কমলা, পার্বতী, দয়া, মহা-নারায়ণী।
আপনে হইলা প্রভু জগতজননী॥”
ভগবদ্বস্তু বিষয়বিগ্রহরূপে পুরুষোত্তম। সকলই তাঁহার পাল্য।আশ্রয়শক্তি সেবোন্মুখী হইয়া যে-কালে স্বীয় লীলাবৈচিত্র্য প্রদর্শন করেন, তখন জীবকে তাঁহার স্বরূপ উদ্বুদ্ধ করান। আর যেকালে তিনি আবরণী ও বিক্ষেপাত্মিকা বৃত্তিদ্বয় পরিচালন করিয়া জীব মোহন কাৰ্য্য সম্পাদন করেন এবং জীব বদ্ধভাবাপন্ন হইয়া উহাই পরম আদরের বস্তু বলিয়া বিচার করেন, তখন তিনি জীবের পূজ্য ভোগাধার হইয়া তাহার নশ্বর মঙ্গলপ্রদাত্রী হন।শ্রীচন্দ্রশেখর-ভবনে বিষয়-বিগ্রহের আশ্রয়োচিত মাতৃত্বপ্রকাশ লীলা সর্বভাবে অবস্থানের অযোগ্যতা-নিরাসকারী হইলেও উহাই বিষয়বিগ্রহ ভগবত্তার নিজ স্বরূপ নহে, ইহা দেখাইবার জন্য ভগবানের ভক্তভাবাঙ্গীকার। শক্তিমত্তত্ত্ব শ্রীগৌরলীলায় বিভিন্ন শক্তির অভিনয়ের আদর্শাভিমান প্রদর্শন করিয়াছেন বলিয়াই যে তাঁহাকে আশ্রয়জাতীয় বদ্ধজীবভোগ্য ব্যাপারবিশেষ মনে করা যাইবে, এরূপ নহে। জগতে জননীত্বের যে আদর্শ প্রকটিত হইয়াছে, উহাতে দেখা যায় যে, প্রসূত-সন্তান জননীর নিকট যে-কালে সেবা গ্রহণ করে, তৎকালে তাহার নিজ চেতনের অনুকূলভাবে চেষ্টা দেখাইতে অসামর্থ্য আছে।জননী দাসীর ন্যায় যে কালে পুত্রের সেবা করেন, পুত্র সেই সময়ে তাঁহার সেবা করিতে সম্পূর্ণ অসমর্থ।জননীর সেবা-গ্রহণ ব্যতীত জননীকে সেবা করা তৎকালে তাহার সম্ভাবনা নাই। সন্তানের জ্ঞানের প্রকৃষ্ট উদয়ে আপনার প্রভু হইবার বিচার-লোভ প্রবল হয়।তখনও তিনি বুঝিতে পারেন না যে, যে জননী তাঁহার প্রকটকালাবধি সেবা করিয়া আসিতেছেন, তাঁহার সেবা করিয়া ঋণমুক্ত হওয়া আবশ্যক।এরূপ বিচার প্রবলতা লাভ করিলে তাহার আর সংসার-ভোগে প্রবৃত্তি হয় না। কিন্তু ‘বিষ্ণু’-মায়া এরূপ শক্তিসম্পন্না যে, সকল জীবকে তিনি সেরূপ অধিকার দেন না। তিনি সর্বদাই প্রভু ও ভোগী, তাঁহার অনুগত শক্তিগণই তাঁহার সেবক-সেবিকা। ভগবদ্বস্তুকে যাঁহারা সেবক-সেবিকা তত্ত্বে পরিণত করিবার অভিপ্রায় করেন, তাঁহারা বিষ্ণুমায়া দ্বারা বিমোহিত হন। বিষ্ণু কখনও বদ্ধজীব-ভোগ্যা শক্তি হন না। তজ্জন্যই ভগবানের বহিরঙ্গা-শক্তিপরিণত জগৎকে ভোগ্যভূমি জ্ঞান করিতে গিয়া তটস্থ-শক্তিপরিণত জীব জগতের প্রভু হইয়া বসিয়াছেন ও শাক্তেয় মতবাদ স্থাপন করিয়া পরমার্থ-পথ হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়াছেন।জড়ভোগকেই যখন প্রয়োজন বোধ হয়, বদ্ধজীব।সেইকালে ভগবদ্বস্তুকে তাহার ইন্দ্রিয়ভোগ্য- সরবরাহকারিণী ব্যাপার বিশেষে স্থাপন করে। সুতরাং তন্নিমিত্ত ভোগরজ্জুতে বদ্ধ হইয়া পড়ে। গৌরসুন্দরের ভক্তভাবাঙ্গীকার-লীলায় যে জগজ্জননীর লীলা প্রদর্শন, তদ্দ্বারা শক্তিমদ্বিষ্ণুর সেবাই যে শাক্তেয় মতবাদীর উপাস্যা মূলা শক্তির একমাত্র বৃত্তি ইহাই প্রদর্শন। বিষুবস্তু কখনই শক্তি নহেন। শক্তি—সর্বদাই ভগবানের আশ্রিতা।সেবোন্মুখিনী শক্তি—শক্তি মত্তত্ত্বের পরমোপযোগিনী এবং বহিরঙ্গা মায়াশক্তি অন্তরঙ্গা শক্তির সহিত বিপরীতভাবে শক্তি পরিচালনা-কার্যের লীলা প্রদর্শন করেন,—ইহা পরিপুষ্ট করিবার জন্যই গৌরসুন্দরের এতাদৃশী লীলার প্রকাশ।