প্রভুর ভক্তগণ-সহ নিজভক্ত বৈষ্ণবাগ্রগণ্য শিবের পূজা-লীলা—
আপনে ভুবনেশ্বর গিয়া গৌরচন্দ্র।
শিবপূজা করিলেন লই ভক্তবৃন্দ।
তথ্য। শ্রীবিশ্বনাথ চক্রবর্তিঠাকুর “সঙ্কল্পকল্পদ্রুম”-গ্রন্থে লিখিয়াছেন—“বৃন্দাবনাবনীপতে জয় সোম সোমমৌলে সনন্দন সনাতন নারদেড্য। গোপেশ্বর-ব্রজবিলাসি-যুগাঙ্ঘ্রি পদ্মে প্রীতিং প্রযচ্ছ নিতরাং নিরুপাধিকাং মে।।’’
অতত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তিসকল মহাদেবের কৃষ্ণ-সেবাময় মাহাত্ম্য এবং কোন কোন পৌরাণিক আখ্যায়িকার প্রকৃত মর্ম বুঝিতে না পারিয়া মনে করেন, শিব- —রামাদি বিষ্ণুতত্ত্ব এবং সীতাদি লক্ষ্মীরও পুজিত ঈশ্বর। সুতরাং রুদ্রই স্বতন্ত্র পরমেশ্বর, বিষ্ণুদেবতা পরমেশ্বর রুদ্রের অধীন। কেহ কেহ বা বিষ্ণুকে রুদ্রের সহিত সমান বা রুদ্রেরই নামান্তর বিবেচনা করিয়া অতাত্ত্বিক সমন্বয়বাদের আবাহন করেন। কিন্তু নিখিল শ্ৰৌতশাস্ত্র ও যুক্তি তাহা নিরাস করিয়াছেন।
“যস্তু নারায়ণং দেবং ব্রহ্মরুদ্রাদিদৈবতৈঃ।।
সমত্বেনাভিজানাতি স পাষণ্ডী ভাবে ধ্রুবম্ ।।’’ পদ্মপুরাণ।।
যে ব্যক্তি শ্রীনারায়ণকে ব্রহ্মা রুদ্র প্রভৃতি দেবতার সহিত সমান মনে করে, নিশ্চয়ই পাষণ্ডী।
মহাভারতের অন্তর্গত ঔপমন্যব্যাখ্যানে যে লিখিত আছে, —শ্রীকৃষ্ণ জাম্ববতীর পুত্রের জন্য তপস্যাদ্বারা রুদ্রের আরাধনা করিয়াছিলেন এবং রুদ্রের অঙ্গ হইতেই বিষ্ণুর সহিত সকল দেবতার উৎপত্তি হইয়াছে এইরূপ সিদ্ধান্তের সঙ্গতি কোথায় ?
যাঁহারা শাস্ত্রের প্রকৃত তাৎপর্য বুঝিতে না পারিয়া এইরূপ সিদ্ধান্ত করেন, তাঁহাদের বিচার অতীব স্থূল। কেন না, শাস্ত্রে বর্ণিত আছে, রুদ্র বাণরাজার যুদ্ধে ভগবান্ বিষ্ণুকর্তৃক পরাভূত হইয়া তাঁহাকেই মুলদেবতা ও পরমেশ্বর বলিয়া স্তব করিয়াছিলেন এবং মোহিনীমূর্তি-দর্শনে মোহিত, বৃকাসুরের হস্ত হইতে রক্ষিত ও ব্রহ্মহত্যার পাতক হইতে মুক্ত হইয়াছিলেন। তবে যে বিষ্ণু কোন কোন স্থলে রুদ্রের পূজাদি-লীলা প্রদর্শন করিয়াছেন, শাস্ত্রে তাহার তাৎপর্য লিখিত আছে—
তস্মাৎ স্বেরেষুসর্বেষু সকামেষু রুদ্রোপাসনাস্থেম্নে মে স্বকীয়স্য তস্য তথারাধনং খ্যাপয়ংস্তদন্তর্যামিনমাত্মানমসৌ সৎকারোতীতি মন্তব্যম্ ।“অহমাত্মা হি লোকানাং বিশ্বেষাং পাণ্ডুনন্দন। তস্মদাত্মানমেবাগ্রে রুদ্রং সংপূজয়াম্যহম্।। ময়া কৃতং প্রমাণং হি লোকঃ সমনুবর্ততে। প্রমাণানি হি পূজ্যানি ততস্তং পূজয়াম্যহম্।। ন হি বিষ্ণুঃ প্রণমতি কস্মৈচিদ্বিবুধায় চ। অত আত্মানমেবেতি ততো রুদ্রং ভজাম্যহম্’’ ইতি নারায়ণীয়ে ভগবদ্ধাক্যাদেব। অত্র বিশ্বেষামন্তর্যাম্যহমতস্তপ্তায়ঃ পিণ্ডবদবিবিক্তং রুদ্রাবেশিনং মদংশমহং পূজয়ামি ‘রুদ্রাদয়ো দেবাঃ পূজ্যাঃ ইতি প্রমাণং ময়া কৃতং তদন্যথা ব্যাকুপ্যেত, তদর্থমহং তান্ পূজয়ামি, স্বোৎকৃষ্টদ্যাভাবাদেব তদ্বুদ্ধ্যাহং ন কিঞ্চিদ্ভজামি, কিন্তু তাদৃশং মদংশমহং ভজামীতি বিস্ফুটম্ । ব্রহ্মরুদ্ৰাদিসর্বান্তর্যামী বিষ্ণুরিতি
তত্রৈব রুদ্রং প্রত্যুক্তং ব্ৰহ্মণা —
“তবান্তরাত্মা মম চ যে চান্যো দেহিসংজ্ঞিতাঃ।। সর্বেষাং সাক্ষিভূতোঽসৌ ন গ্রাহ্য কেনচিৎ ক্বচিৎ।।’’
ঔপমন্যব্যাখ্যানে তু বিশেষেণৈব প্রশ্নোত্তরয়ো সত্ত্বাত্তত্র তাৎপর্যান্তরং কল্পনীয়ম্। তচ্চ দর্শিতমেব। ইতরথা সমুদ্রস্যাপীশ্বরতাপত্তিঃ । শ্রীরামেণ তৎপূজায়া বিধানাৎ এবং ক্কচিদ্ভগবৎপার্ষদানাং দেবতান্তরারাধনমপি তদারাধ্যতাব্যাখ্যাপনার্থং লীলারূপমেব, ন হি তৎসিদ্ধান্তকক্ষামারোক্ষ্যতি। সর্বেশ্বরো বিষ্ণুশ্চৌরেষু মিলিতো রাজেব জগৎকার্যায় দেবেষু প্রবিষ্টস্তস্য স্বেচ্ছাভিব্যক্তির্জন্মেত্যভিধীয়তে। (সিদ্ধান্ত-রত্নম্, ৩য় পাদ ২২, ২৩,২৬,২৭)।।
নিজ নিষ্কপট ভক্ত ব্যতীত ধর্মার্থ-কাম-মোক্ষকামী কৈতবযুক্ত জীবসকলের পক্ষে রুদ্রোপাসনা-প্রচারার্থ ভগবান্ বিষ্ণু স্বকীয় রুদ্রের তদ্রূপ আরাধনার অভিনয় প্রদর্শন করেন। নারায়ণীয়ে অর্জুনের প্রতি শ্রীভগবানের উক্তিতে এই বিষয়টা পরিস্ফুট রহিয়াছে—হে অর্জুন, আমি বিশ্বের আত্মা; আমি যে রুদ্রের পূজা করি, তাহা আত্মারই পূজা। আমি যাহার অনুষ্ঠান করি,
লোকসমূহ তাহার অনুবর্তন করে। প্রমাণই—পূজ্য। এই উদ্দেশ্যেই আমি রুদ্রের পূজা করিয়া থাকি। বিষ্ণু কোন দেবতাকেই প্রণাম করেন না। আমি আত্মাকেই রুদ্র বলিয়া পূজা করি। আমি বিশ্বের অন্তর্যামী। তপ্ত লৌহপিণ্ডের ন্যায় অবিবিক্ত রুদ্ররূপী আমার অংশকেই পূজা করি। “রুদ্রাদি দেবতাসমূহ পূজ্য’’—এই প্রমাণ আমিই করিয়াছি। আমি যদি রুদ্রপূজার আদর্শ প্রদর্শন
করি, তাহা হইলে ঐ প্রমাণ লোকে গ্রহণ করিবে না; এই জন্যই আমি নিজে আচরণ করিয়া আমার ভূত্যের পূজা আমিই শিক্ষা দিয়া থাকি। আমার সমান বা আমা হইতে শ্রেষ্ঠ আর কেহই নাই। সুতরাং ‘শ্রেষ্ঠ’ বুদ্ধিতে আমি কাহারও পূজা করি না। আমার ‘অংশ’ বলিয়াই লোকশিক্ষার্থ আমি রুদ্রাদি- দেবতার পূজার আদর্শ প্রদর্শন করি। ব্রহ্মা এই স্থলেই রুদ্রকে বলিয়াছিলেন, —বিষ্ণুই ব্রহ্মা ও রুদ্র—সকলের অন্তর্যামী। যথা,—“বিষ্ণু তোমার, আমার ও অপর দেহিসমূহের অন্তর্যামী। তাঁহাকে কেহই কোনরূপে অক্ষজ জ্ঞানের বিষয়ীভূত করিতে পারে না।’’
শ্রীরামচন্দ্র জগতে বৈষ্ণববর শিবের পূজা-প্রচারার্থ শিবপূজার অভিনয় প্রদর্শন করিয়াছেন বলিয়া যদি শিবই পরমেশ্বর হন, আর শ্রীরামচন্দ্র তদধীন হন, তাহা হইলে শ্রীরামচন্দ্র সমুদ্রের পূজা করিয়াছিলেন বলিয়া সমুদ্রকেও ‘পরমেশ্বর’ বলিতে হয়। এইরূপ কোথাও কোথাও ভগবৎপার্ষদগণ, যে দেবতান্তরের পূজার অভিনয় করিয়াছেন, তত্তৎস্থলেও বিষ্ণ্বুধীন তত্তদ্ দেবতার পূজাপ্রচারার্থই জানিতে হইবে। উহা শ্রীভগবৎপার্ষদবর্গের “বিষ্ণুর অধীন সমস্ত দেবতা” —ইহা প্রচারার্থ লীলামাত্র। উহা কখনই সিদ্ধান্তকক্ষায় আরূঢ় হইতে পারে না। ভগবান্ বিষ্ণুই—সর্বেশ্বর। তিনি যে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, প্রলয়কর্তা রুদ্রের ন্যায় জগতের স্থিতি বিধান করেন, তাহা চৌরমধ্যে প্রবিষ্ট রাজার ন্যায় জগতের কার্যের জন্য তাঁহার দেবতাগণের মধ্যে প্রবেশ মাত্র। প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মা ও রুদ্র বিষ্ণুরই শক্তিতে সৃষ্টি ও প্রলয়কার্যে সামর্থ্য লাভ করেন। সুতরাং বিষ্ণুই ব্রহ্মা-রুদ্রাদি-দেবতার নিত্য আরাধ্য।
নারায়ণাদীনি নামানি বিনান্যানি স্বনামানি দ্রুহিণদিভ্যো দদাবিতি চোক্তং স্কান্দে;—
“ঋতে নারায়ণাদীনি নামানি পুরুষোত্তমঃ ।
প্রাদাদন্যত্র ভগবান্ রাজেবার্ত স্বকং পুরম্”
কপালিনস্তু শিবস্য ঘোররূপতা মুমুক্ষুহেয়তা চ স্মৃতা * —
মুমুক্ষবো ঘোররূপান্ হিত্বা ভূতপতীনথ ।
নারায়ণকলাঃ শান্তা ভজন্তি হনসূয়বঃ।।’’
(সিদ্ধান্তরত্নম্ , ৩য় পাদ ১৩/১৪)।
স্কন্দপুরাণে উক্ত হইয়াছে যে, ভগবান বিষ্ণু ‘নারায়ণ’ প্রভৃতি কয়েকটী নাম ভিন্ন স্বকীয় নামসমূহ ব্রহ্মারুদ্ৰাদি দেবগণকে প্রদান করিয়াছেন। যেমন, রাজা নিজ রাজধানী ব্যতীত অন্যান্য নগরসমূহ অমাত্য-ভৃত্য-প্রভৃতিকে বাসার্থ প্রদান করেন, তদ্রূপ স্বরাট্ পুরুষোত্তম ভগবান্ বিষ্ণুও স্বকীয় বিশেষ কয়েকটী নাম ভিন্ন অপরাপর নামগুলি অন্যান্য দেবতাকে ব্যবহারার্থ প্রদান করিয়াছেন।
রুদ্রের ঘোররূপত্ব ও মুমুক্ষুহেয়ত্বই প্রসিদ্ধ আছে। এজন্য শ্রীমদ্ভাগবতে উক্ত হইয়াছে,—“অসূয়ারহিত মুমুক্ষুগণ অর্থাৎ নিৰ্মৎসর সাধুগণ ঘোররূপ ভূতপতিসকলকে পরিত্যাগপূর্বক শ্রীনারায়ণের শান্তকলাসমূহের ভজন করিয়া থাকেন।’’
পূর্বে ব্যাসদেবের বাক্য উদ্ধার করিয়া প্রদর্শিত হইয়াছে এবং শ্রীচৈতন্যভাগবতধৃত পৌরাণিক আখ্যায়িকা হইতে প্রমাণিত হইয়াছে যে, শ্রীভুবনেশ্বর ঘোররূপ রুদ্রমূর্তি বা লিঙ্গসামান্যে দ্রষ্টব্য নহেন। শ্রীভুবনেশ্বর শুদ্ধবৈষ্ণবগণের বিচারে শ্রীকৃষ্ণপ্রিয়তম ও শ্রীকৃষ্ণ হইতে অভিন্ন। শ্রীরূপানুগ বৈষ্ণব শ্রীভুবনেশ্বরকে শ্রীগোপালিনী শক্তিরূপে বিচার করিয়া তাঁহার নিকট শ্রীরাধাগোবিন্দের যুগলসেবা প্রার্থনা করেন।