গর্জে যজ্ঞ-বরাহ-প্রকাশে’ খুর চারি।
প্রভু বলে,—“মোর স্তুতি করহ মুরারি!॥”
সহসা গৌরহরি মুরারির গৃহে ধাবমান হইয়া ‘শূকর’ ‘শূকর’ বলিতে বলিতে তাঁহার বিষ্ণুগৃহে প্রবিষ্ট হইলেন। গৌরসুন্দরের এইরূপ অপূর্ব গর্জন ও ‘শূকর’ ‘শূকর’ উক্তি মুরারি সহসা শ্রবণ করিয়া ব্যাপার কি, বুঝিতে পারিলেন না। বিষ্ণুগৃহে একটি বৃহজ্জলপাত্রে জল দেখিয়া দন্তদ্বারা সেই জলপূর্ণ পাত্র উত্তোলন করিলেন। মুরারি তাঁহাকে তৎকালে চতুস্পদ যজ্ঞবরাহরূপে গর্জন করিতে দেখিলেন।বরাহ দেব বিষ্ণুর অবতার, সুতরাং ভগবান্ গৌরসুন্দরের অবতারবিশেষ হওয়ায় তাঁহার নিজানুভূতিতে বরাহ-লীলার প্রাকট্য-সাধন তদনুরূপ বিচারসম্পন্ন ভক্তের নিকট প্রকাশ করিলেন। ইহাতে কোনও মায়াবাদী এরূপ মনে না করেন যে, মায়াবদ্ধ জীব অজ্ঞানমুক্ত হইয়া সকলেই ভগবদ্বস্তুর অনুকরণে এইরূপ ঈশ্বরভাব প্রদর্শন করিতে সমর্থ। যাহারা এরূপভাবে প্রতারিত হইয়া আপনাদিগকে বিষ্ণুজ্ঞনে বঞ্চিত হইল, সেই-সকল কপট নারকিসম্প্রদায়কে অনাদর করিবার জন্যই স্বয়ং ভগবান্ এরূপ লীলা প্রদর্শন করিয়া তাহাদের মূঢ়তা সম্পাদন করিলেন। নিত্য ভগবদ্বিমুখ পাষণ্ডিগণ ভগবচ্চরিত্র বুঝিতে না পারিয়া এই সকল ভাবের অনুকরণপূর্বক যেরূপ ভ্রমপথে পতিত হয় এবং জগতে জঞ্জাল আনিয়া কতকগুলি কপট ব্যক্তিকে নিজ নিজ স্তাবকরূপে প্রতিষ্ঠিত করে, সেইরূপ ঐ সকল ভগবদ্বিদ্বেষীর যোগ্য-ভূমিকা নরক-যন্ত্রণা তাহাদিগকে অনন্তকাল ক্লেশ দিবার জন্য প্রতীক্ষা করে। ছন্নাবতার শ্রীগৌরসুন্দর নিজের স্বরূপ গোপন রাখিয়া ভক্তগণকেও বুঝিতে দেন নাই। অনন্ত নরকলাভের যোগ্য ঘৃণিত মায়াবদ্ধ জীব, যাহার প্রত্যেক দিনে তিন অবস্থা হয়, সে যদি প্রভুকে জীবজ্ঞানে আত্মসদৃশ মনে করিয়া নিজের বঞ্চিত প্রিয় জনগণের দ্বারা এই প্রকারে স্তবসংগ্রহে যত্নবিশিষ্ট হয়, তাহা হইলে তাদৃশ বঞ্চক ও বঞ্চিত, উভয়েই মনুষ্য নামের যোগ্যতা হারাইয়া বিড়্ভোজী বরাহের চতুষ্পদত্বের অভাবে দ্বিপাদ-পশুরূপে পরিণত হয়। এইরূপ দ্বিপাদ পশু বাহিরের দিকে কোনদিনই চতুষ্পদ দেখাইতে পারে না। তাহাদের জন্মান্তরে ঐপ্রকার বিষ্ঠাভোজি-চতুষ্পদত্ব লাভ হয়। শ্রীচৈতন্যদেব স্বীয় বরাহঅবতারের চতুষ্পদ প্রদর্শন করিয়াছেন, আর তদনুকরণে ক্ষুদ্রজীব, যে যাহা নহে সে সেরূপ অভিনয় করিতে গেলে নিতান্ত হাস্যাস্পদ হইয়া থাকে।