সন্ন্যাসীরে সর্ব লোক করে নমস্কার।
সন্ন্যাসীরে কেহ আর না করে প্রহার।
ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ ও বানপ্রস্থ—এই ত্রিবিধ আশ্রমস্থিত ব্যক্তিগণ নিজ নিজ উদ্দেশ্য-সাধনে পরস্পর বিরোধ-ধর্ম পোষণ করে। সম্যগ্রূপে সকল ত্যাগ করার নাম——সন্ন্যাস। কর্মফল ত্যাগ করিলে ‘কর্মসন্ন্যাস’, যাবতীয় জাগতিক জ্ঞান পরিহার করিলে জ্ঞানসন্ন্যাস এবং যাবতীয় বস্তুর সেবা-গ্রহণ প্রবৃত্তি ত্যাগ করিয়া ভগবৎসেবোন্মুখ হইলেই ভক্তিপথে সন্ন্যাস সিদ্ধ হয়। ধর্ম, অর্থ ও কাম কর্মসন্ন্যাসীর প্রাপ্য, মোক্ষ—জ্ঞানসন্ন্যাসীর এবং কৃষ্ণপ্রেমা ভক্তসন্ন্যাসীর প্রাপ্য। সন্ন্যাস গ্রহণ করিলে কাহারও কিছু ব্যাঘাত হয় না; যেহেতু সন্ন্যাসীর প্রার্থনীয় কোন বস্তু অপরের লোভনীয় নহে। সন্ন্যাসীকে কেহ আক্রমণ করে না। সন্ন্যাসীকে ‘ভিক্ষুক’ জানিয়া সকলে দয়ার পাত্র জ্ঞান করে।
কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ যে সময়ে ব্রজমণ্ডলে বহুব্যক্তির বিরাগের পাত্র হইয়াছিলেন এবং বহু মাম্লা-মোকদ্দমায় জড়িত হইয়াছিলেন, সে সময়ে তিনি অনুরাগ-পথে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তাহাতে ব্রজবাসি-সকল তাঁহার প্রতি আক্রমণ পরিত্যাগ করিয়াছিল। কিন্তু শ্রীবিশ্ববৈষ্ণব-রাজ-সভার ত্রিদণ্ডি সন্ন্যাসিগণের বিরুদ্ধে অনেক অনভিজ্ঞ ব্যক্তি ভক্তিপথে সন্ন্যাসের তাৎপর্য গ্রহণ করিতে না পারিয়া আক্রমণ করিয়াছে। যাহারা আক্রমণ করে, তাহাদিগকে দোষ দিবার কিছুই নাই, পরন্তু তাহাদের মূর্খতা ও অর্বাচীনতাই উক্ত দোষের বিষয়।
শ্রীগৌরসুন্দরের প্রকট-কালে কলিধর্ম অত্যন্ত প্রবল না হওয়ায় অনেকেই সন্ন্যাসীর প্রতি আক্রমণ করে নাই। কিন্তু চরিত্রহীন, নীতিবর্জিত, মৎসরস্বভাব জনগণ ত্রিদণ্ডিসন্ন্যাসিগণের বিরুদ্ধে সর্বদাই দৌরাত্ম্য করিয়াছে; এমন কি, বিশুদ্ধ হরিভজন, হরিধাম, বিশুদ্ধ বর্ণাশ্রমধর্মে অনুকূলভাবে জীবন যাপন সকল ব্যাপারেই তাহারা অতি মৎসরতা দেখাইয়া যতিদিগকে আক্রমণ করিয়াছে। মাদক দ্রব্য-সেবন ধর্মের অঙ্গ নহে বলায় কেহ কেহ ক্ষুব্ধ হন, দুশ্চরিত্রতা ধর্মাঙ্গ হইতে পারে না বলিলে ক্রুদ্ধ হন, জাল জুয়াচুরি করিয়া অর্থোপার্জন অপেক্ষা কেবল সৎপথেও নিজের জন্য অর্থোপার্জন করা উচিত নয় বলিলে কেহ কেহ ক্রুদ্ধ হন, কপটতা ধর্মের অঙ্গ নহে বলিলেও কাহারও অসন্তোষের কারণ হয়। জাগতিক উন্নতি-সাধন প্রভৃতি প্রয়োজনীয় বিষয় নহে, মৎসর হওয়া কর্তব্য নহে, নিরপেক্ষভাবে ধর্মের আলোচনা কর্তব্য—এই সকল কথায় মৎসরস্বভাব, ‘ধার্মিক’নামে পরিচয়াকাঙ্ক্ষী জনগণের ঈর্ষা বৃদ্ধি হয়। তাহারাও ধার্মিক সজ্জায় ধার্মিকগণকে তাহাদের ন্যায় অধার্মিক মনে করিয়া বিবাদ করে এবং অপরকে অবৈধভাবে কলহের জন্য উত্তেজিত করে। যাহারা আত্মসংযম করিতে পারে নাই, এরূপ ব্যক্তি ধার্মিক খ্যাতির প্রলোভনে প্রলুব্ধ হইয়া ভণ্ডামি করিবার জন্য উক্তসজ্জায় ভগবান্ তাঁহার ধাম, ভগবদ্ভক্তির যাবতীয় অনুষ্ঠানকে ধ্বংসের চেষ্টা করিয়া বহুদেবতা-বাদের ছলনায় নানা দুর্নীতিকে ধর্ম বলিয়া চালাইতে গিয়া বিরোধি ভাব-প্রচার-সমূহকেই ‘ধর্মপ্রচার’ প্রভৃতি বলিয়া থাকে। ত্রিদণ্ডিগণ উহাদের কোন কথায় ভ্রুক্ষেপ না করিয়া অপরাধশূন্য হইয়া শ্রীনাম-সেবা, বিষয়বিতৃষ্ণ হইয়া শ্রীধামসেবা এবং ইন্দ্রিয়-তর্পণ পরিত্যাগ করিয়া কামদেব-সেবায় কৃষ্ণপ্রেমান্বেষী হন। ধর্মধ্বজিগণ ধর্মযাজনের নামে ‘অর্থসংগ্রহ’ সভা সমিতিতে ধর্মের বক্তৃতার নামেগলাবাজি, শাস্ত্রব্যাখ্যা ও পাঠাদির নামে জীবিকা-অৰ্জনাদি অনুষ্ঠানের ভোগা দিয়া সাধারণের সহানুভূতি লাভে যত্ন করে। এই সকল মৎসরস্বভাব জনগণ যেদিন প্রকৃতপ্রস্তাবে হরিবৈমুখ্যরূপ আত্মম্ভরিতা হইতে পৃথক্ হইতে পারিবে, সেইদিন তাহারা ভক্তিপথের যতিগণকে আদর করিতে শিখিবে এবং দেখিবে যে, তাহাদের ন্যায় নিজেন্দ্রিয় তৎপরতা ও সম্ভোগবুদ্ধি শ্রীবিশ্ব-বৈষ্ণব-রাজসভার কোনসভ্যই আবাহন করে না। তাঁহারা বিশুদ্ধভাবে চৈতন্যচন্দ্রের অনুগমন করিয়া থাকেন। জীবমাত্রেরই ভগবদ্ভক্তিলাভে মঙ্গল হইবে। তজ্জন্যই তাঁহাদের যাবতীয় বিষয়ের ভোগোন্মুখী প্রবৃত্তিকে সেবোন্মুখী প্রবৃত্তিতে পরিণত করাই স্বভাব। শ্রীবিশ্ববৈষ্ণব-রাজসভার প্রচারকগণ অর্থসংগ্রহ বা জনসংগ্রহ দ্বারা উহা নিজের কার্যে লাগান না, কৃষ্ণ বা কৃষ্ণভক্তের সেবায়ই সমস্ত নিয়োগ করেন। বিষ্ণুভক্তিতে দীক্ষিত না হইলে এই সকল কথা বুঝা যায় না।