“শুন শুন নিত্যানন্দ শ্রীপাদ গোসাঞি।
ব্যাস-পূজা তোমার হইবে কোন্ ঠাঞি? ॥
ব্যাসপূজা,—সম্বিচ্ছক্ত্যধিষ্ঠিত অদ্বয়জ্ঞান ব্রজেন্দ্রনন্দনের অভিজ্ঞান-বিগ্রহ ‘বেদ’ নামে প্রসিদ্ধ। শ্রীভগবানের ত্রিবিধ শক্তির অন্তর্গত জীব-শক্তিতে চেতন-ধর্মের বৈশিষ্ট্য বর্তমান। জ্ঞাতৃ, জ্ঞান ও জ্ঞেয়-বিলাসেই অদ্বয়জ্ঞান ব্রজেন্দ্রনন্দন অবস্থিত। মূর্ত বেদ ভগবান্ শব্দাদর্শরূপে অক্ষরাত্মক হইয়া অভিধেয় বেদশাস্ত্রস্বরূপে প্রকটিত সম্বন্ধাভিধেয়-প্রয়োজন-তত্ত্বাত্মক বেদশাস্ত্র যে কালে নির্বিশেষ বিচারে স্তব্ধ হইয়া পড়ে, সেইকালে অদ্বয়জ্ঞান সবিশেষ ধর্ম পরিহাস করেন। জড়বিশেষকেই যাঁহারা প্রাধান্যে স্থাপিত করেন, তাঁহাদের জড়তা-সিদ্ধিরূপ নির্বিশিষ্ট বিচার তাঁহাদের অস্তিত্ব বিনাশ করে। শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস বেদকে ত্রিবিধ বিভাগে বিভক্ত করিয়াছেন। আধ্যাক্ষিকগণের জন্য ঋক্, সাম ও যজুঃ জীবকে কর্মকাণ্ডে আবদ্ধ করিয়া বেদের প্রকৃত তাৎপর্য লাভ-বিষয়ে বিবর্ত আনয়ন করে। নির্বিশেষবাদিগণের মতে গুরু, লঘু প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যের নিত্যত্ব না থাকায় তাঁহারা শ্রীবেদব্যাসকে গুরুরূপে বরণ করিতে অসমর্থ হইয়া তাঁহাকে বলপূর্বক তাঁহাদিগের অজ্ঞান-ধর্মের মূল প্রচারক বলিয়া মনে করেন। শ্রীমদ্ব্যাসের তাৎপর্যজ্ঞানে অসমর্থ হইয়া যেসকল প্রচছন্ন বৌদ্ধ প্রকৃতিবাদ অবলম্বনপূর্বক পরমেশ্বরের সেবারহিত হন এবং আপনাদিগকে ‘স্বগত-সজাতীয়বিজাতীয়-ভেদ-রহিত ব্রহ্ম’ বলিয়া মনন করেন, তাঁহাদের সহিত মতবৈষম্য সংস্থাপনপূর্বক প্রকৃত গুরুদাস্যে অবস্থিত শ্ৰীমদানন্দতীর্থ শ্রীব্যাসাধস্তনগণের সর্ব প্রধান স্থান অধিকার করিয়াছিলেন। সেই মধ্ব-পারস্পর্যে শ্রীমান্ লক্ষ্মীপতি তীর্থের কথা অথবা শ্রীমাধবেন্দ্রপুরীপাদের কথা আমরা সংশ্লিষ্ট দেখিতে পাই। যদিও পঞ্চোপাসক বা মায়াবাদিগণের মধ্যে গুরু-পূজা বা ব্যাস-পূজার প্রথা প্রচলিত আছে, তথাপি তাদৃশ ব্যাসপূজনে অহমিকার বিচারই প্রবল। শুদ্ধভক্তির অভাব-নিবন্ধন তাহাদিগের দ্বারা শ্রীব্যাসপূজা কখনই সাধিত হইতে পারে না। মায়াবাদি-সম্প্রদায়ে জ্যৈষ্ঠ-পুর্ণিমা-দিবসে ব্যাসপুজাভিনয়ের বিধান পরিদৃষ্ট হয়। শ্রুতি বলেন, যে মুহূর্তে বিরাগ উপস্থিত হইবে, সেই মুহূর্তেই জড়ভাগে বিরাম লাভ করিয়া ভগবৎসেবায় রুচি হইবে। তাহার কালাকাল বিচার নাই। জড়ভোগ নিবৃত্ত হইলেই জীব পরিব্রাজনক হইয়া আচার্যের চরণ আশ্রয় করেন। সেই আচার্য-চরণাশ্রয়কেই ভাষান্তরে ‘ব্যাসপূজা’ কহে। শ্রীব্যাসপূজা চারি আশ্রমেই বিহিত অনুষ্ঠান; তবে তুর্যাশ্রমিগণ ইহা যত্নের সহিত বিধান করিয়া থাকেন। আর্যাবর্তে শ্রীব্যাসদেবের অনুগত সম্প্রদায়-ভুক্ত ব্যক্তিগণ বেদানুগ-সম্প্রদায় নামে প্রসিদ্ধ। তাঁহারা প্রত্যেকেই প্রতিবর্ষে স্ব স্ব জন্মদিনে পূর্বগুরুর পূজা বিধান করেন। পূর্ণিমা তিথিই—যতিধর্ম গ্রহণের প্রশস্তকাল। যতিগণ সবিশেষ ও নির্বিশেষ বাদি-নির্বিশেষে সকলেই গুরুদেবের পূজা করিয়া থাকেন। তডজন্য সাধারণতঃ জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমাতেই গুর্বাবির্ভাব তিথি-বিচারে ব্যাস-পূজার আবাহন হয়। শ্রীগৌড়ীয় মঠের সেবকগণ বর্ষেবর্ষে মাঘী কৃষ্ণপঞ্চমী তিথিতে তাঁহাদের গৌরবের পাত্র-বোধে শ্রীব্যাসপূজার আনুকূল্য বিধান করেন। শ্রীব্যাসপূজার পদ্ধতি বিভিন্ন শাখায় ন্যূনাধিক পৃথক্। চারি আশ্রমে অবস্থিত সংস্কারসম্পন্ন দ্বিজগণ সকলেই শ্রীব্যাসগুরুর আশ্রিত বলিয়া প্রত্যহই স্বধর্মানুষ্ঠানে শ্রীব্যাসদেবের ন্যূনাধিক পূজা করিয়া থাকেন, কিন্তু ইহা বার্ষিক অনুষ্ঠানের বিচারে বর্ষকালব্যাপী স্ব-স্ব গুরু পূজার স্মারক দিবস। শ্রীব্যাসপূজার নামান্তর ‘শ্রীগুরুপাদপদ্মে পাদ্যার্পণ’ বা ইহার দ্বারা শ্রীগুরুদেবের মনোঽভীষ্ট যে সুষ্ঠু ভগবৎসেবন, তাহাই উদ্দিষ্ট হয়। তজ্জন্যই আমাদের শুভানুধ্যায়ী নিয়ামক, পূর্বগুরু শ্রীল ঠাকুর শ্রীনরোত্তম শ্রীরূপানুগরূপে আদিগুরুকে অর্ঘ্যপ্রদানোদ্দেশে বলিয়াছেন,:—
“শ্রীচৈতন্যমনোহভীষ্টং স্থাপিতং যেন ভূতলে।
স্বয়ং রূপঃ কদা মহ্যং দদাতি স্বপদান্তিকম্ ॥’
পরম- কৃপা-পরবশ শ্রীচৈতন্যদেবের কৃষ্ণপ্রেম-প্রদান লীলা,—যাহা শ্রীরূপ তাঁহার অনুগগণের জন্য নিত্যসেবা-বৈমুখ্যরূপ ব্যাধিমোচনের নিমিত্ত ঔষধ ও পথ্যরূপে নির্দেশ করিয়াছেন, তাহাই গৌড়ীয়ের ব্যাসপূজার উপায়নাদর্শ।