বৈষ্ণবকে মূর্খ, দরিদ্র-জ্ঞানে অবজ্ঞাকারীর বিষ্ণুপূজা ভক্তজন-প্রিয় কৃষ্ণের অগ্রাহ্য—
দেখি’ মূর্খ দরিদ্র যে বৈষ্ণবেরে হাসে।
তার পূজা-বিত্ত কভু কৃষ্ণেরে না বাসে॥
শ্রীগৌরসুন্দর যে পরমোচ্চ রাগানুগ-বিচারধারা বিধিভক্তির চরম-ফলরূপে নিদের্শ করিয়াছেন, তাহাতে জানা যায় যে, অর্চন-পথের সকল ব্যবস্থা অতিক্রম করিয়াও অনুরাগপথের মহিমা ও মধুরিমা অবস্থিত। যাঁহারা আধ্যক্ষিকবিচারে আপনাদিগকে অত্যুন্নত মনে করিয়া বৈষ্ণবের প্রাকৃতত্ব-বিচারে আত্মবিনাশ করেন, সেইসকল বিষয়মদান্ধ জনগণ বহুপুত্র লাভ করিয়া, প্রচুর ধনবন্ত হইয়া, মর্যাদাসম্পন্ন বংশে জন্ম গ্রহণ করিয়া ‘বৈষ্ণবই যে একমাত্র গুরু’, তাহা বুঝিতে পারেন না। আচার্য-বংশে যে কৃত্রিম অর্চন ও দীক্ষাপ্রদান প্রভৃতি বংশোচিত ক্রিয়া প্রবর্তিত আছে, উহা মদান্ধতা মাত্র। তজ্জন্যই জাতিগোস্বামিবাদের বিচার সমূহ বৈষ্ণব নির্দেশ করিতে অসমর্থ হয়।পণ্ডিতকুল প্রচুর পরিমাণে স্বাধ্যায়নিরত হইয়া স্বাধ্যায়ফললব্ধ বৈষ্ণবকে অনভিজ্ঞ মূর্খ মনে করেন, অভাবগ্রস্ত দরিদ্র মাত্র জানেন এবং উপহাসের পাত্র মনে করিয়া থাকেন, কিন্তু তাদৃশ দাম্ভিকের পূজা এবং পূজোপকরণ কৃষ্ণ কখনই স্বীকার করেন না। দরিদ্র বৈষ্ণবের সব সমৰ্পণ—প্রাপঞ্চিক ইতর-বস্তু-সমূহে লোভহীনতার পরিচায়ক, সুতরাং ঐকান্তিক বৈষ্ণবতা না হওয়া পর্যন্ত কৃষের তুষ্টি হইতে পারে না। “যেষং স এব ভগবান্” শ্লোক এবং “যস্যাহং অনুগৃহ্নামি” শ্লোক এতৎপ্রসঙ্গে আলোচ্য। স্বপ্নকালীয় প্রতীতির ন্যায় বস্তু-লাভ-প্রতীতির অকিঞ্চিৎকরতা, প্রপঞ্চাবস্থিত জাগর-কালের বিচারের নশ্বর-বস্তু-লাভের অকিঞ্চিৎকরতা বৈষ্ণব সর্বক্ষণ বিচার করেন। সুতরাং প্রাকৃত সাহজিকের ন্যায় ভোগিকূল হইতে তিনি সর্বদা বহুদূরে অবস্থিত। কিন্তু পুণ্ডরীক বিদ্যানিধি, রায় রামানন্দ-প্রমুখ ভক্তাধিরাজগণের সম্পত্তিদর্শনে যে বিষয়-চেষ্টার প্রাপঞ্চিকতা আধ্যক্ষিকের নয়নপথে পতিত হয়, উহা তাহাদের বিড়ম্বনা-বৃদ্ধির জন্য। যেহেতু তাহারা বিষয় মদান্ধ। কষ্ণই একমাত্র বিষয়, তদ্ব্যতীত অন্য কোন বিষয় নাই, এরূপ প্রতীতি বিষ্ণুভক্তের একমাত্র লোভনীয় বস্তু। এই লোভের বশবর্তী হইয়া কৃষ্ণ-রূপ-গুণ-পরিকর-বৈশিষ্ট্য লীলাদিতে যাঁহাদের উৎসাহ, তাঁহারাই প্রকৃত প্রস্তাবে প্রাক্তন শত শত জন্মে বাসুদেবের অর্চনপূর্বক নিজমঙ্গল-লাভ করিয়া ও নামাশ্রিত হইয়া অনুরাগ-পথে স্বীয় আদর্শ ভজন-প্রণালী প্রদর্শন করিবার সুযোগ লাভ করেন।