কৃষ্ণদাস্যের গুরুত্ব ও মহিমা এবং তৎসম্বন্ধে ভাষ্যকারগণের বিচার—
‘অল্প’ করি’ না মানিহ ‘দাস’ হেন নাম।
অল্প ভাগ্যে ‘দাস’ নাহি করে ভগবান্॥
মায়াবাদী অনভিজ্ঞ আধ্যাক্ষিকগণ মনে করে যে, ইহজগতে ‘প্রভু’ হওয়াই লোভনীয়।কেন না, দাসজীবনে আজ্ঞাবাহী কুক্কুরের ন্যায় সর্বতোভাবে ক্লিষ্ট হইতে হয়। সুতরাং তারতম্য-বিচারে দাস্য অপেক্ষা প্রভুত্বেরই আদর করা যাইবে। যাহদের বৈকুণ্ঠ ও মায়িক জগতের তারতম্য-বিবেক নাই—বৈশিষ্ট্যের বিচার নাই, তাহারাই সুকৃতিবর্জিত ভাগ্যহীন। ভগবদ্ভক্তের সহিত ইতর দেবগণের সাম্যবুদ্ধি, গো-গর্দভ পাদ-তাড়িত লোষ্ট্রখণ্ডের সহিত অর্চ্য বিষ্ণুর সমবুদ্ধি, মহান্ত গুরুদেবে ‘মরণশীল’ বিচার, বিষ্ণুনাম-মন্ত্রে ‘শব্দসামান্য বোধ’ বিষ্ণুভক্তে কুসাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতা-বোধ ও নির্বিশেষ ব্রহ্মবিচারে ইতর-সাম্যপ্রয়াস, বিষ্ণু-বৈষ্ণববের পদধৌত জলে ‘ইতর-জল’বোধ’ অবৈষ্ণবতার পরিমাণে বৈষ্ণবের শ্রেণীভেদ অর্থাৎ বর্ণাশ্রম-বিচারে, বয়োবিচারে, সৌন্দর্য বিচারে, ধনবিচারে বিষ্ণুভক্তে অগ্রাহ্য করিয়া জাতিভেদ, শ্রেণীভেদ প্রভৃতি মন্দভাগ্যজনগণকে প্রাপঞ্চিক অষ্টপাশে আবদ্ধ করে এবং ক্লেশষট্ক তাহাদিগকে জর্জরিত করে।ভোগ্যবস্তুর সহিত ভগবৎপ্রসাদের সাম্যবুদ্ধি জীবকে নরকে লইয়া যায়। এই শ্রেণীর ব্যক্তিগণ ভগবদ্দাস্য ও মায়িক বস্তুর দাস্যের সহিত সমতা স্থাপন করে।তাদৃশ নির্বিশেষ বিচার ভগবদ্দাস্যের নিত্যত্ব, কেবল-চেতনময়তা ও নিরবচ্ছিন্ন আনন্দময়ত্বের উপলব্ধি না করায়, ভগবদ্দাস্যই যে আত্মার একমাত্র বৃত্তি, তাদৃশ চিদ্বিলাসরহিত ও অচিদ্বিলাস-প্রমত্ত হইয়া সেই হতভাগ্যগণ ভগবান্ ও ভক্তের বৈশিষ্ট্য-দর্শনে অসামর্থ্যহেতু নির্বিশেষ কল্পনা করে।ভাগ্যহীন কর্মিকুল প্রাপঞ্চিক বিচার দ্বারা মায়া কর্তৃক আবৃত ও বিক্ষিপ্ত হয়।সুকৃতিসম্পন্ন জীবই ভজনশীল। সচ্চিদানন্দ বস্তুর সেবাই নিত্য জীবাত্মার —চিদ্বস্তুর—অংশ চিৎকণ জীবের নিত্যবৃত্তি, একথা বুঝিতে না পারিয়া দুস্কৃতিগণ ত্রিবিধ অহঙ্কারচালিত হওয়ায় মানবজন্মের নিস্ফলতার আবাহন করে। প্রকৃতিজাত বস্তুগুলি প্রাকৃত-রাজ্যের উচ্চাবচ-ভাবে অবস্থিত।এক বস্তু ‘প্রভু’ হইয়া অপরকে ‘দাস্যে’ নিযুক্ত করিলে তাদৃশ ভেদ জীবকে কষ্ট দেয়। হে মূঢ়, বেদের বিভিন্ন বিবদমান শাখিগণ, তোমরা নিজ নিজ শাখায় অবস্থিত হইয়া নিজের গুণ বর্ণনা ও অপরের দোষ-বর্ণনমুখে যে অদ্বয়জ্ঞান হইতে বিচ্যুত হইয়া বিষ্ণু হইতে পৃথক্ দেবসমূহ কল্পনা কর, বিষ্ণুদাস্যবর্জিত হইয়া বিষ্ণুকে প্রাকৃত-বস্তু-বিশেষ জ্ঞান কর, তাহা হইতে মুক্ত হইবার জন্য একায়ন-স্কন্ধের আশ্রয় গ্রহণ কর। একায়ন-স্কন্ধ বহুশাখী বৈদিকগণের মন্দভাগ্য অপসারিত করিয়াছেন। হে ক্ষীণপুণ্য জনগণ, তোমরা আধ্যক্ষিক-জ্ঞানে ভগবানের দাস বিস্মৃত হইও না; বিষ্ণুদাস্যে লোভই তোমাদের মঙ্গল উৎপাদন করিবে। ভাগ্যহীন জনগণ গুণদোষ দর্শন করিয়া অপরাধী হন।ভগবৎকৃপাক্রমে ভগবদ্দাসগণের গুণদোষদ্ভব গুণ বর্তমান না থাকায় তাঁহারা একায়ন-পদ্ধতিক্রমে ভগবানেরই ঐকান্তিকী সেবা করিয়া থাকেন। নিখিল সদ্গুণলিয় ভগবান্—বৈকুণ্ঠ বস্তু; সুতরাং আবরণের দ্বারা বা বিক্ষিপ্ত হইয়া বৈকুণ্ঠকে গুণ-দোষের অন্তর্ভুক্ত ব্যাপারবিশেষ মনে করিও না।অনন্ত-কল্যাণ-গুণৈকবারিধি শ্যামসুন্দর—বিভু চিদানন্দঘন এবং ভক্তের আরাধ্য ও প্রিয়বস্তু।সেই প্রিয়তম বস্তুর প্রিয় হইবার চেষ্টাকেই ‘দাস্য’ বলা হয়।মাদকদ্রব্য সেবী দম্ভভরে প্রাকৃত বস্তুর ভোক্তৃত্বাভিমানে যে অমঙ্গল বরণ করে, উহা ভজনীয়-বস্তুর দাস্যভাবের বিপরীত। এমন কি, অপ্যয়দীক্ষিত-গুরু শ্রীকণ্ঠ যে দাস্যমার্গের কথা বর্ণন করিয়া পুনরায় নির্বিশিষ্টভাবে পর্যবসিত করিয়াছেন, ঐরূপ হেয়তা বিষ্ণুভক্তে কখনই আরোপিত হইতে পারে না। বিষ্ণুর অভক্তসম্প্রদায়ে যে নির্বিশেষের অনুকরণে শৈব-বিশিষ্টাদ্বৈতবিচার ও দাস্যভাবের কথা বর্ণিত আছে, উহা মন্দভাগ্যের পরিচয় মাত্র।ভগবান্ যাঁহাকে স্বীয় সেবাধিকার প্রদান করেন, তাঁহাকে আর কোনদিন নির্বিশিষ্ট-বিচারপরতা গ্রাস করিতে সমর্থ হয় না।