Normal view
Book Lang.: বাংলা
English
संस्कृता वाक्
Translation
Gaudīya Base»Books»গর্ভ স্তুতি স্তোত্র»গর্ভ স্তুতি স্তোত্র ১৪

গর্ভ স্তুতি স্তোত্র ১৪

Language: বাংলা
Language: English Translation
  • শ্রীমদ্ভাগবত  ১০..৩৯

    তে হভবস্যেশ ভবস্য কারণং বিনা বিনোদং বত তর্ক্কয়ামহে
    ভবে
    নিরোধঃ স্থিতিরপ্যবিদ্যয়া কৃতা যতস্ত্বয্যভয়াশ্রয়াত্মনি

    হে ঈশ! তুমি অসংসারী সুতরাং ক্রীড়া ব্যতীত তোমার অবস্থার কারণ আর কিছুই স্থির করিতে পারি না। অবিদ্যাকৃত জীবের জন্ম স্থিতি ভঙ্গ হইয়া থাকে তাহা হইতে অভয় ও আশ্রয় কেবল তোমাতেই লক্ষ্য হয় যেহেতু তুমি নিত্যমুক্তস্বরূপ।

    কৃষ্ণতত্ত্বকে স্বরূপসত্য বলিয়া ব্যাখ্যা করত পুনরায় উহার আবির্ভাব প্রকাশ করায় উহাকে অবস্থার বশীভূত করা হয় এই তর্ক দেবতাদের মনে উদয় হইল। স্বরূপসত্যে অবস্থা থাকিতে পারে না অতএব এপ্রকার অবস্থার ঘটনায় সত্যের স্বরূপতার ব্যাঘাত হয়। ইহার দ্বারা সত্য সম্বন্ধীয় হইয়া পড়ে। ইহার তর্কের দ্বারা কোন মীমাংসা হইতে পারে না এজন্য দেবতারা স্থির করিলেন যে জগদীশ্বর সর্ব্বশক্তিমান্ এবং সকল বিধির বিধাতা অথচ কোন বিধির বাধ্য নহেন। বিধি সকলও তাঁহারই ক্রীড়া। বিধি সকলের বাধ্য হইয়া আমাদের পক্ষে মীমাংসার যে কিছু কষ্ট বোধ হয় তাহা ঈশ্বরে সম্ভব হয় যেহেতু তিনি কোন বিধির বশীভূত নহেন। আমাদের ক্ষুদ্র বিচারে যাহা অঘটনীয় বোধ হয় তাহা ঈশ্বরের ইচ্ছাক্রমে অনায়াসেই ঘটিতে পারে। আবির্ভাব ও তিরোভাব যদিও অবস্থা বটে এবং অবস্থাহীন পদার্থে ঐ সকল সম্ভবে না তথাপি ঈশ্বরের লীলাক্রমে তাহা অবশ্যই ঘটিতে পারে যেহেতু তিনি সৰ্ব্বশক্তিমান্। যদিও সকল বস্তুই অবস্থার বশীভূত হইলেই সংসারী হয় এবং বিধিবন্ধনে পতিত হয় তথাপি জগদীশ্বর ক্রীড়া বশত সকলই করিয়াও স্বীয় বিধিতে বদ্ধ হন না। স্বতন্ত্রতাই ঈশ্বরের স্বভাব। জীব মায়াকে স্বীকার করিলেই বদ্ধ হয়। বদ্ধ হইলে জন্ম মরণ রূপ বিধি বন্ধে পড়িয়া যায়। কিন্তু পুনরায় নিত্যমুক্ত ঈশ্বরের আশ্রয় গ্রহণ করিলেই জীব মুক্ত হয়। অতএব অবস্থা অবলম্বনেও ঈশ্বরের বন্ধ হইবার কোন সম্ভাবনা নাই।

    অনেক পণ্ডিতেরা জগদীশ্বরকে অচিন্ত্য বলিয়া ব্যাখা করিয়া আত্মপ্রত্যয় অনুভবকে অস্বীকার করেন। তাঁহাদের যুক্তি এই যে আত্মার দ্বারা ঈশ্বরের উপলব্ধি স্বীকার করিলে জগদীশ্বর চিন্তনীয় হইয়া পড়েন এবং অবস্থার বশীভূত হন। তাঁহাদের বিচারে স্বরূপ সত্য জীব কর্ত্তৃক কখনই প্রাপ্ত হয় না। এই সমস্ত পণ্ডিতাভিমানী ব্যক্তিগণ এই সকল কুতর্কের দ্বারা স্বীয় স্বীয় আত্মাকে বঞ্চনা করেন। জীবের পক্ষে ঈশ্বর স্বভাবতই দুরূহ কিন্তু ঈশ্বর স্বেচ্ছা ক্রমে জীবের প্রতি আত্মপ্রত্যয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষ হন। ইহাতে কোন দোষ হইতে পারে না। পরমেশ্বর যে অচিন্তনীয় হইয়াছেন সেও তাঁহারই ইচ্ছাক্রমে স্বীকার করিতে হইবে। সমস্ত বিধির বিধাতাই তিনি, অতএব যে সমস্ত বিধির দ্বারা ঈশ্বরের দুরবগাহ্য ব্যবস্থাপিত হইয়াছে ঐ সমস্তবিধির ঈশ্বর ব্যতীত আর কে বিধাতা হইতে পারে। যে শক্তির পরিচালনায় পরমেশ্বর প্রাকৃত দেহ, বাক্য ও মনের অগোচর হইয়াছেন ঐ শক্তির কার্য্যক্রমে তিনি অপ্রাকৃত আত্মার অনুভব বৃত্তির দ্বারা পরিগৃহীত হইয়া জীবকে চরিতার্থ করিয়াছেন। জগদীশ্বর স্বেচ্ছাক্রমেও যদি আমাদের প্রত্যক্ষ না হইতে পারেন তবে তাঁহার ঈশিতার অভাব হয়। আত্মপ্রত্যয়কে যেসকল লোক স্বীকার করিতে না পারেন তাঁহারা অতিশয় দুর্ভাগা। অতএব আত্মপ্রত্যয়ের দ্বারা ঈশ্বরের প্রত্যক্ষতাকে অবস্থাদোষ কহা যাইতে পারে না। জীবের অবস্থা ভেদে পরমেশ্বরের যে ধ্যানভেদ তাহাও ঈশ্বরের লীলা মাত্র, অবস্থান্তর নহে। তবে জীবের অবস্থার সমাপ্তিতে যে স্বরূপসত্য-রূপ কৃষ্ণ তত্ত্বের প্রকাশ হয় তাহাতে কি প্রকার অবস্থা হইবার সম্ভাবনা

    স্বরূপসত্য যে কি, ইহা লইয়া পণ্ডিতাভিমানী ব্যক্তিগণ অনেক কুতর্ক করিয়া থাকেন। তাঁহারা ঐ সমুদয় কুতর্কের দ্বারা কৃষ্ণতত্ত্বকে প্রাকৃত বলিয়া প্রকাশ করত জগতকে কলুষিত করেন। ঐ সকল কুতর্কের সমাধা করণাভিপ্রায়ে এই স্থলে স্বরূপ সত্যের লক্ষণ ও ঐ লক্ষণ সকল দ্বারা কৃষ্ণতত্ত্বের স্বরূপ ব্যাখ্যান করা গেল। স্বরূপ সত্য নিম্নলিখিত সাতটী লক্ষণে লক্ষিত হয় যথা—

    ১। দেশকাল ভেদে স্বরূপসত্যের পরিবর্ত্তন হয় না।

    ২। সকলেই স্বরূপ সত্যের অধিকারী।

    ৩। স্বরূপসত্য ঐতিহাসিক বা কল্পিত নহে।

    ৪। স্বরূপসত্য অতুল্য, অগোপ্য, স্বতঃপ্রকাশিত ও সুলভ।

    ৫। স্বরূপসত্য বিচার কালে সর্ব্বপ্রকার প্রমাণের দ্বারা স্থাপিত হইতে পারে।

    ৬। স্বরূপসত্য সর্ব্বাঙ্গ সুন্দর, সর্ব্বাকর্ষক, কল্যাণপ্রদ ও স্নিগ্ধকর।

    ৭। স্বরূপসত্য নিজ সৌন্দর্য্যের দ্বারা শোভিত, কোন প্রকার অলঙ্কারে উহার সৌন্দৰ্য্যবৃদ্ধি দূরে থাকুক সৌন্দর্য্যের অভাব হইয়া যায়।

    কৃষ্ণতত্ত্ব এই সমুদয় লক্ষণ দৃষ্ট হয়। প্রথমতঃ কেবলানুভবানন্দ স্বরূপ যে শ্রীকৃষ্ণ তিনি সৰ্ব্বদেশে এবং সৰ্ব্বকালে স্বীকৃত। যে কেহ বৃহদ্ব্রহ্মকে ভাবনা করেন অথবা সর্ব্বগ পরমাত্মার চিন্তা করেন অথবা ষড়ৈশ্বর্য্যপূর্ণ নারায়ণের স্মরণ করেন তিনিই ঐ সমুদয় মূর্ত্তিতে কেবলানুভবানন্দের প্রতিষ্ঠা করেন। কেবলানুভবানন্দে ব্ৰহ্মত্ব, পরমাত্মত্ত্ব অথবা নারায়ণের ঐশ্বর্য্য অনুভব করা যায় না। অতএব সমুদয় ঈশ্বর চিন্তার সারভাগকে কেবলানুভবানন্দ বলি। ইহাই স্বরূপসত্য, যেহেতু ইহা খণ্ড হইতে পারে না। ভক্তি কেবলানুভবানন্দের অনুগত ব্রহ্ম বা পরমাত্মা ভক্তির বিষয় নহে। অতএব কৃষ্ণভক্তিই সার। পরমাত্মা বা ব্রহ্মোপাসনা অযুক্ত পরিশ্রম মাত্র।

    সকলেই স্বরূপ সত্যের অধিকারী। মনুষ্য মাত্রেরই আত্মায় স্বরূপ সত্যের আবির্ভাব দৃষ্ট হয়। কেবলানুভবানন্দ স্বরূপ শ্রীকৃষ্ণ সকলেরই আত্ম প্রত্যয়ের প্রত্যক্ষ। যাঁহারা এই আত্মপ্রত্যয়কেই অস্বীকার করেন তাঁহারা বস্তুত শ্রীকৃষ্ণকেও অস্বীকার করেন। ইহা কেবল তাঁহাদের পক্ষে বিড়ম্বনা। বৃহদ্বস্তু ব্ৰহ্ম বা সর্ব্বব্যাপী পরমাত্মা সকলের দ্বারা উপলব্ধ হন না। ব্রাহ্মণেরা ব্ৰহ্মকে ও যোগীরা পরমাত্মাকে বুঝিতে পারেন। কিন্তু মনুষ্যমাত্রেই অনুভবানন্দ স্বরূপ কৃষ্ণের অধিকারী। কৃষ্ণ ভজনে ব্রাহ্মণত্ব অথবা যোগের প্রয়োজন নাই। যাহারা অধিক পরিশ্রমের দ্বারা যোগসাধন করে তাহারাই দুরূহ পরমাত্মার কিঞ্চিন্মাত্র আভাস পায় কিন্তু সম্যক্ বুঝিতে পারে না। সাধারণে পরমাত্মা শব্দ শুনিবামাত্র কোন একটী জড়ীভূত পদার্থ থাকা স্বীকার করে। কিন্তু অধিক পরিশ্রম ব্যতীত ঐ পরমাত্মার উপলব্ধি প্রাপ্ত হয় না। ঐ প্রকার প্রাপ্তিরও ফল সামান্য, যেহেতু পরমাত্মা স্বরূপ নহে, অনুরূপ মাত্র। যাহারা মানস বিজ্ঞানের অধিকতর চালনা করে তাহারা বৃহদ্ব্রহ্মকে জানিতে পারে এবং ঐ ব্ৰহ্মকে জানিলে ব্রাহ্মণ অথবা ব্রাহ্ম হয়। ঐ ব্ৰহ্মপ্রাপ্তির ফলও সামান্য, যেহেতু তদ্দ্বারা স্বরূপপ্রাপ্ত হওয়া যায় না, কেবল স্বরূপের যে ঐশ্বৰ্য্য তাহাই উপলব্ধ হয়। ব্রাহ্মণ ও যোগী হওয়া যদিও কঠিন তথাপি কৃষ্ণভক্ত অপেক্ষা ঐ ব্রাহ্মণ ও যোগী অনন্ত গুণে ন্যূন। যদি এরূপ বিতর্ক হয় যে, কেবলানুভবানন্দ কৃষ্ণ যদি সকলেরই প্রাপ্য, তবে জীবের উচচতা ও নীচতা কিজন্য হইয়াছে। সকলেই কি জন্য বৈষ্ণব না হয় তবে তাহার উত্তর এই যে কৃষ্ণ সকলেরই প্রত্যক্ষ কিন্তু কতকগুলি লোক কুতর্ক্ক সহকারে অনুভবানন অস্বীকার করত ব্রাহ্মণ অথবা যোগী হয়, কেহ কেহ মূর্খতা বশত ঈশ্বরপ্রেমে বিরত হইয়া জড়বৎ অবিদ্যার সহিত ক্রীড়া করে ও কেহ কেহ কৰ্ম্মান্ধপ্রায় হইয়া নাস্তিক হইয়া উঠে। সূৰ্য্য যদিও সকলের পক্ষে প্রত্যক্ষ, তথাপি দিনান্ধ উলুক বা পেচক এবং চক্ষুকে যাহারা অবিশ্বাস করে তাহারা ঐ সূর্যের প্রকাশকে জানিতে পারে না। উলুক অথবা দৃষ্টিশক্তি অবিশ্বাসকারী পুরুষের দোষে সূর্য্যের দোষ হইতে পারে না। কৃষ্ণভক্ত যদিও বৈষ্ণবগুণে আপনাকে অতিশয় ক্ষুদ্র জ্ঞান করিয়া থাকেন তথাপি ব্রাহ্মণ বা যোগী অপেক্ষা তিনি অনন্তগুণে উৎকৃষ্ট, যেহেতু স্বরূপাধিকারী অনুরূপ অথবা বৃহদ্রূপ অধিকারী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ

    স্বরূপসত্য ঐতিহাসিক বা কল্পিত নহে। ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত সমুদয় দেশ ও কালে আবদ্ধ এবং প্রাকৃত। রাজা হরিশ্চন্দ্র সমস্ত পৃথিবী দান করিয়াছিলেন ইহা ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত। হরিশ্চন্দ্র বিগত হইয়াছেন ও পূৰ্ব্বকল্পেও ছিলেন না অতএব হরিশ্চন্দ্রও নিত্য নহেন। হরিশ্চন্দ্রের জীবাত্মা যদিও পূর্ব্বে ছিল ও এখনও ঈশ্বর স্বেচ্ছায় অবস্থিতি করিতেছে, তথাপি ঐতিহাসিক বৃত্তান্তটী বিগত হইয়া গিয়াছে। কৃষ্ণ তত্ত্ব তদ্রূপ নহেন। অনাদিকাল হইতে অনন্তকাল পর্যন্ত কৃষ্ণতত্ত্ব প্রত্যক্ষ। জীবাত্মা ও পরমাত্মারূপ জীব ও কৃষ্ণের যে অপ্রাকৃত রাসলীলা জীবের সহিত সৰ্ব্বকালে বর্ত্তমান। অতএব কৃষ্ণতত্ত্ব ঐতিহাসিক না হওয়ায় স্বরূপসত্য বলিতে হইবে। কল্পনা মনের কাৰ্য্য ; অপ্রাকৃত পদার্থে মনের অধিকার নাই। অতএব কৃষ্ণতত্ত্বে সকল আত্মারই অধিকার। ব্ৰহ্মতত্ত্ব ও পরমাত্মতত্ত্ব ঐতিহাসিক ও কাল্পনিক। পরমেশ্বর সৃষ্টির পূর্ব্বে সচ্চিদানন্দ কৃষ্ণই ছিলেন, তাঁহার কোন শক্তির তখন চালনা হয় নাই। যখন সৃষ্টি হইল, তখন বৃহদ্ব্রহ্মের প্রকাশ ও শক্তির চালনা হয়। ইহাই বেদের মধ্যে ঐতিহাসিকরূপে বর্ণিত আছে। সৃষ্টি করত পরমেশ্বর সৃষ্ট পদার্থে ওতপ্রোতভাবে প্রবেশ করিয়া পরমাত্মার প্রকাশ করেন। ইহাও ঐতিহাসিক, যেহেতু ঈশ্বরের ইচ্ছা নিবৃত্তি হইলে পুনরায় ব্রহ্ম ও পরমাত্মা অনুভবানন্দরূপ কৃষ্ণে বিলীন হয়। অনুসন্ধান, ধারণা, গ্রহণ এ সমুদয় মনের কাৰ্য্য এবং এই সকল বৃত্তির দ্বারা যে ব্ৰহ্ম ও পরমাত্মার উপলব্ধি হয় তাহা কাল্পনিকের ন্যায় অনিত্য।

    স্বরূপসত্য অতুল্য, অগোপ্য, স্বতঃপ্রকাশিত ও সুলভ। পূৰ্ব্ব বিচারেই কৃষ্ণতত্ত্ব অতুল্য প্রদর্শিত হইয়াছে যেহেতু ব্ৰহ্মতত্ত্ব ও পরমাত্মতত্ত্ব ইহার তুল্য হইতে পারে না। সকলেই যখন কৃষ্ণতত্ত্বে অধিকারী তখন সুতরাং ইহাকে অগোপ্য কহিতে হইবে। কৃষ্ণতত্ত্ব সমূদয় তত্ত্বের শ্রেষ্ঠ হইলেও উচ্চরবে পরিকীর্ত্তিত হয়, যেহেতু অসৎ পদার্থই লোকে গোপন করিয়া থাকে। ইহাতেই বৈদিক ও তান্ত্রিক মন্ত্রসকল অপেক্ষা কৃষ্ণতত্ত্বের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদিত হইল। ইহা স্বতঃপ্রকাশিত, যেহেতু দেহেন্দ্রিয়গণ অথবা মন ও বাক্য, এই সকলকে কৃষ্ণতত্ত্ব প্রকাশ করিতে হয় না। জীবাত্মা কেবল সুলভ বিশ্বাসের দ্বারাই অনায়াসে কৃষ্ণতত্ত্ব প্রাপ্ত হয়। তর্ক ও বিচার করিতে গেলে দুরূহ হইয়া উঠে। অতএব ইহা নিতান্ত সুলভ। কৃষ্ণভক্ত হইতে কিছুমাত্র পরিশ্রম নাই। ব্ৰহ্মতত্ত্ব পরমাত্মতত্ত্ব অধিক বিচারের দ্বারা সংগৃহীত হয় অতএব নিকৃষ্ট হইলেও সুলভ হয় না। জীবের স্বভাব যত সুলভ হয় উহার বিপরীতাচরণ তত সুলভ নহে। কৃষ্ণদাসত্ব জীবের স্বভাব এ প্রযুক্ত সুলভ।

    স্বরূপসত্য বিচারকালে সর্বপ্রকার প্রমাণের দ্বারা স্থাপিত হইতে পারে। স্বরূপসত্য স্বতঃপ্রকাশিত হওয়ায় বিচারের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু বিচার করিলেও সুন্দররূপে স্থাপিত হয়। প্রমাণ চারি প্রকার অর্থাৎ শ্রুতি, প্রত্যক্ষ, ঐতিহ্য, ও অনুমান। শ্রুতিসকল যদিও ব্রহ্মের গান করিয়া থাকে তথাপি তাহাতে শ্রীকৃষ্ণ ব্যতীত আর কোন উপাস্য বস্তু নাই, ইহা স্পষ্টই প্রকাশ করে। ব্রহ্মকে উপাদানকারণ-রূপে ব্যক্ত করিয়া ব্ৰহ্মাতীত কোন এক পরম পুরুষের উল্লেখ করিয়া থাকে। দশম স্কন্ধে বেদস্তুতিতে শ্রুতিসকল যে গোপীদেহ প্রাপ্তির অর্থ যে যতকাল বিচারাহঙ্কারে শ্রুতিগণ কাল যাপন করিয়াছিল ততদিবস তাহারা শুষ্ক ব্রহ্মজ্ঞানে আবদ্ধ ছিল, কিন্তু তর্ক ও জ্ঞানকে পরিত্যাগ-পূৰ্ব্বক যখন আত্মপ্রত্যয়কে স্বীকার করিল, তখন তাহারা শ্রীকৃষ্ণ তত্ত্বের অধিকারী হইয়া কৃষ্ণসেবা করিল। অতএব নারায়ণ উপনিষৎ ও গোপাল তাপনী ও সাধারণত সমুদায় উপনিষৎই কৃষ্ণতত্ত্ব ব্যখ্যা করে। প্রত্যক্ষ, দ্বিতীয় প্রমাণ আত্মার যে প্রত্যক্ষতা তাহাই ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষতা অপেক্ষা অনন্ত গুণে শ্রেষ্ঠ। যেহেতু জীবের উহাই সাক্ষাদ্দর্শন। শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব তাহাতেই প্রত্যক্ষ হওয়ায় প্রত্যক্ষ প্রমাণের দ্বারা স্থিরীকৃত হয়। ঐতিহ্য তৃতীয় প্রমাণ। সমস্ত ইতিহাস ও মহাজন প্রসিদ্ধিকে ঐতিহ্য কহা যায়। সৰ্ব্বদেশের ইতিহাস আলোচনা করিলে দেখিতে পাওয়া যায় যে, অনুভবানন্দ ব্যতীত মহাজনেরা আর কোন পদার্থকেই ঈশ্বরস্বরূপ বলেন নাই। অনুভবানন্দ স্বীকার করত যেসকল পুরুষেরা ভক্তিপথকে অবলম্বন করিয়াছেন তাঁহারাই দেশ বিদেশে গুরুপদাভিষিক্ত হইয়া কৃষ্ণতত্ত্বের উপাসনা করেন। ভাষাভেদে ও নামভেদে পদার্থভেদ হইতে পারে না। অনুমানই চতুর্থ প্রমাণ। দৃষ্ট পদার্থ হইতে গুহ্যসত্যের আবিষ্করণ শক্তিকে অনুমান কহা যায়। যুক্তিই ফলত আত্মার পক্ষে অনুমান যেহেতু আত্মার প্রত্যক্ষ যে আত্মপ্রত্যয় তাহা যুক্তির পক্ষে অবশ্যই গুহ্য। ঐ গুহ্যকে যুক্তিও বহুযত্নে স্থাপনা করিয়াছেন। যুক্তি সমস্ত পদার্থ বিচার করত তন্ন তন্ন করিয়া অবশেষে এক আনন্দকেই লক্ষ্য করেন। যদিও যুক্তি আনন্দকে বুঝিতে পারেন তথাপি উহাকে সংস্থাপন করিয়া থাকেন। সচ্চিদানন্দ শ্রীকৃষ্ণতত্ত্বই সমস্ত প্রমাণের দ্বারা স্থিরীকৃত হয়।

    স্বরূপসত্য সৰ্বাঙ্গসুন্দর, সর্ব্বাকর্ষক, কল্যাণপ্রদ ও স্নিগ্ধকর। কৃষ্ণতত্ত্ব সর্ব্বাঙ্গসুন্দর যেহেতু দেশ, কাল, গুণ সমুদয় ও তটস্থ বিচারে ইহা বিকৃত নহে। কোন প্রমাণের দ্বারা ইহা দূষিত নহে। সমুদয় তত্ত্ব ইহার অধীন তত্ত্ব, সিংহত্ত্বরূপে ইহাই পুরুষ। সর্ব্বাঙ্গ সুন্দরতার দ্বারা ইহার পুরুষত্ব প্রতিপাদন হয়। ইহাতে যত প্রকার গুণই থাকুক না কেন সমুদয় বিপরীত হইলেও অবিরোধী। ইহাতেও ইহার পুরুষত্ব প্রতিপাদন হইতেছে। সমস্ত গুণ ও ঐশ্বর্য্যের একমাত্র আশ্রয় কৃষ্ণ। তাহাতে ঐ সকল গুণ ও ঐশ্বৰ্য্য স্ত্রীত্ব ভাবাপন্ন হইয়া কৃষ্ণকে একমাত্র পুরুষরূপে বরণ করিয়াছে। গুণ ও গুণাধার কৃষ্ণে অধীন অধীশ্বর সম্বন্ধ। অন্যত্র বিপরীত গুণের সামঞ্জস্য সম্ভবে না, কিন্তু যথার্থ পুরুষরূপ কৃষ্ণে কোন প্রকার বিরোধ উৎপত্তি করিতে বিপরীত গুণদিগের ক্ষমতা নাই, যেহেতু জড়গুণ সমুদয় সচ্চিদানন্দের অবশ্যই বশীভূত। সৌন্দৰ্য্যই সমস্ত গুণের চরম। সৌন্দৰ্য্য প্রযুক্ত কৃষ্ণ সর্ব্বাকর্ষক। ইহাই স্বরূপতত্ত্ব-রূপ কৃষ্ণের প্রধান ক্রিয়া। অতএব সেই পুরুষ যথার্থই বংশীধারী। ঐ বংশীধারী পুরুষই সংসাররূপ অকল্যাণ হইতে জীবকে উদ্ধার করায় কল্যাণপ্রদ। অতএব ঐ বংশীধারী মহাপুরুষই ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিম হইয়া সংসারী জীবগণকে বৃন্দাবনে আকর্ষণ করেন। স্নিগ্ধতাই তাঁহার পরম কল্যাণ অতএব ঐ পুরুষের উজ্জ্বল স্নিগ্ধকর শ্যাম বর্ণই প্রত্যক্ষ। সর্ব্বাঙ্গসুন্দরতা, সর্ব্বাকর্ষকতা, কল্যাণপ্রদতা ও স্নিগ্ধকরতা ব্রহ্মে বা পরমাত্মায় নাই। অতএব কৃষ্ণতত্ত্বই স্বরূপ তত্ত্ব। যেহেতু এই সমুদয় লক্ষণই কেবলানুভবানন্দ ব্যতীত আর কিছুতেই নাই।

    স্বরূপসত্য নিজ সৌন্দর্য্যের দ্বারা শোভিত, কোন প্রকার অলঙ্কারের দ্বারা উহার সৌন্দর্যবৃদ্ধি হওয়া দূরে থাকুক, সৌন্দর্য্যের অভাব হইয়া যায়। বৃহত্তত্ব ও অণুত্ব এই দুহটী অলঙ্কারের মধ্যে পরিগণিত হয়। অনুভবানন্দকে বৃহত্তত্ত্বের দ্বারা অলঙ্কৃত করিলে ব্ৰহ্ম হয় ও অণুত্বে অলঙ্কৃত করিলে পরমাত্মা হয়। অতএব ব্ৰহ্মে ও পরমাত্মায় স্বরূপ সৌন্দৰ্য্য রহিত হইয়া অলঙ্কার সৌন্দর্য্য প্রকাশ পায়। জীব ঈশ্বরের স্বরূপ সৌন্দর্য্যের অধিকারী অতএব অলঙ্কার-সৌন্দর্য্যে আবদ্ধ থাকিতে না পারিয়া আত্মপ্রত্যয়ের দ্বারা কৃষ্ণতত্ত্বরূপ স্বরূপ সৌন্দর্য্যের উপাসক হয়। ব্রহ্মোপাসকগণ বৃহত্তত্বকেই স্বরূপ কহিয়া উহাতে জড়িত আনন্দাভাসকে প্রাপ্ত হন। যোগীগণ বৃহত্তত্ত্বের ক্লীবত্ত্ব জানিয়া ঈশ্বরকে অণু হইতেও অণু বিচার করিয়া হৃদয় মধ্যে সূক্ষ্ম সর্ব্বাব্যাপী ঈশ্বরের চিন্তা করেন। কিন্তু উভয়েই যথার্থ স্বরূপ প্রাপ্ত হন নাই বলিতে হইবে; যেহেতু বেদ ঈশ্বরকে অণু হইতে অণু ও মহৎ হইতে মহৎ কহিয়াছেন। অণুত্ত্ব ও মহত্ত্ব ঈশ্বরের ঐশ্বৰ্য্যমাত্র ; স্বয়ং ঈশ্বর নহে। এই প্রকার ঈশ্বরের একটী একটী অলঙ্কার অবলম্বন করিয়া উপাসনা করত কেহ ব্রাহ্ম, কেহ শৈব, কেহ যোগী নাম দিয়া একটী একটি সম্প্রদায় সংস্থাপন করিয়া থাকেন। কিন্তু স্বরূপসত্য কেবলনুভবানন্দ-স্বরূপ শ্রীকৃষ্ণতত্ত্বে সম্প্রদায় সম্ভবে না। সাম্প্রদায়িকরা শ্রীকৃষ্ণের অলঙ্কারাচ্ছাদিত ও গুণ-বিকৃত ভাবনিচয়ের উপাসক, সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণের উপাসক হইতে পারেন না। অন্যান্য সাম্প্রদায়িকদিগের ভাব দূরে থাকুক শ্ৰীসম্প্রদায়ভুক্ত বিশুদ্ধ বৈষ্ণবগণও ঈশ্বরের অখিল ঐশ্বৰ্য্য ও গুণ সকল দ্বারা অলঙ্কৃত অর্থাৎ স্বরূপাচ্ছাদিত মহারাজ রাজেশ্বর ভাব গ্রহণ করিয়াও সাক্ষাৎ কেবল অনুভবানন্দ রূপ শ্রীকৃষ্ণোপাসনায় বিলম্ব প্রাপ্ত হন।

    অতএব দেবগণ কহিলেন হে কৃষ্ণ! তুমি স্বরূপ সত্য। যেহেতু কৃষ্ণতত্ত্ব তোমার ক্রীড়াবশত সাক্ষাৎ অনুভূত হয়, অন্যান্য তত্ত্বের ন্যায় বদ্ধ ভাব-মলযুক্ত নহে। এই কৃষ্ণতত্ত্বই জীবের বৈভবস্বরূপ কোন সম্প্রদায় নির্ণীত গোপ্য বিষয় নহে। ইহাতেই জীবের চূড়ান্ত ভব নিরোধ সম্ভবে।

Page execution time: 0.0378458499908 sec