কৃষ্ণ-কীর্তনেই শ্রীচৈতন্যদেবের প্রীতি—
যদি আমা’ প্রতি স্নেহ থাকে সবাকার।
তবে কৃষ্ণব্যতিরিক্ত না গাইবে আর।
শব্দের রূঢ়িবৃত্তি বিদ্বদ্ ও অবিদ্বদ্ ভেদে বিপরীত ধর্ম প্রকাশ করে। এক শব্দ অপরের সহিত যে পার্থক্য স্থাপন করে, তাহাতে ভিন্নাংশ অবস্থিত। শব্দের যে বৃত্তিতে ভিন্নাংশ-প্রতিম-নানাত্ব একায়নবিশিষ্ট, উহাই শব্দের বিদ্বদ্ রূঢ়ি-বল। সুতরাং ‘কৃষ্ণ’ শব্দের বিদ্বদ্রূঢ়িত্বে কৃষ্ণব্যতীত অন্য কোন ভোগ্য-ভাব আরোপ করিতে হইবে না। আরোপ করিলেই জানা যাইবে যে, বহুত্ব আসিয়া অদ্বয়-জ্ঞানের ব্যাঘাত করিয়াছে; উহাই মায়াধীনতা। মায়া-মুক্ত পুরুষের শব্দের বিদ্বদ্রূঢ়িবৃত্তিতে উচ্চারিত কৃষ্ণনাম অব্যবসায়ী অনৈকায়ন-বহুশাখা-পদ্ধতিতে অবস্থিত বলিয়া বিচার যে ভেদ উৎপাদন করে, তাহা ভ্রমসঙ্কুল।তজ্জন্যই শ্রীগৌরসুন্দর গঙ্গাদাস পণ্ডিত ও নবদ্বীপের অপরা বিদ্যার আশ্রিত পাঠাৰ্থী ও পাঠাধ্যাপকগণকে পরবিদ্যার কথা জানাইতে গিয়া শিক্ষাষ্টকের প্রথম শ্লোক রচনা করিয়াছেন। দ্বিতীয় শ্লোকে উহারই বিস্তৃতি, তৃতীয় শ্লোকে উহারই সুষ্ঠ সেবার প্রণালী জগৎকে জানাইয়াছেন। জগৎ যে প্রণালীতে কৃষ্ণেতর বস্তু বাসনা করে, তাহার পরিত্যাগের বিধান চতুর্থ শ্লোকে; পঞ্চম শ্লোকে ভগবদৈশ্বর্যোপলব্ধি পরিত্যাগ করিয়া সর্বোত্তমানন্দ অদ্বয়-জ্ঞানের উপাসনা সূত্রে নিজের নিত্য সেবকাভিমানের সহিত শ্রীনামভজনের কথা; নামভজনে উন্নতি-ক্রমে কায়মনোবাক্যের চেষ্টা যষ্ঠ শ্লোকে এবং সপ্তম শ্লোকের নাম-নামীর অভেদ-বিচারে আপনদশা-লাভে শিক্ষার্থীর যোগ্যতা লাভ হয় এবং শিক্ষার্থী সম্ভোগ-বিচার পরিত্যাগপূর্বক নাম-ভজন করিতে করিতে হরিবৈমুখ্যলাভের দুঃসঙ্গ হইতে আত্মোন্ধার সাধন করিয়া সম্পূর্ণভাবে শরণাগতির সর্বলক্ষণে লক্ষিত হইয়া যাহাতে কৃষ্ণপ্রেমা সঞ্চয় করিতে পারেন, সেই অষ্ট শ্লোক দ্বারা যে শিক্ষকের কার্য করিয়াছেন, তদ্ব্যতীত কৃষ্ণের আংশিক পরিচয়ের কোন কথাতেই নিযুক্ত থাকিতে স্বীয় প্রেমাস্পদগণকে নিবারণ করিয়াছেন। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচন্দ্রের স্নেহবর্জিত জীবগণই কঠিন শুষ্ক হৃদয় হইয়া রসময় ভগবত্তাকে স্বকান্ত জ্ঞান করেন না। এই উপদেশ স্বয়ংরূপ কৃষ্ণব্যতীত অপর কেহই দিতে সাহস করেন না।