কৃষ্ণভক্তিপর শাস্ত্রের প্রশংসা ও অভক্তিপর শাস্ত্রের গর্হণ—
সে-ই শাস্ত্র সত্য—কৃষ্ণভক্তি কহে যা’য়।
অন্যথা হইলে শাস্ত্র পাষণ্ডত্ব পায় ॥
যে সকল নিরস্তকুহক সাত্বতশাস্ত্র কৃষ্ণভক্তি প্রতিপাদন ও কীর্তন করেন, সেইসকল শাস্ত্রই সত্য ও পরমধর্মনিরূপক। যদি কোন শাস্ত্রে কৃষ্ণের নাম, রূপ, গুণ, পরিকরবৈশিষ্ট্য ও লীলার কথা শ্রুত বা কীর্তিত না থাকে, অথবা কৃষ্ণভক্তের নিত্যত্ব ও সর্বশ্রেষ্ঠ গৌরব-মাহাত্ম বর্ণিত না থাকে, অথবা একমাত্র কৃষ্ণভক্তিরই সর্বোত্তম অভিধেয়ত্ব লিখিত না থাকে, তাহা হইলে উহাকে ‘শাস্ত্র’ বলিবার পরিবর্তে ‘পাষণ্ডীর প্রজল্প’ বলিয়া দুঃসঙ্গ-জ্ঞানে কখনই অনুশীলন করিবেন না।
(শ্রীমধ্বভাষ্য-ধৃত স্কন্দপুরাণ-বাক্য) “ঋগ্ যজুঃসামাথার্বাশ্চ ভারতং পঞ্চরাত্রকম্। মূলরামায়ণঞ্চৈব শাস্ত্র মিত্যভিধীয়তে॥ যচ্চানুকূলমেতস্য তচ্চ শাস্ত্রং প্রকীর্তিতম্। অতোহন্যগ্রন্থবিস্তারো নৈব শাস্ত্রং ‘কুবর্ত্ম’ তৎ॥”
অর্থাৎ, ‘ঋক্, যজুঃ, সাম ও অথর্ব—এই চারিবেদ এবং মহাভারত, মূল-রামায়ণ ও পঞ্চরাত্র, —এই সকলই ‘শাস্ত্র’ বলিয়া কথিত হইয়াছে। ইহাদের অনুকূল যে-সকল গ্রন্থ, তাহাও শাস্ত্র’-মধ্যে পরিগণিত। এতদ্ব্যতীত যে-সকল গ্রন্থ, তাহা শাস্ত্র ত’ নহে-ই, বরং তাহাকে ‘কুবর্ত্ম’ বলা যায়।’
(তত্ত্বসন্দর্ভধৃত মৎস্যপুরাণবাক্য—) “সাত্ত্বিকেষু চ কল্পেষু মাহাত্ম্যমধিকং হরেঃ। রাজসেষু চ মহাত্মমধিকং ব্রহ্মণো বিদুঃ। তদ্বদগ্নেশ্চ মাহাত্ম্যং তামসেষু শিবস্য চ। সঙ্কীর্ণেষু সরস্বত্যাঃ পিতৃণাঞ্চ নিগদ্যতে॥”
অর্থাৎ, ‘সাত্ত্বিক পুরাণাদি শাস্ত্রে হরির মহিমাই অধিক বর্ণিত হইয়াছে। রাজসিক পুরাণে ব্রহ্মার মহিমাধিক্য এবং তামসিক পুরাণে ব্রহ্মার ন্যায় অগ্নি, শিব ও দুর্গার মহিমা, আর সঙ্কীর্ণ অর্থাৎ সত্ত্বরজস্তমো-মিশ্র বিবিধ শাস্ত্রে সরস্বতী প্রভৃতি নানা-দেবতার মহিমা ও পিতৃলোকের মাহাত্ম্য কীর্তিত হইয়াছে।
অনেক অনভিজ্ঞ ভারবাহী আত্ম-পর-বঞ্চনাভিলাষি ব্যক্তি ধারণা করিয়া থাকেন যে, কৃষ্ণের, কৃষ্ণভক্তির ও কৃষ্ণভক্তের মহিমাগানকারি-শাস্ত্রসমূহ ইন্দ্রিয়পরায়ণ সকাম জনগণের বিরুদ্ধে লিখিত হইয়াছে বলিয়া সেই সকল শাস্ত্র—তাহাদেরই ন্যায় বিবাদপরায়ণ ও সাম্প্রদায়িক। কিন্তু শ্রীগৌরসুন্দর স্বীয় জননীকে কৃষ্ণ-কার্ষ্ণ-ভক্তিমহিমা-কীর্তনমুখে ঐ সকল আধ্যক্ষিক-জ্ঞানসম্বল মূর্খগণকে তাহাদের পূর্বোক্ত ভ্রান্তিময়ী ধারণা হইতে পরিত্রাণ করিবার মানসেই এই সত্যার্থ ব্যাখ্যা করিলেন। নিরস্তকুহক শাস্ত্রের কৃষ্ণকার্ষ্ণভক্ত-মহিমা কীর্তন—সাম্প্রদায়িক বিবদমান অর্থবাদ নহে, পরন্তু তাহাই সমগ্র চরমকল্যাণার্থি-জীবকুলের একমাত্র পরম মঙ্গলপ্রদ সিদ্ধান্ত। আধ্যক্ষিক বিচারপরায়ণ সঙ্কীর্ণচেতা নারকিগণই সর্বেশ্বরেশ্বর বিষ্ণুপরতত্ত্ব কৃষ্ণকেও অন্যান্য ইতর দেবতার সহিত সমান ও প্রতিদ্বন্দ্বী বা কোন সঙ্কীর্ণ সম্প্রদায়বিশেষের আরাধ্য-দেব বলিয়া মনে করেন। তাহা হইলেও তাহাদের নির্বিশেষ-বিচারপর জ্ঞানশাস্ত্র ও অর্থবাদপূর্ণ মধুপুষ্পিত ফলশ্রুতিজ্ঞাপক বহুদেবযজনোদ্দেশক সকাম কর্মশাস্ত্রের ব্যাখ্যাবাদ ও বাগ্বৈখরীরূপ দুঃসঙ্গদ্বয় পরিত্যাগ করিয়া ঐকান্তিক কৃষ্ণভক্তি-প্রতিপাদক একায়নশাস্ত্র অধ্যয়ন করিলেই নিত্য নিঃশ্রেয়সলাভের সুযোগ লাভ করিবেন।