অহর্নিশ শ্রবণে শুনয়ে কৃষ্ণনাম।
বদনে বোলয়ে ‘কৃষ্ণচন্দ্র’ অবিরাম॥
শ্রীগৌরসুন্দর মহাভাগবত-বৈষ্ণবের লীলা প্রকাশ করিয়া সর্বত্র কৃষ্ণ ও কৃষ্ণসম্বন্ধি-কাষ্ণ দর্শন করিতে লাগিলেন। সাধারণ কৃষ্ণবিস্মৃত প্রাকৃত লোক যেরূপ জড়-প্রত্যক্ষাদিজ্ঞানে বিমূঢ় হইয়া কৃষ্ণদর্শনাভাবে কৃষ্ণেতর ভোগ-ভূমিকারূপ এই পঞ্চিক জগৎ দর্শন করে, মহাপ্রভু তদ্রূপ ভোক্তৃঅভিমানে ভোগ্য দর্শনের আদর্শ না দেখাইয়া কৃষ্ণবিমুখ ও বিস্মৃত বদ্ধজীবের পরিলক্ষিত এই প্রাণিজগৎ ও জড়-জগৎকে কৃষ্ণসেবোন্মুখ, মহা-ভাগবত-বৈষ্ণবের সচ্চিদানন্দ-কৃষ্ণময়ী দৃষ্টিতে দর্শন করিলেন। প্রত্যেক ভূত-হৃদয়ে উপাস্য বস্তু সশক্তিক কৃষ্ণের বিলাস প্রতীত হইতে লাগিল, সুতরাং বদ্ধ বিমুখ বিস্মৃত-জীবের ন্যায় অচিৎ জড়পরমাণুর ব্যবধান দর্শন না করায় সর্বত্র তুরীয় বৈকুণ্ঠ-গোলোক-দর্শনে তদ্রূপ-বৈভবসমূহ তাহাকে কৃষ্ণের ভোগসেবা-বিলাসদর্শনে বাধা দিল না॥
(চৈঃ চঃ মধ্য ৮ম পঃ ২৭৪)
“স্থাবর-জঙ্গম দেখে, না দেখে তার মূর্তি।
সর্বত্র ফ্রয়ে তার ইষ্টদেব-মূর্তি॥”
(ভাঃ ১১/২/৪৫, ৪৯-৫৪ শ্লোকে বিদেহরাজনিমির প্রতি নবযোগেন্দ্রের অন্যতম শ্রীহরির উক্তি—)
“সর্বভূতেষু যঃ পশ্যেদ্ভগবদ্ভাবমাত্মনঃ।
ভূতানি ভগবত্যাত্মন্যেষ ভাগবতোত্তমঃ॥”
অর্থাৎ ‘যিনি নিখিল-বস্তুতে সর্বভূতের নিয়ন্ত্বরূপে অধিষ্ঠিত পরমাত্মার ভগবদ্ভাব-বিলাস, দর্শন করেন এবং পরমাত্মা ভগবান্ শ্রীহরিতে চিদ্বিলাস-বৈচিত্র্য দর্শন করেন তিনিই ‘উত্তম ভাগবত।
“দেহেন্দ্রিয়প্রাণমনোধিয়াং যো জন্মপ্যয়ক্ষুদ্ভয়তর্ষকৃচ্ছৈঃ।
সংসারধর্মৈরবিমূহ্যমানঃ স্মৃত্যা হরের্ভাগবতপ্রধানঃ॥”
অর্থাৎ ‘সংসারে থাকিয়াও দেহ ইন্দ্রিয়, প্রাণ, মন ও বুদ্ধির জন্ম, নাশ, ক্ষুধা, ভয়, তৃষ্ণা ইত্যাদি সংসারধর্মে যিনি মোহিত অর্থাৎ আসক্ত হন না, সর্বদা হরিস্মৃতি-দ্বারা কুশলে থাকেন, তিনিই ‘ভাগবতপ্রধান’।’
“ন কামকর্মবীজানাং যস্য চেতসি সম্ভবঃ।
বাসুদেবৈকনিলয়ঃ স বৈ ভাগবতোত্তমঃ॥”
অর্থাৎ ‘যিনি কৃষ্ণে অবস্থিত হইয়া শান্ত হন এবং কামকৰ্মবীজ যাঁহার চিত্তে উদ্ভূত হয় না, তিনিই ভাগবতোত্তম।
“ন যস্য জন্মকর্মাভ্যাং ন বর্ণাশ্রমজাতিভিঃ।
সজ্জতেঽস্মিন্নহম্ভাবো দেহে বৈ স হরেঃ প্রিয়ঃ॥”
অর্থাৎ ‘যে পুরুষের এই জড়দেহে জন্ম, কর্ম, বর্ণাশ্রম বা জাতিদ্বারা ‘অহং’-ভাব উৎপন্ন না হয়, তিনিই ‘হরির প্রিয়পাত্র’।’
“ন যস্য স্বঃ পর ইতি বিত্তেষাত্মনি বা ভিদা।
সবর্ভূতসমঃ শান্তঃ স বৈ ভাগবতোত্তমঃ॥”
অর্থাৎ ‘যাঁহার বিত্তে ও দেহে ‘স্ব’ ও ‘পর’—এরূপ ভেদ নাই, যিনি সর্বভূতে সম ও শান্ত, তিনিই ভাগবতোত্তম।
“ত্রিভুবনবিভবহেতবেঽপ্যকুণ্ঠস্মৃতিরজিত্মসুরাদিভির্বিমৃগ্যাৎ।
ন চলতি ভগবৎপদারবিন্দাৎ লবনিমিষার্ধমপি যঃ স বৈষ্ণবাগ্র্যঃ॥”
অর্থাৎ ‘হরিগতচিত্ত ব্রহ্মাদি দেবগণও যে-কৃষ্ণের অন্বেষণ করেন, যিনি ত্রিভুবন-প্রাপ্তির লোভেও সেই কৃষ্ণের পদারবিন্দ হইতে লব অর্থাৎ নিমিষার্ধও বিচলিত না হইয়া অকুণ্ঠস্মৃতি থাকেন, তিনিই ‘বৈষ্ণবাগ্রগণ্য।
“ভগবত উরুবিক্রমাঙ্ঘ্রিশাখা-নখমণিচন্দ্ৰিকয়া নিরস্ততাপে।
হৃদিকথমুপসীদতাং পুনঃ স প্রভবতি চন্দ্র ইবোদিতেঽর্কতাপঃ ॥”
অর্থাৎ ‘শ্রীকৃষ্ণের উরুবিক্রম পাদপদ্মের নখমণিচন্দ্রিকাদ্বারা যাঁহার হৃদয়ের তাপ দূর হইয়াছে, তাহার আর দুঃখ কি? সূর্যতাপতপ্ত ব্যক্তি দিবাবসানে চন্দ্রকিরণ পাইলে তাহার কি আর তাপক্লেশ থাকে?’।