শ্রীমদ্ভাগবত ১০.২.৩৩
তথা ন তে মাধব তাবকাঃ ক্কচিদ্ভ্রশ্যন্তি মার্গাত্ত্বয়ি বদ্ধসৌহৃদাঃ
তৃয়াভিগুপ্তা বিচরন্তি নির্ভয়া বিনায়কানীকপমুর্দ্ধসু প্রভো॥
হে মাধব! হে প্রভো! তোমাতে বদ্ধসৌহৃদ তোমার দাসসকল সুপথ অর্থাৎ স্বভাব হইতে ভ্রষ্ট হন না বরং তোমা কর্ত্তৃক পরিরক্ষিত হইয়া বিঘ্নকারীনিকরের পালক সমুদয়ের মস্তকের উপর পদ প্রদান করত নির্ভয়ে বিচরণ করেন।
কৰ্ম্ম ও জ্ঞানের দ্বারা যে বৈরাগ্য উদয় হয় তাহাও ক্ষণিক হইলেও শান্তরসের মধ্যে গণনা হইবে। অতএব কৰ্ম্ম ও জ্ঞানের দ্বারা শান্তরস পর্য্যন্ত পাইবার সম্ভাবনা। কিন্তু ভক্তিমার্গ তাহা অপেক্ষা অনন্ত গুণে উৎকৃষ্ট। ভক্তিমার্গে চারিটী অপূর্ব্বরস আছে অর্থাৎ দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর। বস্তুত বৈষ্ণবধৰ্ম্মে শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর এই পাঁচটী রসের অবস্থিতি। শান্তরস জীবের স্বপদ, অপর চারিটী রস জীবের স্বভাব আত্মতত্ত্ব বিচারের দ্বারা আত্মাকে সমুদয় শারীরিক অর্থাৎ অনিত্য পদার্থ হইতে পৃথক্ করণকে শান্তি কহে । শান্তরসে সমুদয় অনিত্য বিষয়ের তৃষ্ণা রহিত হয়। কিন্তু শান্তরসের অধিকারী পুরুষ যদ্যপি তাহাতেই আবদ্ধ থাকেন তবে শুষ্ক বৈরাগ্য হইয়া উঠে। স্বার্থ পরিত্যাগ অতিশয় মহৎ বটে কিন্তু পরমার্থের জন্য না হইলে ঐ উৎকৃষ্ট পদের যোগ্য হয় না। অর্থাভাবে, মূর্খতা প্রযুক্ত, সাধু লোকের তাড়নাক্রমে ও গৃহসুখের ব্যাঘাতবশত যে সকল দুর্ভাগা ব্যক্তি বৈরাগ্য গ্রহণ করিয়া কিছুই না করে, তাহাদের বৈরাগ্য নিতান্ত শুষ্ক ও নিস্ফল। অতএব শান্তরসই জীবের চরম ভাব নহে। যৎকালে জীব শান্তরসে অবস্থিতি করেন তখন তিনি স্বপদস্থ হইয়াছেন ইহাই বলিতে হইবে। কিন্তু স্বীয় স্বভাব তখনও তাঁহার গ্রহণ হয় নাই ইহা স্বীকার করতে হইবে। স্বপদস্থ জীব স্বীয় স্বভাব গ্রহণ করিবামাত্ৰ দাস্যরূপ দ্বিতীয় রসের অবলম্বন করেন। যদিও বৈরাগ্যই বৈষ্ণবতার প্রথম সোপান বলা যায় তথাপি উহাতে কোন সাক্ষাৎ রস না থাকায় দাস্য প্রেমকেই মহাপুরুষগণ ভক্তিমার্গের প্রারম্ভ বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন। এই দাস্য প্রেম বিশুদ্ধ হইলে সখ্যপ্রেম হয়। সখ্য-প্রেম গাঢ় হইলে বাৎসল্য হইয়া উঠে। ঐ বাৎসল্য-প্রেমের অকুণ্ঠত্ব নিবৃত্তি হইলে মধুর প্রেম। মধুর প্রেম পুনরায় অনন্তরূপিণী হইয়া অনন্ত উন্নতি প্রাপ্ত করান। এই সমুদয় তত্ত্বের ব্যাখ্যা এস্থলে দুঃসাধ্য ও নিষ্প্রয়োজন। এই শ্লোকে কেবল দাস্য প্রেমাবলম্বী মহাত্মা বৈষ্ণবগণের উল্লেখ। ঐ দাস্য প্রেমের অধিকারী পুরুষেরা জগদীশ্বরকে পরব্যোমে লক্ষ্মীপতিরূপে দৃষ্টি করেন ও দাস্য সম্বন্ধ সংস্থাপনার্থে প্রভু বলিয়া তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া থাকেন। এনিমিত্ত দেবগণ এই শ্লোকে ভগবানকে মাধব ও প্রভু বলিয়া সম্বোধন করিলেন। তাঁহারা কহিলেন হে কৃষ্ণ! তোমার সখা, পিতা, ও পুত্র এবং বনিতাগণ দূরে থাকুক, তোমার দাসগণও বিঘ্নজয় পূৰ্ব্বক স্বস্বভাবে অবস্থিতি করিতে সমর্থ হয়। অর্থাৎ তোমার ঐশ্বৰ্য দৃষ্টে যাহারা প্রেম করিয়া থাকে তাহারাও ভ্রষ্ট হয় না। যাহারা উচ্চস্বভাব প্রাপ্ত হইয়া তোমার সহিত সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর সম্বন্ধ স্থাপনা করে তাহাদের তো কথাই নাই। অর্থাৎ লক্ষ্মীনারায়ণের সেবক সকলও বিঘ্নবিজয় করিতে সমর্থ হয়। ব্রজভাবাপন্ন মহাত্মা গণের যে কোন বিঘ্ন হইতে পারে না, ইহাতে কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। মাধব দাসেরাও সমস্ত বিঘ্ন দূর করতে সমর্থ হন।
বিনায়ক অর্থাৎ বিঘ্ন অসংখ্য। তাহাদিগের পালনকৰ্ত্তা পাঁচটী। এই পাঁচটী বিরোধীকে ভগবদ্দাস্য প্রেমাবলম্বীগণও জয় করিতে সম্পূর্ণ সক্ষম হন। এই পাঁচটী বিরোধীর নাম স্বরূপ-বিরোধী, পরত্ত্ব-বিরোধী, পুরুষার্থ-বিরোধী, উপায়-বিরোধী, ও প্রাপ্তি-বিরোধী। দেহাত্মাভিমান ও স্বস্বাতন্ত্র্য এই দুইটী স্বরূপ-বিরোধী। সংসারী জীব সকল দেহে আত্মবোধ করিয়া অনিত্য বিষয়ে প্রেম করে ও তজ্জনিত সুখদুঃখবশতঃ আত্মার নিত্যতা বিস্মৃত হয়। ঈশ্বর-পারতন্ত্র্যই যে জীবের কর্ত্তব্য, তাহা না বুঝিয়া ভোগেচ্ছায় ভগবদ্দত্ত স্বতন্ত্রতাকে স্বস্বাতন্ত্র্যত্বে বরণ করিয়া জীবের সংসার গতি হয়। পরত্ত্ব-বিরোধীই জীবের দ্বিতীয় বিরোধী। ভগবান ব্যতীত অন্য কোন জীব বা গুণ বা ভাণকে দেবতা বোধে প্রতিপত্তি করাকে পরত্ত্ব বিরোধী কহা যায়। ভগবদবতারে প্রাকৃত জ্ঞানকেও পরত্ত্ব বিরোধী কহা যায়। অনেকানেক পাষণ্ডলোক ভগবদবতারের গুণ, জন্ম, কৰ্ম্মসকল প্রাকৃত ইতিহাসের ন্যায় ব্যাখ্যা করিয়া জগৎকে অপবিত্র করেন যেহেতু তাঁহারা পরত্ত্ব স্বরূপ অবগত নহেন। অর্চ্চাবতারে অর্থাৎ প্রতিমূৰ্ত্তি সকলে স্থাবর বোধে অর্চ্চনাকেও পরত্ত্ব বিরোধী কহা যায়। যাঁহাদের প্রতিমাদর্শন মাত্রেই অপ্রাকৃত ভগবদ্ধ্যান উপস্থিত হয় তাঁহারাই পরত্ত্ব স্বরূপ জানেন। পুরুষার্থান্তরে ইচ্ছা ও স্বতন্ত্র দাস্যে অনিচ্ছাকে পুরুষার্থ-বিরোধী কহা যায়। ধৰ্ম্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ ও প্রেম এই পাঁচটী পুরুষার্থ। প্রেমই জীবের যথার্থ পুরুষার্থ। অপর চারিটী কৈতব। ধৰ্ম্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ চারিটীর মধ্যে যেকোনটীর ইচ্ছাকে পুরুষাৰ্থ বিরোধী বলা যায়। জড় ভাব পরিত্যাগপূর্ব্বক স্বাধীনতার পরিচালনার সহিত ভগবানের যে অপ্রাকৃত সেবা তাহাতে অনিচ্ছাকেও পুরুষার্থ বিরোধী কহা যায়। উপায়-বিরোধী দুই প্রকার অর্থাৎ ভক্তি ব্যতীত উপায়ান্তর বোধ ও পবিত্র অপ্রাকৃত ভাব পরিত্যাগ করত প্রাকৃত রূপে ভগবৎ সাধন। বৈদিক কর্ম্মকাণ্ডকে ভগবৎপ্রাপ্তির উপায় বলিয়া বোধ করিলে উপায় বিরোধী হয়। কৰ্ম্মকাণ্ডের ফলভোগ, দাসত্ব হইতে পারেনা, অতএব কৰ্ম্মকাণ্ডের সাধনের দ্বারা জীব ভগবান হইতে দূরীভূত হন। কিন্তু ভগবদ্দাসত্ব-জনিত যে ভজনক্রিয়া উহাকে কর্মকাণ্ড কহা যায় না। পবিত্র অপ্রাকৃতভাবেই ভগবৎ সাধন হইতে পারে। অনেকানেক অপণ্ডিত লোক প্রাকৃত দ্রব্য সকলকে ঈশ্বরোপাসনার উপকরণ মনে করেন কিন্তু স্বরূপবেত্তাগণ প্রেমকেই একমাত্র উপকরণ জানেন এবং তজ্জনিত ক্রিয়া-যোগে প্রাকৃত বস্তু ভগবান্কে উৎসর্গ করিয়া দেন। স্নানাদিতে অন্তঃশুদ্ধি হইতে পারে না, অতএব বাহ্য-শৌচ দ্বারা যাঁহারা অন্তরের শুচি বোধ করেন তাঁহাদের উপায় স্বরূপ বোধ হয় নাই, বলিতে হইবে। প্রাপ্তি-বিরোধী বহুবিধ। জন্মবশত শরীরের শ্রেষ্ঠত্ব ও নীচত্ত্ব বোধ, অনুতাপ শূন্য প্রায়শ্চিত্ত, বিচার না করিয়া গুরুস্থিরকরণ, ক্ষুদ্র দেবতাতে ভগ্বজ্ জ্ঞান, ভণ্ডকে বৈষ্ণবজ্ঞান, ভূক্তি ও মুক্তিতে অর্থজ্ঞান, ভ্রমাত্মক বিচারকে সত্যজ্ঞান, এই প্রকার অনেক প্রাপ্তি বিরোধী জ্ঞান হয়। জগতের অধিকাংশ লোকই জাত্যহঙ্কারে মত্ত হইয়া অপর অপরকে নীচ জ্ঞানকরত তাহাদিগকে বেদোক্ত ঈশ্বরজ্ঞানের অধিকার প্রদান করে না এবং পক্ষান্তরে নীচকুল জন্মভাণ করিয়া অনেকানেক পুরুষ পরমব্রহ্মের বিমল জ্ঞানে আপনাদিগকে অধিকারী বোধ না করিয়া প্রাপ্তিবিরোধীর পূজা করিয়া থাকে। গোবধ করিয়া অনেকানেক ব্যক্তি কপর্দ্দক ও গাভি ইত্যাদি দান ও চান্দ্রায়ণ প্রভৃতি আচরণ করিয়া নিস্পাপ ভাণ করিয়া প্রাপ্তি-বিরোধী উপাসনা করে। পরন্তু ভক্তিজনিত অনুতাপ ব্যতীত প্রায়শ্চিত্ত সফল হইতে পারে না। অনেকেই কুল গুরুকে গুরুবোধ করত গুরু-সেবা করিয়াছি এমত বোধ করেন ইহাও প্রাপ্তি বিরোধী। অপ্রাকৃততত্ত্ব ব্যাখ্যা কর্ত্তাই যথার্থ গুরু, যেহেতু কৃষ্ণতত্ত্ব যিনি অবগত নহেন তিনি যথার্থ জ্ঞান প্রদর্শক গুরু হইতে সক্ষম হন না। অপদাৰ্থতে পদার্থ বোধ করিলে কোন উৎকৃষ্ট ফল হইবার সম্ভাবনা নাই। ক্ষুদ্র দেবতায় ভগবদ্ধুদ্ধি করা ও অনর্থপ্রদ পরমেশ্বর অদ্বিতীয় অতএব দেবতান্তর অসম্ভব। যেকোন দেবতার উপাসনা করা যায় তাহাতেই পরমেশ্বরের উপাসনা হয় কিন্তু উপাসনা অনির্ম্মল হওয়া প্রযুক্ত সুখকর হয় না। বিশুদ্ধ সত্ত্বের উপাসনাই প্রয়োজন অতএব অন্যান্য গুণাধিষ্ঠিত ঈশ্বরের উপাসনায় সদগতি সম্ভবে না। ভণ্ডকে বৈষ্ণব জ্ঞানও বিরোধী স্বরূপ। কোন এক ব্যক্তিকে তুলসী মাল্যে ভূষিত ও গোপীচন্দনে চিত্রিত দেখিয়াই যদি বৈষ্ণব বলিয়া গ্রহণ করা যায় তবে প্রকৃত বৈষ্ণবের অপমান হয়। সাধুসঙ্গের যে অপূৰ্ব্ব ফল তাহাও প্রাপ্ত হওয়া যায় না। শত শত তুলসী মালায় আবৃত ও সর্ব্বাঙ্গে নামাঙ্কিত পুরুষও হরিভক্তি বিহীন হইলে বৈষ্ণব আখ্যা পাইবার যোগ্য হয় না বরং বৈষ্ণবগণ কর্ত্তৃক সতর্কতা সহকারে পৃথক্ কৃত হয়। কালনেমী ও হনুমান সংবাদই ইহার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। পক্ষান্তরে ভক্ত যদিও মালা ও তিলক প্রভৃতি বাহ্যিক লক্ষণ পরিত্যাগ করেন তথাপি তাঁহাকে বৈষ্ণবগণ সাধু বলিয়া আখ্যা দিয়া থাকেন। বাহ্য বৈষ্ণবতা নিতান্ত অকর্ম্মণ্য। বাহ্য বৈষ্ণবের সহবাসে সাধুসঙ্গ হয় না। ভুক্তি ও মুক্তিকে পুরুষার্থ জ্ঞানও প্রাপ্তি বিরোধী। কৰ্ম্মকাণ্ডপ্রিয় ব্রাহ্মণপণ্ডিতগণ ভুক্তিকে জীবনের উদ্দেশ্য বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়া থাকেন। কৰ্ম্মফলভোগকে ভুক্তি কহে। জ্ঞানকাণ্ডে যাহারা আবদ্ধ তাঁহারা মুক্তিকে পুরুষার্থ বলেন। মুক্তি কখনো পুরুষার্থ হইতে পারে না। সালোক্য, সারূপ্য, সার্ষ্টি, সামীপ্য ও সাযুজ্য এই পঞ্চ প্রকার মুক্তি, ইহার মধ্যে সাযুজ্য মুক্তি অগ্রাহ্য। অন্য চারিপ্রকার মুক্তি লভ্য করিয়াও যদি ভগবৎপ্রেম না পাওয়া যায় তবে জীবের কি হইল? মুক্তি জীবের স্বপদ কিন্তু স্বভাব নহে। যতক্ষণ জীব স্বীয় স্বভাবকে পুনঃ প্রাপ্ত না হয় ততক্ষণ পুরুষাৰ্থ প্রাপ্ত হইয়াছে এমত বলা যাইতে পারে না। অতএব ভগবৎ প্রেমই পুরুষার্থ। তদিতর বস্তু ভুক্তি ও মুক্তিকে অর্থ বলিয়া বোধ করিলে মূর্খতা প্রকাশ হয়।
এই সমস্ত বিরোধীগণকে জয় করা কেবল বৈষ্ণবের কৰ্ম্ম। জ্ঞানী ও কৰ্ম্মকাণ্ডপ্রিয় ব্যক্তিগণ ইহাদিগের কর্ত্তৃক পরাজিত হন। অতএব ব্রহ্মাদি দেবগণ কহিলেন, হে প্রভো! যখন উদ্ধবের ন্যায় তোমার দাসেরাও এই সমস্ত বিঘ্ননিকরের মস্তকে পদার্পণ করিয়া বিচরণ করেন তখন উদ্ধবের পূজ্য তোমার ব্রজবাসী সখাগণ ও তাহাদের অপেক্ষা উৎকৃষ্টাধিকারীসকল যে ঐ সমস্ত বিঘ্নকে তৃণবৎ জানিবে ইহাতে আর আশ্চর্য কি ?