তোমা-সবা লাগিয়া কৃষ্ণের অবতার।
হেন কৃষ্ণ ভজ, সব ছাড় অনাচার॥”
স্বয়ংরূপ কৃষ্ণ পার্ষদ ‘অকৃষ্ট’গণ-সহ যে নিত্যলীলা ব্রজেপ্রকট করেন, ‘তাহাজীবের মন্দভাগ্য-নিরসনের জন্য; সুতরাং কৃষ্ণভজন ব্যতীত ইতরসেবা-সমূহ করিতে যাওয়া আচারহীনতা মাত্র। অতএব কৃষ্ণসম্বন্ধজ্ঞানে আপনাকে ‘আকষ্ট’ জানিয়া তোমাদের আত্মার নিত্যবৃত্তি উন্মেষিত কর। জীবের স্বরূপোপলব্ধি হইলে পথিক সেবাবিমুখিনী আচারহীনতা আর থাকিতে পারে না, সেইকালে কৃষ্ণভজনের প্রবৃত্তি প্রবলা হয়। নিরপেক্ষ কৃষ্ণের তটস্থাশক্তি জীব মুক্তাবস্থায় কিঞ্চিন্ন্যূন সৌভাগ্যবিশিষ্ট হইলে শ্রীরামচন্দ্রের ভজন করিয়া থাকে। শ্রীরামভজনে কৃষ্ণের প্রকৃতির অতীত সর্বশক্তিমত্তার সম্পূর্ণ প্রকাশের অবকাশ নাই। শ্রীরামচন্দ্রের আকর-মূলরূপ শ্রীবলদেবপ্রকাশতত্ত্বে যে অপ্রাকৃত রাম-লীলা বর্ণিত আছে, তাহা রঘুনন্দন রামে সেরূপভাবে নাই। দণ্ডকারণ্যবাসী ঋষিগণের চেষ্টা হইতেই দাসরথীর রাসলীলার অনুপযোগিতা নিরূপিত হইয়াছে। স্বয়ংরূপ শ্রীকৃষ্ণবিলাস এবং শ্রীবলদেবস্বয়ংপ্রকাশের বৈচিত্র্য গোলোক-বৃন্দাবনে প্রকটিত আছে। সেই লীলার সৌভাগ্য প্রখ্যাপনের জন্য স্বয়ংরূপ কৃষ্ণ অবতীর্ণ হইয়া শ্রীগৌরলীলা অবতারণ করিয়াছেন। এই অবতরণ-কার্যের মুখ্যত্ব-বিচারে ঔদার্যভাবের মাধুর্যবিগ্রহই শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রের অবতারণা। যে-সকল ব্যক্তি পাপপুণ্যাশ্রিত হইয়া প্রাপঞ্চিক ভূমিকায় অনিত্যোপলব্ধিতে অবস্থিত, তাহাদিগের জন্যই শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রের শ্রীরাধা-গোবিন্দমিলিত-তনু শ্রীগৌরাঙ্গের নিত্যরূপের অবতারণা। ভজনীয়বিগ্রহ কৃষ্ণচন্দ্র রসভেদে ভজনকারী কৃষ্ণের আশ্রয় বিগ্রহ-সমূহ সম্মিলিত-তনু শ্রীগৌরসুন্দর অবতীর্ণ হইয়া জগতের প্রাপঞ্চিক বিচাররূপ অনাচার ত্যাগ করিয়া কৃষ্ণভজনের সুযোগ প্রদান করিতেছেন। কৃষ্ণভজনের পারতম্য শ্রীগৌরাবতারের কৃষ্ণপ্রেমপ্রদান-লীলায় অভিব্যক্ত হইয়াছে। যে-সকল সৌভাগ্যবন্তজন শ্রীরাম-সীতা, শ্রীরাম বজ্রাঙ্গজী, শ্রীলক্ষ্মী-নারায়ণ, শ্রীবিষ্বক্সেন-গরুড়-নারায়ণ, শ্রীবাসুদেব-সঙ্কৰ্ষণ-প্রদ্যুম্নানিরুদ্ধ। ব্যূহচতুষ্টয়ের সেবায় নিরত থাকিবার নির্মলতা লাভ করিয়াছেন, তাঁহাদের সৌভাগ্যের পূর্ণতমত্বে ব্রজেন্দ্রনন্দনের সেবাই সর্বোত্তমা॥
এই ঔদার্য-প্রচারকারী কৃষ্ণচন্দ্র জগদ্গুরুরূপে পরম নির্মল জীবাত্মগণকে যে উপদেশ প্রদান করিতেছেন, তাহাতে দুঃসঙ্গ পরিত্যাগ পূর্বক ভগবদুপাসনার তারতম্য বিচারকারী, কৃষ্ণের তটস্থাশক্তি জীবের জন্যই স্বয়ংরূপ কৃষ্ণ অবতীর্ণ হইয়াছেন। জগদ্গুরু শ্রীনিত্যানন্দ এবং জগদ্গুরু ঠাকুর হরিদাস মহাপ্রভুর সাক্ষাৎ আজ্ঞা প্রাপ্ত হইয়া, জগদ্গুরুর প্রকাশবিশেষ হইয়া জগৎকে কৃষ্ণের ঔদার্যময় অবতারের কথা জানাইতেছে। ঔদার্যময় কৃষ্ণ মহামহোপদেশকরূপে সকল দুঃসঙ্গ পরিত্যাগ পূর্বক সর্বোত্তম বিচিত্র বিলাসসম্পন্ন পঞ্চরসাভিষিক্ত স্বয়ংরূপ বস্তুর উপাসনা শিক্ষা দিতেছেন। তোমরা দুঃসঙ্গ পরিত্যাগ করিয়া সেই সচ্চিদানন্দ বস্তুর সঙ্গলাভ কর এবং আপনাদিগকে তাহার পঞ্চরসের সেবোপকরণের অন্যতম জানিয়া সর্বকাল তাঁহারই ভজন কর। কামের পূর্ণাঙ্গতা দাম্পত্যে অবস্থিত, তন্ন্যূন বাৎসল্যে, তন্ন্যূন সখ্যে, তন্ন্যূন দাস্যে ও তন্ন্যূন শান্তে অবস্থিত। আর পরিত্যজনীয় প্রাপঞ্চিক বিপরীত অনুভূতি —অনাচারমধ্যে গণ্য। কৃষ্ণের প্রকাশবিগ্রহের বিলাসসমূহ কৃষ্ণ হইতে অভিন্ন। হইলেওদ্বাদশ-রসময়-মূর্তি কৃষ্ণই স্বয়ংরূপ, স্বয়ংগুণ, স্বয়ংপরিকরবৈশিষ্ট্য ও স্বয়ংলীলা। তাঁহারই প্রকাশতত্ত্ব শ্রীবলদেব-- প্রকাশরূপ, প্রকাশগুণ, প্রকাশপরিকরবৈশিষ্ট্য, প্রকাশলীলাময়। সুতরাং তাঁহাদের ভজনে কৃষ্ণভজনই হয়। তবে “যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে” বিচারে “তাংস্তথৈব ভজাম্যহং” স্বয়ংরূপ কৃষ্ণের উক্তিই বিচার্য। কাহারও বিচারে বাসুদেবাদি চতুর্ব্যূহাত্মক কৃষ্ণ, কাহারও বিচারে সীতারামাদি কৃষ্ণ, কাহারও বিচারে রেবতীরমণাদি কৃষ্ণের ভজন পরম আদরের। ঐগুলি কৃষ্ণভজন হইলেও “আমিই কৃষ্ণ, আমাকেই ভজন কর”—এই কথার তাৎপর্য যাঁহাদের উপলব্ধির বিষয় হয়, তাঁহারাই শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রের ঔদার্যময়ী মূর্তি শ্রীগৌরসুন্দরের দর্শনে যোগ্যতা লাভ করেন। ভাক্তাধিরাজ বিষ্ণুসকলের মূল আকর শ্রীবলদেব নিত্যানন্দ প্রভু এবং ভক্তাধিরাজ নামাচার্য আদিগুরু বিরিঞ্চি এই সকল কথা তারস্বরে ছন্নাবতারের প্রকটকালে আপনাদিগকে কৃষ্ণলীলার অভিন্নবিগ্রহ জানিয়া শিষ্টা সরস্বতীর প্রকাশপূর্বক ভাগ্যহীন জনগণের নিকট আবরণ করিতেছেন। কৃষ্ণ—রসময়; সুতরাং সকল রসের একমাত্র আশ্রয় বিগ্রহ বা সকল আশ্রিতের একমাত্র বিষয়বিগ্রহ। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ংরূপ বস্তু। রূপরহিত আংশিক পরমাত্মপ্রকাশমাত্র নহেন। রূপ-রহিত বৃহদবোধক পদার্থমাত্র নহেন। তিনি ব্রহ্মা-পরমাত্মাদি সর্ব কারণ-কারণ। স্বয়ংরূপ কৃষ্ণের পূর্ণতমতাই বলদেব, অংশই—কারণার্ণবশায়ী ভগবান্, কলাই—গর্ভোদকশায়ী ভগবান্, বিকলা-ক্ষীরোদকশায়ী ভগবান্। সকলই সেই স্বয়ংরূপ কৃষ্ণের বিষয়বিগ্রহ; আশ্রিত—বিষয়বিগ্রহের প্রকাশবিশেষ। সুতরাং কৃষ্ণ ও ‘আকৃষ্ট’ কৃষ্ণভক্তগণ প্রাপঞ্চিকদর্শনে খণ্ডিত ভাবযুক্ত বস্তুবিশেষ নহেন। সর্বসাকল্যে তিনিই পূর্ণ পুরুষ। সেই পূর্ণত্বের আংশিক প্রকাশ প্রাপঞ্চিক ব্যাপকতার আকর, যাহার অংশে অবস্থিত কলা-বিকলা। সেই কৃষ্ণভজন ব্যতীত আকৃষ্ট আত্মার আর অন্য কোন বৃত্তি নাই। আকৃষ্ট আত্মা যে সময়ে বিক্ষিপ্ত হইয়া বৈকুণ্ঠ হইতে মায়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, তখনই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্ট হয় এবং তটস্থাশক্তি পরিণতিক্রমে জৈবধর্মে জড়ভোগ আসিয়া তাহাকে কৃষ্ণবিমুখ করায়। কৃষ্ণবৈমুখ্য হইতেই বদ্ধজীবের ব্রহ্মা-পরমাত্মা প্রভৃতি আংশিক ধারণাসমূহ জীবকে উন্মত্ত করাইয়া ব্ৰহ্মপরমাত্মার আংশিক বিচারে জড়ভাবে নিজাবরণ করিয়া বসে। কৃষ্ণই সকল রসের আশ্রয় বলিয়া মূল প্রকাশবিগ্রহ বলদেবেও সর্বরসাশ্ৰয়ত্ব বিদ্যমান। সেই বলদেব প্রভু কৃষ্ণেরই ভজন করিয়া থাকেন। “যথা তরোমূলনিষেচনেন” বিচার গ্রহণ করিলেই কৃষ্ণভজনের পারতম্যবিয়ে কোন প্রকার অনাচার করিতে হয় না। তখন রসভেদে শ্রীচৈতন্যচরণ আশ্রয় করিয়া কেহ বা মধুর-রতির আশ্রয়বিগ্রহের আনুগত্য সুষ্ঠভাবে অবস্থিত হন, কেহ বা বাৎসল্য-রতির আশ্রয়বিগ্রহগণের আনুগত্যে স্বসৌভাগ্য প্রখ্যাপন করেন। সার্ধদ্বয়রসের আকৃষ্ট রসিকগণ গোলোক বৃন্দাবনীয় পূর্ণাধার হইতে গোলার্ধাধার বৈকুণ্ঠ সেবায় নিরত হন। তখনই তাঁহাদের ঔদার্য ন্যূনতা লাভ করিয়া ঐশ্বর্যমার্গে মর্যাদাবিশিষ্ট হয়। বদ্ধজীবের অনাচার ও মুক্ত ভগবদুপাসকের অনাচার সম্পূর্ণ পৃথক্। বৈকুণ্ঠে অনাচার–পূর্ণাচারের অভাব, ব্রহ্মাণ্ডের অনাচার-দুরাচার এবং সর্বতোভাবে
পরিত্যাজ্য। বদ্ধজীবের পক্ষে মহাবৈকুণ্ঠের শক্তি অপেক্ষা রাম-বৈকুণ্ঠের শক্তি অধিক বরণীয়। সেজন্য সীতারাম বা হনূমদ্রামোপাসকগণ যে রসের রসিক, সেই রস মহাবৈকুণ্ঠে বিষ্বক্সেন-নারায়ণ ও লক্ষ্মী-নারায়ণ হইতে নিরপেক্ষ বিচারে বৈশিষ্ট্য স্থাপন করে। শক্তিরহিত শক্তিমানের সবিশেষ বিচারে বাসুদেবাদি যে ব্যূহের উপাসনা, তাদৃশ উপাস্যতত্ত্ব ক্লীবব্রহ্মের জ্ঞানমাত্র হইতে শ্রেষ্ঠতা স্থাপন করে। জড়ের অবরতা আরোপ সেখানে সম্ভবপর নহে। উপাস্যবস্তু মায়ার অধীন নহেন। তিনি স্বতন্ত্রেচ্ছ এবং অবাধগতিবিশিষ্ট । সুতরাং কৃষ্ণভজন করিতে হইলে বাসুদেব কৃষ্ণ, লক্ষ্মী গোবিন্দ-কৃষ্ণ, সীতারাম-কৃষ্ণের উপাসনা উত্তরোত্তর সেবনোৎকর্ষক্রমে শ্রীরাধাগোবিন্দের উপাসনার সর্বোত্তমত্ব সেই রাধাকৃষ্ণমিলিত-তনু ঔদার্যবিগ্রহব্রজেন্দ্রনন্দন দেখাইতেছেন। এরূপ দয়া অপরিমিত ও অপরিসীম। সেজন্যই মহাপ্রভু স্বয়ংরূপ প্রকাশবিগ্রহের দ্বারা ও জগদ্বিধাতার দ্বারা সর্বত্র হরিসেবা-শিক্ষা দিতে আরম্ভ করিলেন।