শ্রীমদ্ভাগবত ১০.২.৪০
মৎস্যাশ্বকচ্ছপনৃসিংহবরাহহংসঃ
রাজন্যবিপ্রবিবুধেষু কৃতাবতারঃ।
ত্বং পাসি নস্ত্রিভুবনঞ্চ যথাধুনেশ
ভারং ভুবো হর যদূত্তম বন্দনং তে॥
হে ঈশ! তুমি পূৰ্ব্বে, মৎস্য, অশ্ব, কচ্ছপ, বরাহ, নৃসিংহ, হংস, ক্ষত্রিয়, বিপ্র এবং দেব এই সকলে অবতার গ্রহণ করিয়া আমাদিগকে এবং ত্রিভুবনকে যদ্রূপ পালন করিয়াছ এক্ষণেও তদ্রূপ পালন কর অধিকন্তু এই ভূমি ভার হরণ কর। হে যদুত্তম! তোমাকে বন্দনা করি।
আত্মারাম অবতারের ব্যাখ্যায় ভগবানের অসংখ্য অবতারের বর্ণনা পূর্ব্বেই করা হইয়াছে। কিন্তু ঐ সমুদয় অবতার তিন ভাগে বিভক্ত হয়। রাজসিক ও তামসিক অবতারের বিষয় এস্থলে বক্তব্য নহে, যেহেতু ঐ সকল অবতারের কোনপ্রকার উপাসনা কর্ত্তব্য নহে। সত্ত্বগুণের যে অবতার তাহাই সাধুগণ কর্ত্তৃক সর্ব্বকালে বিচাৰ্য্য। এজন্য মৎস্য প্রভৃতি অবতারের উল্লেখ এস্থলে করিয়াছেন। সত্ত্বনিধি বিষ্ণুও সর্ব্বকালে এবং সর্ব্ব অবস্থায় জীবের নিকট অবতাররূপে প্রত্যক্ষ হন।
চৈতন্যবিশিষ্ট জীবের কীট হইতে সাধু মানবদেহ পৰ্য্যন্ত বহুবিধ অবস্থা। এই অবস্থা নানাবিধ হইলেও বিজ্ঞানশাস্ত্রের দ্বারা কতকগুলি লক্ষণানুসারে পণ্ডিতেরা শ্রেণীবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। জলকীটের মধ্যে অনেকগুলি নির্দ্দণ্ডী ও কতকগুলি বজ্ৰদণ্ডী। বিমানচারী ও ভূচর জীবের মধ্যে অনেকগুলি মেরুদণ্ডী, এই প্রকার বহুবিধ লক্ষণের দ্বারা মৎস্য, কচ্ছপ, বরাহ প্রভৃতি জীবের অবস্থায় শ্রেণী প্রকাশক হয়। পুনরায় ক্ষুদ্রাকার হইতে বৃহদাকার মানব ও অসভ্য মানব হইতে সুসভ্য মানব এই প্রকারে অনেক প্রকার শ্রেণী বিভাগ হইয়াছে জীবের সমস্ত অবস্থাতেই মঙ্গলস্বরূপ সত্ত্বনিধি বিশ্বব্যাপী বিষ্ণু জীবের সহচর। অতএব জীবের যতপ্রকার শ্রেণী বিভক্ত অবস্থা, বিষ্ণুর ততপ্রকার আবির্ভাব অবতার স্বীকার করা যায়। শ্রেণীবিভাগের প্রণালীও ভিন্ন ভিন্ন। কেহ বা জীবের নির্দ্দণ্ডী অবস্থা হইতে শ্রেণীবিভাগ করিতে করিতে মৎস্য অবতার হইতে অবতারের ব্যাখ্যা করেন, কেহ বা মানবের আদিম অবস্থা হইতে বিচার করিয়া ঋষভ দেব হইতে অবতারের আরম্ভ দৃষ্টি করেন। বিষ্ণু সর্বকালেই পালনকর্ত্তা। জীবের যে অবস্থায়ই স্থিতি হয় ঐ অবস্থার ভাবানুযায়ী ঈশ্বরভাব উদয় হইয়া পালন করে। অবস্থা বিচারই এই সকল তটস্থ অবতারের একমাত্র কারণ। মৎস্য অবতার হইতে শ্রীরামচন্দ্রের আবির্ভাব পৰ্য্যন্ত তটস্থাবতার বলিয়া স্বীকার করা যায়। শ্রীকৃষ্ণাবতার তটস্থ নহেন স্বরূপ তত্ত্ব। মানবের সমুদয় বিচার সিদ্ধান্ত হইলে আত্মপ্রত্যয়ে কৃষ্ণতত্ত্ব প্রকাশ পায়। কৃষ্ণতত্ত্ব বিচারের দ্বারাও বহুদর্শিতার দ্বারা উদ্ভাবিত হয় এমত নহে। এই তত্ত্ব জীবের চিরসঙ্গী কিন্তু জীব যতদিবস মূর্খতাবশত আত্মপ্রত্যয় বৃত্তি স্বীকার করে নাই ততদিবস কৃষ্ণতত্ত্ব অপ্রকাশিত থাকে। সাত্বত বংশেই এই পরমতত্ত্বের আবির্ভাব হয় এজন্য দেবগণ যদূত্তম বলিয়া ভগবানকে সম্বোধন করিলেন। সাত্বতগণই সাধু, যেহেতু তাহারা কুতর্কের দ্বারা আত্মপ্রত্যয়কে অস্বীকার করে না। জীবের নির্দ্দণ্ডী অবস্থায় মৎস্যবতার, বজ্ৰদণ্ডী অবস্থায় কচ্ছপাবতার ও মেরুদণ্ডী অবস্থায় বরাহ অবতার বলা যায়। ঐ মেরুদণ্ডের দণ্ডায়মান অবস্থায় প্রথমে নৃসিংহ, পরে বামন, পরে পরশুরাম, পরে রামচন্দ্র ও অবশেষে জ্ঞানের পূর্ণাবস্থায় পরব্যোমস্থিত দেব দেব নারায়ণ এ সমুদয় অবতার দৃষ্ট হয়। ইহাতে জীবের ক্রমশোন্নতিই বিচারিত হইতে পারে। কিন্তু সাত্বতকুল যখন যুক্তির হস্ত হইতে বিচারকে উদ্ধার করতঃ কেবলানুভবানন্দে নিযুক্ত করেন তখন স্বরূপতত্ত্ব শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হয়। পূর্ব্ব পূৰ্ব্ব সমুদয় অবতার স্বীকার করত ভগবান জীবকে উন্নতি ও পালন করিয়া থাকেন। কিন্তু ঐ সমস্ত অবতারের গৌণ কাৰ্য্যে যদিও ভার হরণ দেখিতে পাওয়া যায় তথাপি মায়াগুণ গ্রহণে জীবের গলগ্রহরূপ ভার শ্রীকৃষ্ণ ব্যতীত কোন অবতারেই সাক্ষাৎ উপনীত হয় না। ইহাই কৃষ্ণের বিশেষ মাহাত্ম্য।
মানবের আদিম অবস্থানুসারে যাঁহারা অবতার প্রণালী বিচার করিয়াছেন তাঁহারা ঋষভদেব হইতে আরম্ভ করেন। পৃথু অবতারে মানবেরা কৃষিকৰ্ম্ম শিক্ষা করিয়াছিল এই প্রকার চব্বিশ অবস্থায় চব্বিশটী অবতারও দৃষ্ট হয়। ক্রমে ক্রমে অবতারদিগের দ্বারা জীবের উৎকর্ষতাই দৃষ্ট হয়। নারদাবতারে ভক্তিমার্গ সংস্থাপন ও ব্যাসাবতারে সমস্ত জ্ঞানের পরম আধার যে শ্রীমদ্ভাগবত তাহা প্রকাশিত হয়। এ প্রণালীক্রমেও কৃষ্ণতত্ত্ব সর্ব্বশ্রেষ্ঠ।
ফলত সমস্ত উন্নতি ও জ্ঞানের ফলই শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব। ইহাই জীবের শেষ প্রাপ্য। শ্রবণই জ্ঞানের সংগ্রহ, কীৰ্ত্তন জ্ঞানের ব্যাখ্যা, বিষ্ণুস্মরনই ধারণা, অর্চ্চনই পূজা ও প্রতিষ্ঠা এবং বন্দনই জ্ঞানের চরমকারন। বন্দনার সহিত জ্ঞানের সমাপ্তি হয়। বন্দনার পর দাস্য, সখ্য ও বাৎসল্য ও মধুর রূপ দ্বিবিধ আত্ম নিবেদন। অতএব দাস্য, সখ্য ও আত্মনিবেদনই জ্ঞানশূন্য ভক্তিবাচ্য। দেবতারা এই জ্ঞানগর্ভ স্তবে কেবল বন্দনা পর্য্যন্ত অধিকার দৃষ্টি করিলেন। জ্ঞানহীন যে ভক্তি তাহার ব্যাখ্যা করিবার যোগ্যস্থল বোধ করিলেন অতএব দেবগণ কহিলেন, হে যদূত্তম! আমরা তোমাকে বন্দনা করি। প্রথম শ্লোকে প্ৰপত্তি স্বীকার করায় যে দাস্য প্রকাশ করিয়া ছিলেন, সে উপাসনারূপ দাস্য নহে। কেবলানুভবানন্দ রূপ স্বরূপতত্ত্বের ব্যাখ্যা ও সংস্থাপনরূপ যে কৃষ্ণদাস্য তাহাই প্রথম শ্লোকের প্রপত্তির অর্থ। দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর এই চারিটী রস ব্রজলীলাতে পূর্ণরূপে অবস্থান করে। এই অল্পবুদ্ধি লেখকের যদি সাবকাশ হয় এবং তদীয় প্রভু চৈতন্যদেব যদি তাঁহার প্রতি অনুগ্রহ করেন তবে কোন সময়ে চরম ফল স্বরূপ পূর্ব্বোক্ত চারিটী রসপূর্ণ ভাগবতের ব্রজলীলা লিখিতে প্রবৃত্ত হইবেন।
এই টীকা পাঠ করিয়া ইহার মৰ্ম্ম যে ব্যক্তি হৃদয়ঙ্গম করিতে সক্ষম হন তাঁহার সম্বন্ধ জ্ঞানের উদয় হয় এবং মায়াভাব উচ্ছিন্ন হইয়া যায়। অতএব বৈষ্ণবধৰ্ম্মের প্রবেশিকা-স্বরূপ এই টীকা সকল লোক পাঠ করিয়া অমৃত হউন। শ্ৰীশ্ৰীমচ্চৈতন্যচন্দ্রের পদযুগে প্রণাম করত সমস্ত বৈষ্ণবগণের পাদপদ্ম আমার মস্তকে ধারণ করিলাম।
সম্বন্ধ তত্ত্ব চন্দ্রিকা সমাপ্ত।