শ্রীমদ্ভাগবত ১০.২.৩২
যেন্যেঽরবিন্দাক্ষ বিমুক্তমানিনস্তয্যস্তভাবাদবিশুদ্ধবুদ্ধয়ঃ।
আরুহ্য কৃচ্ছ্রেণ পরং পদন্ততঃ পতন্ত্যধোনাদৃতযুষ্মদঙ্ঘ্রয়ঃ॥
হে অরবিন্দ লোচন! অপর যে সকল ব্যক্তিরা তোমার দাসত্বরূপ স্বভাবকে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অবিশুদ্ধ বুদ্ধি প্রাপ্ত হইয়া আপনাদিগকে বৃথা বিমুক্ত অভিমান করত বহু কষ্টে পরমপদ পাইয়া ও তোমার পাদাশ্রয়কে অনাদর করে তাহারা অধোগতি প্রাপ্ত হয়।
কৰ্ম্মযোগ ও জ্ঞানদ্বারা ব্যক্তিরা যে পরমপদকে প্রাপ্ত হয় তাহা স্থির থাকে না। অপ্রাকৃত জীবের প্রাকৃত পদার্থের সহিত সম্বন্ধ রাহিত্যকে পরংপদ বলা যায়। উহাই জীবের স্বপদ কিন্তু স্বভাব নহে। ভগবদ্দাস্যই জীবের স্বভাব। অনেকানেক পণ্ডিতাভিমানী ব্যক্তিগণ ভক্তিকে হীন বোধ করিয়া কর্ম্ম ও জ্ঞানকে শ্রেষ্ঠ বলিয়া স্থাপন করেন। অখিল বেদে এই তিন প্রকার উপায় লক্ষিত হয়। কর্ম্মকাণ্ড বহুবিধ। সংসার স্থাপনের জন্য বর্ণ ও আশ্রম্ভেদে যতপ্রকার ব্যবস্থা হইয়াছে ঐ সমুদয়ই কৰ্ম্ম। বর্ণভেদে সংস্কার ও আশ্রমভেদে অনুষ্ঠান এই সকল বিষয়ে যত প্রকার প্রাচীন ব্যবস্থা আছে তাহাকে ধৰ্ম্মশাস্ত্র কহা যায়। ধৰ্ম্মশাস্ত্রোল্লিখিত কর্ম্মকাণ্ড অপার অতএব অতিশয় কৃচ্ছ্রসাধ্য, কিন্তু ঐ সমস্ত কাৰ্য্যের চরমফল ত্যাগ, ইহাই বেদ প্রতিপাদ্য। কর্ম্মকাণ্ডে জীব বহুতর উন্নতি পাইয়া ক্রমে ক্রমে ব্ৰহ্মপদকে প্রাপ্ত হন। ঐ ব্রহ্মা দ্বিপরাৰ্দ্ধাবসানে ঈশ্বরে প্রবিষ্ট হইয়া যান। পুনরায় কল্পারম্ভে সংসারে প্রসূত হইয়া ঐ ব্রহ্মা যখন প্রকাশ হন, তখন ঐ সমুদয় কৰ্ম্মফল প্রাপ্ত জীব পুনরপি সংসারে বিচরণ করিতে থাকেন। অতএব কৰ্ম্ম যদিও কৃচ্ছ্রসাধ্য হইয়া পরম পদ লাভ করান তথাপি তদ্দ্বারা জীবের নিত্য কল্যাণ সম্ভবে না বরং বার বার অমঙ্গলই ঘটিয়া থাকে। পক্ষান্তরে যে সকল ব্যক্তি জ্ঞান যোগদ্বারা জগতের সমুদয় পদার্থ হইতে আপনাকে বিলক্ষণ জানিয়া বৃহদ্বস্তু ব্রহ্মে আপনাদিগকে লয় করিয়া থাকেন, তাঁহারাও হিরণ্যগর্ভের সহিত প্রলয়াবসানে সংসারে পুনরাগত হন। অতএব ব্রহ্মজ্ঞানস্বরূপ কৃচ্ছ্র-সাধনেও পরমপদ হইতে চ্যুত হইবার আশঙ্কা আছে। পরব্যোমের বহির্ভাগে যে একটী জ্যোতির্ম্ময় মণ্ডল আছে তাহাই ব্ৰহ্মলোক। জ্ঞানী লোকেরা তথায় উপস্থিত হইয়া কিছুক্ষণ আত্মানন্দ ভোগকরত উহাতে তৃষ্ণারহিত হইবামাত্রই অধোগতি প্রাপ্ত হয়েন। অতএব কর্ম্মী ও জ্ঞানী ইহাঁরা যদিও আপনাদিগকে বিমুক্ত জ্ঞান করেন তথাপি ফলতঃ তাহা হইতে পারেন না। ইহাঁদের অভিমান পর্য্যন্তই সীমা। জ্ঞান ও কর্ম্মের দ্বারা চিরানন্দ না পাইবার বিশেষ কারণ এই যে যদিও জ্ঞান ও কর্ম বহুকষ্টে ও বহুকালে জীবের বৈরাগ্য রূপ স্বপদকে প্রাপ্ত করান তথাপি ঐ স্বপদাস্থত জীবকে তথায় দৃঢ় রাখিতে সক্ষম হন না, যেহেতু জীবের স্বপদে উপস্থিত হইবামাত্র তাঁহার সঙ্গী জ্ঞান ও কর্ম্মের অবসান হইয়া যায়। বৈরাগ্য হইলে আর কর্ম্ম ও জ্ঞানের আবশ্যক হয় না, যেহেতু ফল প্রাপ্তি হইলে উপায়ের প্রয়োজন কি ? নদী পার হইয়া গেলে নৌকার আবশ্যক কি? কিন্তু স্বাভাবিক কাৰ্য্য ব্যতীত অস্তিত্বের বৈক্লব্য ঘটিয়া উঠে। জীব অকর্ম্মকৃৎ হইয়া এক মুহুর্ত্তও অবস্থিতি করতে পারে না। স্বপদস্থ জীব সুতরাং অপদস্থ হইয়া পুনরায় পূর্ব্ব সঙ্গী জ্ঞান ও কর্ম্মের সামীপ্য ও সৌহৃদ্য বাসনা করে। বাসনার নাম কাম ও কামের ফল কৰ্ম্ম ও কৰ্ম্ম ফলের নাম দৈব। ঐ দৈববিপাকে জীব সুতরাং সংসারগতি প্রাপ্ত হয়। শ্লোকে যে “অস্তভাবাৎ” শব্দ দেবতারা প্রয়োগ করিয়াছেন তাহার অর্থ এই যে, সূর্য্যের প্রকাশই স্বভাব এবং অস্তই স্বভাবের বিপরীত। জীবকে সূর্য্যের সহিত তুলনা করিয়া উহার স্বভাব ভগবদ্দাসত্বকে প্রকাশের সহিত ও ভগবদ্বিমুখতাকে অস্তের সহিত উপমা দেওয়া হইয়াছে। যে সকল জীব ঈশ্বরপ্রদত্ত স্বাধীনতার কুব্যবহার করত ভগবদ্বিমুখতারূপ অস্তভাবকে স্বীকার করিয়া নিজ নিজ বৃদ্ধিকে অবিশুদ্ধ করিয়াছেন তাঁহারাই কৰ্ম্ম ও জ্ঞানের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া আপনাদিগকে বিমুক্ত অভিমান করিয়া থাকেন। কিন্তু যদি ঐ সকল ব্যক্তি অবশেষে ভগবৎ পাদাশ্রয়রূপ স্বীয় স্বভাবকে অবলম্বন করেন তবে পুনরায় সংসার গতি প্রাপ্ত হন না। অনেকানেক বিমুক্তাভিমানী ব্যক্তিগণ চতুরতা-পূর্ব্বক ভক্তির সংস্থাপন করত তদুপরি জ্ঞানের প্রতিষ্ঠা করিয়া থাকেন। তাঁহারা বলেন যে, ভক্তি করিতে করিতে জ্ঞান হইয়া থাকে। এই বাক্যটী নিতান্ত অকর্ম্মণ্য। ভক্তিই জীবের স্বভাব, নিত্যমুক্তজীব সকল ভক্তিব্যতীত আর কিছুই জানে না। নিত্যানিত্য জ্ঞানের দ্বারা জীবের বৈরাগ্য রূপ স্বপদ প্রাপ্তি হইলে ভগবদ্ পাদ সেবারূপ স্বভাবে জীব নিযুক্ত থাকে ।