সিদ্ধান্ত বলিয়া চিত্তে না কর অলস ৷
ইহা হৈতে কৃষ্ণে লাগে সুদৃঢ় মানস ৷৷ ১১৭ ৷৷
কোন কোন ভক্তিপিপাসু ব্যক্তি এইসকল সিদ্ধান্তকে ভক্তির অঙ্গ না বলিয়া ইহাতে প্রবিষ্ট হইতে আলস্য প্রকাশ করেন, কিন্তু তাহা মঙ্গলের বিষয় নয় ; কেন না কৃষ্ণের সম্বন্ধজ্ঞান জানিতে পারিলে, তাঁহার পাদপদ্মে চিত্ত দৃঢ়রূপে লগ্ন হয় । অতএব এরূপ সৎসিদ্ধান্ত শুদ্ধভক্তির মূল ।
ইতি অমৃতপ্রবাহ-ভাষ্যে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
অনেকে জাতরুচি ভক্তগণের আদর্শদর্শনে মনে করেন যে, সিদ্ধান্ত-বিষয়ে প্রবেশ করিবার তাদৃশ আবশ্যকতা নাই । এইরূপ আলস্য হইতে অনেকে ভজনবিষয়ে অভাবগ্রস্ত হইয়া কৃষ্ণবৈমুখ্য সংগ্রহ করেন ও ভক্তির বিরোধী জড়ভাবসমূহকে ভক্তি মনে করিয়া অনর্থগ্রস্ত হন । বিচারপ্রধান-মার্গ যদিও অজাতরুচিগণের পক্ষে উপযোগী, তথাপি জাতরুচিমানী স্বল্পরুচিবিশিষ্ট জনের শ্রবণাঙ্গ বিশেষ আবশ্যক । কৃষ্ণবিষয়ক-সিদ্ধান্ত শ্রবণ না করিলে রুচিবৃদ্ধি হয় না । নবধা-ভক্তির প্রারম্ভেই কীৰ্ত্তিত বাক্যের পূর্বে ‘শ্রবণের’ ব্যবস্থা । শ্রবণ-কীৰ্ত্তন-জলেই সিঞ্চিত হইলে ভক্তিলতা সংবর্দ্ধিতা হন । ব্রহ্মা যে-কালে ত্যক্তজ্ঞানপ্রয়াস ভক্তগণের অবস্থা বলিয়া কৃষ্ণের স্তব করিলেন, তথায়ও “সন্মুখরিতাং ভবদীয়বার্ত্তাং শ্রুতিগতাং” বলিয়াছেন । পারমহংস্য অমলজ্ঞানপ্রদ ভাগবতের বিচারপর হইয়া পঠন-শ্রবণাদি করিলেই জীবের মহাভাগবতাধিকার হয় । শ্রীমহাপ্রভুর সনাতনশিক্ষামধ্যেই আমরা শুনি,—“শাস্ত্রযুক্ত্যে সুনিপুণ দৃঢ়শ্রদ্ধা যাঁর । উত্তম অধিকারী তিঁহ তারয়ে সংসার।।” শ্রীরূপগোস্বামিপাদও বলিয়াছেন,—আলস্য ত্যাগ করিয়া “উৎসাহান্নিশ্চয়াদ্ধৈৰ্য্যাৎ তত্তৎকৰ্ম্মপ্রবর্ত্তনাৎ । সঙ্গত্যাগাৎ সতো বৃত্তেঃ ষড়্ভির্ভক্তিঃ প্রসিদ্ধ্যতি।।” সিদ্ধান্তহীন ভক্তাভিমানিগণ মূর্খতাবশতঃ অনেক সময়ে কৃত্রিমভাবে সাত্ত্বিক-বিকারসমূহ অভ্যাস করিয়া লোকচক্ষে বৈষ্ণব-পদবীকে খর্ব্ব করেন । তাঁহাদের তাদৃশ অসৎ অভ্যাস গর্হণ করিয়া শ্রীমদ্ভাগবত “তদশ্মসারং” শ্লোক লিখিয়াছেন । তাঁহার টীকায় শ্রীপাদ চক্রবর্ত্তিঠাকুর বলেন,—“বহিরশ্রুপুলকয়োঃ সতোরপি যদ্ধদয়ং ন বিক্রিয়েত তদশ্মসারমিতি কনিষ্ঠাধিকারিণামেব অশ্রুপুলকাদিমত্ত্বেঽপি অশ্মসার-হৃদয়তয়া নিন্দৈষা ।”
সিদ্ধান্তকে অনাদর করিলে যে কৃত্রিম ভক্তি দেখা যায়, তাহার চিত্র শ্রীরূপপ্রভু এরূপ লিখিয়াছেন,—“নিসর্গপিচ্ছিলস্বান্তে তদভ্যাসপরেঽপি চ । সত্ত্বাভাসং বিনাপি স্যুঃ ক্বাপ্যশ্রুপুলকাদয়ঃ।।” মিছাভক্তদল সিদ্ধান্তাভাবপ্রযুক্ত কিরূপ মায়িক বিকারকে অপ্রাকৃত বলিয়া মনে করে, তাহাও ইহার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত । অনেকে শ্রীরামানুজ-মধ্বাচার্য্য-নিম্বার্ক-বিষ্ণুস্বামী প্রভৃতি বৈষ্ণবাচাৰ্য্যগণের লিখিত সিদ্ধান্তগ্রন্থের পাঠকেও ভক্তিবিরোধী অদ্বৈতবাদিগণের গ্রন্থালোচনার ন্যায় গর্হণ করে । শ্রীজীবপাদ ইহাদের সুসিদ্ধান্ত-গুলিই ষট্সন্দর্ভে বৈষ্ণবগণের মঙ্গলের জন্য উদ্ধার করিয়াছেন । নির্ব্বিশেষবাদিগণ যেরূপ ভক্ত্যঙ্গগুলিকে ভ্রমবশতঃ কৰ্ম্মাঙ্গজ্ঞান করেন, তদ্রূপ সিদ্ধান্তহীন বৈষ্ণবাখ্য জীব, ভক্তির অনুকূল-সিদ্ধান্তগুলিকেও প্রতিকূল-শ্রেণীস্থ কল্পনা করিয়া কৃষ্ণভক্তি হইতে বিচ্যুত হন ।