শ্রীমদ্ভাগবত ১০।১।১ শ্লোকের ভাবার্থ-দীপিকায়—
দশমে দশমং লক্ষ্যমাশ্রিতাশ্রয়বিগ্রহম্ ৷
শ্রীকৃষ্ণাখ্যং পরং ধাম জগদ্ধাম নমামি তৎ ৷৷ ৯৫ ৷৷
দশমস্কন্ধে আশ্রিতগণের আশ্রয়-বিগ্রহস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণ লক্ষিত হইয়াছেন । সেই শ্রীকৃষ্ণাখ্য পরমধাম ও জগদ্ধামকে আমি নমস্কার করি । তাৎপৰ্য্য এই যে, জগতে দুইটী তত্ত্ব আছে অর্থাৎ আশ্রয় ও আশ্রিত । যাঁহাকে আশ্রয় করিয়া সমস্ত আশ্রিততত্ত্ব বৰ্তমান, সেই মূলতত্ত্বই আশ্রয় । সেই তত্ত্বকে আশ্রয় করিয়া যেসকল তত্ত্ব আছেন, তাঁহারা সকলেই আশ্রিত-তত্ত্ব । সর্গ হইতে মুক্তি পৰ্য্যন্ত সমস্ত আশ্রিততত্ত্ব, সুতরাং পুরুষাবতার ও তদনুগত সমস্ত অবতার, সমস্ত শক্তি, তদনুগত জৈব ও জড় জগৎ সকলেই সেই কৃষ্ণরূপ আশ্রয়ের আশ্রিত । ভাগবতে স্তব ও আখ্যানচ্ছলে কিঞ্চিৎ গৌণরূপে এবং সাক্ষাৎ উপদেশস্থলে সাক্ষাৎ আশ্রয়তত্ত্বেরই বিচার করিয়াছেন । অতএব কৃষ্ণের স্বরূপ ও শক্তিত্রয়জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা ।
শ্রীজীবপ্রভু ভগবৎসন্দর্ভে (১৬ সংখ্যা)—“একমেব তৎ পরমতত্ত্বং স্বাভাবিকাচিন্ত্যশক্ত্যা সর্ব্বদৈব স্বরূপ-তদ্রুপবৈভব-জীব-প্রধানরূপেণ চতুর্দ্ধাবতিষ্ঠতে—সূৰ্য্যান্তর্মণ্ডলস্থতেজ ইব মণ্ডল-তদ্বহির্গতরশ্মি-তৎপ্রতিচ্ছবিরূপেণ । দুর্ঘটঘটকত্বং হ্যচিন্ত্যত্বম্ । শক্তিশ্চ সা ত্রিধা—অন্তরঙ্গা, তটস্থা, বহিরঙ্গা চ । তত্রান্তরঙ্গয়া স্বরূপশক্ত্যাখ্যয়া সূৰ্য্যতন্মণ্ডলস্থানীয়-পূর্ণেনৈব স্বরূপেণ বৈকুণ্ঠাদিস্বরূপবৈভবরূপেণ চ তদবতিষ্ঠতে, তটস্থয়া রশ্মিস্থানীয়-চিদেকাত্মশুদ্ধ-জীবরূপেণ, বহিরঙ্গয়া মায়াখ্যয়া প্রতিচ্ছবিগত-বর্ণশাবল্যস্থানীয়-তদীয়বহিরঙ্গবৈভবজড়াত্ম-প্রধানরূপেণ চেতি চতুৰ্দ্ধাত্বম্ । অতএব তদাত্মকত্বেন জীবস্যৈব তটস্থশক্তিত্বং প্রধানস্য চ মায়ান্তর্ভূতত্বমভিপ্রেত্য শক্তিত্রয়ং বিষ্ণুপুরাণে গণিতম্ । অবিদ্যা কৰ্ম্ম কার্য্যং যস্যাঃ সা তৎসংজ্ঞা মায়েত্যর্থঃ । যদ্যপীয়ং বহিরঙ্গা, তথাপ্যস্যাস্তটস্থশক্তিময়মপি জীবমাবরিতুং সামর্থ্যমস্তীতি । তারতম্যেন তৎকৃতাবরণস্য ব্রহ্মাদিস্থাবরান্তেষু দেহেষু লঘুগুরুভাবেন বৰ্ত্ততে । যয়ৈব অচিন্ত্যমায়য়া চিদ্রূপতানির্ব্বিকারতাদি-গুণরহিতস্য প্রধানস্য জড়ত্বং বিকারিত্বঞ্চেতি জ্ঞেয়ম্ । অত্রান্তরঙ্গত্ব-তটস্থত্ব-বহিরঙ্গত্বাদিনাং তেষামেকাত্মকানাং তত্তৎসাম্যং, ন তু সর্ব্বাত্মনেতি তত্তৎস্থানীয়ত্বমেবোক্তং, ন তু তত্তদ্রূপত্বম্ । ততস্তত্তদ্দোষা অপি নাবকাশং লভন্তে ।”
সেই একমাত্র পরমতত্ত্ব, স্বাভাবিক, মানবজ্ঞানাতীত শক্তিবলে সকল সময়েই স্বরূপ, তদ্রূপবৈভব, জীব ও প্রধানরূপে চারিপ্রকারে অবস্থিত—সূৰ্য্য, অন্তর্মণ্ডলস্থিত তেজঃ সদৃশ মণ্ডল, মণ্ডল-বহির্গত কিরণ ও তাহার প্রতিচ্ছবি—এই চারিরূপ । দুর্ঘটঘটকত্বই অচিন্ত্যত্ব । শক্তিও ত্রিবিধা—অন্তরঙ্গা, তটস্থা ও বহিরঙ্গা । (তন্মধ্যে) অন্তরঙ্গা স্বরূপ-শক্তিপ্রভাবে পূর্ণ-স্বরূপবিগ্রহ এবং বৈকুণ্ঠ-গোলোক প্রভৃতি স্বরূপ-বৈভব ; তটস্থাশক্তিপ্রভাবে কিরণস্থানীয় চিন্ময়শুদ্ধ-জীববিগ্রহ এবং বহিরঙ্গা মায়াশক্তিপ্রভাবে প্রতিচ্ছবিগত বৰ্ণশাবল্যস্থানীয় তৎসম্বন্ধীয় বহিরঙ্গবৈভব জড়প্রধান রূপ—এই চারিপ্রকার । অতএব তদাত্মক বলিয়া জীবের তটস্থ-শক্তিত্ব এবং প্রধানের মায়ার অন্তর্ভুক্তত্ব জ্ঞান করিয়া বিষ্ণু-পুরাণে তিনটী শক্তির গণনা দেখা যায় । যাহার অবিদ্যা কৰ্ম্ম করিতে হয়, তাহার সংজ্ঞাই মায়া । যদিও এই শক্তি বহিরঙ্গা, তাহা হইলেও তটস্থ-শক্তিময় জীবকে আবরণ করিবার ক্ষমতা এই শক্তিতেই ন্যস্ত আছে। মায়াকর্ত্তৃক আবৃত হইয়া জীব লঘু ও গুরু তারতম্যে স্থাবর হইতে ব্রহ্মা পৰ্য্যন্ত দেহে বৰ্ত্তমান থাকে । চিদ্রূপত্ব ও বিকাররাহিত্যাদি গুণরহিত প্রধানের জড়ত্ব ও বিকার-বিশিষ্টতা সেই অচিন্ত্য-মায়াদ্বারাই ঘটে—জানিতে হইবে । একাত্মক অন্তরঙ্গ, তটস্থ ও বহিরঙ্গ শক্তিত্বে সাম্য হইলেও সৰ্ব্বতোভাবে পরস্পর সদৃশ নহে— তত্তৎস্থানীয়ত্ব উদ্দেশে কথিত, তত্তদ্রূপত্বে নহে; সুতরাং তটস্থত্বে বহিরঙ্গত্বে যে দোষসমূহ অবস্থিত, তাহা অন্তরঙ্গত্বে থাকিবার অবকাশ নাই । আবার বহিরঙ্গত্বের দোষ তটস্থত্বে, তটস্থত্বের দোষ বহিরঙ্গত্বে থাকিবার অবকাশ নাই ।