মহাপ্রভু ঠাকুর হরিদাসকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন,— “তোমার ব্রাহ্মণেতর অহিন্দু-শরীর আমার ব্রাহ্মণ-শরীর হইতে অবর বলিয়া কেহ কেহ মনে করিতে পারে, কিন্তু তাহাদের দৃষ্টি ভ্রান্তিময়ী। আমি দৃঢ়ভাবে বলিতেছি, তোমার জাতি এবং আমার জাতিতে ভেদ নাই। আমার দেহ হইতে তোমার দেহ সর্বতোভাবে শ্রেষ্ঠ। আধুনিক হিন্দুগণ নিজ নিজ দেহকে যবনদেহ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করেন বলিয়া পাষণ্ডী হিন্দুগণ নিজ নিজ জাতি-মদে মত্ত হইয়া যে কোন কুলে অবতীর্ণ ভগবদ্ভক্তকে ‘অবর’ জ্ঞান করে । তাহাদের যুক্তি প্রণালী বিশেষ দোষ-যুক্ত। যে শরীরধারী ব্যক্তি অনুক্ষণ ভগবৎ-সেবারত, তাঁহার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও শরীরাদি আপাত আধ্যক্ষিক-দর্শনে ইতর জাতির সহিত তুল্য বিবেচিত হইতে পারে, কিন্তু উহা অপরাধজনক। শুক্র-শোণিত জাত দেহধারী জনগণ নিজ নিজ হিন্দু বা অহিন্দু-বিচারে আপন আপন শ্রেষ্ঠতা স্থাপনে ব্যস্ত হয়। হরিভজনের দৃঢ়তা ও গাঢ়তা বিষয়ে উদাসীন থাকিলে তাহাদের ঐ প্রকার বিচারই প্রবল হয়। পাপিষ্ঠ যবন বা তথাকথিত পুণ্যবান্ হিন্দু শরীর লৌকিক বিচারে নিজ নিজ শ্রেষ্ঠতা স্থাপন করে। তাদৃশ বিচার-বশে বৈষ্ণব-নিন্দা করিয়া নরকের পথে চলিলে তাহাদের মঙ্গল হয় না ।
“দীক্ষাকালে ভক্ত করে আত্মসমর্পণ। সেইকালে কৃষ্ণ তারে করে আত্মসম॥ সেই দেহ করে তা’র চিদানন্দময়। অপ্রাকৃত দেহে তাঁর চরণ ভজয়॥’’(—চৈঃ চঃ অ ৪/ ১৯২-১৯৩)।“প্রাকৃতদেহেন্দ্রিয়াদীনামেব ভক্তিসংসর্গেণাপ্রকৃতত্বং স্পর্শমণিন্যায়েনৈব সাধু বুধ্যামহে। * * অচিন্ত্যশাক্তা ভক্ত্যুপদেশকাল এব তস্য গুণাতীতানি দেহেন্দ্ৰিয়মনাংসি ময়া ভক্তিমাহাত্ম্যদর্শনার্থমলক্ষিতমেব সৃজান্তে, মিথ্যাভূতানি তান্যত্যলক্ষিতমেব লয়ং যান্তি।’’ (—ভাঃ ৫/১২/১১ শ্লোকের সারার্থদর্শিনী টীকা), অর্থাৎ স্পর্শমণিদ্বারা লৌহ যেমন স্বর্ণতা প্রাপ্ত হয়, ভক্তি-সংসর্গে তদ্রূপ প্রাকৃত দেহন্দ্রিয়াদিও অপ্রাকৃতত্ব প্রাপ্ত হয়। ভক্তি উপদেশকাল হইতেই ভগবান্ ভক্তি-মাহাত্ম্য প্রদর্শন করিবার নিমিত্ত অচিন্ত্যশক্তিবলে ভক্তের ত্রিগুণাতীত দেহ, ইন্দ্রিয় ও মন অন্যের অলক্ষিতভাবে প্রকাশিত করিয়া থাকেন এবং মিথ্যাভূত দেহেন্দ্রিয়াদি অন্যের অলক্ষিতভাবে বিনাশ প্রাপ্ত হয়। ‘অন্যের অলক্ষিত’ বলিবার তাৎপর্য এই যে, তত্ত্বান্ধব্যক্তিগণ তাঁহার স্বরূপ উপলব্ধি করিতে না পারিয়া তাঁহাকে পূর্ব-পরিচয়ে পরিচিত করেন এবং তাঁহার দেহকেও জন্মমরণশীল, হাড়মাংসের থলি জ্ঞান করিয়া বৈষ্ণব চরণে অপরাধী হন। “দৃষ্টৈঃ স্বভাবজনিতৈর্বপুষশ্চ দোষৈঃ ন প্রাকৃতত্বমিহ ভক্তজনস্য পশ্যেৎ। গঙ্গাম্ভসাং ন খুল বুদ্বুদ্ফেন-পঙ্কৈর্ব্রহ্মদ্রবত্বমপগচ্ছতি নীরধমৈঃ॥’’ (—উপদেশামৃত ৬ষ্ঠ শ্লোক), “ভক্তানাং সচ্চিদানন্দরূপেষ্বঙ্গেন্দ্রিয়াত্মসু! ঘটতে স্বানুরূপেষু বৈকুণ্ঠেঽন্যত্র চ স্বতঃ॥’’ (—বৃহদ্ভাগবতামৃত ২/৩/১৩৯ শ্লোক), অর্থাৎ ভক্ত বৈকুণ্ঠবাসীই হউন কিম্বা যে কোন স্থানেই বাস করুন না কেন, তাঁহার সেবনোপযোগী সচ্চিদানন্দময় দেহ স্বতঃই প্রকাশ পাইয়া থাকে। ভক্তির স্ফূর্তিতে তাঁহার পাঞ্চভৌতিক দেহ সচ্চিদানন্দরূপতা প্রাপ্ত হয়। তাদৃশ দেহের জন্ম-মৃত্যু ভগবানের সচ্চিদানন্দমায় দেহের আবির্ভাবতিরো ভাবের ন্যায়। যাঁহারা ভক্ত ও ভগবানের আবির্ভাবতিরোভাবকে কর্মফলবাধ্য জীবের জন্ম-মৃত্যুর ন্যায় মনে করেন, তাঁহারা মুক্তিলাভের পরিবর্তে পুনঃ পুনঃ প্রপঞ্চক্লেশ লাভ করিয়া থাকেন, মুক্ত হইতে পারেন না।
মহাপ্রভু ঠাকুর হরিদাসকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন,— “তোমার ব্রাহ্মণেতর অহিন্দু-শরীর আমার ব্রাহ্মণ-শরীর হইতে অবর বলিয়া কেহ কেহ মনে করিতে পারে, কিন্তু তাহাদের দৃষ্টি ভ্রান্তিময়ী। আমি দৃঢ়ভাবে বলিতেছি, তোমার জাতি এবং আমার জাতিতে ভেদ নাই। আমার দেহ হইতে তোমার দেহ সর্বতোভাবে শ্রেষ্ঠ। আধুনিক হিন্দুগণ নিজ নিজ দেহকে যবনদেহ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করেন বলিয়া পাষণ্ডী হিন্দুগণ নিজ নিজ জাতি-মদে মত্ত হইয়া যে কোন কুলে অবতীর্ণ ভগবদ্ভক্তকে ‘অবর’ জ্ঞান করে । তাহাদের যুক্তি প্রণালী বিশেষ দোষ-যুক্ত। যে শরীরধারী ব্যক্তি অনুক্ষণ ভগবৎ-সেবারত, তাঁহার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও শরীরাদি আপাত আধ্যক্ষিক-দর্শনে ইতর জাতির সহিত তুল্য বিবেচিত হইতে পারে, কিন্তু উহা অপরাধজনক। শুক্র-শোণিত জাত দেহধারী জনগণ নিজ নিজ হিন্দু বা অহিন্দু-বিচারে আপন আপন শ্রেষ্ঠতা স্থাপনে ব্যস্ত হয়। হরিভজনের দৃঢ়তা ও গাঢ়তা বিষয়ে উদাসীন থাকিলে তাহাদের ঐ প্রকার বিচারই প্রবল হয়। পাপিষ্ঠ যবন বা তথাকথিত পুণ্যবান্ হিন্দু শরীর লৌকিক বিচারে নিজ নিজ শ্রেষ্ঠতা স্থাপন করে। তাদৃশ বিচার-বশে বৈষ্ণব-নিন্দা করিয়া নরকের পথে চলিলে তাহাদের মঙ্গল হয় না ।
“দীক্ষাকালে ভক্ত করে আত্মসমর্পণ। সেইকালে কৃষ্ণ তারে করে আত্মসম॥ সেই দেহ করে তা’র চিদানন্দময়। অপ্রাকৃত দেহে তাঁর চরণ ভজয়॥’’(—চৈঃ চঃ অ ৪/ ১৯২-১৯৩)।“প্রাকৃতদেহেন্দ্রিয়াদীনামেব ভক্তিসংসর্গেণাপ্রকৃতত্বং স্পর্শমণিন্যায়েনৈব সাধু বুধ্যামহে। * * অচিন্ত্যশাক্তা ভক্ত্যুপদেশকাল এব তস্য গুণাতীতানি দেহেন্দ্ৰিয়মনাংসি ময়া ভক্তিমাহাত্ম্যদর্শনার্থমলক্ষিতমেব সৃজান্তে, মিথ্যাভূতানি তান্যত্যলক্ষিতমেব লয়ং যান্তি।’’ (—ভাঃ ৫/১২/১১ শ্লোকের সারার্থদর্শিনী টীকা), অর্থাৎ স্পর্শমণিদ্বারা লৌহ যেমন স্বর্ণতা প্রাপ্ত হয়, ভক্তি-সংসর্গে তদ্রূপ প্রাকৃত দেহন্দ্রিয়াদিও অপ্রাকৃতত্ব প্রাপ্ত হয়। ভক্তি উপদেশকাল হইতেই ভগবান্ ভক্তি-মাহাত্ম্য প্রদর্শন করিবার নিমিত্ত অচিন্ত্যশক্তিবলে ভক্তের ত্রিগুণাতীত দেহ, ইন্দ্রিয় ও মন অন্যের অলক্ষিতভাবে প্রকাশিত করিয়া থাকেন এবং মিথ্যাভূত দেহেন্দ্রিয়াদি অন্যের অলক্ষিতভাবে বিনাশ প্রাপ্ত হয়। ‘অন্যের অলক্ষিত’ বলিবার তাৎপর্য এই যে, তত্ত্বান্ধব্যক্তিগণ তাঁহার স্বরূপ উপলব্ধি করিতে না পারিয়া তাঁহাকে পূর্ব-পরিচয়ে পরিচিত করেন এবং তাঁহার দেহকেও জন্মমরণশীল, হাড়মাংসের থলি জ্ঞান করিয়া বৈষ্ণব চরণে অপরাধী হন। “দৃষ্টৈঃ স্বভাবজনিতৈর্বপুষশ্চ দোষৈঃ ন প্রাকৃতত্বমিহ ভক্তজনস্য পশ্যেৎ। গঙ্গাম্ভসাং ন খুল বুদ্বুদ্ফেন-পঙ্কৈর্ব্রহ্মদ্রবত্বমপগচ্ছতি নীরধমৈঃ॥’’ (—উপদেশামৃত ৬ষ্ঠ শ্লোক), “ভক্তানাং সচ্চিদানন্দরূপেষ্বঙ্গেন্দ্রিয়াত্মসু! ঘটতে স্বানুরূপেষু বৈকুণ্ঠেঽন্যত্র চ স্বতঃ॥’’ (—বৃহদ্ভাগবতামৃত ২/৩/১৩৯ শ্লোক), অর্থাৎ ভক্ত বৈকুণ্ঠবাসীই হউন কিম্বা যে কোন স্থানেই বাস করুন না কেন, তাঁহার সেবনোপযোগী সচ্চিদানন্দময় দেহ স্বতঃই প্রকাশ পাইয়া থাকে। ভক্তির স্ফূর্তিতে তাঁহার পাঞ্চভৌতিক দেহ সচ্চিদানন্দরূপতা প্রাপ্ত হয়। তাদৃশ দেহের জন্ম-মৃত্যু ভগবানের সচ্চিদানন্দমায় দেহের আবির্ভাবতিরো ভাবের ন্যায়। যাঁহারা ভক্ত ও ভগবানের আবির্ভাবতিরোভাবকে কর্মফলবাধ্য জীবের জন্ম-মৃত্যুর ন্যায় মনে করেন, তাঁহারা মুক্তিলাভের পরিবর্তে পুনঃ পুনঃ প্রপঞ্চক্লেশ লাভ করিয়া থাকেন, মুক্ত হইতে পারেন না।