শ্রীমদ্ভাগবত ১০.২.৩৮
দিষ্ট্যা হরেহস্যা ভবতঃ পদো ভুবো
ভারোপনীত স্তব জন্মনোশিতুঃ।
দিষ্ট্যাঞ্চিতাং ত্বৎপদকৈঃ সুশোভনৈ
র্দ্রক্ষ্যাম গান্দ্যাঞ্চ তবানুকম্পিতাম্॥১৩॥
হে হরে! পরমভাগ্য যে এই ধরণী তোমার চরণভূতা তোমার জন্মমাত্রে ইহার ভার অপনীত হইল। আমাদের পরমভাগ্য অদ্য তোমার সুশোভন চরণের ধ্বজ, বজ্র, অঙ্কুশাদি শুভ লক্ষণ দ্বারা অবনীকে অঙ্কিতা এবং সুরলোককে তোমা কর্ত্তৃক অনুকম্পিত দেখিতে পাইব।
প্রথমে ধরণী, চরণ ও জন্ম এই তিনটী প্রাকৃত শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। এই শ্লোকে কোন প্রকার সম্বন্ধীয় বৃত্তান্ত নাই কেবল স্বরূপতত্ত্ব সম্বন্ধে কথিত হইয়াছে। তবে যে প্রাকৃত শব্দের ব্যবহার দৃষ্ট হয় সে কেবল বাক্যের মলদোষ মাত্র। শ্লোকের ভাবটী অতিশয় উৎকৃষ্ট ও নিগূঢ়। ভগবানের জন্ম নাই। জীবের অপ্রাকৃত বিভাগে ভগবানের আবির্ভাব মাত্র স্বীকার করা যায়। ধরণীশব্দে এস্থলে পৃথিবীস্থ জীব সমুদয়কে বুঝায়। নিত্যতত্ত্বের আবিষ্কারই কৃষ্ণজন্ম। কৃষ্ণ যখন জীবের আত্মায় পাদ শব্দে আশ্রয় প্রদান করেন তখন আত্মার ভার অপনীত হয়। ইহাই ভগবানের ঈশিতা। আত্মার ভার কি? জীব যৎকালে ঈশ্বরের সেবা পরিত্যাগ পূৰ্ব্বক স্বাতন্ত্রের অসদ্ব্যবহার করত ভোগেচ্ছাকে গ্রহণ করে, তখনই মায়া তাহার গলগ্রহ হইয়া ভার স্বরূপ হইয়া উঠে। মায়া গুণই জীবের যথার্থ ভার। ঐ ভারের দ্বারা আক্রান্ত হইয়া জীব ক্রমে ক্রমে ব্যাকুল হইয়া পড়ে। তখন ঔষধের অন্বেষণ করিতে করিতে আত্মতত্ত্বরূপ ঔষধি প্রাপ্ত হয়। কিন্তু ইহাতেও ভার উত্তমরূপ যায় না। যতক্ষণ কৃষ্ণতত্ত্বরূপ মহৌষধি না প্রাপ্ত হয়, ততক্ষণ রোগের সম্পূর্ণ শান্তি হইতে পারে না। আত্ম প্রত্যয়রূপ চক্ষের দ্বারা যখন কৃষ্ণের স্বরূপ তত্ত্ব অবগত হয় তখন ভগবানের কৃপায় ঐ দুঃসহ ভার একেবারে বিগত হইয়া যায়। জীবের আত্মায় কৃষ্ণতত্ত্বের প্রকাশ দৃষ্টি করিয়া সমুদয় দেবগণ জীবকে ধন্য কহিলেন। শ্রীকৃষ্ণের পাদ স্পর্শ দ্বারা জীবের আর কোন প্রকার দুঃখ রহিল না। যখন ভগবদ্বিষয়ে স্বরূপ সত্য প্রকাশিত হইল তখন জীবের আর দুঃখ কি? জীব যথার্থই চরিতার্থ হইলেন। ভগবানের পাদপদ্ম জীবের আত্মায় প্রদত্ত হওয়ায় ধ্বজ বজ্র ও অঙ্কুশ এই তিনটা আশ্চৰ্য্য অঙ্ক দৃষ্ট হইল। স্বরূপ সত্য সমুদায় সম্বন্ধীয় সত্যকে জয় করে অতএব ভগবানের আশ্রয়ে সমস্ত জয় হয়। ধ্বজ জয়ের চিহ্ন। কাঠিন্য প্রকাশ করিবার জন্য বজ্রের চিহ্ন প্রদত্ত হয়। ভগবানের স্বরূপ সত্যের আশ্রয় করিলে তাহা হইতে অন্যত্র যাইতে হয় না অতএব কৃষ্ণতত্ত্ব অটল কৃষ্ণ পাদাশ্রিত ব্যক্তির সত্য হইতে পাদ স্থলিত হইবার আশঙ্কা নাই। কৃষ্ণতত্ত্বাশ্রিত ব্যক্তি স্বরূপ বিধিরূপ অঙ্কুশ প্রাপ্ত হয়েন অতএব বিপথ গতি তাহার পক্ষে অসম্ভব। কৃষ্ণতত্ব প্রাপ্ত জীব ধ্বজ বজ্রাঙ্কুশ অঙ্কিত হইয়া শোভা প্রাপ্ত হন। অতএব জগতের মধ্যে তিনিই ধন্য। জীব কৃষ্ণতত্ত্ব প্রাপ্ত হইলে সুরলোকও ভগবানের দ্বারা অনুকম্পিত হন। ইহার তাৎপৰ্য এই যে সুরলোকস্থিত দেবতারাও জীব, কিন্তু কর্ম্মকাণ্ডের বলে তাঁহারা ভোগাধিকার প্রাপ্ত হইয়া দেবতা পদবী প্রাপ্ত হইয়াছেন। কোন ভোগই অক্ষয় নহে। ঐ সকল দেবতা ভোগাবসানে নর গতি প্রাপ্ত হন। যৎকালে তাঁহারা সুরলোকে দেবত্ত্ব ভোগ করিতেছেন সেই সময়ে পৃথিবীতে যে কৃষ্ণতত্ত্ব প্রকাশিত হইয়াছে তাহা তাঁহাদের ভোগক্ষয় হইবা মাত্র তাঁহারা পাইতে পারিবেন। কৃষ্ণতত্ত্ব প্রাপ্ত হইলে ভোগরূপ যে বিড়ম্বনা তাহা দূরীভূত হয়, অতএব কৃষ্ণতত্ত্বের প্রকাশের দ্বারা দেবতারাও আপনাদিগকে অনুকম্পিত বোধ করিলেন।
কৃষ্ণতত্ত্বই জগতে পরমতত্ত্ব। ইহাতে কোন প্রকার প্রাকৃত গুণের গন্ধও নাই। পণ্ডিত এই পরমতত্ত্বের আশ্রয় ত্যাগ করিয়া থাকিতে পারেন না। যত দিবস এই কৃষ্ণতত্ত্বের প্রকাশ হয় নাই, ততদিবস পণ্ডিতেরা কল্পনা অথবা যুক্তির দ্বারা প্রাকৃত গুণের বিশুদ্ধ ভাবকে অবলম্বনপূৰ্ব্বক ক্ষুদ্ৰোন্নতি সাধন করিতেন। যতক্ষণ চন্দ্রোদয় না হয় ততক্ষণ নক্ষত্রালোকই শ্রেষ্ঠ বোধ হয়। যতদিবস কৃষ্ণতত্ত্ব অপ্রকাশিত ছিল, ততদিবস মানবগণ গুণাবতার, অংশাবতার ও যুগাবতারের সাধনে কিছু কিছু উন্নতি সাধন করিতেন। কিন্তু কৃষ্ণতত্ত্ব অবতার তত্ত্ব নহে। ইহাই স্বরূপ তত্ত্ব। অবতার-বীজ যে পরব্যোমস্থিত নারায়ণ তিনিও কৃষ্ণের ঐশ্বৰ্য্যাংশ মাত্র, অতএব দেবতারা যে কৃষ্ণতত্ত্ব অবগত হইয়া ধন্য হইবেন ইহাতে সন্দেহ কি ?