এইমত নানা ভাবে নানা কথা কয়।
দেখিয়া বৈষ্ণব-সব আনন্দে ভাসয় ॥
কৃষ্ণসেবায় তন্ময়তা লাভ করিয়া গৌরসুন্দর তাঁহার ভক্তগণের মুখে কৃষ্ণের যে যে লীলার কথা শ্রবণ করেন, তাদৃশী লীলায় প্রবিষ্ট হইয়া তদনুরূপ ভাব প্রদর্শন করেন। দাস্যভাবে রোদন করিতে করিতে দুই প্রহর কাল গঙ্গা-ধারার ন্যায় অশ্রু বিসর্জন করিলেন। কখনও বা সার্ধসপ্তদণ্ডকাল হাস্যরসে বিভোর থাকিয়া প্রমত্ত থাকিলেন। কোন সময়ে বা তিনঘণ্টা-কাল শ্বাসরুদ্ধ হইয়া মুর্চ্ছিত থাকিলেন। কখনও বা দম্ভভরে নিজের ঐশ্বর্য প্রকাশ করিতে গিয়া হাস্যপূর্বক “আমি সেই বস্তু” বলিয়া চীৎকার করিলেন। ভগবান্ গৌরসুন্দর আপনাকে ভগবান্ বলিয়া লোককে জানাইলে সত্য হইতে চ্যুত হইতে হয় না। কিন্তু অসুরস্বভাব সম্পন্ন অপরাধী জীব “জীবমাত্রেই ভগবান্” প্রভৃতি প্রলপিত বাক্যের দ্বারা আত্মবিনাশ সাধন করিলে তাহাদের মঙ্গল হয় না।যদিও গৌরলীলায় কৃষ্ণ ভক্তভাব অঙ্গীকারপূর্বক জীবকূলকে তাহাদের সৌভাগ্য উদ্ঘাটিত করিয়া সেবকের লীলা দেখাইতেছেন, তথাপি তাহার মধ্যেও মায়াবাদী পাষণ্ডি অসুর-প্রকৃতি জনগণের মোহন-জন্য মায়াবাদীর ন্যায় বাক্য উচ্চারণ করিয়া তাহাদিগের মূঢ়তা-সম্পাদন করিতেছেন। গৌরহরি কোন সময়ে বলিতেছেন, —“আমাকে বৈকুণ্ঠ হইতে যিনি প্রপঞ্চে আনয়ন করিয়াছেন, সেই বৃদ্ধ আচার্য অদ্বৈত এখন আমাকে ফেলিয়া কোথায় চলিয়া গেলেন? তাঁহার ইচ্ছামতেই আমি প্রত্যেক গৃহে ভক্তিরস বিতরণ করিব।’ এইরূপ বলিতে বলিতে গৌরসুন্দর নিজের লম্বমান চাঁচর কেশদ্বারা স্বীয়-পদ-বন্ধনে নিযুক্ত হইলেন। কখনও বা ‘কৃষ্ণ’, ‘বাপ’, ‘সৌম্য’, ‘প্রিয়’ প্রভৃতি শব্দে উচ্চস্বরে সুদূরবর্তী কৃষ্ণের আহ্বান করিতে করিতে ক্রন্দন করিতে লাগিলেন। কখনও বা বাহ্যজ্ঞান-রহিত হইয়া অক্রুর যেরূপ ব্রজে আগমনপূর্বক কৃষ্ণকে লইবার জন্য বাক্যবিন্যাস করিয়াছিলেন, সেই অক্ররের ভাবে বিভাবিত হইয়া বলিতে লাগিলেন—
“হে নন্দ! রামকৃষ্ণকে লইয়া মথুরায় চল।
সেখানে গিয়া আমরা ধনুর্যজ্ঞ-মহোৎসব দর্শন করি।’
(ভাঃ ১০/৩৯,৪২ অঃ দ্রষ্টব্য)।
কখনও ভূমিতে পড়িয়া দণ্ডবৎপ্রণতি করিতে লাগিলেন। এরূপ নানাবিধ ভঙ্গীদর্শনে ভক্তগণ আনন্দমগ্ন হইলেন।