ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবদ্বিচার :—
প্ৰকাশবিশেষে তেঁহ ধরে তিন নাম ৷
ব্ৰহ্ম, পরমাত্মা আর স্বয়ং ভগবান্ ৷৷ ১০ ৷৷
প্রভু শ্রীজীবগোস্বামী শ্রীভগবৎসন্দর্ভে (৩য় সংখ্যা) —“তথা চৈবং বৈশিষ্ট্যে প্রাপ্তে পূর্ণাবির্ভাবত্বেনাখণ্ডতত্ত্বরূপোঽসৌ ভগবান্। ব্রহ্ম তু স্ফুটমপ্রকটিত-বৈশিষ্ট্যাকারত্বেন তস্যৈবাসম্যগাবির্ভাবঃ । ‘সংভৰ্ত্তেতি তথা ভর্ত্তা ভকারোঽর্থদ্বয়ান্বিতঃ । নেতা গময়িতা স্রষ্টা গকারার্থস্তথা মুনে।। বসন্তি তত্র ভূতানি ভূতাত্মন্যখিলাত্মনি । স চ ভূতেষ্বশেষেষু বকারার্থস্ততোঽব্যয়ঃ।। জ্ঞানশক্তি-বলৈশ্বৰ্য্য-বীর্য্যতেজাংস্যশেষতঃ । ভগবচ্ছব্দবাচ্যানি বিনা হেয়ৈর্গুণাদিভিঃ।।’ সংভর্ত্তা স্বভক্তানাং পোষকঃ । ভর্ত্তা ধারকঃ স্থাপকঃ । নেতা স্বভক্তিফলস্য প্রেম্ণঃ প্রাপকঃ । গময়িতা স্বলোক-প্রাপকঃ। স্রষ্টা স্বভক্তিষু তত্তদ্ গুণস্যোদ্গময়িতা ।” (৪র্থ সংখ্যা—) “স্বয়মহেতুঃ স্বরূপশক্ত্যৈকবিলাসময়ত্বেন তত্রোদাসীনমপি প্রকৃতিজীবপ্রবর্ত্তকাবস্থ-পরমাত্মাপরপৰ্য্যায়-স্বাংশলক্ষণপুরুষদ্বারা যদস্য স্বর্গস্থিত্যাদিহেতুৰ্ভবতি তদ্ভগবদ্রূপং বিদ্ধি । ** যেন হেতুকর্ত্রা আত্মাংশভূত-জীবপ্রবেশেনদ্বারা সংজীবিতানি সন্তি দেহাদীনি তদুপলক্ষণানিপ্রধানাদি-সর্ব্বাণ্যেব তত্ত্বানি যেনৈব প্রেরিতয়ৈব চরন্তি স্ব-স্ব-কার্য্যে প্রবর্ত্তন্তে, তৎপরমাত্মরূপং বিদ্ধি । জীবস্য আত্মত্বং তদপেক্ষয়া তস্য পরমত্বং ইত্যতঃ পরমাত্মশব্দেন তৎসহযোগী স এব ব্যজ্যতে । যদেব তত্তত্ত্বং স্বপ্নাদৌ অন্বয়েন স্থিতং, যচ্চ তদ্বহিঃ শুদ্ধায়াং জীবাখ্যশক্তৌ তথা স্থিতং, চকারাৎ ততঃ পরত্রাপি ব্যতিরেকেণ স্থিতং স্বয়মবশিষ্টং তদ্ব্রহ্মরূপং বিদ্ধি ।” ****
সমস্তশক্তিবিশিষ্ট হইয়া পূর্ণ আবির্ভাববশতঃ ভগবান্ অখণ্ডতত্ত্বরূপ । আর ব্রহ্মে তাদৃশ বৈশিষ্ট্যাকারত্বের অপ্রকাশহেতু ব্রহ্ম ভগবানের খণ্ড অসম্যক্ আবির্ভাবমাত্র। হে মুনে ভগবৎ-শব্দের আদ্যক্ষর ভ-কারের সংভর্ত্তা ও ভর্ত্তা এই দুই অর্থ ; গ-কারের অর্থ নেতা, গময়িতা ও স্রষ্টা । প্রাণিগণ অখিলাত্মা ভূতাত্মায় বাস করেন, আর সেই অব্যয়পুরুষও অশেষ প্রাণীতে বাস করেন, ইহাই ব-কারের অর্থ । অশেষ জ্ঞান, শক্তি, বল, ঐশ্বৰ্য্য, বীৰ্য্য ও তেজঃ হেয়গুণসমূহ বর্জ্জিত হইয়া ভগবৎ-শব্দবাচ্য। ‘সংভর্ত্তা’-শব্দে স্বভক্তগণের পোষক । ‘ভর্ত্তা’-অর্থে ধারক ও স্থাপক, ‘নেতা’-অর্থে নিজভক্তিফলের অর্থাৎ প্রেমের প্রাপক । নিজলোকপ্রাপক ‘গময়িতা’। ‘স্রষ্টা’-শব্দে নিজভক্তসমূহে তত্তদ্গুণের উদ্গমকারী । যিনি স্বয়ং অহেতু, স্বরূপশক্তিদ্বারা একমাত্র বিলাসবিশিষ্ট, সংসারে সম্পূর্ণ উদাসীন হইলেও প্রকৃতি ও জীবের প্রবর্ত্তক-অবস্থা-বিশিষ্ট স্বাংশ-লক্ষণান্বিত পুরুষদ্বারা সংসারের জন্ম, স্থিতি প্রভৃতির হেতু, সেই তত্ত্বকেই ভগবত্তত্ত্ব জানিবে । যে হেতুকৰ্ত্তা, জগতে আত্মাংশভূত জীবগণকে প্রবেশ করাইয়া জগৎকে সঞ্জীবিত করেন, দেহাদি উপলক্ষণ-প্রধানাদি তত্ত্বসমূহ যাঁহাকর্ত্তৃক প্রেরিত হইয়া অবস্থানপূর্ব্বক নিজ নিজ কার্য্যে প্রবৃত্ত হয়, তাঁহাকে পরমাত্মা বলিয়া জানিবে। জীব স্বরূপতঃ আত্মা, জীবাপেক্ষা যাহার পরমত্ব ; একারণে ‘পরমাত্মা’-শব্দে তিনি জীবের নিত্য সহযোগিরূপে ব্যক্ত হইতেছেন। যে তত্ত্ব স্বপ্ন-জাগর-সুষুপ্তিতে অন্বয়ভাবে স্থিত, যাহা সমাধিতে শুদ্ধা। জীবশক্তি হইয়া অবস্থিত হইলেও পরে পরত্রও ব্যতিরেকভাবে অবস্থিত হইয়া স্বয়ং অবশিষ্ট, তাহাকেই ব্রহ্ম বলিয়া জানিবে ।