“পাতকী তারিতে প্রভু কৈলা অবতার।
এমত পাতকী কোথা পাইবেন আর?॥
পাতক—‘পাতয়তি অধোগময়তি দুষ্ক্রিয়াকারিণম্’ ইতি। গৃহস্থাশ্রমীর ‘কাম’, ‘ক্রোধ’ ও ‘লোভ’ নামে তিনটি প্রধান রিপু আছে, মানবগণ এই সকল শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হইয়া পাপাচরণ করে। আচরিত পাপসকল ‘অতিপাতক’, ‘মহাপাতক’, ‘অনুপাতক’, ‘উপপাতক’, ‘জাতিভ্রংশকর’, ‘সঙ্করীকরণ’, ‘অপাত্ৰীকরণ’, ‘মলাবহ’ এবং ‘প্রকীর্ণক’ নামে অভিহিত।
মাতৃগমন কন্যাগমন এবং পুত্রবধূগমন—এই ত্রিবিধ পাপ ‘অতিপাতক’।
ব্রহ্মাহত্যা, সুরাপান, ব্রাহ্মণের সুবর্ণ-চুরি, ও গুরুপত্নীগমন--এই চতুর্বিধ এবং এইরূপ পাপীর সহিত বিশেষ সংসর্গই ‘মহাপাতক’।
অনুপাতক-পঁয়ত্রিশ প্রকার-—১) নীচজাতি হইয়া আপনাকে উচ্চজাতি বলিয়া পরিচয় দেওয়া। (২) যে দোষ প্রকাশ করিলে প্রাণদণ্ড হইতে পারে, রাজার নিকট তেমন দোষ বলা। (৩) গুরুজনের মিথ্যাদোষ রটনা করা—এই তিনটী ব্রহ্মহত্যার সমান। (১) বেদত্যাগ কিম্বা বেদ পড়িয়া ভুলিয়া যাওয়া॥ (২) বেদের নিন্দা করা। (৩) কুটিল কথা বলিয়া ফেরে ঘোরে সাক্ষী দেওয়া—(ইহা দুই প্রকার। এক,—কোন, বিষয় জানিয়া তাহা গোপন রাখা। আর একপ্রকার,—সত্য গোপন করিয়া মিথ্যা বলা)
(৪) বন্ধুর প্রাণ নষ্ট করা। (৫) বিষ্ঠাদিজাত দ্রব্য ভোজন করা। (৬) অখাদ্য দ্রব্য ভোজন করা। এই ছয় প্রকার অনুপাতক সুরাপানের সমান। (১) গচ্ছিত ধন ফাঁকি দিয়া লওয়া, (২) মানুষ চুরি করা, (৩) ঘোড়া চুরি করা, (৪) রূপা চুরি করা, (৫) ভূমি চুরি করা, (৬) হীরা চুরি করা, (৭) মণি চুরি করা, এই সাত প্রকার অনুপাতক সুবর্ণ হরণ করার সমান। (১) সহোদরা ভগিনী গমন, (২) কুমারী গমন (৩) নীচজাতির স্ত্রী গমন, (৪) বন্ধুর স্ত্রী গমন, (৫) ঔরসজাত পুত্র ভিন্ন অন্যপুত্রের স্ত্রী গমন (৬) পুত্রের অসবর্ণা স্ত্রী গমন, (৭) মাতৃষ্বসা গমন, (৮) পিতৃষ্বসা গমন, (৯) শ্বাশুড়ী গমন (১০) মাতুলানী গমন (১১) পুরোহিত স্ত্রী গমন, (১২) ভগিনী গমন, (১৩) আচার্যের স্ত্রী গমন, (১৪) শরণাগতা স্ত্রী গমন, (১৫) রাণী গমন, (১৬) যিনি গৃহাশ্রম পরিত্যাগ করিয়াছেন, এমন স্ত্রীগমন, (১৭) শ্রোত্রিয়-স্ত্রীগমন, (১৮) সাধ্বী স্ত্রী গমন এবং (১৯) উচ্চবর্ণের স্ত্রীর কাছে নীচ বর্ণের পুরুষের গমন—এই উনিশ প্রকার অনুপাতক গুরুপত্নী-হরণের তুল্য।
গোবধ, অযাজ্যযাজন, পরস্ত্রীগমন, আত্মবিক্রয়, পিতা, মাতা ও গুরুত্যাগ, স্বাধ্যায়ত্যাগ ও আলস্য দ্বারা অগ্নিত্যাগ, পুত্রত্যাগ অর্থাৎ পুত্রের জাতকর্ম-সংস্কার না করা, জ্যেষ্ঠ অবিবাহিত থাকিলে কনিষ্ঠের বিবাহ, এরূপ জ্যেষ্ঠ বা কনিষ্ঠকে কন্যাদান অথবা এইরূপ বিবাহে পৌরোহিত্য করা, অরজস্কা কন্যাদূষণ, বৃদ্ধি দ্বারা জীবিকা, ব্রহ্মচারীর স্ত্রী সম্ভোগাদি দ্বারা ব্রতচ্যুতি, তড়াগ, উদ্যান কিম্বা স্ত্রীপুত্রাদি বিক্রয় করা, ষোড়শ বর্ষ অতীত হইলেও উপনয়ন না হওয়া, পিতৃব্য প্রভৃতি বান্ধব ত্যাগ, বেতন লইয়া বেদাধ্যাপন, বেতনগ্রাহী অধ্যাপকের নিকট বেদ অধ্যয়ন, অবিক্রেয় বস্তুর বিক্রয়, রাজাজ্ঞায় সুবর্ণাদি-খনিতে কাজ বৃহৎ সেতু প্রভৃতিতে কাজ, ওষধি নষ্ট, ভার্যাদির উপ-পতি দ্বারা জীবিকানির্বাহ, শ্যেনাদি আভিচারিক যোগ বা মন্ত্র দ্বারা নিরপরাধীর অনিষ্ট করণ, জ্বালানি কাঠের জন্য অশুষ্ক বৃক্ষছেদন, দেবপিত্রাদির উদ্দেশ-ব্যতিরেকে নিজের জন্য পাক যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান, লশুনাদি নিন্দিত খাদ্যভোজন, অগ্ন্যাধ্যান না করা, সোণা ব্যতীত অন্য জিনিস চুরি, দেব, ঋষি ও পিতৃঋণ পরিশোধ না করা, অসৎশাস্ত্রের আলোচনা, গীতবাদ্যে আসক্তি, ধান, তাম্র ও লৌহদি ধাতু ও পশু চুরি, মদ্যপায়িনী স্ত্রীগমন, স্ত্রী, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্ৰহত্যা এবং নাস্তিকতা—এই সকল ‘উপপাতক’।
দণ্ডাদিদ্বারা ব্রাহ্মণকে ব্যথা দেওয়া, লশুনপুরীষাদি বস্তু ও মদ্য আঘ্রাণ করা, কুটিলতা, পশু মৈথুন এবং পুংমৈথুন—এই সকল পাপ ‘জাতিভ্রংশকর’। গ্রাম্য ও আরণ্য-পশু হিংসা-পাপ--- ‘সঙ্করীকরণ’। নিন্দিতের নিকট হইতে ধনগ্রহণ, বাণিজ্য ও কুসীদদ্বারা জীবিকা নির্বাহ, অসত্যভাষণ এবং শূদ্রসেবা---এই সকল পাপ ‘অপাত্ৰীকরণ’।
পক্ষিহত্যা, জলচরহত্যা, মৎস্যাদি জলজপ্রাণিহত্যা কৃমিহত্যা ও কীটহত্যা, মদ্যসংশ্লিষ্ট দ্রব্যভোজন—এই সকল পাপ ‘মলাবহ’।
যে –সকল পাপের লিখিত হইল না, সেই সকল পাপ—‘প্রকীর্ণক’-পদবাচ্য (—বিষ্ণুসংহিতা, প্রায়শ্চিত্ত বিবেক এবং মনুসংহিতা দ্রষ্টব্য) । মহাভারত দানধর্মে পাপ দশবিধ বলিয়া উক্তি আছে, প্রাণিহত্যা, চৌর্য ও পরদারহণ—এই তিন প্রকার পাপ ‘কায়িক’, অসৎপ্রলাপ, পারুষ্য, পৈশুন্য এবং মিথ্যাবাক্য কখন---এই চারি প্রকার ‘বাচিক’ এবং পরধনে চিন্তা, সর্বজীবে দয়াশূন্যতা ও ‘কর্মের ফল হউক’—এইরূপ চিন্তা, এই ত্রিবিধ পাপ ‘মানসিক’।