কোন কালে এ শিশুর ভাগ্য পাই যবে।
‘কৃতার্থ’ করিয়া আপনারে মানি তবে॥
তথ্য। “শোকশাতন’—প্রদোষ-সময়ে, শ্রীবাসঅঙ্গনে, সঙ্গোপনে গোরামণি। শ্রীহরি-কীর্তনে, নাচে নানারঙ্গে, উঠিল মঙ্গল ধ্বনি॥১॥ মৃদঙ্গ মাদল, বাজে করতাল, মাঝে মাঝে জয়তুর। প্রভুর নটন, দেখি’ সকলের, হইল সন্তাপ দূর॥২॥ অখণ্ড প্রেমেতে, মাতল তখন, সকল ভকতগণ। আপনা পাসরি’, গোরাচাঁদে ঘেরি’, নাচে গায় অনুক্ষণ॥৩॥ এমত সময়ে, দৈব ব্যাধিযোগে, শ্রীবাসের অন্তঃপুরে। তনয়বিয়োগে, নারীগণ শোকে, প্রকাশল উচ্চৈঃস্বরে॥৪॥ ক্রন্দন উঠিলে, হ’বে রসভঙ্গ, ভকতিবিনোদ ডরে। শ্রীবাস অমনি বুঝিল কারণ, পশিল আপন ঘরে॥৫॥ প্রবেশিয়া অন্তঃপুরে, নারীগণ শান্ত করে, শ্রীবাস অমিয় উপদেশে। শুন পাগলিনীগণ, শোক কর অকারণ, কিবা দুঃখ থাকে কৃষ্ণাবেশে॥৬॥ কৃষ্ণ নিত্য সুত যা’র শোক কভু নাহি তার, অনিত্যে আসক্তি সর্বনাশ। আসিয়াছ এ সংসারে ‘কৃষ্ণ’ ভজিবার তরে, নিত্য-তত্ত্বে করহ বিলাস॥৭॥ এ দেহে যাবৎ স্থিতি, কর, কৃষ্ণচন্দ্রেরতি, কৃষ্ণেজান, ধন, জন, প্রাণ। এ-দেহ অনুগ যত, ভাই-বন্ধু-পতি-সুত’ অনিত্য সম্বন্ধ বলি’ মান’॥৮॥ কে বা কার পতি সুত, অনিত্য-সম্বন্ধ কৃত, চাহিলে রাখিতে নারে তারে। করম-বিপাক-ফলে, সুত’ হ’য়ে বসে কোলে, কর্মক্ষয়ে আর রৈতে নারে॥৯॥ ইথে সুখ দুঃখে মানি’ অধোগতি লভে প্রাণী, কৃষ্ণপদ হৈতে পড়ে দুরে। শোক সম্বরিয়া এবে, নামানন্দে মজ’ সবে’ ভকতিবিনোদ-বাঞ্ছা পূরে॥১০॥ ধন, জন, দেহ, গেহ, কৃষ্ণে সমর্পণ। করিয়াছ শুদ্ধচিত্তে করহ স্মরণ॥১১॥ তবে কেন মম সুত বলি’ কর দুঃখ। কৃষ্ণ নিল নিজ-জন তাহে তা’র সুখ॥১২॥ কৃষ্ণ-ইচ্ছা মতে সব ঘটয় ঘটনা। তাহে সুখ-দুঃখ জ্ঞান অবিদ্যা-কল্পনা॥১৩॥ যাহা ইচ্ছা করে কৃষ্ণ তাই জান ভাল; ত্যজিয়া আপন ইচ্ছা ঘুচাও জঞ্জাল॥১৪॥ দেয় কৃষ, নেয়। কৃষ্ণ, পালে কৃষ্ণ সবে। রাখে কৃষ্ণ, মারে কৃষ্ণ, ইচ্ছা করে যাবে॥১৫॥ কৃষ্ণ-ইচছা-বিপরীত যে করে বাসনা। তা’র ইচ্ছা নাহি ফলে সে পায় যাতনা॥১৬॥ ত্যজিয়া সকল শোক শুন ‘কৃষ্ণ’-নাম। পরম আনন্দ পাবে পূর্ণ হবে কাম॥১৭॥ ভকতি-বিনোদ মাগে শ্রীবাস-চরণে। আত্মনিবেদন-শক্তি জীবনে মরণে॥১৮॥ সবু মেলি’ বালক-ভাগ বিচারি’। ছোড়বি মোহ শোক চিত্তবিকারী॥১৯ চৌদ্দ-ভুবন-পতি নন্দকুমারা। শচীনন্দন ভেল নদীয়া-অবতারা॥২০॥ সোহি গোকুলচাঁদ অঙ্গনে মোর। নাচই ভক্ত-সহ আনন্দ-বিভোর॥২১॥ শুনত নাম গান বালক মোর। ছোড়ল দেহ’ হরি-প্রীতি বিভোর॥২২॥ ঐছন ভাগ যব ভই হামারা। তবহুঁ হঁউ ভর-সাগর-পারা॥২৩॥ তুঁহু সবু বিছরি এহি বিচারা। কাঁহে করবি শোক চিত্তবিকারা।২৪॥ স্থির নাহি হওবি যদি উপদেশে। বঞ্চিত হওবি রসে অবশেষে॥২৫॥ পশিবুঁ হাম সুরতটিনী মাহে। ভকতিবিনোদ প্রমাদ দেখে তাহে॥২৬॥ শ্রীবাস-বচন, শ্রবণ করিয়া, সাধ্বী পতিব্রতাগণ। শোক পরিহরি’, মৃত শিশু রাখি’, হরি-রসে দিল মন॥২৭॥ শ্রীবাস তখন, আনন্দে মাতিয়া, অঙ্গলে আইল পুনঃ। নাচে গোরা সনে, সকল পাসরি,’ গায় নন্দসুত-গুণ ॥২৮॥ চারি দণ্ড রাত্রে, মরিল কুমার অঙ্গনে কেহ না জানে। শ্রীনাম মঙ্গলে, তৃতীয় প্রহর, রজনী অতীত গানে॥২৯॥ কীর্তন ভাঙ্গিলে, কহে গৌরহরি, আজি কেন পাই দুঃখ। বুঝি, এই গৃহে, কিছু অমঙ্গল, ঘটিয়া হরিল সুখ॥৩০॥ তবে ভক্তগণ, নিবেদন করে, শ্রীবাস-শিশুর কথা। শুনি’ গোরা-রায়, বলে হায় হায়, মরমে পাইনু ব্যাথা॥৩১॥ কেন না কহিলে, আমারে তখন, বিপদ-সংবাদ সবে। ভকতিবিনোদ, ভকত বৎসল, স্নেহেতে মজিল তবে॥৩২॥ প্রভুর বচন, তখন শুনিয়া শ্রীবাস লোটাঞা ভূমি। বলে, শুন নাথ! তব রসভঙ্গ, সহিতে না পারি আমি॥৩৩॥ একটী তনয়, মরিয়াছে নাথ, তাহে মোর কিবা দুঃখ। যদি সব মরে, তোমারে হেরিয়া, তবু ত পাইব সুখ॥৩৪॥ তব নৃত্যভঙ্গ, হইলে আমার, মরণ হইত হরি। তাই কুসংবাদ, না দিল তোমারে, বিপদ্ আশঙ্কা করি’॥৩৫॥ এবে আজ্ঞা দেহ, মৃত সুত ল’য়ে, সৎকার করুন সবে। এতেক শুনিয়া, গোরাদ্বিজমণি, কাঁদিতে লাগিল তবে॥৩৬॥ কেমনে এ সবে, ছাড়িয়া যাইব, পরাণ বিকল হয়। সে কথা শুনিয়া, ভকতিবিনোদ, মনেতে পাইল ভয়॥৩৭॥ গোরাচাঁদের আজ্ঞা পেয়ে গৃহবাসিগণ। মৃত সুতে অঙ্গনেতে আনে ততক্ষণ॥৩৮॥ কলিমলহারী গোরা জিজ্ঞাসে’ তখন শ্রীবাসে ছাড়িয়া, শিশু’ যাও কি কারণ?৩৯॥ মৃত শিশুমখে জীব করে নিবেদন। লোক শিক্ষা লাগি’ প্রভু তব আচরণ॥৪০॥ তুমি ত’ পরম তত্ত্ব অনন্ত অদ্বয়। পরাশক্তি তোমার অভিন্ন-তত্ত্ব হয়।৪১॥ সেই পরা শক্তি ত্রিধা হইয়া প্রকাশ। তব ইচ্ছামত -করায় তোমার বিলাস॥৪২॥ চিচ্ছক্তিস্বরূপে নিত্যলীলা প্রকাশিয়া। তোমারে আনন্দ দেন হ্লাদিনী হইয়া॥৪৩॥ জীবশক্তি হঞা তব চিৎকিরণচয়ে। তটস্থ স্বভাবে জীবগণে প্রকটয়ে॥৪৪॥ মায়াশক্তি হ’য়ে করে প্রপঞ্চ-সৃজন। বহির্মুখ জীবে তাহে করয় বন্ধন॥৪৫॥ ভকতিবিনোদ বলে ‘অপরাধফলে। বহির্মুখ হ’য়ে আছি প্রপঞ্চ-কবলে॥৪৬॥ “পূর্ণচিদানন্দ তুমি, তোমার চিৎকণ আমি, স্বভাবতঃ আমি তুয়া দাস। পরম স্বতন্ত্র তুমি, তুয়া পরতন্ত্র আমি, তুয়া পদ ছাড়ি’ সর্বনাশ॥৪৭॥ স্বতন্ত্র হ’য়ে যখন, মায়া প্রতি কৈনু মন, স্ব স্বভাব ছাড়িল আমায়। প্রপঞ্চে মায়ার বন্ধে, পড়িনু কর্মের ধন্ধে, কর্মচক্রে আমারে ফেলায়॥৪৮॥ মায়া তব ইচ্ছামতে, বাঁধে মোরেএ জগতে, অদৃষ্ট নির্বন্ধ লৌহ করে। সেই’ত নির্বন্ধ মোরে, আনে শ্রীবাসের ঘরে, পুত্ররূপে মালিনী-জঠরে॥৪৯॥ সে নির্বন্ধ পুনরায়, মোরে এবে ল’য়ে যায়, আমি’ত থাকিতে নারি আর। তব ইচ্ছা সুপ্রবল, মোর ইচ্ছা সুদুর্বল, আমি জীব অকিঞ্চন ছার॥৫০॥ যথায় পাঠাও তুমি, অবশ্য যাইব আমি, কার কে বা পুত্র পতি পিতা। জড়ের সম্বন্ধ সব, তাহা নাহি সত্য সব, তুমি জীবের নিত্য পালয়িতা॥৫১॥ সংযোগে বিয়োগে যিনি, সুখ-দুঃখ মনে গণি, তব পদে ছাড়েন আশ্রয়। মায়ার গর্দভ হ’য়ে, মজেন সংসার ল’য়ে, ভক্তিবিনোদের সেই ভয়॥৫২॥ বাঁধিলমায়া, যেদিন হ’তে, অবিদ্যা-মোহ-ডোরে। অনেক জন্ম, লভিনু আমি, ফিরিনু মায়াঘোরে॥৫৩॥ দেবদানব, মানব-পশু, পতঙ্গকীট হ’য়ে। স্বর্গে-নরকে, ভূতলে ফিরি, অনিত্য আশা ল’য়ে॥৫৪॥ না জানি কি বা, সুকৃতি-বলে শ্রীবাসসুত হৈনু। নদীয়া-ধামে, চরণ তব, দরশ পরশ কৈনু॥৫৫॥ সকল বারে, মরণ-কালে, অনেক দুঃখ পাই। তুয়া প্রসঙ্গে, পরম সুখে, এবার চ’লে যাই॥৫৬॥ ইচ্ছায় তোর, জনম যদি, আবার হয়, হরি! চরণে তব, প্রেম-ভকতি, থাকে মিনতি করি॥৫৭॥ যখন শিশু, নীরব ভেল, দেখিয়া প্রভুর লীলা। শ্রীবাস-গোষ্ঠী ত্যজিয়া শোক, আনন্দ মগন ভেলা॥৫৮॥ গৌর-চরিত, অমৃতধারা, করিতে করিতে পান। ভক্তিবিনোদ শ্রীবাসে মাগে’, যায় যেন মোর প্রাণ॥৫৯॥ শ্রীবাসে কহেন প্রভু, তুঁহ মোহ দাস। তুয়া প্রীতে বাঁধা আমি জগতে প্রকাশ॥৬০॥ ভক্তগণ সেনাপতি শ্রীবাস পণ্ডিত । জগতে ঘুষুক আজি তোমার চরিত॥৬১॥ প্রপঞ্চ-কারা রক্ষিণী মায়ার বন্ধন। তোমার নাহিক কভু, দেখুক জগজ্জন॥৬২॥ ধন, জন, দেহ, গেহ আমারে অর্পিয়া। আমার সেবার সুখে আছ সুখী হঞা॥৬৩॥ মম লীলাপুষ্টি লাগি’ তোমার সংসার। শিখুক্ গৃহস্থ জন তোমার আচরণ॥৬৪॥ তব প্রেমে বদ্ধ আছি আমি, নিত্যানন্দ আমা দুঁহে সুত জানি’ ভুঞ্জহ আনন্দ॥৬৫॥ নিত্যতত্ত্ব সুত যাঁর অনিত্য তনয়ে। আসক্তি না করে সেই সৃজনে প্রলয়ে॥৬৬॥ ভক্তিতে তোমার ঋণী আমি চিরদিন। তব সাধুভাবে তুমি ক্ষম মোর ঋণ॥৬৭॥ শ্রীবাসের পায় ভক্তিবিনোদ কুজন। কাকুতি করিয়া মাগে গৌরাঙ্গ-চরণ। ॥৬৮॥ শ্রীবাসের প্রতি, চৈতন্যপ্রসাদ, দেখিয়া সকল জন। জয় শ্রীচৈতন্য, জয় নিত্যানন্দ, বলি’ নাচে ঘন ঘন। ॥৬৯॥ শ্রীবাস-মন্দিরে, কি ভাব উঠিল, তাহা কি বর্ণন হয়। ভাবযুদ্ধ-সনে, আনন্দ-ক্রন্দন, উঠে কৃষ্ণপ্রেমময়॥৭০॥ চারি ভাই পড়ি’ প্রভুর চরণে প্রেম গদগদ স্বরে কাঁদিয়া কাঁদিয়া, কাকুতি করিয়া, গড়ি’ যায় প্রেমভরে॥৭১॥ ওহে প্রাণেশ্বর এ হেন বিপদ, প্রতিদিন যেন হয়। যাহাতে তোমার চরণ-যুগলে আসক্তি বাড়িতে রয়॥৭২॥ বিপদ সম্পদে, সেই দিন ভাল, যে দিন তোমারে স্মরি॥ তোমার স্মরণ-রহিত যে দিন, সেদিন বিপদ হরি॥৭৩॥ শ্রীবাস-গোষ্ঠীর, চরণে পড়িয়া ভকতিবিনোদ ভনে। তোমাদের গোরা, কৃপা বিতরিয়া, দেখাও দুর্গত জনে॥৭৪॥ মৃত শিশু ল’য়ে তবে ভকত-বৎসল। ভকত-সঙ্গেতে গায় শ্রীনাম-মঙ্গল॥৭৫॥ গাইতে গাইতে গেলা জাহ্নবীর তীরে। বালকে সৎকার কৈল জাহীর নীরে॥৭৬॥ জাহ্নবী বলেন, মম সৌভাগ্য অপার॥ সফল হইল ব্রত ছিল যে আমার॥৭৭॥ মৃত শিশু দেন গোরা জাহ্নবীর জলে। উথলি জাহ্নবীদেবী শিশু লয় কোলে॥৭৮॥ উথলিয়া স্পর্শে গোরা-চরণকমল। শিশু কোলে প্রেমে দেবী হয় টলমল॥৭৯॥ জাহ্নবীর ভাব দেখি, যত ভক্তগণ। শ্রীনাম-মঙ্গল-ধ্বনি করে অনুক্ষণ॥৮০॥ স্বর্গ হৈতে দেবে করে পুষ্প-বরিষণ। বিমান সঙ্কুল তবে ছাইল গগন॥৮১॥ এইরূপে নানা ভাবে হইয়া মগন। সৎকার করিয়া স্নান কৈল সর্বজন॥৮২॥ পরম আনন্দে সবে গেল নিজ ঘরে। ভকতিবিনোদ মজে গোরা-ভাবভরে॥৮৩॥ (শ্রোতৃগণের প্রতি নিবেদন)—নদীয়া-নগরে গোরা-রচিত অমৃত। পিয়া, শোক ভয় ছাড়’, স্থির কর চিত॥৮৪॥ অনিত্য সংসার ভাই, কৃষ্ণ মাত্র সার। গালা-শিক্ষা-মতে কৃষ্ণ ভজ’ অনিবার॥ গোরার চরণ ধরি’। যেই ভাগ্যবান্॥৮৬॥ রাধাকৃষ্ণ—গোরাচাঁদ, ন’দে—বৃন্দাবন। এই মাত্র কর সার, পাবে নিত্য ধন॥৮৭॥ বিদ্যাবুদ্ধি হীন অকিঞ্চন ছার। কর্মজ্ঞানশূন্য আমি শূন্য-সদাচার॥৮৮॥ শ্রীগুরু-বৈষ্ণব মোরে দিলেন উপাধি। ভক্তিহীনে উপাধি হইল এবে ব্যাধি॥৮৯॥ যতন করিয়া সেই ব্যাধি নিবারণে। শরণ লইনু আমি বৈষ্ণব-চরণে॥৯০॥ বৈষ্ণবের পদরজ মস্তকে ধরিয়া। এ শোকশাতন গায় ভক্তিবিনোদিয়া॥৯১॥—(শ্রীগীতমালা)।