শ্রীমদ্ভাগবত ১০.২.২৭
একায়নোসৌ দ্বিফলস্ত্রিমূলশ্চতূরসঃ পঞ্চবিধঃ ষড়াত্মা।
সপ্তত্বগষ্ট বিটপো নবাক্ষো দশচ্ছদী দ্বিখগো হ্যাদিবৃক্ষঃ॥
দেবগণ জ্ঞানশূন্য ভক্তি দ্বারা একেবারে স্পন্দহীন কিয়ৎকাল রহিয়া ক্রমে ক্রমে পুনরায় জ্ঞান প্রাপ্ত হইতে লাগিলেন। যখন পুনরায় তাঁহা-দিগের স্থূল-দৃষ্টি প্রত্যাগত হইল তখন তাঁহাদের স্বীয় দেহের প্রতি মনোযোগ হইতে লাগিল। ভগবানের মাহাত্ম্য ও স্বীয় ক্ষুদ্রতা আলোচনা পূৰ্ব্বক তাঁহারা কহিলেন “অহো! আমরা অতিশয় ক্ষুদ্র যেহেতু আমরা দেহী। দেহীগণ স্বভাবতঃ সীমা বিশিষ্ট কিন্তু পরমেশ্বর অসীম। এই দেহ অথবা সংসাররূপ আদিবৃক্ষ কেবল সপ্ত পঞ্চাশৎ অঙ্গ বিশিষ্ট কিন্তু পরমেশ্বর অনন্ত। মায়া প্রকৃতিই ইহার একমাত্র অয়ন, সুখ ও দুঃখ ইহার দুইটি ফল, সত্ত্ব রজঃ তমো গুণ ইহার তিনটি মূল, ধর্ম্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ ইহার চারিবিধ রস, শ্রোত্র-স্পর্শ-চক্ষু-জিহবা-নাসিকা এই পাঁচটী ইহার জ্ঞানাগম প্রকার, শোক-মোহ-জরা-মৃত্যু-ক্ষুধা-পিপাস ইহার ছয়টী স্বভাব, ত্বক্-অসৃক্-মাংস-মেদ-অস্থি-মর্জ্জা-শুক্র ইহার ত্বক্ স্বরূপ, ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোম-মনঃ-বুদ্ধি-অহঙ্কার ইহার বিটপ স্বরূপ, নবদ্বার ইহার ছিদ্র, দশ প্রাণ (অপানাদি) ইহার পত্র, জীব ও পরমাত্মা ইহার দুইটী পক্ষী। এবম্বিধ দেহ বিশিষ্ট জীব কি প্রকারে অহঙ্কার করিতে পারে? দশ প্রাণ পৰ্য্যন্ত যে দেহের প্রাকৃত বিভাগ তাহাতেই মূঢ় লোকেরা আত্মবুদ্ধি করিয়া মৃত্যু প্রাপ্ত হয়। কিন্তু যে সকল বুদ্ধিমান্ ব্যক্তি একমায়া হইতে দশ প্রাণ পৰ্য্যন্ত এই দেহকে ক্ষুদ্র ও অনিত্য বোধ করিয়া জীবাত্মা ও পরমাত্মারূপ পক্ষীদ্বয়কে আলোচ্য জানিয়া তদ্বিষয়ে চিন্তা করেন তাঁহারাই স্বস্বরূপ জ্ঞাত হইয়াছেন এরূপ বলিতে হইবে। এই দেহের সম্বন্ধে জীব একটী পক্ষী বিশেষ যেহেতু এই বৃক্ষের সহিত জীবের স্থায়ী সম্বন্ধ নহে। পক্ষীগণ যেরূপ রাত্রি যাপন করিবার জন্য একটী বৃক্ষের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া পরে প্রভাত হইবামাত্র স্থানান্তরে গমন করে জীবও তদ্রুপ এই সংসাররূপ দেহকে অবলম্বন পূর্ব্বক বদ্ধভাব নিশাবসানে অপ্রাকৃত ধামে গমন করিয়া থাকে। অতএব যে সকল ব্যক্তি এই সংসার রূপ বৃক্ষকে স্বীয় সম্পত্তি বোধ করত কেবল প্রাকৃত পদার্থের তত্ত্ব নির্ণয় করিতে ব্যস্ত হয় তাহারা নিতান্ত নির্ব্বোধ। প্রাকৃত তত্ত্ববাদীগণ যে প্রকার পরিশ্রম করিয়া থাকেন তদুপযুক্ত ফল প্রাপ্ত হন না। প্রকৃতি গুণময়ী, অতএব তাহার গুণ সকল ও গুণ সকলের পরস্পর সম্বন্ধ ও তাহাদিগের পরিণাম চিন্তা করিতে করিতে কোন প্রকার নিত্যলাভ হইবার সম্ভাবনা নাই। এই প্রকার উপদেশের দ্বারা প্রাকৃত তত্ত্ব জঘন্য এরূপ কহা যায় না যেহেতু তত্তত্ত্ববিৎ পণ্ডিতেরা অপ্রাকৃত তত্ত্বাবিষ্কারের পক্ষে অনেক উপকার করিয়াছেন ও করিবেন। জীব যত কাল জড় দেহে আবদ্ধ থাকিবে ততদিবস তাহার পক্ষে অপ্রাকৃত তত্ত্ব উপলব্ধি করা সুকঠিন। জড় দেহের গুণ সকল আলোচনা করিতে করিতে মনের ভাবসকল উদয় হয়, একারণ মানবগণের কল্পনা বিভাবনারূপ সমুদয় চিন্তা প্রকৃতি-মূলক অতএব অপ্রাকৃত হইতে পারে না। চিচ্ছক্তির পরিণাম স্বরূপ অনন্ত বৈকুণ্ঠাদি ধামের উপলব্ধি ব্যতীত জীব আর কিছুই বুঝিতে পারে না। পরমার্থ ব্যাকুল মহাত্মাগণ কেবল মাত্র উপলব্ধিতে আবদ্ধ থাকা ক্লেশকর বোধ করিয়া ঐ সমস্ত নিত্যধামের নানাবিধ বিভাবনা করিয়াছেন। কিন্তু তৎসমুদয়ই প্রাকৃত স্বরূপ ব্যাখ্যা হইয়া থাকে। প্রাকৃত তত্ত্ববাদীগণ প্রকৃতির গুণ ও সম্বন্ধ সকল পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আবিষ্কার করায় অপ্রাকৃত তত্ত্ববেত্তার যদিও কোন সাক্ষাৎ উপকার হয় না তথাপি গৌণ উপকার হইয়াছে স্বীকার করিতে হইবে। শ্রুতি সকল কহিয়াছেন যে ‘তন্ন তন্ন’ করিয়া অবশিষ্ট যাহা পাওয়া যাইবেক তাহাই অপ্রাকৃত তত্ব। অতএব প্রাকৃত তত্ত্ববাদী যে প্রাকৃত গুণের আবিষ্কার করিবেন তাহা অপ্রাকৃত নহে এইরূপ স্থির করিতে করিতে অবশেষে যাহা পাওয়া যাইবেক তাহাই নিশ্চয় অপ্রাকৃত। বদ্ধ সংস্কার জনিত অনেকানেক ভাব নিচয়কে অনেকেই অপ্রাকৃত বলিয়া স্বীকার করিয়া গিয়াছেন কিন্তু যখন প্রাকৃত তত্ত্ববাদী ঐ ভাব সকলকে প্রাকৃত বলিয়া স্থাপনা করিয়াছেন, তখন অপ্রাকৃত তত্ত্ববিৎ উহাদিগকে পরিত্যাগ করিবেন। এই প্রকারে প্রাকৃত তত্ত্ববাদী হইতে অপ্রাকৃত তত্ত্ববাদী অনেক গৌণ উপকার প্রাপ্ত হইতেছেন স্বীকার করিলে প্রাকৃত সম্প্রদায়কে ঘৃণা করা যায় না বরং শ্রদ্ধা করিতে হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে প্রাকৃত তত্ত্ববেত্তারা অনেকেই পাষণ্ডতা প্রকাশ পূৰ্ব্বক প্রাকৃত তত্ত্বাবিষ্কারকেই পরম বলিয়া জানেন। উহার যথার্থ উদ্দেশ্যকে উপলব্ধি করিতে পারেন না। ফলতঃ মূঢ়তাই, তাঁহাদের পক্ষে ফল স্বরূপ হয়। কোন কোন নৈয়ায়িক পরমাণু হইতে সমস্ত জগৎ সৃজন করত উহার গুণ সমষ্টিকে পদার্থপদে ব্যাখ্যা করেন। কোন কোন পরিণামবাদী পরমাণুতেও শান্তি প্রাপ্ত না হইয়া একমূলা অন্ধকাররূপিণী প্রকৃতির প্রতি লক্ষ্য করিয়া থাকেন। এই প্রকার কেহ চতুর্ব্বিংশতি তত্ত্ব, কেহ নবতত্ত্ব, কেহ দ্বিপঞ্চাশৎ তত্ত্ব আবিষ্কার করিয়া সমস্ত সংশয়ের মীমাংসা হওয়া স্বীকার করত নিশ্চিত হন। আহা! কি খেদের বিষয় যে জগতের সমস্ত পদার্থের আবিষ্কার করিয়াও ঐ সকল বিপথগামী তত্ত্বতৃষুগণ আমি কোন্ ব্যক্তি, আমার পরিণাম কি, ও তৎপরিণামের উপায় কি এইরূপ স্বরূপ চিন্তার বিষয়ে চিরকাল অজ্ঞ রহিলেন। আকাশস্থ বিদ্যুৎ ও জল মধ্যস্থ প্রবাল ও ভূগর্ভস্থ ধাত্বাকর প্রভৃতি সমুদয় পদার্থের যিনি নির্ণয় করিলেন তিনি আপনাকে জানিতে পারিলেন না। আত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে তিনি কখন মৃত্তিকাদির পরিণাম, কখন বানরাদির বংশাবলী বলিয়া মানব আত্মাকে ব্যাখ্যা করিতে লাগিলেন। বানরের বংশাবলী বলিয়া আপনাকে যাঁহারা অপদস্থ করিয়া থাকেন তাঁহাদিগকে শ্রীশ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থে দ্বিবিদ বলিয়া উক্ত করা হইয়াছে। অপ্রাকৃত তত্ত্বজ্ঞ ভগবদ্দাস জীবের মূল স্বরূপ সঙ্কর্ষণ কর্ত্তৃক ঐ সকল দ্বিবিদ গণের সংহার হইয়া থাকে। অন্ধকার বলিয়া মূল প্রকৃতিকে যাঁহারা জানিয়াছেন তাঁহারা মায়া প্রকৃতিকে নিশ্চয় করিতে পারিয়াছেন ইহা স্বীকার করিতে হইবে, কিন্তু মায়া প্রকৃতি যদিও সংসাররূপ বৃক্ষের মূল তথাপি জীব শক্তির মূল হইতে পারে না। জীব শক্তি একটী স্বতন্ত্র শক্তি উহা পক্ষীর ন্যায় ঐ মায়া প্রসূত সংসার বৃক্ষের কোটরে কিয়ৎকালের জন্য বাস করিতেছে। জীব আলোক স্বরূপ অতএব অন্ধকারের পরিণাম হইতে পারে না। এই মায়া শক্তিই অন্ধকাররূপে এই সংসার বৃক্ষের একমাত্র আশ্রয়। অতএব ইহাকে একায়ন উপাধি প্রদত্ত হইয়াছে। সুখ ও দুঃখ এই দুইটী ইহার ফল। পার্থিব সমস্ত সুখই দুঃখের ন্যায় নিরানন্দময় সুখের চরম ভাবকে স্বর্গ বলা যায়। ঐ স্বর্গও প্রাকৃত যেহেতু পারিজাত ঘ্রাণ, অপ্সরা নৃত্য, গন্ধর্ব্ব গীত, নন্দন কানন ও ইন্দ্র সভা দর্শন ও অস্পরা দিগের অঙ্গ স্পর্শন, অমৃত পান ইত্যাদি যত প্রকার সুখের উল্লেখ আছে তাহাও ইন্দ্রিয়জনিত। ইন্দ্রিয় সকল দেহের উপলব্ধির দ্বার অতএব দেহের সহিত অনিত্য। শত বর্ষের উচ্চ স্বর্গ সুখ একত্র করিলেও এক বিন্দু অপ্রাকৃত সুখের তুল্য হইতে পারে না। অসুতৃপ ব্যক্তিগণ যে ইন্দ্রিয়সুখকে পরম করিয়া জ্ঞান করে সে কেবল তাহাদের অপ্রাকৃত ভক্তি সুখের অজ্ঞতাবশতঃ বলিতে হইবে। ইন্দ্রিয় সুখ অনিত্য ও ভয়জনক কিন্তু অপ্রাকৃত সুখ নিত্য ও বিমলানন্দ পূর্ণ। পশুগণ যেরূপ অপ্রাকৃত সুখের অজ্ঞতা প্রযুক্ত ইন্দ্রিয়সুখকে শ্রেষ্ঠ জানে, তদ্রুপ দ্বিপাদ পশুগণ ও অপ্রাকৃত মুখের ভৌক্তা গণকে উন্মাদ বোধ করিয়া মূঢ়তা প্রযুক্ত ইন্দ্রিয় সুখানুভবে দিনপাত করে। প্রাকৃত সুখ মরীচিকাবৎ ভ্রমজনক। যত দিবস ঐ সুখের বিষয়টী হস্তগত না হয় তত দিবস উহাতে যে পরম সুখ আছে এ প্রকার বোধ হয় কিন্তু ঐ সুখভোগ করিবার পর ভয়ানক নিরানন্দ আসিয়া আত্মাকে আক্রমণ করে।
প্রাকৃত সুখ ও প্রাকৃত দুঃখ দুই তুল্য। সংসার বৃক্ষের তিনটী মূল অর্থাৎ সত্ব, রজ ও তম। অপেক্ষাকৃত সমুদয় উত্তমগুণ গুলিকে সত্ত্বগুণ কহা যায়, মধ্যমগুণ গুলিকে রজোগুণ ও অধমকে তমোগুণ কহা যায়। পালন, স্থিতি, দয়া, ধৰ্ম্ম, বিচার প্রভৃতি সত্ত্বগুণের লক্ষণ। সৃষ্টি স্বর্গাভিলাষ যুক্ত কর্ম্মকাণ্ড ও প্রাকৃতাপ্রাকৃত ধৰ্ম্ম সকলে মিশ্রিত বোধকরণ প্রভৃতি অনেকানেক রজোগুণের লক্ষণ আছে। ভয়ঙ্কর ঈশ্বর বিরোধী ক্রিয়া সকল উন্মত্ততা, পাপকে পুণ্য বলিয়া প্রতিষ্ঠা, সংহার, কৃতঘ্নতা প্রভৃতি তমগুণের সৈন্যনিচয় বলিয়া জানা যায়। এই তিনটী গুণই সংসারের মূল স্বরূপ। ধৰ্ম্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ এই চারিটী এই বৃক্ষের রস। "মানবগণ এই সংসারে কখন ধৰ্ম্মের কখন অর্থের কখন কামনার, কখন মোক্ষের আস্বাদন করিয়া থাকেন। মন্বাদি ধর্ম্মশাস্ত্র সম্মত ও বৈদিক কর্ম্মকাণ্ড অবলম্বন পূর্ব্বক যে সকল মনুষ্যের স্বর্গাদি ফল পাইবার জন্য শ্রাদ্ধ তর্পন, দুর্গোৎসবাদি দেবতা পূজা, অশ্বমেধাদি যজ্ঞানুষ্ঠান, ও পুরশ্চরণাদি প্রায়শ্চিত্ত করিয়া থাকেন তাঁহারা আর্য্য প্ৰণীত ধৰ্ম্মের আস্বাদন করেন। পৃথিবীতে সার্ব্বভৌম পদ ও স্বর্গে নানা প্রকার সুখ ভোগকে অর্থ বলে। ইন্দ্র চন্দ্র বায়ু বরুণ ব্ৰহ্মা প্রভৃতি দেবতাগণের পদবাঞ্ছাকে কাম কহে। এই সমুদয় প্রাকৃত সুখের আশাকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক স্বার্থপরতার সহিত স্বীয় আত্মাকে জগদীশ্বরের অপ্রাকৃত ঐশ্বৰ্য্য স্বরূপ পরব্যোমধামে সালোক্য, সার্ষ্টি, সামীপ্য, ও সারূপ্যরূপ মুক্তিতে নীত করণেচ্ছায় যাঁহারা ঐশ্বৰ্য্যযুক্ত পরমেশ্বরকে সাধনা করেন তাঁহারা মোক্ষ রসকে ভোগ করেন। তদ্ব্যতীত সাযুজ্যরূপ মোক্ষ বাসনায় অনেকানেক ব্যক্তি জ্ঞানযোগদ্বারা পরব্যোমের বহির্ভাগস্থিত এক জ্যোতির্ম্ময় মণ্ডলকে প্রাপ্ত হন। তথায় জগদীশ্বরকে নিরাকার জ্ঞানবশত দৃষ্টি করিতে না পাইয়া সোহং ভাবে আপনাকে ব্ৰহ্ম বোধ করত স্বীয় ক্ষুদ্ৰাত্মার মধ্যে যে কিছু ক্ষুদ্র রস আছে তাহাকেই ব্ৰহ্মানন্দ ভাণ করিয়া চুষিতে থাকেন কিন্তু অতিশীঘ্র ঐ রসে তৃপ্ত হইয়া পুনরায় কামনা বশত সংসার গতি প্রাপ্ত হন।
সংসার মধ্যে পঞ্চবিধ প্রাকৃত জ্ঞানপ্রকার। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, ত্বক, ও রসনা ইহারাই প্রাকৃত পদার্থের জ্ঞান মনোরূপে আত্মার সহিত সংযোগ করে। এই পঞ্চদ্বার হইয়া যে জ্ঞান আত্মার নিকটস্থ হয় ইহাকে সামান্য লোক প্রত্যক্ষ প্রমাণ বোধ করিয়া থাকে। ইন্দ্রিয়ের সহিত বিষয়ের সংস্পৰ্শকে বিষয়ানুভব বলা যায় ও তদন্তরে চিত্তের দ্বারা বিষয়ের প্রতিভা মনস্থ হইলে বিষয়োপলব্ধি সংজ্ঞা প্রাপ্ত হয়। রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ এই পঞ্চগুণ ও তাঁহাদের মিশ্রভাবই মনের বিষয় এই সমুদায় রূঢ়ি প্রতিবিম্ব হইতে মানবগণ বিভাবনা শক্তির দ্বারা অদৃষ্ট স্বর্ণ পর্ব্বতাদি ও ইন্দ্রপুরী প্রভৃতি নানাবিধ প্রাকৃত লোক কল্পনা করিয়া থাকেন। এই বিভাবনা শক্তির অনুকল্প বিকল্প রূপ দুইটী গতি আছে। অনুকল্প গতিদ্বারা সমষ্টি হইতে ব্যষ্টি নির্ণীত হয় অর্থাৎ সাধারণ শ্রেণী হইতে বিশেষ বিশেষ রূঢ়ি পদার্থ পৃথক্ কৃত হয়। যথা জীবরূপ সমষ্টি হইতে উদ্ভিজ্জ, অণ্ডজ, স্বেদজ প্রভৃতি ব্যষ্টি পৃথকরূপে পরিদৃশ্য হয়। বিকল্পগতির দ্বারা ব্যষ্টি সমুদয়ের সাধারণ লক্ষণ দৃষ্ট হইয়া ঐ সমুদায় কোন এক সাধারণ শ্রেণীভুক্ত হইয়া যায়। এই প্রকার বিভাবনা শক্তির যে নির্ণয়াকারী সৌন্দৰ্য্য তাহাকে যুক্তি কহা যায়। এই যুক্তি শক্তির দ্বারা জীবের মঙ্গল ও অমঙ্গল উভয়ই ঘটিবার সম্ভব। জীব যখন ঐ শক্তির দ্বারা সমুদয় প্রাকৃত পদার্থে অনিত্যতা দৃষ্টি করেন তখন উহা কৰ্ত্তৃক মঙ্গল হয়, কিন্তু যৎকালে ঐ শক্তির দ্বারা উহার অগোচর অপ্রাকৃত পদার্থকে নির্ণয় করিতে ব্যস্ত হন তখন তিনি মূঢ় পদবাচ্য হইয়া উঠেন। যুক্তি যখন সমুদয় বিচার আলোচনা পূৰ্ব্বক জীবের অপ্রাকৃত বিভাগের জীবন স্বরূপ অচ্যুত বিশ্বাসকে দৃঢ় করে তখন উহার প্রকৃত কর্তব্য অনুষ্ঠিত হয়।
শোক-মোহ-জরা-মৃত্যু-ক্ষুধা-পিপাসা ইহারা প্রাকৃত দেহের স্বভাব, আত্মার নহে। হতভাগ্য নাস্তিকগণ আত্মার অমরত্ব স্বীকার করেন না। শোক ও মোহ যদিও আত্মায় সম্ভবে না তথাপি দেহাত্মাভিমানী ব্যক্তিগণ উহাদের কর্তৃক আত্মার পীড়া স্বীকার করিয়া থাকেন।
পঞ্চভূত এবং মন বুদ্ধি অহঙ্কার এই দেহ বৃক্ষের বিটপ। আত্মার বিষয় ধ্যানকে মন কহা যায়। বুদ্ধির অন্যতম নাম বিষয় জ্ঞান। দেহে আত্মাভিমানকে অহঙ্কার কহিয়া থাকে।
এই সমুদয় প্রাকৃত পদার্থময় সংসাররূপ আদিবৃক্ষে জীবাত্মা ও পরমাত্মা অবস্থিতি করেন ।