প্রভুর প্রসাদী মালা প্রদানপূর্বক সকলকে কৃষ্ণভজনের উপদেশ—
আপন গলার মালা সবাকারে দিয়া।
আজ্ঞা করে প্রভু সবে—“কৃষ্ণ গাও গিয়া।
নদিয়া-নগরে ‘শ্রীমায়াপুর’ পল্লীর সকল অধিবাসীকে স্বীয় বরণীয় প্রথারূপ মালিকা প্রদান করিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একটি ভার বা ‘কমিশন’ দিলেন।
সবাকারে—স্ত্রী পুরুষ-নির্বিশেষে, বর্ণাশ্রম-নির্বিশেষে, ধর্মাধর্ম-নির্বিশেষে। যিনি প্রভুর আজ্ঞা পালন করিবেন, তাঁহাকেই কৃষ্ণগানের অধিকারী করিলেন। কপটতা-বশে যিনি ভগবদাজ্ঞা পালন না করিয়া যোষিৎসঙ্গ করিবেন ও কৃষ্ণসেবা করিবেন না, তিনি মহাপ্রভুর আজ্ঞা-বাহক ভৃত্য হইতে পারিবেন না। কেবল তাঁহার গলদেশেই শ্রীগৌরসুন্দরের মালিকা থাকিতে পারিবে না। বর্তমানকালে শ্রীধাম মায়াপুরে শ্রীচৈতন্যমঠে কৃষ্ণগানকারিগণের গলদেশে শ্রীচৈতন্যচন্দ্রের মালিকা নিহিত হইয়াছে, তাঁহারাই কৃষ্ণগান করিবেন। বর্তমানকালে শ্রীভাগবত –জনানন্দ ব্রহ্মচারী মহাশয় তাঁহার নির্যাণকালের পক্ষকালপূর্বেও মাসাধিক কাল পূর্বে সুস্থশরীরে অবস্থানকালে যে ভবিষ্যদ্বাণী লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, তাহা ‘গৌড়ীয়’ নামক পত্রে প্রকাশিত হইয়াছিল। শ্রীধাম মায়াপুরে শ্রীচৈতন্যমঠে শ্রীগৌরসুন্দরের গলদেশের মালিকা সকলকেই প্রদান করা হয়। শ্রীচৈতন্যদাসগণই কৃষ্ণগান করিতে পারেন; যেহেতু তাঁহারা শ্রীগৌরসুন্দরের শিক্ষা ও আজ্ঞা পালন করেন এবং ‘শিক্ষাষ্টকে’ই তাঁহারা দীক্ষিত ও শ্রীরূপ পাদের ‘উপদেশামৃতে’ই তাঁহারা পালিত। পরাবিদ্যাপীঠে গৌরবিহিত কৃষ্ণসঙ্কীর্তন হইয়া থাকে। শ্রীব্রহ্মসংহিতার শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভে শ্রীরূপানুগ শ্রীজীবগোস্বামিপ্রভু বিস্তৃতভাবে কৃষ্ণকথা নিরূপণ করিয়াছেন, আর শ্রীব্রহ্মসংহিতার টীকায় তিনি কৃষ্ণকথা পুনরায় আলোচনা করিয়াছেন॥
শ্রীমদ্ভাগবতে কৃষ্ণের পুরুষাবতারসমূহ অংশ কলা শ্রেণীতে নির্দিষ্ট হইয়াছেন। কৃষ্ণ—স্বয়ং ভগবান্; মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, দাশরথি ও রৌহিণেয় রাম, বুদ্ধ ও কল্কি প্রভৃতি নৈমিত্তিক অবতার-সমূহ কারণার্ণবশায়ী, গর্ভোদকশায়ী ও ক্ষীরোদকশায়ী প্রভৃতি পুরুষাবতার সমূহ চতুর্ব্যূহ প্রকাশ ও পরব্যোমস্থ প্রকাশসমূহ স্বয়ংরূপ কৃষ্ণেরই অংশ কলা বৈভবাবতার, মন্বন্তরাবতার ও যুগাবতারসমূহ কালধারায় নিমিত্ত এবং ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্ট্যাদির নিমিত্ত গুণাবতারসমূহ। আবেশাবতারসমূহ —তদেকাত্মবিচারে ভগবানের বিভিন্ন অবতার; জীবকোটিতে ও গুণকোটিতে আংশিক বিভিন্ন চিদ্চিৎ-শক্তির পরিণতিক্রমে যত প্রকার বৈকুণ্ঠ হইতে ব্রহ্মাণ্ডে অবতরণ, সকল অবতারেরই আদি মূল পুরুষ স্বয়ংরূপ কৃষ্ণ।
শ্রীকৃষ্ণ—অখিলরসামৃতমূর্তি; কৃষ্ণ-সচ্চিদানন্দবিগ্রহ, কৃষ্ণ কালের জনক, রক্ষক ও বিনাশক। কৃষ্ণের প্রকাশ-বিগ্রহের অংশ—পুরুষাবতার; তাহার উপাদানাংশ—মায়া, সেই উপাদানাংশের অংশ—গুণত্রয়; সেই গুণত্রয়ের ক্ষুদ্রাংশ হইতেই বিশ্বোৎপত্তি প্রভৃতি; নারায়ণাদি পরতত্ত্বের বিচার—তাঁহারই অঙ্গবিশেষের পরিচায়ক বস্তু। তিনি আনন্দ-সত্তা এবং পূর্ণজ্ঞানময়। তিনি যামুনচারী, গোষ্ঠে অবস্থিত, গোপালক ও গোপ-পালক, মৃত্যু তাঁহাকে ভয় করে। তিনি স্বপ্ৰকাশ ও পরপ্রকাশক, তিনি পরম প্রেমাস্পদ। তাঁহার দেহ-দেহি-ভেদ নাই। তিনি ভিন্ন ভিন্ন দ্রষ্টার নিকট ভিন্ন ভিন্ন অধিষ্ঠানযুক্ত। তিনি মহেন্দ্র। গোলোকের ‘গো’ হইতে যজ্ঞসমূহের প্রবৃত্তি ‘গা’ হইতে দেবগণের প্রাকট্য, ‘গো’ হইতেই সষড়্ ঙ্গপদক্রমবেদসমূহ উদ্ভূত। তিনি সেই গোলোকপতি গোবিন্দ। তিনি সকল কারণের কারণরূপ পরমেশ্বর, কার্য-কারণের অধিপতি, নিত্যমুক্ত গোপীগণের বল্লভ। তিনি স্বয়ংরূপ; তাঁহার নাম ও তিনি পৃথক্ নহেন।