শ্রীমদ্ভাগবত ১০.২.৩১
স্বয়ং সমুত্তীৰ্য্য সুদুস্তরং দ্যুমন্ ভবার্ণবং ভীমমদভ্র সৌহৃদাঃ।
ভবৎপদাম্ভোরুহনাবমন্ত্রতে নিধায় যাতাঃ সদনুগ্রহো ভবান্॥
হে দ্যুমন অর্থাৎ হে স্বপ্রকাশ! আত্ম প্রত্যয়ানুভূত ভক্তিমার্গের আবিষ্কর্ত্তা মহোদয়গণ সৰ্ব্বভূতের প্রতি দয়া প্রযুক্ত তোমার পাদপদ্মতরী র্স্পশ করিয়া স্বয়ং ভয়ানক ভবার্ণবে উত্তীর্ণ হইয়াছেন কিন্তু ঐ অপূৰ্ব্বতরী এই জগতেই রাখিয়া গিয়াছেন, যেহেতু তুমি সমস্ত সাধুলোকের প্রতি অনুগ্রহ করিয়া থাক।
স্বপ্রকাশ নাম সম্বোধনের বিশেষ তাৎপর্য্য এই যে পরমেশ্বরকে আবিস্কার করার প্রযোজন হয় না, আত্মপ্রত্যয়রূপ দর্শনে তিনি অনায়াসে দৃষ্ট হন। যুক্তিগর্দ্দভব্যক্তিগণ সহসা ঐ স্বতঃপ্রত্যয়রূপ আত্মপ্রত্যয়কে স্বীকার করিতে চাহে না । ঐ সমস্ত ব্যক্তিগণের উপকারার্থ আত্ম প্রত্যয়বৃত্তিকে যে সমস্ত মহোদয় স্থাপনা করিয়া গিয়াছেন তাঁহাদিগকে উহার আবিষ্কর্ত্তা কহা যায়। ঐ সকল মহোদয় যে পরম দয়ালু ইহাতে আর সন্দেহ কি ? এই পরম রমণীয় ভক্তি মার্গ আবিষ্কার করত আবিষ্কর্ত্তা জগদীশ্বরের আশ্রয়রূপ তরণীযোগে ভয়ানক ভবসমুদ্র পার হইয়াছেন কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে তাঁহারা ঐ তরণী এই পারেই অন্যান্য জীবগণের জন্য রাখিয়া গিয়াছেন। এই ব্যাখ্যার দ্বারা একটী বিশেষ তত্ত্বের প্রকাশ হইতেছে । আবিস্কৃত সত্য সমুদয় দুই প্রকার অর্থাৎ স্বরূপ সত্য ও সাম্বন্ধিক সত্য। আবিষ্কর্ত্তাগণ কোন একটা উপায় নির্ণয় করিয়া নিজ নিজ কার্য্যোদ্ধার করেন, এই উপায়টী তাঁহাদের পক্ষেই ফলদায়ক কিন্তু অন্যের পক্ষে তদ্রুপ হয় না। কোন কোন মহাত্মা জগৎ কৌশল দৃষ্টে যুক্তি পথাবলম্বন পূর্ব্বক ঈশ্বরের পদাশ্রয় করত শান্তি প্রাপ্ত হইয়াছেন। কিন্তু ঐ যুক্তি পথ অবলম্বন করিয়াও অনেকানেক ব্যক্তি নিরীশ্বর হইয়া উঠেন। অতএব যুক্তি পরমপদ প্রাপ্তির পক্ষে স্বরূপ সত্য নহে অর্থাৎ সাম্বন্ধিক সত্য মাত্র। ইহাতে তুলনাস্থলে বলিতে হইবে যে, যুক্তি মার্গরূপ তরী অবলম্বন করিয়া যে সমুদয় মহোদয় ভব সাগর পার হন তাঁহারা স্বার্থপর হইয়া তরণী খানি সঙ্গে লইয়া চলিয়া যান। কিন্তু আত্ম প্রত্যয়রূপ স্বরূপ সত্য তদ্রূপ নহে। জীব যৎকালে ঐ আত্ম প্রত্যয় সম্ভূত ভক্তিমার্গ অবলম্বন করেন তখন তাঁহার ভগবৎ পাদপদ্ম ব্যতীত আর কিছুই প্রাপ্তি হইবে না। অতএব এই স্বরূপ সত্যের আবিষ্কর্ত্তা নিঃস্বার্থরূপে দয়ালু। এই সত্য যে চিরকাল জীবের একমাত্র অবলম্ব্য হইবে ইহাতে সন্দেহ কি?
এই ভবার্ণবকে সুদুস্তর ও ভয়ানক বলিয়া বর্ণন করা হইয়াছে। ভব সংসার যে কতদূর ভয়ানক তাহা বর্ণন করা দুঃসাধ্য। অনেকানেক অদূরদর্শীগণ এই সংসারকে ঈশ্বরের প্রিয়ক্ষেত্র বলিয়া ব্যাখ্যা করেন! তাঁহারা কহিয়া থাকেন যে এই সংসারটী ঈশ্বরের উদ্যানস্বরূপ এবং জীবসকল ইহার রক্ষক ও পরিপালক রূপে নিযুক্ত আছেন। বৈদিককৰ্ম্মকাণ্ডে যাহাদের চরমফল প্রাপ্তির আশা তাঁহারা বলেন যে জীবের বৈরাগ্য অকর্ম্মণ্য, যেহেতু ঈশ্বরের দাস্যরূপ সংসারকার্য্য নির্ব্বাহ না করিলে কেবল ভক্তি দ্বারা কিছুই হইতে পারে না। এই যুক্তিদ্বারা কৰ্ম্মকাণ্ডের মাহাত্ম্য প্রকাশ করিয়া প্রবৃত্তিমার্গের স্থাপনা করিয়া থাকেন। অনেকানেক ইন্দ্রিয়পরতন্ত্র তার্কিকগণ কহিয়া থাকেন যে, সমুদয় জীব যদ্যপি বৈরাগ্যাশ্রম গ্রহণ করে তবে জীবের বংশরক্ষারূপ বৃহৎকার্য্য কাহা কর্ত্তৃক সম্পন্ন হইবে এবং অতি স্বল্পকালের মধ্যে সংসার রূপ ঈশ্বরের ক্ষেত্র উচ্ছেদ হইয়া যাইবে তাঁহাদের সংসার সাপেক্ষ যুক্তি এই যে এই ব্রহ্মাণ্ড রচনা করায় ঈশ্বরের কোন একটি মহান্ উদ্দেশ্য আছে।
মানব অসভ্য অবস্থা হইতে ক্রমশ সভ্য ও পণ্ডিত অবস্থা প্রাপ্ত হইতেছেন এবং কালক্রমে নানাবিধ শিল্প ও বিজ্ঞানের আবিষ্কার করত এই জগতকে এক উৎকৃষ্ট প্রদেশ করিবেন। তৎকালে জগদীশ্বরের কোন একটী মহান্ উদ্দেশ্য সফল হইবে। বৈরাগ্যের দ্বারা যদি এই জগৎকে উচ্ছেদ করা যায় তবে ঈশ্বর কদাচ আমাদের প্রতি সন্তোষ হইতে পারিবেন না। এই সকল অগম্ভীর যুক্তির দ্বারা তাঁহারা স্থাপনা করিয়া থাকেন যে, জগদীশ্বর আমাদিগকে যত প্রকার বৃত্তি দিয়াছেন ও ঐ সকল বৃত্তির বিষয় প্রদান করিয়াছেন ঐ সমুদয়কে সদ্ব্যবহার করিয়া মানবের পক্ষে সংসারের উন্নতি করা উচিত। এই সমুদয় প্রবৃত্তিমার্গীয় পুরুষেরা ভক্তির আস্বাদনে ও নিত্যানিত্যের বিচারে কখনই প্রবৃত্ত হন না। তাঁহারা যদি গম্ভীর যুক্তি অবলম্বন করেন তবে এই মতকে নিকৃষ্ট বলিয়া বোধ হয়। পরমেশ্বর সর্ব্বশক্তিমান এবং সত্য সঙ্কল্প। এই ব্রহ্মাণ্ড রচনায় তাঁহার কোন গৌণ উদ্দেশ্য থাকা স্বীকার করিতে পারা যায় না। তাঁহার উদ্দেশ্য সকল অগৌণে বিনা উপায়ে সিদ্ধ হয় যেহেতু তিনি সিদ্ধ সঙ্কল্প। সামান্য মানবগণের ন্যায় বিদ্যাভ্যাস করিয়া তাঁহার জ্ঞান সংগ্রহ করা সম্ভবে না। সামান্য শিল্পকার যেরূপ যন্ত্র নির্ম্মাণ করিয়া উদ্দেশ্য সফল করে তদ্রুপ ঈশ্বরকে চিন্তা করিলে তাঁহার স্বরূপের অজ্ঞতা প্রকাশ হয়। এই পরিদৃশ্য জগদ্রচনায় যদি কোন উদ্দেশ্য থাকিত তাহা হইলে ঐ উদ্দেশ্য এতদিবস অপেক্ষা না করিয়া সঙ্কল্প মাত্র সিদ্ধ হইত। অতএব প্রবৃত্তি-মার্গ যে মানবের পক্ষে কেবল স্বার্থপর ইহাই স্বীকার করিতে হইবে। পরমার্থ হইতে ভ্রষ্ট হইবার নাম স্বার্থ অতএব পণ্ডিতেরা নিস্বার্থ হইয়া বৈরাগ্যযুক্ত ভক্তিই অবলম্বন করিবেন। বৈরাগ্যযুক্ত ভক্তি জীবের স্বভাব এবং সংসারই জীবের বন্ধ। এই ভব সংসারে ইন্দ্রিয় সুখ ব্যতীত আর কিছুই হইতে পারে না। শিল্পবিদ্যার ফল স্বরূপ ধূম্রযান ও তড়িৎবার্ত্তাবহ প্রভৃতি যত কিছু হইতে পারে এবং বিজ্ঞান শাস্ত্রের আবিষ্কৃত ক্ষেত্ৰতত্ত্ব, ভূতত্ব, পশুতত্ত্ব, জলতত্ত্ব, তড়িত্তত্ত্ব, ধাতুতত্ত্ব, জ্যোতিষ-তত্ত্ব, ইতিহাস প্রভৃতি যাহা কিছু দেখিতে পাওয়া যায় ও পাওয়া যাইতে পারে এ সমুদয়ই কেবল ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয় বর্দ্ধিত মনের সুখকর হইবে, আত্মার পক্ষে বিশেষ উপকার করিবে না। এই সমুদয় অনিত্য পদার্থের জ্ঞান নিত্য পদার্থ জীবের কি বিশেষ উপকার করিতে পারে ? অনিত্য পদার্থে জড়িত হলে নিত্য বিচারের ব্যাঘাত হয় যেহেতু তদ্বিষয়ে সময় থাকে না। কিন্তু জগদীশ্বর করুণাময়, এজন্য তিনি জীবের প্রতি মহৎকৃপা করত সমুদয় অনর্থ হইতে ও অর্থ প্রাপ্ত হইবার উপায় করিয়া দেন । প্রাকৃত তত্ত্ববাদী পাষণ্ডতা প্রযুক্ত স্বীয় পরিশ্রমের ফল স্বরূপ প্রাকৃত তত্ত্বই অন্বেষণ করিয়া থাকেন কিন্তু তাহাতে অপ্রাকৃত তত্ত্ববাদীর গৌণ ফল হইয়া থাকে। শোভা, অর্থ সংগ্রহ ও রাজ্যপালন জন্য সৈন্য চালন। প্রভৃতি নিতান্ত সাংসারিক উদ্দেশ্যে যে ধূম্রযানের সৃষ্টি হইয়াছে তদ্দ্বারা অপ্রাকৃত পণ্ডিতেরা সাধু দর্শন, উৎকৃষ্ট ভক্তি-উদ্দীপক স্থান দর্শন প্রভৃতি উত্তম উত্তম কর্ম্ম সকল প্রাপ্ত হয়েন। বস্তুত প্রাকৃত বিষয়ের উন্নতিতে এই সমুদয় উপকারই হইয়া থাকে।
শাস্ত্র, যুক্তি, ঐতিহ্য ও অনুমান এই সমুদয় প্রমাণের দ্বারা ভব সংসারকে নিকৃষ্ট কহা যায়। ইহাই জীবের কারাগার। জীবের স্বরূপ অপ্রাকৃত অতএব দেহ যোগটী কেবল বিড়ম্বনা বই আর কি বলা যাইতে পারে। অদূরদর্শীগণ এই মীমাংসার যদিও প্রতিবাদ করিতে পারিবেন না তথাপি ইহাতে সম্মতি প্রকাশ করাও তাঁহাদিগের পক্ষে কঠিন।অকল্যাণ শীঘ্র মানবকে পরিত্যাগ করিতে চাহে না। যত দিবস কৰ্ম্মজনিত বন্ধ ক্ষয় হইবার সময় উপস্থিত না হয় তত দিবস জীব সংসার গতির প্রতি প্রেম করিয়া থাকে, যেহেতু নিত্যবিষয়ে প্রেম জন্মিবামাত্রই অনন্ত কল্যাণ উপস্থিত হয়। পরমেশ্বর-দও স্বাধীনতার অসদ্ব্যবহারই এই দুরন্ত অমঙ্গলের একমাত্র কারণ। সংসার যদিও অমঙ্গল স্বরূপ তথাপি ইহার উদ্দেশ্য জীবের মঙ্গল সাধন ব্যতীত আর কিছুই নহে। রাজাদিগের কারাগার সংস্থাপনের কি উদ্দেশ্য? প্রজার কল্যাণ ব্যতীত আর কিছুই নহে। দণ্ডবিধিও মঙ্গলজনক। জগদীশ্বরের শেষত্ত্ব অর্থাৎ নির্ম্মল দাসত্বই জীবের যথার্থ স্বভাব। ঐ স্বভাবকে উজ্জল করিবার জন্য স্বাধীনতারূপ একটি রত্ন জীবকে ঈশ্বর প্রদান করিয়াছিলেন। যাহারা ঐ স্বাধীনতার বশবর্তী হইয়া স্বীয় ভোগেচ্ছায় রত হইয়াছেন তাঁহারাই বদ্ধ ও তাঁহাদের অবস্থাকে সংসার কহা যায়। এই সংসারের উৎকৃষ্ট অংশই ইহা হইতে বিরাগ।
পরন্তু বৈরাগ্যও শুষ্ক হইলেও অনর্থপ্রদ। ভোগ পরিত্যাগই যে জীবের স্বভাব এমত নহে। জীবের স্বভাব এই যে স্বয়ং ঈশ্বরের ভোগ্য হইয়া তাঁহার দাসত্বামৃত পান করিতে করিতে পরমেশ্বরের পূর্ণানন্দের বিষয় হয়। অনেকে বৈরাগ্যের যথার্থ অর্থ না বুঝতে পারিয়া দেহের নানাবিধ দণ্ড দিয়া থাকেন। দেহকে অনিত্য বোধ করিয়া দেহের ক্রিয়াসকল দেহের জন্য এবং আত্মার কার্য্য সকল নিজকার্য্য এরূপ স্থির করিয়া অনুষ্ঠান তৎপর হইলে বৈরাগ্য হয়। দেহেতে বিরক্ত হইয়া যদি কেহ উহাকে ত্যাগ করতে বাঞ্ছা করেন তবে বৈরাগ্যের বিপরীত হইয়া উঠে। রাজাকর্ত্তৃক কারারুদ্ধ কোনব্যক্তি উপযুক্ত কালের পূৰ্ব্বেই যদি পলায়ন পরায়ণ হয় তবে সে অধিক দণ্ডের যোগ্য হয় বলিতে হইবে। অতএব বৈষ্ণব ধৈর্য্য অবলম্বন পূর্ব্বক আপন নিরূপিত কালকে অতিবাহিত করিতে যত্ন করিবেন। বিষয় সকলে আসক্তি না করিয়া দেহের জন্য নিয়মিত রূপে কৰ্ম্মাচরণ করত কৃষ্ণতত্ত্বরূপ ভগবৎ পাদপদ্মে চিত্ত ও আত্মাকে অর্পণ করিয়া রাখিবে। তাহা হইলে তাহার কৰ্ম্ম ক্ষয় হইয়া অবশেষে স্বস্বভাবে অবস্থিতি করিতে সক্ষম হইবে সন্দেহ নাই এই বৈরাগ্য যুক্ত ভক্তিযোগই জীবের অভিধেয় তত্ত্ব ।