শ্রীগৌরসুন্দরকৃত ব্যাখ্যায় অবিশ্বাসকারীর অধোগতি—
এ সব কথায় যার নাহিক প্রতীত।
অধঃপাত হয় তার, জানিহ নিশ্চিত ॥
নির্বিশেষবাদী “সর্বতঃ” পাঠ রক্ষা করিয়া উহা সর্বত্র অর্থেই ব্যবহার করিয়াছেন। সবিশেষবাদী ভগবত্তার স্বরূপ স্বীকার করেন। নির্বিশেষবাদী জগন্মিথ্যাত্ববাদের পক্ষ গ্রহণ করায় ভগবৎস্বরূপের পাণিপাদ-কর্ণ-চক্ষু শিরঃ ও বদনের নিত্যত্ব স্বীকার করেন না। অচিন্ত্যভেদাভেদ- বিচারে বহির্দশনে যে প্রকার ভোগ্য রূপসমূহ পরিদৃষ্ট হয়, তদ্ব্যতীত সেবনোপযোগী নিত্যভাবে সেব্যেন্দ্রিয়সমূহের উপলব্ধি ঘটে। মহাভাগবত সর্বত্র ভগবানের পুরুষোত্তমের ও হৃষীকেশত্ব দর্শন করেন। তাঁহারা বহির্জগতের ভোগ্যভাব-সমূহ দর্শনের পরিবর্তে পুরুষোত্তমের ভোক্তৃত্বের কারণসমূহ দেখিয়া থাকেন। বিশিষ্টাদ্বৈত-বিচারক যেরূপ প্রপঞ্চকে ভগবৎস্বরূপের স্থুল শরীর বিচার করেন, অথবা কেবলাদ্বৈত বিচারক যেরূপ প্রাপঞ্চিক-দর্শনের স্বীকারবিরোধী, অচিন্ত্যভেদাভেদের পরম সূক্ষ্ম দর্শনে সেরূপ ধারণার আবশ্যকতা নাই। প্রেমাঞ্জনচ্ছুরিত ভক্তিবিলোচন দ্বারা ভগবদ্ভক্তের নিকট সর্বত্রই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গাদি সহ নিত্যরূপ পরিদর্শনের ব্যাঘাত হয় না। সেবা-বিমুখতা জন্য যে প্রাপঞ্চিক ভোগ-দর্শন, উহা নশ্বর জগতে সত্য হইলেও শুদ্ধজীবাত্মার দর্শনে উহাতে অনর্থের প্রতীতি নাই। জীবের অর্থই সেব্যে আশ্রিত। সুতরাং ভাগবুদ্ধির বশবর্তী হইয়া কর্মফলবাধ্য জীব যেরূপ জাগতিক ভোগের আবাহন করেন, সর্বত্র সেইরূপ ভোগময় দর্শন করিতে হইবে না, —ইহাই প্রভুর অভিপ্রায়। কর্মবাদী তাহার অনর্থ থাকা কালে নশ্বর বস্তুকে ‘ভোগ্য’ জ্ঞান করেন এবং বিরাট রূপকে রূপক ও কাল্পনিক মনে করেন। আবার নির্ভেদ-ব্রহ্মানুসন্ধিৎসু প্ৰাপঞ্চিক রূপের অস্তিত্ব ইন্দ্রিয়কল্পিত-জ্ঞানে প্রাপঞ্চিক অধিষ্ঠানের নশ্বর-বাস্তবতায় ঔদাসীন্য প্রকাশ করেন। শুদ্ধাদ্বৈতবাদী বহির্জগতে চিদানন্দ দর্শন-রহিত হওয়ায়, শুদ্ধজীবে আনন্দরাহিত্য স্বীকার করায় এবং জড় জগতে সচ্চিদানন্দানুভূতির সম্বন্ধনির্ণয়ে ভাবান্তর প্রকাশ করায় অচিন্ত্যভেদাভেদ বিচার তাহার হৃদয়ঙ্গম হয় না। ভগবৎশক্তিমত্তায় সর্বত্র সচ্চিদানন্দানুভূতি বর্তমান বলিবার জন্যই “সর্বত্র পাণিপাদন্তৎ’’ শ্লোকের অবতারণা । শ্রীগৌরসুন্দরের প্রকাশিত ব্যাখ্যায় ও শ্রীঅদ্বৈত-প্রভুর তদ্গ্রহণে যে সত্য নিহিত আছে, তাহাতে বিশ্বাস-রহিত ব্যক্তি বাস্তব সত্য হইতে বঞ্চিত হয়। প্রাপঞ্চিক নশ্বর প্রতীতিরূপ অধঃপতনই তাহার লভ্য হয়।