নিন্দক-সন্ন্যাসী বাটোয়ারে নাহি ভেদ।
দুইতে নিন্দক বড়—‘দ্রোহী’ কহে বেদ॥
আশ্রমচতুষ্টয়ে ব্রাহ্মণেরই অধিকার। ক্ষত্রিয়াদির বানপ্রস্থাধিকার। সন্ন্যাস—নরোত্তম ও ধীর ভেদে দ্বিবিধ। বৈদিক বিধি যে সন্ন্যাস গৃহীত হয়, তাহাকে ত্রিদন্ড- গ্রহণ বলে। বিধির অতীত পরমহংস আশ্রমের অনুকুলে একদণ্ড- সন্ন্যাসের ব্যবস্থায় ব্রাহ্মাণাচার শ্লথ হইয়া পড়ে। শুদ্ৰাচারে বৈদিক সংস্কার নাই। শূদ্ৰাচার-সম্পন্ন তপোবেশোজীবী যদি প্রতিগ্ৰহ করিবার বাসনায় ধাবিত হয়, তাহা হইলে উহা পুনরায় শুদ্ৰাচারে পরিণত হয়। ত্ৰিদণ্ড যাহাদের উপজীবিকা, তাহারা ‘ভণ্ড’ নামে শাস্ত্রে কথিত হইয়াছে। উহারা উত্তমাসন লাভ করিয়াও ধর্মের তাৎপর্য জানিতে না পারায় অধর্মকে ‘ধর্ম’ বলিয়া প্রচার করে। মায়াবাদী একদণ্ডিগণ শূদ্রাচার-সম্পনন্নহওয়ায় পরমহংসধর্ম হইতে বঞ্চিত হন। সেইকালে শূদ্রগণের যে প্রকার প্রতিগ্রহ নিষিদ্ধ, সে প্রকার প্রতিগ্রহ-বাসনায় ধাবিত হইলে তপোবেশোপজীবি মাত্র’ বিচারে প্রতিষ্ঠিত হইতে হয়। ত্রিদণ্ডি সন্ন্যাসিগণের সংস্কার পূর্ণমাত্রায় অবস্থান করে। সে কালে তাঁহাদের আশ্রমে অবস্থান সম্পূর্ণরূপে বৈদিক অনুষ্ঠান বলিয়া গৃহীত হয়। সংস্কারবর্জিত শূদ্রাচারে প্রতিগ্রহ করা অধর্মানয়ন মাত্র। ব্রাহ্মণাদি বর্ণচতুষ্টয়াভিমান এবং ব্রহ্মচারী প্রভৃতি আশ্রমচতুষ্টয়াভিমানে যে সকল তপস্যা, পরিচ্ছদ এবং জীবিকা বর্তমান, ত্রিদণ্ডিবিষ্ণুসেবকগণের সেই প্রকার কোন অভিমান নাই। তাঁহারা আপনাদিগকে ব্রাহ্মণব্রুব ক্ষত্রিয়ব্রুব বৈশ্যব্রুব শূদ্রব্রুব সংজ্ঞায় অভিহিত করেন না। তাঁহারা বর্ণাতীত। তাঁহারা ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ, বানপ্রস্থ ও ভিক্ষু—এই আশ্রম-চতুষ্টয়ে প্রতিপাল্য সকলবিধি ভগবৎসেবনোদ্দেশে নিযুক্ত করায় ভোগময় জগতের তপস্যা, বেষ বা নিজ প্রাণধারণের উপজীবিকা প্রভৃতিতে আবদ্ধ নহেন। তাঁহারা শ্রীনারদ-পঞ্চরাত্রকথিত “আরাধিতো যদি হরিঃ” শ্লোক পাঠ করিয়াছেন, সুতরাং তপস্যার প্রতি নিয়মাগ্রহ’ প্রকাশ বা ‘নিয়ম-অগ্রহ’ প্রকাশ করিয়া হরি-আরাধনাতেই বৈমুখ্য প্রদর্শন করেন না। বাহ্য বেশের প্রতি তাঁহাদের কোন আদর নাই। গৃহস্থের বেশ তাঁহাদের সম্মানের লাঘব কল না। সন্ন্যাসীর বেশে তাঁহারা আপনাদিগকে উন্নত বলিয়া অভিমান করেন না, ব্রাহ্মাণাদি বর্ণ চতুষ্টয়ের জীবিকার ন্যায় তাঁহাদের নিজজীবন-ধারণের জন্য কোন চেষ্টাই নাই। তাঁহারা বিষ্ণুবৈষ্ণবসেবার জন্যই অর্জন করিয়া থাকেন। কিন্তু নিজ-সেবার জন্য ব্রাহ্মণাদির ন্যায় বৃত্তিজীবিমাত্র হন না। ব্রাহ্মণাচার বর্জিত হইয়া অপরের দান-গ্রহণ-দ্বারা নিজের জীবিকার্জনকে আধোগমনের হেতু জানিয়া কোন বিষ্ণুসেবক নিজ উদরের জন্য বা ভোগের জন্য কোন দ্রব্যের প্রতিগ্রহ করেন না। কিন্তু বৃত্তিজীবিগণ ত্রিদণ্ডকে আশ্রয় করিয়া নিজ ব্যবহারোপযোগী সকল বিষয় ভোগ করিতে করিতে রাবণাদির ন্যায় কপট তপোবেশোভিনিবেশ প্রদর্শন করেন। অতপস্বী অপেক্ষা তপস্বীর শ্রেষ্ঠতা
বেদশাস্ত্র ও লোকাচারে প্রসিদ্ধ আছে। কিন্তু তপস্যার ছলনায় বেশাদিগ্রহণে নিজেন্দ্রিয়-তর্পণপরতা জীবকে বর্ণধর্মে ও আশ্রমধর্মে প্রতিষ্ঠিত করাইয়া ভগবদ্বিমুখ করে। সুতরাং ‘উত্তমাসনে আরূঢ়’ অভিমানে অধর্মজ্ঞ জনগণ মায়াবাদ প্রচারমুখে যে সমস্ত ধর্মার্থকামমোক্ষের কথা বলিয়া থাকেন, উহা শূদ্রোচিত দানগ্রহণ-পিপাসা মাত্র এবং তপোবেশোপজীবীর গৃহীত কপটতা মাত্র। উহাই শূদ্রাচার এবং সেইরূপ শূদ্রাচারই কলিজনোচিত । ইহারাই গৌরসুন্দরের আনুগত্য পরিত্যাগ করিয়া বাটপাড়ের ন্যায় কার্য করে এবং শুদ্ধ গৌরভক্তগণকে আক্রমণ করিয়া নরকাভিযানে প্রবৃত্ত হয় । বাটপাড়গণ এইপ্রকার মায়াবাদী সন্ন্যাসী শূদ্রগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । কলিযুগে বিবাদ-ধর্ম আশ্রয় করিয়া আপনাদিগকে শূদ্রেতরজ্ঞানে যে তপোবেশোপজীবিকার আশ্রয়ে ‘ধর্মোপদেশক’ বলিয়া কপটাভিমান, ঐগুলি কলির প্রচণ্ডনৃত্য মাত্র । তজ্জন্য শ্রীমদ্ভাগবত অন্তিম স্কন্ধে এই ঘৃণ্য আচারের উল্লেখ করিয়াছেন । শ্রীমদ্ভাগবত-কথিত (৭ম স্কন্ধ ১৩শ অঃ ৩২ শ্লোকের) বিচার উল্লঙ্ঘন করিয়া যে-সকল বর্ণব্রুবাভিমানিজন বিপথগামী হন, তাঁহাদিগের উদ্দেশেই এই শ্লোকের অবতারণা।