বণিক্ অধম মূর্খ যে করিলা পার।
ব্রহ্মাণ্ড পবিত্র হয় নাম লৈলে যাঁ’র ॥
নিত্য-কৃষ্ণদাস প্রপঞ্চে বর্ণধর্মে অবস্থিত হইয়া তৃতীয়স্তরে বিনিময়-বৃত্তিতে অবস্থান করেন। এতাদৃশ সামাজিকগণ বৈশ্য বা বণিক্-শব্দে কথিত হন। তাদৃশ বণিক্গণ তাঁহাদের বৃত্তি -পরিচালনা করিতে গিয়া কুসীদগ্রহণ, গোরক্ষণ, ভূমিকৰ্ষণ ও পণ্যদ্রব্যের ক্রয়বিক্রয়াদিতে কাল অতিপাত করেন। কৃষ্ণবিস্মৃতি কালে জীবের বণিক্বৃত্তিতেই রুচি হয় এবং তাদৃশী বাসনা ক্রমে তিনি বণিকের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। অন্যান্য সমাজ বণিকের মুখাপেক্ষী হইয়া তাহাদিগকে শ্রেষ্ঠী, আঢ্য, মহাজন প্রভৃতি মর্যাদা সূচক উপাধিতে বরণ করেন। উঁহারাও ঐ সকল উপাধি লাভ করিয়া আপনাদিগকে সম্মানিত মনে করেন। পণ্যদ্রব্যের মর্যাদাভেদে বণিকের শ্রেষ্ঠতা ও অবরতা নিরূপিত হয়। যাঁহারা মাদক দ্রব্যের ব্যবসায় করেন তাঁহারাও বণিক, কিন্তু অপরাপর পণ্যদ্রব্যের তারতম্যানুসারে উহাকে গর্হিত দ্রব্যের ব্যবসায়ি-বিচার উক্ত ব্যবসায়িগণ অবর-বৈশ্য-সংজ্ঞায় কথিত হন। কনক প্রভৃতির অভিনিবেশে মানবের হরিসেবাপ্রবৃত্তিরূপ আত্মধর্ম বিজড়িত (লুপ্ত) হওয়ায় কনক-ব্যবসায়ী নিতান্ত নিন্দিত হইয়া অবর-বৈশ্য-নামে অভিহিত হন। এরূপ কুলজাত ও প্রাক্তন সংস্কার-বিশিষ্ট বংশোদ্ভূত ব্যক্তিকেও তাঁহাদের জড়াভিনিবেশ হইতে মুক্ত করিয়া নিত্যানন্দপ্রভু আচার্যের পদবী প্রদান করিয়াছিলেন। বাহ্য পরিচয় তাৎকালিকমাত্র। সেই পরিচয় বিচ্ছিন্ন হইলে এবং অপর জড়পরিচয়দ্বারা আবৃত না হইলে জীবের স্বরূপ উদ্বুদ্ধ হয়। তিনি মুক্ত হইয়া হরিসেবায় ব্রতী হন।
জগতের বিচারে কেহ বা উচ্চ, কেহ বা মধ্যম, কেহ বা অধম বলিয়া সংজ্ঞিত হন। অভিজ্ঞজনের বিচারে কেহ পণ্ডিত, কেহ অনভিজ্ঞ, কেহ বা মূর্খ-নামে অভিহিত হন। এই সকল বাহ্য পরিচয় আগন্তুকরূপে নিত্যকৃষ্ণদাসের বুদ্ধিকে আবরণ করিয়া জড়ের সহিত সংশ্লিষ্ট করায় চেতনধর্মের বিলুপ্তিবশতঃ ভগবৎসেবারহিত সুপ্তচেতন আত্মা নিজের নিত্যপরিচয় বিস্মৃত হয়। শ্রীনিত্যানন্দপ্রভু স্বীয় উপদেশদ্বারা জীবের জড়াভিনিবেশ উন্মুক্ত করিয়া তাঁহাদের নিত্য কল্যাণ বিধান করেন। তৎকালে জীব আধ্যক্ষিক দর্শন বিমুক্ত হইয়া পারমার্থিক রাজ্যে ভ্রমণ করিতে থাকেন। যাহারা জড়বিচার-পর চেষ্টায় আপনাকে নিযুক্ত করে, তাহাদের দর্শনে মুক্তপুরুষগণের বাহ্য-পরিচয় ব্যাঘাত উৎপাদন করিয়া তাহাদিগকে কর্মবন্ধনে আবদ্ধ করে। অপারকৃপাময় নিত্যানন্দ-প্রভু বণিক্বৃত্তিযুক্ত ও বণিক্বংশোদ্ভূতজনগণের এবং মূর্খ ও লোক-নিন্দিত জনগণের মহা উপকার সাধন করিতে গিয়া সকলকেই জাগতিক বিচার হইতে অবসর দিয়াছিলেন। নিত্যানন্দপ্রভুর নাম শ্রবণ করিলে জগতের সকল লোকের পাপ পবৃত্তি প্রশমিত হইয়া পবিত্রতার উদয় হয়। বণিক, অধম, মূর্খ,—ইহারাও পবিত্র হইয়া ব্ৰহ্মজ্ঞ ও ভগবদ্ভক্ত হন। তখন তাঁহাদের পবিত্রতার প্রতি কেহই সন্দিগ্ধ হইতে পারেন না।অন্ত্য ৫ম পঃ দ্রষ্টব্য।