জিহ্বোদরোপস্থ-লম্পট অসৎসঙ্গীর নিরয়-লাভ-তথাহি (ভাঃ ৩/৩১/৩২)—
“যদ্যসদ্ভিঃ পথি পুনঃ শিশ্নোদরকৃতোদ্যমৈঃ।
আস্থিতো রমতে জন্তুস্তমো বিশতি পূর্ববৎ॥”
অনুবাদ: মানব যদি সৎপথে অবস্থিত হইয়াও, উদরোপস্থলস্পট অসজ্জনগণের সহিত সঙ্গ করে, তাহা হইলে তাহাকেও পূর্বোক্ত-প্রকারে অর্থাৎ গলদেশে যমদূতগণকর্তৃক পাশবদ্ধ হইয়া নরকে প্রবেশ করিতে হয়॥২৩৬॥
ভাঃ ৩য় স্কঃ ৩০শ অঃ—৩১ অঃ ৩১ সংখ্যা পর্যন্ত শ্লোকে মাতা দেবহূতির প্রতি ভগবান্ কপিলদেবের উক্তি—
শ্রীভগবান্ বলিলেন,—মাতঃ, এই যে কালের কথা কহিলাম, মনুষ্য ইহার প্রভাবেই চালিত হয়; কিন্তু মেঘসকল বায়ুকর্তৃক বিচলিত হইয়াও যেমন বায়ুর বিক্রম অবগত হইতে পারে না, মনুষ্যগণও সেইরূপ এই বলবান কালের অসীম বিক্রম জানিতে পারে না।
মনুষ্য সুখের নিমিত্ত অতিশয় ক্লেশ স্বীকার করিয়াও যে যে প্রয়োজনীয় বস্তু উপার্জন করে, শক্তিমান্ কাল সে-সমুদয় অর্থই বিনষ্ট করিয়া থাকে।
দুর্মতি-জীব মোহবশতঃ কলত্রাদি-সমন্বিত অনিত্য দেহ, গেহ, ক্ষেত্র ও বিত্তকে নিত্য বলিয়া মনে করে, সুতরাং ঐ সকল বস্তু নষ্ট হইলে, উহারা শোকে নিমগ্ন হয়।
জন্তু-সকল এই সংসারে যে যে যোনি পরিভ্রমণ করে, সেই সেই যোনিতেই সন্তোষ লাভ করিয়া থাকে; সুতরাং কিছুতেই বিরক্ত হইতে পারে না।
দৈব-মায়া-বিমোহিত পুরুষ নরক-যোনি লাভ করিয়াও নরকযোগ্য আহারাদিতে সন্তুষ্ট থাকিয়া নারকি-শরীর পরিত্যাগ করিতে ইচ্ছা করে না।
ঐ ব্যক্তি দেহ, স্ত্রী, পুত্র, গৃহ, পশু, ধন, বন্ধু প্রভৃতিতে নানা মনোরথ বন্ধন করিয়া আপনাকে কৃতাৰ্থ বোধ করে।
কুটুম্বদিগের পোষণ-চিন্তার দুরাশায় সেই মূঢ়ব্যক্তির আপাদমস্তক নিরন্তর দগ্ধীভূত হইতে থাকে; সুতরাং সে পাপাচরণে প্রবৃত্ত হয়।
ঐ গৃহব্রত ব্যক্তি কাপট্যধর্মবহুল সুখদুঃখপ্রধান-গৃহে নিরলস হইয়া কলভাষি-শিশুগণের আধ-আধ-আলাপে ও অসতী স্ত্রীগণের নির্জন-বিরচিত সম্ভোগাদিরূপা মায়ারদ্বারা মন ও ইন্দ্রিয়গণের সহিত অভিভূত হইয়া থাকে; নিরন্তর কেবল দুঃখপ্রতীকারের যত্নপূর্বক উহাকে সুখ’ বলিয়া মনে করিয়া থাকে।
সেই মূঢ়ব্যক্তি যাহাদিগের পো পোষণে অধোগতি হয়, গুরুতর হিংসাবৃত্তিদ্বারা নানাস্থান হইতে অর্থোপার্জনপূর্বক সেই পরিবারবর্গকেই পোষণ করিয়া থাকে এবং স্বয়ং তাহাদিগের ভোজনাবশেষ যাহা কিছু থাকে, তাহাই আহার করিয়া জীবন ধারণ করে॥
যখন সে জীবিকা-রহিত হয়, তখন সে অন্য জীবিকা অবলম্বনের জন্য বারম্বার চেষ্টা করিয়া ব্যর্থমনোরথ হইলে লোভে অভিভূত হইয়া পরের ধনে স্পৃহা করে।
মূঢ়ব্যক্তি, হতভাগ্য-পুরুষ বারম্বার যত্ন করিয়াও যখন কুটুম্বভরণে অশক্ত হয়, তখন হতশ্রী ও দুঃখিত হইয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করে।
এইরূপ যখন তাহার স্ত্রী-পুত্রাদির ভরণ-পোষণে সে অসমর্থ হইয়া পড়ে, তখন নির্দয় কৃষকগণ যেরূপ বলীবর্দকে অযত্ন করে, সেইরূপ তাহার পুত্র-কলত্রাদিও ঐ গৃহব্রতব্যক্তিকে আর পূর্বের ন্যায় আদর করে না।
কিন্তু তাহাতেও তাহার সংসারের প্রতি বিরাগ উপস্থিত হয় না; জরাগ্রস্ত, বিরূপাকৃতি ও মৃত্যুগ্রস্ত হইয়া সেই গৃহব্রত-ব্যক্তি গৃহেই বাস করে এবং পূর্বে যে পুত্রকলাদিকে স্বয়ং প্রতিপালন করিয়াছিল, তাহারাই অবজ্ঞা করিয়া তাহাকে যৎসামান্য যেকিছু খাদ্য-দ্রব্যাদি প্রদান করে, সে গৃহপালিত কুকুরের ন্যায় তাহাই ভক্ষণ করিয়া থাকে; তখন সে রোগগ্রস্ত হইয়া পড়ে, সুতরাং তাহার জঠরাগ্নির আর তাদৃশ বল থাকে না, তাহার আহারও অল্প হইয়া আসে; সে পরিশ্রমে অশক্ত হইয়া গৃহেই অবস্থান করিতে থাকে।
দেহস্থ বায়ুর উর্ধগতিনিবন্ধন বায়ুর গমনাগমন-মার্গরূপ নাড়ীসমূহ কফ-দ্বারা রুদ্ধ হইয়া যায়; সুতরাং বায়ুর প্রকোপে চক্ষু বাহির হইয়া পড়ে; তাহাতে কাশি কিম্বা নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সময় তাহার অত্যন্ত কষ্ট হয় এবং কণ্ঠদেশে ‘ঘুর ঘুর’ শব্দ হইতে থাকে।
ক্রমে ঐ গৃহব্রত ব্যক্তি মৃত্যুশয্যায় শয়ন করে, তখন আত্মীয়-বন্ধু-বান্ধবগণ তাহার চতুর্দিকে ঘিরিয়া শোক করিতে আরম্ভ করে এবং বারম্বার তাহাকে নানাকথা জিজ্ঞাসা করিতে থাকে; কিন্তু সে কালপাশের বশবর্তী হইয়া ঐ বন্ধুগণের কোন কথারই উত্তর দিতে পারে না।
কুটম্বভরণে ব্যাপৃতচিত্ত অজিতেন্দ্রিয় ঐ গৃহব্রত ব্যক্তি এইরূপ অবস্থাতেও রোরুদ্যমান আত্মীয়-স্বজনের সাতিশয় দুঃখ সন্দর্শন করিয়া অধীর হয়; অবশেষে সে নষ্টবুদ্ধি হইয়া প্রাণ পরিত্যাগ করে।
তাহার মৃত্যুসময়ে সক্রোধনেত্র ভয়ঙ্কর যমদূতদ্বয় আসিয়া উপস্থিত হয়। ঐ ব্যক্তি উহাদিগকে দর্শন করিয়াই ত্রাস পায় এবং ভয়ে পুনঃ পুনঃ মলমূত্র পরিত্যাগ করিতে থাকে।
অনন্তর যমদূতদ্বয় ঐ গৃহব্রত ব্যক্তিকে স্থূলদেহ হইতে যাতনা-দেহে নিরুদ্ধ করিয়া বলপূর্বক তাহার গলদেশে পাশ বন্ধন করে এবং যেরূপ রাজপুরুষগণ দণ্ডনীয়-ব্যক্তিকে পাশবদ্ধ করিয়া লইয়া যায়, যমরাজের কিঙ্করগণও সেইরূপ তাহাকে লইয়া দীর্ঘপথে প্রস্থান করিতে থাকে।
যমদূতগণের তিরস্কার-বাক্যে ঐ পুরুষের হৃদয় বিদীর্ণ হইতে থাকে এবং সর্বশরীরে কম্প উপস্থিত হয়। পথিমধ্যে কুকুরসকল তাহাকে ভক্ষণ করিতে আসে; তাহাতে ঐ ব্যক্তি যাতনায় অত্যন্ত ব্যথিত হইয়া স্বকৃত পাপ স্মরণ করিতে করিতে চলিতে থাকে। যমদূতগণ তাহাকে যে পথ দিয়া লইয়া যায়, তাহা প্রতপ্ত বালুকা-পরিপূর্ণ; তথায় কোন বিশ্রাম-স্থল বা পানীয়-জল নাই; ঐ ব্যক্তি ক্ষুধায় প্রপীড়িত এবং সূর্যকিরণ ও দাবানলদ্বারা সন্তপ্ত হইয়া চলিতে নিতান্ত অসমর্থ হইলেও যমদূতগণ তাহার পৃষ্ঠদেশে কশাঘাত করিতে থাকে; সুতরাং সে অতিকষ্টে চলিতে বাধ্য হয়।
শ্রান্তিবশতঃ সেই ব্যক্তি যাইতে পথিমধ্যে পদস্থলিত ও বারম্বার মূর্চ্ছিত হইয়া পড়ে; আবার চেতনতা লাভ করিয়া পাপবহুল অন্ধকারময়-পথদ্বারা যম-সদনে নীত হয়।
যে-পথে যমগৃহে যাইতে হয়, তাহার পরিমাণ—অত্যন্ত দীর্ঘ। যমদূতগণ কোন কোন দণ্ড্য-ব্যক্তিকে দুই মুহূর্তের মধ্যে ঐ দীর্ঘপথ অতিক্রম করাইয়া থাকে। সুতরাং সেই পাপী ব্যক্তি যখন যম-সদনে উপস্থিত হয়, তখন সে দেখিতে পায়,—কোথাও জ্বলন্ত অঙ্গার-দ্বারা গাত্র-বেষ্টন করিয়া পাপীর দেহ দগ্ধ হইতেছে, কোথাও বা অপরের দ্বারা, আবার কোথাও বা আপন-মাংস নিই ছিন্ন করিয়া সেই মাংস ভোজন করিতেছে; জীবন থাকিতেই যমালয়স্থ কুক্কুর, গৃধ্র প্রভৃতি জীবগণ নাড়ীসকল টানিয়া বাহির করিতেছে; কেহ বা সর্প, বৃশ্চিক ও দংশক প্রভৃতি জন্তুগণে দংশনে অতিশয় বেদনা অনুভব করিতেছে, কাহারও অঙ্গপ্রত্যঙ্গসকল খণ্ড খণ্ড করিয়া নৃশংসভাবে ছেদন করিতেছে, কাহাকেও বা পর্বত-চূড়া হইতে নিক্ষেপ করিতেছে, কাহাকেও বা জল ও গর্তের মধ্যে অবরুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে—এই সকল যাতনা সে ভোগ করিয়া থাকে।
অন্ধতামিস্র, রৌরব প্রভৃতি যতপ্রকার নরক-যন্ত্রণা পরস্পরের পাপসংসর্গ জন্য নির্মিত হইয়াছে, ঐ মৃত গৃহব্রত ব্যক্তি, পুরুষই হউক, আর নারীই হউক, সেইসকল যাতনা ভোগ করিতে বাধ্য হয়।
হে মাতঃ, এই স্থানেই নরক, এই স্থানেই স্বর্গ—তত্ত্ববিদ্গণ ইহাই কহিয়া থাকেন। নরকে যে সকল যাতনা ভোগ করিতে হয়, তাহা এই জগতেও দেখিতে পাওয়া যায়।
কুটুম্ব-পোষণেই বিব্রত থাকুক বা স্বীয় উদর-ভরণেই ব্যস্ত থাকুক, মৃত্যুর পর এই স্থানেই কুটুম্ব ও নিজদেহ, উভয়কেই পরিত্যাগ করিয়া ঐ সকল কর্মের পূর্বোক্তরূপ ফল ভোগ করিতে হয়।
প্রাণিহিংসাদ্বারা পরিপুষ্ট স্থূলদেহ এবং সঞ্চিত ধন—এই উভয়কেই এই জগতে পরিত্যাগপূর্বক পাপরূপ পাথেয় লইয়া ঐ গৃহব্রত ব্যক্তি অন্ধকারপূর্ণ ঘোর নরক প্রাপ্ত হইয়া থাকে।
ঐ গৃহব্রত পুরুষের কুটুম্ব-পোষণের পাপ-ফল পরকালে ঈশ্বর-কর্তৃক প্রদত্ত হয়; সে আতুরের মত হতজ্ঞান হইয়া নরকে তাহার ফল ভোগ করে।
যে ব্যক্তি কেবল অধর্মের দ্বারা কুটুম্ব-ভরণে উৎসুক, সে ব্যক্তি নরকের চরম-পথ অন্ধতামিস্রে গমন করে।
সেই নরক-ভোগের পর কুকুর-শূকরাদি যোনিতে যত প্রকার যাতনা আছে, ক্রমশঃ সেই সকল যাতনা ভোগ করিয়া যখন ভোগের দ্বারা সেই ব্যক্তি ক্ষীণপাপ হয়, তখন আবার শুচি হইয়া এই নরলোকে আগমন করে।
শ্রীভগবান্ কহিলেন,—হে মাতঃ, জীব দৈব-কর্তৃক প্রেরিত হইয়া পূর্বকৃত কর্মের ফলানুসারে দেহপ্রাপ্ত হইবার জন্য পুরুষের রেতঃকণা আশ্রয় করিয়া স্ত্রীর গর্ভে প্রবিষ্ট হয়।
ঐ রেতঃকণা গর্ভমধ্যে পতিত হইলে এক রাত্রিতে শোণিতের সহিত মিশ্রিত হয়, পঞ্চরাত্রিতে বুদ্বুদাকারে পরিণত হয়, দশ দিবসের মধ্যে বদরীফলের ন্যায় কঠিন মাংসপিণ্ডাকার ধারণ করিয়া থাকে।
এইরূপে একমাসের মধ্যে তাহার মস্তক, দুই মাসে তাহার হস্ত-পদাদি অঙ্গ-বিভাব এবং তিনমাসে নখ, লোম, অস্তি, চর্ম ও ছিদ্রসকল প্রকটিত হয়।
চারিমাসে সপ্তধাতু (রস, রক্ত, মাংস, অস্থি, মেধ, মজ্জা ও শুক্র) এবং পঞ্চম মাসে ক্ষুধা তৃষ্ণার উদয় হয়। ছয়মাসে ঐ জীব জরায়ুদ্বারা আবৃত হইয়া দক্ষিণ-কুক্ষিতে ভ্রমণ করে।
সেই জীব মাতৃ-ভুক্ত অন্নপানাদির দ্বারা পরিবর্ধিত হইতে থাকে। সুতরাং তাহার অনভিপ্রেত হইলেও তাহাকে প্রাণিগণের। উৎপত্তিস্থান মল-মূত্র-গর্তে শয়ন করিয়া থাকিতে হয়।
সেই গর্ভ-মধ্যে তত্রস্থ ক্ষুধার্ত কৃমিসকল তাহার সুকুমার দেহ পাইয়া, সর্বাঙ্গ নিয়ত ক্ষত-বিক্ষত করিতে থাকে, তাহাতে সে নিরতিশয় ক্লেশ প্রাপ্ত হইয়া মুহুর্মুহুঃ মুচ্ছিত হয়।
গর্ভধারিণী দুঃসহ কটু, তীক্ষ, উষ্ণ, লবণ, রুক্ষ, অম্লাদি যেসকল রস ভক্ষণ করেন, সেইসকলের সহিত গর্ভস্থ-জীবের দেহ সংযুক্ত হওয়ায় তাহার সর্বাঙ্গে বেদনা জন্মে। সে ভিতরে জরায়ুদ্বারা বেষ্টিত এবং বাহিরে নাড়ীদ্বারা বিশেষরূপে আবদ্ধ হইয়া পৃষ্ট ও গ্রীবাদেশ কুঞ্চিত করিয়া কুক্ষি দেশে মস্তক স্থাপনপূর্বক অবস্থান করে। সুতরাং পিঞ্জরস্থ পক্ষীর ন্যায় স্বীয় অঙ্গ সঞ্চালন করিতে অসমর্থ হইয়া সেই গর্ভমধ্যেই বাস করে।
ঐ গর্ভমধ্যে তাহার দৈবক্রমে পূর্ব-পূর্ব-জন্মের কৃতকর্মের স্মৃতি উদিত হয়। তখন সে শত-শত জন্মের পাপকর্ম-সমূহ স্মরণ করিয়া দীর্ঘ-নিশ্বাস পরিত্যাগ করে, সুতরাং এরূপ অবস্থায় সে কিরূপে সুখ লাভ করিতে পারে ?
এইরূপে জীব যখন সপ্তম-মাসে পদার্পণ করে, তখন তাহার জ্ঞানোদয় হয়। কিন্তু প্রসবকারণ বায়ুদ্বারা পরিচালিত হইয়া সমানোদর-জন্মা বিষ্ঠাজাত কৃমির ন্যায় একস্থানে স্থির হইয়া অবস্থান করে না।
তখন দেহাত্মদর্শী জীব পুনরায় গর্ভবাস-যন্ত্রণার ভয়ে ভীত হইয়া সপ্ত ধাতুর দ্বারা বদ্ধাবস্থায়ই কৃতাঞ্জলিপূর্বক ব্যাকুলচিত্তে, যে পরমেশ্বর তাহাকে মাতৃগর্ভে প্রেরণ করিয়াছেন, তাহার স্তব করিতে আরম্ভ করে।
জীব বলিতে থাকে,— “এই পরিদৃশ্যমান জগৎ পালন করিতে ইচ্ছুক হইয়া যিনি নানাবিধ মূর্তি প্রকট করেন এবং যে ভগবান্ আমার ন্যায় অসদ্ব্যক্তির অনুরূপা এই গতি বিধান করিয়াছেন, আমি তাহার ভূতলসঞ্চারি অভয় পাদারবিন্দে শরণ গ্রহণ করিলাম।
যে ‘আমি’ জননী-জঠরে দেহাকার-পরিণতা মায়াকে আশ্রয়পূর্বক কর্মদ্বারা আবৃত-স্বরূপ বদ্ধ হইয়া অবস্থান করিতেছি, এবং ভগবান্—যিনি অন্তর্যামিরূপে আমার সহিত এইস্থানে বাস করিতেছেন, সেই ‘আমাতে’ ও ‘ভগবানে’ বিশেষ ভেদ আছে। ভগবান্—স্থূল ও লিঙ্গ উপাধি-রহিত অর্থাৎ তাহার দেহ ও দেহীতে ভেদ নাই: তিনি অখণ্ডজ্ঞানস্বরূপ। আমার সন্তপ্তহৃদয়ে তাঁহার ঐ রূপ প্রতিভাত হইতেছে। তিনিই আমার শরণ্য, তাহাকে আমি নমস্কার করি।
আমি পঞ্চভূতরচিত এই দেহমধ্যে আচ্ছন্ন হইয়া বাস করিতেছি বলিয়া আমার যাহা আপাত-বোধ হইতেছে, কিন্তু বস্তুতঃ আমি তাহা নহি; কারণ, আমার নিত্যস্বরূপ পাঞ্চভৌতিক দেহের সহিত অসম্পৃক্ত; সুতরাং ইন্দ্রিয়, গুণ বিষয় ও চিদাভাসাত্মক হওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব, কিন্তু ভগবানের মহিমা এই শরীর-যোগেও কুণ্ঠিত হয় না অর্থাৎ তিনি ব্যষ্টিজীব-হৃদয়ে অন্তর্যামিরূপে অবস্থান করায় তাঁহার অপ্রাকৃতস্বরূপ কোন বিকার বা মায়া-সংস্পর্শ লাভ করেন না, কিম্বা মায়িক-জীবের দেহের ন্যায় তাহার দেহ-দেহীতে কখনও ভেদ হয় না; কারণ, তিনি বৈকুণ্ঠ বস্তু। তিনি প্রকৃতি ও পুরুষের নিয়ন্তা এবং সর্বজ্ঞ। আমি সেই আদিপুরুষকে বন্দনা করি।
যাঁহার মায়া-দ্বারা জীব জ্ঞান ও পূর্বস্মৃতি হারাইয়া বিস্তৃত গুণকর্মনিমিত্ত এই সংসার-পথে শ্রান্ত হইয়া ভ্রমণ করিতেছে, সেই পরমেশ্বরের কৃপা ব্যতীত অন্য কোনপ্রকরই জীব পুনর্বার স্ব-স্বরূপ প্রাপ্ত হইতে পারে না।
পরমেশ্বর ব্যতীত আমাকে ত্ৰৈকালিক জ্ঞান দান করিতে আর কে-ই বা সমর্থ হইবেন? পরমেশ্বরের অংশ অন্তর্যামিপরমাত্মরূপে চরাচর নিখিল পদার্থে প্রবিষ্ট রহিয়াছেন। অতএব কর্মফলে বদ্ধজীব-পদবী প্রাপ্ত হইয়া আমরা ত্রিতাপজ্বালা দূর করিবার জন্য তাহাকে ভজন করি॥
হে ভগবন্! আমি রক্ত, মল মূত্রপূর্ণ কূপস্বরূপ মাতৃগর্ভে পতিত হইয়া তাহার জঠরানল দ্বারা সন্তপ্ত হইতেছি। এই স্থান হইতে নির্গত হইবার জন্য আমি আমার পরিমিত মাস গণনা করিতেছি; ভাবিতেছি,—ভগবান্ কবে আমায় এইস্থান হইতে নিষ্কৃতি দিবেন।
হে ঈশ, অসীম-কৃপাময় যে পুরুষ দশমাসমাত্রবয়স্ক জীবকে এইরূপ জ্ঞান প্রদান করিয়াছেন, সেই দীননাথ আপনি আপন-কার্যদ্বারা সন্তুষ্ট হউন। কেবল অঞ্জলি রচনা ব্যতীত কোন ব্যক্তি ভগবানের কৃতোপকারের যথোচিত প্রত্যুপকার করিতে সমর্থ হইবেন ?
হে ভগবন্! সপ্তধাতুরূপ বন্ধনে আবদ্ধ পশ্বাদি অপরাপর জন্তুসকল কেবল স্ব-স্ব-দেহে তদুৎপন্ন-সুখ-দুঃখ অনুভব করিয়া থাকে। কিন্তু আমি যাহার প্রদত্ত বিবেক-জ্ঞানবলে সমদমাদিযুক্ত হইয়াছি, সেই ভোক্তৃ-স্বরূপ অপরোক্ষরূপে প্রতীয়মান অনাদি পূর্ণ-পুরুষকে অন্তরে ও বাহিরে দর্শন করিতেছি।
হে প্রভো! আমি বহুবিধ দুঃখের নিলয় এই গর্ভমধ্যে বাস করিয়াও এই স্থান হইতে বহির্গত হইতে ইচ্ছা করি না; কেন না, বাহিরে ইহা অপেক্ষাও ঘোর অন্ধকারময় সংসার-কুপ বিদ্যমান। যে ব্যক্তি ঐ স্থানে গমন করে, আপনার মায়া তাহাকে আচ্ছাদন করিয়া থাকে। মায়া দ্বারা আচ্ছন্ন হইয়া জীব দেহাদিতে ‘অহং’ বুদ্ধি করিয়া পুত্রকলত্রাদির সম্বন্ধ-নিমিত্ত এই সংসারচক্রে পরিভ্রমণ করে।
অতএব আমি এই স্থানেই অবস্থানপূর্বক বিষ্ণুপাদযুগল হৃদয়ে ধারণ-পূর্বক সারথীরূপিণী বুদ্ধির সাহায্যে সংসার হইতে আত্মাকে অতিশীঘ্রই উদ্ধার করিব। হে ভগবন! যেন পুনর্বার আমি নানা-গৰ্ভবাসরূপ দুঃখে পতিত না হই।’
ভগবান্ কপিলদেব কহিলেন,—(মাতঃ) এইরূপ দশমাস-বয়স্ক গর্ভস্থ জীব যখন ভগবানের স্তব করিতে থাকে, অমনি প্রসবের কারণীভূত বায়ু তাহাকে অবাঙ্মুখ করিয়া ভূমিষ্ঠ হইবার জন্য প্রেরণ করে।
সেই জীব প্রসব-বায়ুদ্বারা অধঃক্ষিপ্ত হয় এবং সেই মুহূর্তেই অধোমস্তক হইয়া অবশভাবে অতিকষ্টে বহির্গত হইতে থাকে, সেই সময় তাহার শ্বাসরুদ্ধ ও স্মৃতিশক্তি বিলুপ্ত হইয়া পড়ে।
অনন্তর ঐ জীব রক্তাক্ত কলেবরে ভূমিতে পতিত হইয়া পুরীযজন্ম-কৃমির ন্যায় অঙ্গ সঞ্চালন করিতে থাকে এবং ভিন্নদশাপ্রাপ্তি-হেতু পূর্ব জ্ঞান বিনষ্ট হওয়ায় পুনঃ পুনঃ ক্রন্দন করিতে থাকে।
যাহারা পরের অভিপ্রায় জানে না, সেইরূপ অজ্ঞব্যক্তির দ্বারা সেই নব-প্রসূত শিশু প্রতিপালিত হয়। সুতরাং শিশুর ক্রন্দনের তাৎপর্যোপলব্ধিতে অসমর্থ সেই প্রতিপালক ঐ শিশুর ক্রন্দনকালে উহাকে তাহার অনভিপ্রেত বস্তু প্রদান করিলেও (অর্থাৎ স্তন্যের জন্য ক্রন্দন করিলে, শিশুর উদর-ব্যথা কল্পনা করিয়া নিম্বরস প্রদান এবং শিশু প্রকৃতপক্ষে উদর-ব্যথায় ক্রন্দন করিলে। তাহাকে ঔষধদানের পরিবর্তে স্তন্য দান করিলেও), সেই শিশু তাহা প্রত্যাখ্যান করিতে সমর্থ হয় না।
শিশুর প্রতিপালক তাহাকে অপবিত্র পর্যঙ্কে শয়ন করাইয়া রাখে। শিশুর স্বেদজাত কীটসমূহ উহার গাত্রে দংশন করিতে থাকিলেও ঐ শিশু স্বীয় শরীর কণ্ডুয়ন বা শয্যা হইতে উত্থানাদির চেষ্টা করিতে পারে না।
বৃহৎ বৃহৎ কৃমিকুল যেরূপ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃমিগণকে দংশন করে, তদ্রূপ দংশ, মশক ও মকুণাদি শিশুর কোমল শরীর পাইয়া দংশন করে। শিশুর মাতৃগর্ভে অবস্থানকালীন জ্ঞান বিগত হওয়ায় সে কোন প্রতীকারের উপায় করিতে সমর্থ না হইয়া কেবল ব্যথা অনুভব ও ক্রন্দন করে।
এইরূপ পঞ্চবর্ষ পর্যন্ত পূর্বোক্ত ক্লেশসমূহ ভোগ করিয়া পরে পৌগণ্ড অবস্থায় অধ্যয়নাদির দুঃখ অনুভব করে। অতঃপর যখন সে যৌবন-দশায় উপনীত হয়, তখন অভিলষিত বস্তুসমূহ লাভ করিতে না পারিয়া অজ্ঞান-বশতঃ ক্রোধে প্রদীপ্ত হইয়া। উঠে এবং শোকাভিভূত হয়। তাহার শরীরবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেহাত্মাভিমানও বৃদ্ধি পায়। তখন ঐ কামি-জীব, কামের অপূরণে যে ক্রোধের উৎপত্তি হয়, তদ্বারা অভিভূত হইয়া নিজ-বিনাশের নিমিত্ত অন্যকামিগণের সহিত বিরোধ করে।
মূঢ় মন্দবুদ্ধি জীব পঞ্চভূত-বিনির্মিত দেহে পুনঃ পুনঃ ‘আমি’ ও ‘আমার’—এইরূপ বুদ্ধি করিয়া থাকে।
যে দেহ অবিদ্যা ও কর্মদ্বারা জীবের বন্ধন হেতুভূত হইয়া জীবকে ক্লেশ প্রদানপূর্বক জন্মে-জন্মে জীবের অনুগমন করে, মূঢ়-দেহী আবার সেই দেহের নিমিত্তই কর্মের অনুষ্ঠান পূর্বক কর্ম-বদ্ধ হইয়া সংসার ভ্রমণ করে।‘—ইত্যাদি কৃষ্ণবিস্মৃত কৃষ্ণবহির্মুখ অষ্টপাশ-বদ্ধ জীবগণের কালচক্ৰদ্বারা পীড়ন-লাভ, গর্ভবাস-দুঃখ, জন্মে জন্মে তাপ ও দুর্গতি বর্ণন আলোচ্য।