শ্রীমদ্ভাগবত ১০.২.২৯
বিভর্ষি রূপাণ্যববোধ আত্মা ক্ষেমায় লোকস্য চরাচরস্য।
সত্ত্বোপপন্নানি সুখাবহানি সতামভদ্ৰাণি মুহুঃ খলানাম্॥
দেবগণ কহিলেন হে বিভো! তুমি জ্ঞান স্বরূপ আত্মা চরাচরস্থিত লোকসকলের প্রতি কৃপা করিয়া তুমি নানারূপে প্রতিভাত হও অর্থাৎ সৎলোকের প্রতি তুমি সত্ত্বোপপন্ন আনন্দপ্রদরূপসকল ধারণ কর এবং খল লোকের পক্ষে সর্ব্বদাই অভদ্রমুৰ্ত্তি দেখাইয়া থাক।
এই অপূর্ব্ব বাক্যের দ্বারা দেবতাগণ ঈশ্বরের আত্মারাম অবতারের ব্যাখ্যা করিলেন। সমুদয় সৃষ্ট পদার্থে পরমাত্মারূপে পরমেশ্বর প্রবেশ করিয়াছেন। সমস্ত ভূত সকলে ও সকলশ্রেণীবর্গে জগদীশ্বরের প্রতিভা আছে। পরমেশ্বর অখিল জগতের ও জীবগণের প্রাণের প্রাণ-স্বরূপ অতএব তাঁহার পরমাত্মা অবতার সমুদয় পদার্থে না থাকিলে সকলই অপদার্থ হইত। জগতে যতগুলি পৃথক পৃথক বস্তু আছে সেই সমুদয়ে ষড়ৈশ্বর্য্য ভগবান গর্ভোদকশায়ী পরমাত্মা রূপে বিরাজমান করিতেছেন। ফলত বস্তু সকলের পৃথক্ত্ব হেতু পরমাত্মার পৃথক্ পৃথক্ রূপ প্রতিভাত হইয়াছে। যে আধারে যে সমুদায় গুণ আছে তদনুযায়ী ঈশ্বরের রূপ বিকল্পিত হয়। জড় জগতে অচিন্ত্য কৌশল দৃষ্ট হয় অতএব কৌশলের চিহ্ন-স্বরূপ চক্রধারী ভগবান উহাতে প্রতিভাত হইয়াছেন। যে সকল ব্যক্তিগণ আত্মপ্রত্যয় রূপ অচ্যুত বিশ্বাসকে স্থান দান করেন না তাঁহারা যুক্তি দ্বারা চক্রধারী ভগবানের স্বরূপ দেখিতে পান। তাঁহারা অনন্ত অবতারের রূপ সমুদয় বিচার করিতে সমর্থ হন না। তদ্রূপ জগতে যতগুলি জীব আছে তাহাদের আত্মায় পরমেশ্বর ভিন্ন ভিন্ন রূপে দৃষ্ট হন। বাহ্যাকারে যে রূপ দেহ সকল ভিন্ন ভিন্নাকারে ন্যস্ত, আত্ম-স্বরূপ জীবসকলও ঈশ্বরের অনন্ত শক্তি প্রমাণ করত ভিন্ন ভিন্ন স্বভাব ও গুণে অবস্থিত আছেন। ঐ সকল স্বভাব ও গুণের স্বরূপ অনুযায়ী আত্মারাম পরমাত্মার ও ভিন্নরূপ বিবেচিত হয়। অতএব জগতে যতগুলি জীব আছে ঈশ্বরের তত প্রকার অবতার স্বীকৃত হইল। সত্ত্বগুণান্বিত ব্যক্তিগণের আত্মায় ঈশ্বরের সত্ত্বগুণান্বিতরূপ দৃষ্ট হয়। তদ্রুপ যাহারা রজোগুণান্বিত তাহারা রজোগুণান্বিত ঈশ্বরের রূপ দেখিতে পায়। তমো গুণবিশিষ্ট ব্যক্তিগণ ঈশ্বরকে তামসিকরূপে দৃষ্টি করে। এই প্রকার গুণ সকলের অনুলোম বিলোম জনিত অনন্ত প্রকার গুণের সম্ভাবনা সুতরাং ঈশ্বরের প্রতিভাত রূপ সকলও অনন্ত প্রকার। জীব সকল নিজ নিজ গুণাধিষ্ঠিত ঈশ্বর মূৰ্ত্তির আরাধনা করে। এই প্রকার আরাধনা করিলে তাহাদের নিজ নিজ গুণের সমৃদ্ধি হইয়া তাহার চরম ফল প্রাপ্ত হয়। তমোগুণান্বিত ব্যক্তিগণ ঈশ্বরের তমোগুণান্বিত কোন ভয়ঙ্কর মূর্ত্তির আরাধনা করত তাহার চরম ফল-স্বরূপ ভয় প্রাপ্ত হয়। তদ্রূপ সত্ত্বগুণান্বিত মূৰ্ত্তির সেবা করত জীবের কল্যাণ-রূপ বিশুদ্ধ সত্ত্বময় প্রেম প্রাপ্ত হইয়া থাকে। ভগবান জগতের জীবন স্বরূপ হইয়া যদিও অনন্তরূপ ধারণ করেন তথাপি জীবগণ তটস্থ বিচার পূর্ব্বক ভগবানের স্বস্বরূপ বিশুদ্ধ সত্ত্বকে অবলম্বন করিয়া পরব্যোমস্থিত শিবত্ব প্রাপ্ত হন। তমোগুণ-প্রচুর খল সকল ভগবানের অভদ্ররূপ প্রাপ্ত হইয়া দণ্ডিত হয়।
এ স্থলে এরূপ সন্দেহ হইতে পারে যে, ভগবানের যে প্রকারে হউক উপাসনা হইলেই জীবের মঙ্গল হইবার সম্ভাবনা, যেহেতু ভগবান সূর্য্যস্বরূপ, অতএব তম-স্বরূপ অমঙ্গলের সান্নিধ্যমাত্র তিরোহিত করিতে সমর্থ হন। এই সন্দেহটা নিতান্ত অকর্ম্মণ্য। জীবের স্বাধীনতাই ভগবানের অবতারের জনক। জীবের নিত্যস্বভাব কি ইহাই বিচার করা কৰ্ত্তব্য। ঈশ্বর পারতন্ত্র্যই জীবের নিত্য স্বভাব, যেহেতু জীব স্বভাবতই কৃষ্ণদাস। জীবের মঙ্গল সাধনাৰ্থে অর্থাৎ প্রলোভন দ্বারা বলীয়ান্ করণার্থে পরমেশ্বর স্বীয় স্বাতন্ত্র্যের কণামাত্র জীবকে দেখাইয়াছেন। যেসকল জীব দুর্ব্বল তাহারা স্বতন্ত্রের চাকচিক্যে ভ্রান্ত হইয়া পরতন্ত্ররূপ নিজ স্বভাবকে পরিত্যাগ-পূর্ব্বক স্বতন্ত্রতাতে লোভ করত মায়ার গুণ সকলকে অবলম্বন করিলেন। এই স্বতন্ত্রতা অবলম্বন করাতে মায়াদত্তগুণ প্রাপ্ত হইয়া ঐ সমুদয় জীব ভিন্ন ভিন্ন আকার প্রাপ্ত হইলেন। পরন্তু যেসকল জীব বলবান তাঁহার স্বতন্ত্রতাকে অগ্রাহ্য করায় কৃষ্ণদাসত্ব স্বরূপ স্বস্বভাবে রহিলেন। তাঁহাদের কখনো পতন হয় নাই, এজন্য তাঁহাদিগকে নিত্যমুক্ত কহা যায়। যাঁহারা স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন-পূর্ব্বক মায়িক গুণ স্বীকার করিলেন তাঁহারা বদ্ধ সংজ্ঞা প্রাপ্ত হইলেন। নিত্যমুক্ত পুরুষেরা পরমেশ্বরের নিজরূপের মাধুর্য্য কর্ত্তৃক আকৃষ্ট থাকিয়া তাঁহার অপ্রাকৃতধামে সেবকত্ব প্রাপ্ত হইয়া আছেন। অর্থাৎ ঈশ্বরের স্বস্বরূপ প্রাপ্ত হওয়ায় তাহারা অবতার বিষয় জ্ঞাত নহেন। বদ্ধ পুরুষদিগের পক্ষেই ঈশ্বরের অবতার। ঈশ্বরের গুণাবতার সকলকে সুতরাং বদ্ধ-পুরুষেরা উপাসনা করিয়া গুণাধিষ্টিত ফল প্রাপ্ত হন। অতএব জীবের স্বতন্ত্রতাই অবতারের কারণ বলিতে হইবে যেহেতু জীব যদ্যপি স্বতন্ত্রতা অবলম্বন করিয়া মায়া-গুণ অঙ্গীকার না করিতেন তবে আত্মারামের ভিন্ন ভিন্ন অবতার হইত না। এ প্রযুক্ত বেদান্তশাস্ত্রে প্রকৃতিকে স্বক্রিয় বলিয়া ঈশ্বরকে নির্ব্বিকার ব্যাখ্যা করিয়াছেন। ইহাতে ইহাও প্রতিপন্ন হয় যে জীব নিজ স্বতন্ত্র কর্ম্মফলে আপনার বদ্ধত্ব প্রাপ্ত হইয়াছেন। যদিও বিচার-পূর্ব্বক কৰ্ম্মফলই অবস্থার কারণ বলিতে হইবে ঐসমস্ত বিচারে বিশেষ মীমাংসা না হওয়ায় এতৎ সমুদয় ঈশ্বরের লীলা বলিয়া গৃহীত হয়। জগদীশ্বর সর্ব্বশক্তিমান অতএব জীবের মঙ্গলার্থে অমঙ্গল-রূপ স্বতন্ত্রতা কি প্রয়োজনে প্রদান করিয়া কতগুলি জীবকে মায়াবদ্ধ করিয়াছেন ইহা স্থির করা অসাধ্য। শ্রীচৈতন্যদেব এই চিন্তাকে অসাধ্য ভ্রম কহিয়া ইহা হইতে বৈষ্ণবদিগকে নিরস্ত হইতে উপদেশ করিয়াছেন। বস্তুত প্রভু-আজ্ঞাই প্রবল যেহেতু তাহা অতিক্রম করিলে বন্ধ্যাতর্কে প্রবেশ করিতে হয়। এই স্বতন্ত্রতা যদিও জীবের অনেক অমঙ্গলের হেতু হইয়াছে তথাপি প্রভু ইহাকে ঈশ্বরের মঙ্গলময় দান বলিয়া রামানন্দের নিকট ব্যাখ্যা করিয়াছেন। যে সমুদায় জীব এই স্বতন্ত্রতা অবলম্বন করিয়াও ঈশ্বর পারতন্ত্র্যের অনুগামী থাকিতে পারিলেন তাঁহারা পূৰ্ব্বাপেক্ষা ভগবানের অধিক প্রিয়তর হইলেন। অতএব মহাপ্রভুর উপদেশ এই যে, জীবসকল ঈশ্বর-প্রদত্ত স্বতন্ত্রতার উচিত ব্যবহার করিলে উৎকৃষ্ট কৃষ্ণভক্তি প্রাপ্ত হইতে পারেন। স্বতন্ত্রতা না থাকিলে জীবের ঈশ্বর-পারতন্ত্র্যে অগত্যা থাকিতে হইত অতএব তাহাতে জীবের মাহাত্ম্য ছিল না। যে সকল জীব স্বাতন্ত্র্যের বশীভূত হইয়া বদ্ধপ্রায় জগতে বিচরণ করিতেছেন তাঁহারা মায়া হইতে ভিন্ন ভিন্ন গুণ প্রাপ্ত হইয়া ঐ সকল গুণোদ্ভাবিত ভগবানের নানা প্রকার প্রতিভার সেবা করেন, কিন্তু ঐ সকল সেবার দ্বারা ভগবৎসেবা হয় না যেহেতু ভিন্ন ভিন্ন রূপের দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন ফল প্রাপ্ত হওয়া যায়। ভগবানের মুখ্য সেবাই প্রেম, একারণ যাঁহারা তামসিক মূৰ্ত্তি সকলের ভয়, ঘৃণা ও লম্পটতা দ্বারা সেবা করিয়া থাকেন তাঁহারা শান্তি হইতে দূরীকৃত হন। যদিও ভগবান্ কোন না কোন রূপে তাঁহাদের সহগামী হইয়া নরকেও অবস্থিতি করেন তথাপি তাঁহাদের প্রেম অভাবে মঙ্গল হইতে পারে না। ঈশ্বর সর্ব্বব্যাপী ও সর্ব্বান্তর্যামী, অতএব জীব যে গতিতে যেখানেই থাকুক ঈশ্বর হইতে দূরে থাকিতে পারে না, কিন্তু শান্তির মুখ্য উপায় যে অহৈতুকী ভক্তি তাহা যতকাল জীবের আশ্রয় না হয়, ততকাল জগদীশ্বরের ভীষণমূৰ্ত্তি ব্যতীত শান্তমুৰ্ত্তির দৃষ্টিগোচর হয় না। এজন্য জীবের তটস্থ বিচার দ্বারা সত্ত্বোপপন্ন শান্তমূর্তির ধ্যান ও সেবা করা নিতান্ত কর্ত্তব্য। স্বতন্ত্রতা জনিত জীবের যে বদ্ধত্ব তাহাও ঐ সত্ত্ব গুণের সেবার দ্বারা ঘুচিবার সম্ভাবনা ।