তথাপি মোহার চিত্তে নহিব অন্যথা।
সত্য সত্য তোমারে কহিলুঁ এই কথা ॥”
মদিরা-পানোন্মত্ত জনগণ নানা কু-কার্যে প্রবৃত্তিবিশিষ্ট হয় বলিয়া তাহারা সামাজিকের দর্শনে অত্যন্ত ঘৃণ্য। মদিরা-দ্বারা জীবের বুদ্ধি-বৃত্তি বিনষ্ট হয় এবং কু-কার্যে প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পায়। প্রকৃত রূপাকৃষ্ট ভোগি-সম্প্রদায় জাতিকুল-আচারাদির বিচার না করিয়াই যবনীর সহিত সংসর্গ করে। তদ্বারা তাহারা তাহাদের জাতিকুলে কলঙ্ক প্রবেশ করে এবং তাহারা অধঃপতিত হয়।
প্রাজাপত্য ও ব্রাহ্মা-বিবাহ ব্যতীত পৈশাচ, রাক্ষসাদি-বিবাহ এবং সবর্ণবিবাহ ব্যতীত অসবর্ণ বিবাহ, অপকৃষ্ট ম্লেচ্ছ—সংসর্গ জাতিদোষের কারণ। আসব-সেবার দ্বারা জীবের বুদ্ধিবৃত্তি পাপপথে চালিত হইয়া যবনী-সংসর্গের উপাদেয়ত্ব ব্যক্তিবিশেষের রুচিতে প্রকাশিত হয়। সামাজিক বিচারে উহা বিশেষ ঘৃণিত ব্যাপার। প্রভু নিত্যানন্দ বৎসলরসাশ্রিত আশ্রয়গণের অতি প্রিয় বস্তু । জগদ্গুরু অবধূত শ্রীনিত্যানন্দ যদি কখনও, ঐরূপ সর্বাপেক্ষা ঘৃণিত কার্যও করিয়া বসেন, তাহা হইলেও তাঁহার প্রতি শ্রীবাসের অনুরাগ শ্লথ হইবেনা। শ্রীবাস বলিতেছেন,— শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু যদি তাঁহার জাতি নাশ করেন বা তাঁহাকে সংহার কিম্বা তাঁহার ধনাদি অপহরণ করেন, তাহা হইলেও নিত্যানন্দের প্রতি তাঁহার সেবা-প্রবৃত্তির লেশমাত্র হ্রাস হইবে না। প্রেমের এই প্রকার স্বভাব যে, প্রেমের পাত্রের প্রতি লৌকিক বিতৃষ্ণাকারক কোনও লক্ষণ পরিলক্ষিত হইলেও তদ্বৈলক্ষণ্য ঘটে না।‘শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুতে আমি নিত্যকাল অনুরক্ত, সামান্য লৌকিক নশ্বর বিরোধি-ভাব তাঁহাতে দেখা গেলেও আমি তাঁহার অনুরাগের পক্ষপাতিত্ব পরিহার করিব না। প্রকৃত প্রস্তাবে শ্রীনিত্যানন্দপ্রভু পরম নৈতিকের পরমোচ্চ আদর্শ। যদি কেহ তাহাকে গর্হণ করিবার মানসে সর্বাপেক্ষা নীচতার সহিত তাঁহাকে সংশ্লিষ্ট করিবার প্রয়াস করে, তাহা হইলেও আমার বিচারে নিত্য আনন্দময় বস্তুর সেবা পরিত্যাগ করা আবশ্যক বলিয়া বিবেচিত হইবে না।’ দুর্বলহৃদয়, পাপপ্রবণ-চিত্ত নরগণ এই সকল নিত্যানন্দ-মহিমার কথা বুঝিতে না পারিয়া বিকৃতভাবে গ্রহণপূর্বক তাহাদের নিজ অসৎ স্বভাবের সমর্থন করে। তাহাতে নীতি বিগর্হিত ঘূণিত রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। অদূরদর্শিতা, সত্যবস্তুতে প্রবেশাধিকারবঞ্চিত ভাব-সমূহ কখনও শ্রীশ্রীমন্নিত্যানন্দ প্রভুর অপ্রাকৃত গম্ভীরলীলার মধ্যে প্রবেশ করিতে সমর্থ হয় না। পাপিগণের বুদ্ধি-বিপর্যয় করিবার জন্য কৃষ্ণের স্তেয়-লীলা বা বহির্বিচারে লাম্পট্য-লীলা; তাহা অধমরুচিবিশিষ্ট জনগণের অধিক অমঙ্গল উৎপাদন করে। কিন্তু জড়বাসনারহিত ভগবৎসেবাপর জনগণের পরমোচ্চতা-প্রদর্শন-কল্পে যে-সকল নিত্য লীলার বিস্তার, তাহাতে জীবের স্বভাবগত নিত্য-সেবা-প্রবৃত্তি উন্মোষিত হয়। কৃষ্ণদাস কবিরাজপ্রভুর ভ্রাতা শ্রীচৈতন্যদেবে সামান্য অনুরাগবিশিষ্ট থাকিলেও শ্রী প্রভু নিত্যানন্দের লোকাতীত প্রেম বুঝিতে না পারিয়া নিজের সর্বনাশ আবাহন করিয়াছিলেন তাহার অনুসরণে বাউল, প্রাকৃত-সহজিয়া প্রভৃতি অপসম্প্রদায় নরকাভিযানের জন্য ব্যস্ত হওয়ায় তাহাদেরও শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুতে দুর্নীতির আরোপ কবিবার প্রবৃতি দৃষ্ট হয়। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু কোনদিনই নীতিশাস্ত্র বিগর্হিত কার্যে উদ্গ্রীব ছিলেন না। আধ্যাত্মিক বা আসুরিক দর্শনে তাহার প্রতি ঐ সকল ভাবের আরোপ যাহাদের ইন্দ্রিয়জ্ঞানে প্রতিভাত হয়, সেই ভাগ্যহীন জনগণের সঙ্গ সর্বতোভাবে পরিত্যাগ করিযা শ্রীনিত্যানন্দ চরণ-শরণ জনগণের পদানুসরণ সর্বতোভাবে বিধেয়।