সে দুঃখ-বিপদ্ প্রভু, রহু বারে বার।
যদি তোর স্মৃতি থাকে সর্ব-বেদ-সার॥
সকল বেদের ইহাই একমাত্র সারকথা যে, নিরন্তর কৃষ্ণস্মৃতি থাকিলে জীবের কখনও কোনও প্রকার অমঙ্গল থাকে না বা উপস্থিত হয় না। হে ভগবন্! এই প্রপঞ্চে প্রাক্তন কর্ম-ফলে নানাপ্রকার দুঃখে পতিত হইয়াও যদি তোমার অবিস্মৃতি আমার চিত্তে নিরন্তর জাগরূক থাকে, তাহা হইলে উহাই আমার পক্ষে সর্বোত্তম মঙ্গল।
বিস্মৃত বহির্মুখ জীবকুলকে দ্বিতীয়াভিনিবেশ হইতে মুক্তি প্রদান করিয়া ভগবান্ তাঁহার প্রতি উন্মুখীকরণের নিমিত্ত জীবের অসংখ্য ত্রিতাপ-দুঃখ-ক্লেশ-কষ্টাদি, বহিঃপ্রতীতিতে দণ্ড-স্বরূপ, কিন্তু অন্তঃদৃষ্টিতে মহা-কৃপার নিদর্শনস্বরূপ, সাজাইয়া রাখিয়াছেন। প্রতি পদে কর্মের কর্তৃত্বাভিমানে অহঙ্কারবিমুঢ় হইয়া আমরা ইন্দ্রিয়সুখ-ভোগে সর্বক্ষণ আসক্ত থাকি, কিন্তু মোহিনী বঞ্চনাময়ী মায়া আমাদের সমস্ত সুখ-ভোগকেই দুঃখে পরিণত করায়। তথাপি এই ত্রিতাপদুঃখে ক্লিষ্ট, দণ্ডিত ও নিষ্পেষিত হইবার কঠোর বিধানের অন্তরালে ভগবানের অতুল দয়া—অন্তঃসলিলা ফল্গুনদীর ন্যায় প্রবাহিতা; যেহেতু সংসারে নানা প্রকার অসংখ্য বাধাবিঘ্ন বিপত্তি বিপাকাদি অসুবিধার ফলে আমাদের ইন্দ্রিয়তর্পণের ব্যাঘাত ঘটিলে ত্রিতাপ-ক্লেশের মূলকারণ আমাদের ঈশ্বর-বিরোধী স্বাতন্ত্র্যের অপব্যবহার ও নিজ-বহির্মুখতার প্রতি ধিক্কার এবং সঙ্গে সঙ্গে সাংসারিক অভিনিবেশের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা আসে। তখন এই দুঃখময় প্রপঞ্চভোগ হইতে নিবৃত্ত ও নিজের নিত্য মঙ্গলানুসন্ধানের নিমিত্ত চেষ্টান্বিত হইয়া বিপদবারণ, দুরিতদলন নিত্যপ্রভু মধুসূদনের পাদপদ্মের অসীম কৃপা স্মরণ করি। ইহাতে আমরা এই শিক্ষা পাই যে, এই সংসারের প্রতি প্রভুত্ব করিবার বাসনায় ভোগী হইবার চেষ্টা—নিতান্ত নির্বোধের বিচার। সচ্চিদানন্দবিগ্রহ সর্বকারণকারণ কৃষ্ণের স্মরণ এবং স্মরণরূপা সেবাই আমাদের নিত্যধন ও পরমকল্যাণপ্রদ।
(ভাঃ ২/১/৬ শ্লোকে পরীক্ষিতের প্রতি শ্ৰীশুকোক্তি—)
“এতাবান্ সাংখ্য-যোগ্যভ্যাং স্বধর্মপরিনিষ্ঠয়া।
জন্মলাভঃ পরঃ পুংসামন্তে নারায়ণস্মৃতিঃ॥
অর্থাৎ ‘স্ব-স্ব-বর্ণাশ্রমধর্ম-পালন, সাংখ্যজ্ঞান এবং অষ্টাঙ্গ-যোগের দ্বারা অন্তে নারায়ণ-স্মৃতিই পুরুষের জন্মলাভের সর্বশ্রেষ্ঠ ফল।”