উপাসকগণ ঈশ্বর ভজন বিষয়েও ‘এস্ক্‌’ শব্দ ব্যবহার করেন; কিন্তু প্রায়ই ‘এস্ক’ শব্দে মায়িক প্রেমকে লক্ষ্য করিয়া থাকেন। ‘লয়লা মজনুর’ ইতিবৃত্ত ও হাফেজের ‘এস্ক’-ভাব বর্ণন দেখিলে মনে হয় যে, যবনাচার্যগণ শুদ্ধ চিদ্বস্ত যে কি, তাহা উপলব্ধি করিতে পারেন নাই। স্থূলদেহের প্রেম বা কখন লিঙ্গ দেহের প্রেমকে তাঁহারা ‘এস্ক’ বলিয়া লিখিয়াছেন। বিশুদ্ধ চিদ্বস্তুকে পৃথক্‌ করিয়া তাঁহার কৃষ্ণের প্রতি যে বিমল প্রেম তাহা অনুভব করেন নাই। সেরূপ প্রেম আমি যবনাচার্যের কোন গ্রন্থে দেখি নাই। কেবল বৈষ্ণব-ধর্মেই দেখিতে পাই। যবনাচার্য দিগের ‘রু’ যে শুদ্ধ জীব, তাহাও বোধ হয় না। বরং বদ্ধভাব প্রাপ্ত জীবকেই যে ‘রু’ বলিয়া থাকেন, এরূপ বোধ হয়। অন্য কোন ধর্মেই আমি বিমল কৃষ্ণ-প্রেমের শিক্ষা দেখি নাই। বৈষ্ণব-ধর্মে সাধারণতঃ কৃষ্ণপ্রেম উল্লিখিত আছে। শ্রীমদ্ভাগবতে ‘প্রোজ্‌ঝিতকৈতব ধর্ম”-রূপ শ্রীকৃষ্ণপ্রেম বিশদরূপে বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস এই যে, শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের পূর্বে আর কেহ সম্পূর্ণ বিমল কৃষ্ণপ্রেম-ধর্মের শিক্ষা দেন নাই। আমার কথায় যদি তোমাদের শ্রদ্ধা হয়, তবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর।” আমি এই উপদেশ শ্রবণ করিয়া সনাতন গোস্বামীকে বার বার দণ্ডবৎ প্রণাম করিয়াছিলাম। সন্ন্যাসী ঠাকুরও সেই সময় দণ্ডবৎপ্রণাম করিলেন।

    পরমহংস বাবাজী মহাশয় কহিলেন,― “ভক্তপ্রবর, আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর প্রদান করিতেছি, চিত্তনিবেশপূর্বক শ্রবণ করুন। জীব সৃষ্টি ও জীবগঠন—এইসকল শব্দ মায়িক সম্বন্ধে ব্যবহৃত হয়। জড়ীয় বাক্য কতকটা জড়ভাব আশ্রয় করিয়া কাৰ্য্য করে। ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান—এই তিন অবস্থায় যে কাল বিভক্ত, তাহা মায়াগত জড়ীয় কাল। চিজ্জগতের যে-কাল, তাহা সর্বদা বর্তমান। তাহাতে ভূত ও ভবিষ্যদ্‌রূপ বিভাগগত ব্যবধান নাই। জীব ও কৃষ্ণ সেইকালে অবস্থান করেন। অতএব জীব নিত্য ও সনাতন এবং জীবের কৃষ্ণপ্রেমরূপ ধর্মও সনাতন। এই জড়-জগতে আবদ্ধ হইবার পর জীবের সৃষ্টি, গঠন, পতন ইত্যাদি মায়িক কাল-গত ধর্মসকল জীবে আরোপিত হইয়াছে। জীব অণু-পদার্থ হইলেও চিন্ময় ও সনাতন। জড়-জগতে আসার পূর্বেই তাঁহার গঠন। চিজ্জগতে কালের ভূত-ভবিষ্যদ্‌রূপ অবস্থা না থাকায় সেই কালে যাহা যাহা থাকে, সকলই নিত্য বর্তমান। জীব ও জীবের ধর্ম বস্তুতঃ নিত্য বর্তমান ও সনাতন। একথাটি আমি বলিলাম বটে, কিন্তু আপনি যতদূর শুদ্ধ চিজ্জগতের ভাব পাইয়াছেন, ততদূরই আপনার একথার যথার্থ অর্থ উপলব্ধি হইবে। আমি আভাসমাত্র দিলাম, আপনি অর্থটি চিৎসমাধিদ্বারা অনুভব করিয়া লইবেন। জড়-জাত যুক্তি ও তর্কদ্বারা এসকল কথা বুঝিতে পারিবেন না। জড়বন্ধন হইতে অনুভবশক্তিকে যত শিথিল করিতে পারিবেন, ততই জড়াতীত চিজ্জগতের অনুভব উদিত হইবে। আদৌ স্বীয় শুদ্ধ-স্বরূপের অনূভব এবং সেই স্বরূপে শুদ্ধ চিন্ময় কৃষ্ণনাম অনুশীলন করিতে করিতে জৈব-ধর্মের উদয় প্রবলরূপে হইতে থাকিবে। অষ্টাঙ্গ-যোগ বা ব্রহ্মজ্ঞানদ্বারা চিদনুভব বিশুদ্ধ হইবে না। সাক্ষাৎ কৃষ্ণানুশীলনই নিত্যসিদ্ধ ধর্মোদয় করাইতে সমর্থ। আপনি নিরন্তর উৎসাহের সহিত হরিনাম করুন্। হরিনাম-অনুশীলনই একমাত্র চিদনুশীলন। কিছুদিন হরিনাম করিতে করিতে সেই নামে অপূর্ব অনুরাগ জন্মিবে। সেই অনুরাগের সঙ্গে সঙ্গেই, চিজ্জগতের অনুভব উদিত হইবে। ভক্তির যত প্রকার অঙ্গ আছে, তন্মধ্যে শ্রীহরিনামঅনুশীলনই প্রধান ও শীঘ্র ফলপ্রদ। অতএব শ্রীকৃষ্ণদাসের উপাদেয় গ্রন্থে এই কথাটি শ্রীমহাপ্রভুর উপদেশ বলিয়া লিখিত আছে―

    “ভজনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নববিধা ভক্তি।
    ‘কৃষ্ণপ্রেম’ ‘কৃষ্ণ’ দিতে ধরে মহাশক্তি॥
    তা’র মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নাম-সংকীর্তন।
    নিরপরাধে নাম লৈলে পায় প্রেমধন॥”

    (চৈঃ চঃ অন্ত্যঃ ৪র্থ ৭০,৭১)

    মহাত্মন্‌, যদি আপনি একথা জিজ্ঞাসা করেন যে, “কাহাকে বৈষ্ণব বলিব?” আমি তাঁহার উত্তরে এই মাত্র বলিব,—“যিনি নিরপরাধে কৃষ্ণনাম করেন, তিনি বৈষ্ণব। সেই বৈষ্ণব তিন প্রকার অর্থাৎ কনিষ্ঠ, মধ্যম ও উত্তম। যিনি মধ্যে মধ্যে কৃষ্ণনাম করেন, তিনি কনিষ্ঠ বৈষ্ণব। যিনি নিরন্তর কৃষ্ণনাম করেন, তিনি মধ্যম বৈষ্ণব। যাঁহাকে দেখিলে মুখে কৃষ্ণনাম আইসে, তিনি উত্তম বৈষ্ণব। শ্ৰীমন্মহাপ্রভুর শিক্ষামতে অন্য কোন প্রকার লক্ষণদ্বারা বৈষ্ণব নির্ণয় করিতে হইবে না।”

    সন্ন্যাসী ঠাকুর বাবাজীর শিক্ষামৃতে নিমগ্ন হইয়া “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে॥”—এই নাম গান করিতে করিতে নৃত্য করিতে লাগিলেন। সে-দিন তাঁহার হরিনামে রুচি জন্মিল এবং সাষ্টাঙ্গে গুরুপাদপদ্মে পতিত হইয়া বলিলেন,—“প্রভো, দীনের প্রতি কৃপা করুন।”

Page execution time: 0.091912984848 sec