শ্রীভবনেশ্বরে—
সর্বতীর্থ-জল যথা বিন্দু বিন্দু আনি’
‘বিন্দু-সরোবর’ শিব সৃজিলা আপনি।
‘স্বর্ণাদ্রিমহোদয়ে’ ষষ্ঠ ও সপ্তম অধ্যায়ে মহাদেব বলিতেছেন;—“হে ব্রহ্মন্, একাম্রক- কাননে দেবতাগণের সহিত উপস্থিত হইয়া দিব্যবস্তুসমূহের দ্বারা সযত্নে সেই পুরাণলিঙ্গের অর্চন করিবে এবং অর্চনান্তে শ্রদ্ধার সহিত সেই প্রসাদ-নির্মাল্য ভোজন করিবে।’’
মহাদেবের এই আদেশ শ্রবণ করিয়া ব্রহ্মা জিজ্ঞাসা করিলেন,—“হে মহেশ্বর, আমরা তোমার মাহাত্ম্য জানি না। মুনিগণ কিন্তু লিঙ্গ-নির্মাল্য ‘অভক্ষ্য’ বলিয়া থাকেন, অতএব সেই নৈবেদ্য কিরূপে গ্রাহ্য হইতে পারে ?’’
ব্যাস বলিলেন,—“লিঙ্গ- নির্মাল্য অভক্ষ্য বটে; কিন্তু শ্রীভুবনেশ্বর লিঙ্গ নহেন; ইনি সনাতন ব্রহ্ম। শিবনির্মাল্য-দূষণ বাক্যগুলি। ভুবনেশ্বরে প্রযোজ্য নহে। দেবগণ ভবসাগর উত্তীর্ণ হইবার জন্য এই ভুবনেশ্বরনৈবেদ্য গ্রহণ করেন। ভুবনেশ্বরে অর্পিত অন্ন ব্রহ্মবুদ্ধিতে সেবন করিবে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং অধম জাতিও ভুবনেশ্বরের প্রসাদে পংক্তিভেদ করিবে না, অন্যথা। নিশ্চয়ই নরকে যাইবে। ভুবনেশ্বরের প্রসাদ প্রাপ্তিমাত্রেই ভোজন করিবে; ইহাতে কোনও স্পর্শদোষ হয় না। দেবতা, পিতৃগণ ও ব্রাহ্মণগণকে এই প্রসাদ দান করিবে। কুরুক্ষেত্রে চন্দ্ৰসূর্যোপরাগে মহাদানে যে ফল লাভ হয়, ভুবনেশ্বরের উচ্ছিষ্ট অন্নদানে সেই ফলপ্রাপ্তি ঘটে। শুষ্ক, পর্যুসিত, দূরদেশাহৃত ভুবনেশ্বর-প্রসাদসেবনেও অনর্থমুক্তি ঘটে। ভুবনেশ্বর-প্রসাদ-সেবনে বিষ্ণুর দর্শন, পূজন, ধ্যান, শ্রবণাদির ফল উৎপন্ন হয়। অমৃতভক্ষণে বরং পুনর্জন্ম সম্ভব, কিন্তু ভুবনেশ্বর নির্মাল্যসেবনে পুনর্জন্ম হয় না। ভুবনেশ্বরের নির্মাল্য-দর্শনে কামদ, শিরে ধারণ পাপঘ্ন, ভক্ষণে অমেধ্য-ভোজন দোষের নিবারক, আঘ্রাণে মানসপাপনিষেধক, দর্শনে দৃষ্টিজ পাপনাশক, গাত্রলেপে শারীরপাপবিনাশক, আকণ্ঠভোজনে নিরম্বু-একাদশীব্রতপালনের ফলদায়ক এবং সর্বতোভাবে। সেবায় বিষ্ণুভক্তিপ্রদায়ক।
পুনর্বার ঋষিগণের দ্বারা জিজ্ঞাসিত হইয়া ব্যাস বলিলেন,---“ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে ব্রহ্মা নারদকে বলিয়াছিলেন, —মানুষের কথা কি,ব্রহ্মাদি-দেবতাগণ নরদেহ ধারণপূর্বকভিক্ষুরূপে ভুবনেশ-নির্মাল্য যাচ্ঞা করেন। ভুবনেশ নির্মাল্য-ভক্ষণে শৌচাশৌচবিচার,
কালনিয়মাদি বিচার কিছুই নাই। অত্যন্ত নীচ ব্যক্তির দ্বারাও ভুবনেশ্বর প্রসাদ সৃষ্ট হইলে সেই প্রসাদগ্রহণে বিষ্ণুলােক-প্রাপ্তি ঘটে। যাহারা ভুবনেশ্বরের প্রসাদনির্মাল্যকে লিঙ্গনির্মাল্যসামান্যে বিচার করিয়া তাহার নিন্দা করে, তাহারা নরকগামী হয়। ভুবনেশ্বরের নৈবেদ্যের পাচিকা--স্বয়ং বৈষ্ণবীশ্রেষ্ঠা গৌরী এবং ভােক্তা সনাতন ব্রহ্ম; সুতরাং ইহাতে স্পর্শদোষের বিচার নাই। ইহাকে সাক্ষাৎ ব্রহ্মবৎ জানিবে। শ্রীঅনন্তবাসুদেবের উচ্ছিষ্ট-ভুবনেশ-মহামহাপ্রসাদ-নির্মাল্য কুকুরের মুখভ্রষ্ট এবং অমেধ্যস্থানগত হইলেও ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠগণেরও ভােজনীয়। বৈকুণ্ঠ-লিঙ্গরাজান্নভােজনে ব্রহ্মেন্দ্রাদির অপ্রাপ্য শ্রীবিষ্ণুর অনাময়পদ। প্রাপ্ত হওয়া যায়। সেই অন্নভােজনকারীকে যাহারা নিন্দা করে, তাহারা যতকাল চন্দ্রসূর্য থাকিবে, ততকাল নরকবাস করিবে। স্নাত বা অস্নাত অবস্থায় প্রাপ্তিমাত্র ভুবনেশ্বরের মহাপ্রসাদ-সেবনে বাহ্যাভ্যন্তর পবিত্র হয়। শ্রীঅনন্তবাসুদেবের উচ্ছিষ্টের উচ্ছিষ্ট স্বরূপ এই মহামহাপ্রসাদের মাহাত্ম্য অনন্তদেবও সহস্ৰবদনে বর্ণন করিতে পারেন না। এই প্রসাদ-মাহাত্মশ্রবণে ভুবনেশ প্রসন্ন হন; ভুবনেশ প্রসন্ন হইলে গােবিন্দও প্রসন্ন হইয়া থাকেন।” । | প্রত্যহ শ্রীশ্রীঅনন্তবাসুদেবের পূজা ও ভােগ সমাপ্ত হইলে শ্রীভুবনেশ্বর স্বীয় পূজা ও ভােগাদি গ্রহণ করিয়া থাকেন। এই বিধি এখনও শ্রীভুবনেশ্বরে প্রচলিত রহিয়াছে। এতদ্ব্যতীত তিনি নিজেরথাদিতে অরােহণ না করিয়া এবং চন্দন্যাত্রা, নৌকাবিলাস প্রভৃতিতে বহির্গত না হইয়া তাহার নিত্যপ্রভু শ্রীশ্রীঅনন্তবাসুদেব ও শ্রীশ্রীমদনমােহনকে ঐ সকল যান ও নানাবিধ বিলাসপরিচর্যাদি প্রদান করিয়া স্বীয় আচরণের দ্বারা কৃষ্ণপ্রীতে ভােগত্যাগের আদর্শ প্রদর্শনপূর্বক জগদ্বাসীকে বিষ্ণুভক্তি শিক্ষা প্রদান করেন। পূর্বে যে যে স্থানে শ্রীভুবনেশ্বরের বিমান ও রথাদিতে আরােহণ প্রভৃতি বিষয় উল্লেখ করা হইয়াছে, তত্তস্থানেও শ্ৰীশ্ৰীমদনমােহন ও শ্রীঅনন্তবাসুদেবের বিজয়বিলাসই বুঝিতে হইবে। | ভুবনেশ্বরের পাণ্ডাগণ শ্রীশ্রীমদনমােহনকে ‘ভুবনেশ্বরের প্রতিনিধি’ বলিয়া থাকেন। এখানে প্রতিনিধি’ শব্দের অর্থ অধীন পুরুষ নহে; যেমন সাধারণতঃ ‘রাজা’ ও ‘রাজপ্রতিনিধি’ প্রভৃতি শব্দে অর্থপ্রতীতি হয়। শ্রীভুবনেশ্বর ভৃত্য বা শক্তিতত্ত্ব বিচারে যাবতীয় ভােগবিলাস নিজে গ্রহণ না করিয়া একমাত্র প্রভু, শক্তিমত্তত্ত্ব, সকল ভােগের মালিক, স্বরাট পুরুষ মদনমােহনকেই ভােগ করাইয়া থাকেন অর্থাৎ নিজে ভােগ না করিয়া প্রভুকে ভােগ করান বলিয়া প্রতিনিধি’ অর্থাৎ বদলী’ বলা হইয়াছে। ভুবনেশ্বর নিজ পূজার পরিবর্তে তৎপ্রভু শ্রীমদনমােহন ও শ্রীঅনন্ত-বাসুদেবের পূজাই বরণ করেন। তিনি যখন নিজেও কোন পূজা গ্রহণ করেন, তাহাও শ্রীমদনমােহন বা শ্ৰীঅনন্তবাসুদেবের ভৃত্যবিচারে; স্বতন্ত্রবুদ্ধিতে তিনি কখনও কোন সেবা গ্রহণ। করেন না। | শ্রীমদনমােহন-মূর্তি--—যাহা শ্রীভুবনেশ্বরে বিরাজিত রহিয়াছেন, তাহা দ্বিভুজ নহেন, পরন্তু চতুর্ভুজ। শ্রীমদনমােহনের বামহস্তের উপরিভাগে মৃগ’, দক্ষিণ হস্তের উপরিভাগে ‘পরশু’, বামহস্তের নিম্নভাগে ‘অভয়’ এবং দক্ষিণ হস্তের নিম্নভাগে
চক চিহ্ন শােভিত রহিয়াছে। ভুবনেশ্বরের মূল মন্দিরের দক্ষিণে একটী মন্দিরে শ্রীমদনমােহন, শ্রীগােবিন্দ, পঞ্চবক্ত মহাদেব, শ্রীঅনন্তবাসুদেবের বিজয়মূর্তি, চতুর্ভুজ হরিহরমূর্তি, শ্রীশালগ্রাম প্রভৃতি বিরাজিত রহিয়াছেন।
ভুবনেশ্বরের মন্দিরের সেবাদি পরিচালনার তত্ত্বাবধায়কস্বরূপ কমিটীর সভ্যমধ্যে কটকের উকীল শ্রীযুক্ত প্রিয়নাথ চট্টোপাধ্যায়, পুরী-জেলাস্থ ঢেঙ্গার জমিদার শ্রীযুক্ত গঙ্গাধর চৌধুরী এবং কটকের উকীল শ্রীযুক্ত গােপাল প্রহররাজ আছেন। কমিটী একজন
ম্যানেজার নিযুক্ত করিয়াছেন। বর্তমান ম্যানেজারের নাম শ্রীযুক্ত লছমন রামানুজদাস। ম্যানেজার পাণ্ডাগণের
তরফের নিম্নলিখিত চারি জন পাণ্ডার নিকট হইতে ভুবনেশ্বরের বিভিন্ন সেবার খরচাদি এবং আয়-ব্যয় প্রভৃতি বুঝা-পড়া করিয়া থাকেন। এই চারি জনের নাম—১) জগন্নাথ মহাপাত্র, (২) নারায়ণ মকদম, (৩) দামোদর সান্তরা এবং (৪) সদয় মহাপাত্র।
শ্রীজগন্নাথদেবের সিংহদরজার অভ্যন্তরে যেরূপ বর্ণাশ্রমবহির্ভূত পতিত ব্যক্তিগণের দর্শনার্থ ভুবনেশ্বরের মন্দিরের সিংহদরজার অভ্যন্তরেও পতিতপাবন মুর্তি বিরাজমান। সিংহদ্বারের মধ্যেই আনন্দবাজার; পুরীর আনন্দবাজারের মত এখানেও প্রসাদাদি ক্রয়-বিক্রয় হইয়া থাকে, জগন্নাথের প্রসাদের মত এখানেও প্রসাদে স্পর্শদোষ ও উচ্ছিষ্ঠাদি বিচার নাই। সিংহদরজা অতিক্রম করিবার পর মন্দিরের সম্মুখে যে গরুড়স্তম্ভ আছে, সেই স্তম্ভের উপর বৃষ ও গরুড় বিরাজিত আছেন এবং জগন্নাথের মন্দিরের ন্যায় এখানেও প্রবেশপথে নৃসিংহ-মূর্তি বিরাজমান। তিনি চতুর্ভুজ, শান্তমূর্তি, উপরিভাগের দক্ষিণ হস্তে চক্র, উপরিভাগের বামহস্তে শঙ্খ, নিম্নের দুই হস্তে বেদপুস্তক এবং অঙ্কে শ্রীলক্ষ্মীদেবী। মূল মন্দিরের দক্ষিণ দিকে ভুবনেশ্বরের ভোগশালা, এখানে চন্দ্র-সূর্যের কিরণ পতিত হইতে পারিবে না—এইরূপ আদেশ আছে। এখানে ৩৬০ ঘরের ব্রাহ্মণপাণ্ডাগণ রন্ধন করেন। মূল মন্দিরের অভ্যন্তরে হরিহর-মিলিত-তনু শ্রীভুবনেশ্বর। পাণ্ডাগণ কু ও শ্বেতঅঙ্গ মিলিত শ্রীভুবনেশ্বর দেখাইয়া থাকেন। শ্রীভুবনেশ্বরের অঙ্গ চক্রাকার, তাহাতে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর চিহ্ন এবং মৎস্য-কুর্মাদি দশাবতার রহিয়াছেন।
ভুবনেশ্বরের মন্দিরের অপূর্ব শিল্পনৈপুণ্য সাধারণ দর্শকগণেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া থাকে। ভুবনেশ্বরের মন্দির, শ্ৰীঅনন্তবাসুদেবের মন্দির এবং ভুবনেশ্বরের আরও বহু বহু মন্দিরের ভাস্কর্য-নৈপুণ্য দর্শন করিলে একদিন ভারতীয় শিল্পের কিরূপ অভ্যুদয় হইয়াছিল, তাহা হৃদয়ঙ্গম করা যায়। ভুবনেশ্বরের মন্দির উচ্চে প্রায় ১৬৫ ফুট। বিন্দুসাগরের দক্ষিণে প্রায় ৩০০ গজ দূরে উচ্চ প্রাকার পরিবেষ্টিত সুবৃহৎ পাষাণময় চত্বর-মধ্যে এই মন্দির অবস্থিত। মন্দির-ভূমি দৈর্ঘ্যে ৫২০ এবং প্রস্থে ৪৬৫ ফুট।
তদ্ব্যতীত উত্তরমুখে ২৮ ফুট বাহিরশালা রহিয়াছে। মুখশালীর পরিমাণ ২৩৫ ফুট। প্রাকারের স্থূলতা ৭ ফুট ৫ ইঞ্চি। আকারের চতুর্দিকে বৃহৎ প্রবেশদ্বার আছে। পূর্ব দ্বারই সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ইহা ‘সিংহদ্বার’- নামে কথিত । দ্বারের দুই পার্শ্বে দুইটী বৃহৎ সিংহমূর্তি বিরাজিত আছে । প্রাকারের ভিতর বরাবর ২০ ফুট বিস্তৃত ও ৪ ফুট উচ্চ পাথরের গাঁথুনি আছে। বহিঃশত্রুগণের হস্ত হইতে মন্দির-রক্ষার নিমিত্ত এই দুর্ভেদ্য প্রস্তরায়তন নির্মিত হইয়াছিল। ইহারই একপার্শ্বে শ্রীনৃসিংহ মূর্তি বিরাজমান আছেন। পশ্চিমদিকে চত্বরের মধ্যে আরও অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিবালয় রহিয়াছে, তন্মধ্যে একটী ২০ ফুট উচ্চ মন্দির আছে। উহা মূল মন্দির অপেক্ষাও অধিকতর প্রাচীন। ইহার গর্ভগৃহ চত্বরের সমতল হইতে প্রায় ৫/০ ফুট নিম্নে কথিত হয়, এই স্থানেই আদি লিঙ্গমুর্তি বিরাজিত। মূল মন্দির নির্মিত হইবার পরও এস্থান হইতে আদিলিঙ্গ স্থানচাত করা হয় নাই। পশ্চিমদিকের এক কোণে
ভুবনেশ্বরীর মন্দির আছে। সিংহদ্বার-পথে প্রবেশ করিয়া যে সুবিস্তৃত পাষাণ চত্বর দৃষ্ট হয়, সেই চত্বরের একপার্শ্বে সমতল ছাদবিশিষ্ট গোপালিনীর মন্দির। গোপালিনীর মন্দিরের ভূমি মূল মন্দিরের চত্বর অপেক্ষা নিম্ন হইলেও উপরি-উক্ত আদিলিঙ্গ -মূর্তির সহিত সমতলে অবস্থিত। গোপালিনীর মন্দিরের পশ্চিমে ছয়টা প্রস্তর-সোপান আছে। ঐ প্রস্তর-সোপানের উপরে ও ভুবনেশ্বরের ভোগমণ্ডপের তলদেশে মধ্যস্থলে প্রবেশদ্বারের দক্ষিণভাগে বৃষভমূর্তি উপবিষ্ট।
শ্রীভূবনেশ্বরের মন্দিরের সম্মুখভাগে ভোগমণ্ডপ; তৎপশ্চাতে নাট্যমন্দির, তৎপরে জগমোহন এবং জগমোহনের পশ্চাতে মূলমন্দির ও তন্মধ্যে গর্ভগৃহ অবস্থিত। রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সিদ্ধান্তানুসারে উক্ত ভোগমণ্ডপ কমলকেশরীর রাজত্বকালে ৭৯২ হইতে ৮১১ খৃষ্টাব্দের মধ্যে নির্মিত হয় । কিন্তু আবার অপরাপর প্রত্নতত্ত্ববিদ্গণ বলেন যে, যিনি কোণার্কের সূর্যমন্দির নির্মাণ করিয়াছিলেন, সেই গঙ্গাবংশীয় নরপতি নরসিংহদেব তাঁহার রাজ্যের ২৪ অঙ্কে উক্ত ভোগমণ্ডপ প্রস্তুত করাইয়াছিলেন। নাট্যমন্দিরের কপাটে যে উৎর্কীর্ণ-লিপি আছে, তৎপাঠে অবগত হওয়া যায় যে, কর্ণাটবিজেতা মহারাজ কপিলেন্দ্রদেব ভুবনেশ্বরের
সেবার জন্য বহু জমিজমার বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছিলেন। অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদ্-এর মতে এই নাট্যমন্দির কপিলেন্দ্রদেবের বহু পূর্বে নির্মিত হইয়াছিল। রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র বলেন, —১০৯৯ হইতে ১১০৪ খৃষ্টাব্দের মধ্যে শালিনীকেশরীর রাণী এই নাট্যমন্দির নির্মাণ করাইয়াছিলেন; কিন্তু অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদ্ এই উক্তির ভ্রম প্রদর্শন করেন। দেউলের অভ্যন্তরস্থ প্রবেশ-দ্বারের দক্ষিণ পার্শ্বে যে উৎকীর্ণশিলালিপি আছে, তাহা হইতে জানা যায়, রাজা নরসিংহদেব কোণার্কের সূর্যমন্দির ও তাহার দ্বার প্রস্তুত করাইয়াছিলেন। ভুবনেশ্বরের নাটমন্দির ও উহার দ্বার সেই বীর গঙ্গ-রাজেরই কীর্তি। ঐ শিলালিপির উপরে রাজতনুজা’র নাম থাকায় অনেকে মনে করেন, সেই গঙ্গারাজকন্যাই উহার সূত্রপাত করিয়া যান। কেহ কেহ অনুমান করেন, উক্ত রাজকন্যাই মাদলাপঞ্জিতে শালিনীকেশরীর মহিষী বলিয়া উক্ত হইয়াছেন। জগমোহনের নির্মাণকৌশল, ভাস্করকার্য ও শিল্পনৈপুণ্য অতীব অপূর্ব। জগমোহনের ছাদ ভোগমণ্ডপের ছাদেরই ন্যায় চূড়াকার। ৩০ ফুট করিয়া উচ্চ চারিটী সুবৃহৎ পাষাণস্তম্ভ ছাদের অবলম্বনস্বরূপ বিরাজিত রহিয়াছে। ইহার দক্ষিণ প্রবেশ-দ্বারের নিকট বামভাগে একটী চতুর গৃহ রহিয়াছে, তাহা যথেষ্ট শিল্পনৈপুণ্য-বিভূষিত; কিন্তু নির্মাতা উহার কারুকার্য শেষ করিয়া যাইতে পারেন নাই। এই ঘরে কয়েকটী পিতলময়ী অর্চা বিরাজিত রহিয়াছেন। ইঁহারা ভুবনেশ্বরের উৎসবকালীন বিজয়মূর্তি। ভুবনেশ্বরের মন্দিরের উচ্চতা চত্বর হইতে কলস পর্যন্ত ১৬০ ফুট; কিন্তু মন্দিরের গর্ভগৃহ চত্বর হইতে ২ ফুট নিন্ন হওয়ায় পূর্বের চত্বর গৃহ-ভূমিকা হইতে আরও ২৩ ফুট নিম্নে অবস্থিত ছিল। কাজেই সেই সময়ের দেউলের উচ্চতা প্রায় ১৬৫ ফুট হইবে। ভুবনেশ্বরে লিঙ্গরাজ শ্রীভুবনেশ্বরের মন্দির, শ্রীঅনন্তবাসুদেবের মন্দির ব্যতীত চতুর্দিকে আরও বহু মন্দির বিস্তৃত রহিয়াছে। পূর্বে উক্ত হইয়াছে, ভুবনেশ্বরের মন্দিরের উচ্চতা বর্তমানে চত্বর হইতে কলস পর্যন্ত ১৬০ ফুট। অনন্তবাসুদেবের মন্দিরের উচ্চতা ৬০ ফুট। এতদ্ব্যতীত রামেশ্বরের মন্দির উচ্চে ৭৮ ফুট, যমেশ্বর ৬৭ ফুট, রাজারাণী দেউল ৬৩ ফুট, ভগবতীর মন্দির ৫৪ ফুট, সারীদেউল ৫৩ ফুট, নাগেশ্বর ৫২ ফুট, সিদ্ধেশ্বর ৪৭ পুট, কপিলেশ্বর ৬৪ ফুট, কেদারেশ্বর ৪৬ ফুট, পরশুরামেরশ্বর ৩৮ ফুট, মুক্তেশ্বর ৩৫ ফুট, এবং কোপারি ৩৫ ফুট।
অনেকে মনে করেন, পুরীর মন্দির অপেক্ষা ভুবনেশ্বরের মন্দির অধিকতর প্রাচীন এবং পুরীর মন্দিরের শিল্প ভুবনেশ্বরেরই আনুকরণ।
রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র বলিয়াছেন,—রাজা যযাতিকেশরী মগধ হইতে আগমন করিয়া যবনদিগকে বিতাড়িত করেন এবং বৌদ্ধধর্মের ধ্বংসাবশেষের উপর পুনরায় হিন্দুধর্ম সংস্থাপন করিয়াছিলেন। যযাতিকেশরীর রাজত্বকাল ৪৭৪ হইতে ৫২৬ খৃষ্টাব্দ। যযাতিকেশরীর রাজ্যাবসানকালে ভুবনেশ্বরের মন্দির ও জগমোহনের নির্মাণকার্য আরম্ভ হয়। যযাতিকেশরী নির্মাণ কার্য শেষ করিয়া যাইতে পারেন নাই। তাঁহার বংশধর সূর্যকেশরী বহুকাল রাজত্ব করিলেনও মন্দিরের জন্য কোন চেষ্টা করেন নাই; কিন্তু তাঁহার উত্তরাধিকারী অনন্তকেশরী মন্দিরের নির্মাণকার্য পুনরায় আরম্ভ করেন। অবশেষে ললাটেন্দুকেশরীর রাজত্বকালে ৫৮৮ শকে (৬৬৬ খৃষ্টাব্দে) ভুবনেশ্বরমন্দিরের নির্মাণকার্য সম্পন্ন হয়। এ সম্বন্ধে রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র নিম্ন নিম্নলিখিত শ্লোকটী উদ্ধৃত করিয়াছেন, —
“গজাষ্টেষুমিতে জাতে শকাব্দে কীর্তিবাসসঃ।
প্রাসাদমকরোদ্ৰাজা ললাটেন্দুশ্চ কেশরী।।’’
কিন্তু কোন কোন প্রত্নতত্ত্ববিৎ মিত্র মহাশয়ের এই মতের অনুমোদন করেন না। তাঁহারা বলেন, জগন্নাথের মন্দির নির্মাণ সম্বন্ধে যেরূপ হাতগড়া শ্লোক প্রচলিত হইয়াছে, এটীও সেইরূপ কল্পিত শ্লোক, ইহার মূলে কোনরূপ ঐতিহাসিক সত্য নাই। তাঁহারা আরও বলেন, জগন্নাথের মাদলাপঞ্জি হইতে রাজা রাজেন্দ্র লাল মিত্র যে বিবরণ উদ্ধার করিয়াছেন, তাহা ইতিহাসানভিজ্ঞ পাণ্ডাগণের দ্বারা তীর্থের প্রাচীনতা-প্রদর্শনের কাল্পনিক চেষ্টা মাত্র। ভুবনেশ্বরের মন্দির ও জগমোহন হইতে মন্দিরনির্মাণ কালের সমসাময়িক যে শিলালিপি বহির্গত হইয়াছে, তাহার সাহায্যেই ভুবনেশ্বরের মন্দির নির্মাণকাল জানা যায়। যে অনঙ্গভীম পুরুষোত্তমের শ্রীমন্দির-নির্মাতা বলিয়া বিখ্যাত, সেই অনিয়ঙ্কভীমই শিলালিপিতে ভুবনেশ্বরের মন্দির নির্মাণকারী বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। শিলালিপিতে অনিয়ঙ্কভীমের ৩৪ অঙ্ক ও প্রবহতি সংবৎসর পাওয়া গিয়াছে। চাটেশ্বরের শিলাপিপি ও দ্বিতীয় নরসিংহদেবের তাম্রশাসনে অনঙ্গভীম বা অনিয়ঙ্কভীম বলিয়া দুই জনের নাম পাওয়া যায়। প্রথম অনঙ্গভীম চোড়গঙ্গের চতুর্থ পুত্র। ইনি ১০ বৎসরকাল রাজত্ব করেন। ইনি উকলবিজয় করিয়া পুরুষোত্তমের মন্দির নির্মাণ করিয়াছিলেন। দ্বিতীয় অনঙ্গভীম প্রথম অনঙ্গভীমের পৌত্র ও রাজরাজের পুত্র। ইনি প্রায় ১২৫৩ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ৩৪ ব’সরকাল রাজত্ব করেন। ভুবনেশ্বরের শিলালিপিতে “রাজরাজতনুজ’ ও অনিয়ঙ্কভীমের ৩৪ রাজ্যাঙ্ক থাকায় কোন কোন প্রত্নতত্ত্ববিৎ দ্বিতীয় অনিয়ঙ্ক বা অনঙ্গভীমকেই ভুবনেশ্বরের মন্দির নির্মাণকারী বলিয়া নির্দেশ করেন। এই দ্বিতীয় অনিয়ঙ্কভীম কটক, পুরী ও গঞ্জাম জেলার বহু স্থানে সুবৃহৎ শিবমন্দিরসমূহ প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন।
আমরা বিন্দুসরোবরের পূর্বতটে মধ্যঘাটের সম্মুখে অনন্তবাসুদেবের মন্দিরের কথা পূর্বে উল্লেখ করিয়াছি। এই মন্দির দৈর্ঘ্যে ১৩১ ফুট ও প্রস্থে ১১৭ ফুট। ইহার মুখশালীর দৈর্ঘ্য ৯৬ ফুট ও বিস্তৃতি ২৫ ফুট। মূল মন্দিরের সঙ্গে প্রথমে জগমোহন, তৎপরেনাট্যমন্দির ও তৎপশ্চাতে ভোগমণ্ডপ। কলস পর্যন্ত মন্দিরের উচ্চতা ৬০ ফুট। নাট্যমন্দিরের অভ্যন্তর প্রদেশে কৃষ্ণপ্রস্তরময়ী একটা গরুড়মূৰ্ত্তিবিরাজিত রহিয়াছেন। মূলমন্দিরে শ্রীঅনন্তবাসুদেব বিষ্ণু বিরাজমান। এই অনন্তবাসুদেবের শ্রীমন্দিরই ভুবনেশ্বরের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন মন্দির; ইহা প্রত্নতত্ত্ববিদ্গণও একবাক্যে স্বীকার করিয়া থাকেন। সর্বাগ্রে সর্বেশ্বরেশ্বর অনন্তবাসুদেব বিষ্ণুর শ্রীমূর্তি দর্শন না করিয়া তীর্থযাত্রিগণ শ্রীবাসুদেব-বশ্য অন্য কোন দেবতার দর্শনে গমন করিতে পারেন না। এখনও এই বিধি ভুবনেশ্বর-তীর্থে প্রচলিত রহিয়াছে। ইতঃপূর্বে শ্রীঅনন্তবাসুদেবের শ্রীমন্দিরের প্রাচীন-গাত্রে শিলাফলকোদ্ধৃত ভবদেবমিত্র কবি-বাচস্পতিমিশ্র-রচিত শ্লোকাবলী হইতে জানা গিয়াছে, অনন্তবাসুদেবের মন্দির ও তৎসম্মুখস্থ বিন্দুসরোবর ভবদেব ভট্ট নির্মাণ করাইয়াছেন। বাচস্পতিমিশ্র ৮৯৮ শকে অর্থাৎ ৯৭৬ খৃষ্টাব্দে ‘ন্যায়সূচীনিবন্ধ’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁহার প্রিয় পুত্র ভবদেব ভট্টের অভ্যুদয়কাল তৎসমসাময়িক বিচার করা অনুচিত নহে; কাজেই কোন কোন প্রত্নতত্ত্ববিৎ শ্ৰীঅনন্তবাসুদেবের মন্দির খৃষ্টীয় ১০ম শতাব্দিতে নির্মিত বলিয়া বিচার করেন।
বিন্দুসরোবর দৈর্ঘ্যে ১৩০০ ফুট, প্রস্থে ৭০০ ফুট এবং গভীরতায় ১৬ ফুট। এই সুবৃহৎ সরোবরের চতুর্দিকেই পাথর দিয়া বাঁধান। বিন্দরসোবরের মধ্যস্থলে পাথরের আলিদ্বারা গাঁথা একটা দ্বীপ আছে। এই দ্বীপের পরিমাণ ১০০X১০০ ফুট। উক্ত দ্বীপের উত্তরপূর্বকোণে একটী ক্ষুদ্র মন্দির বিরাজিত। স্নানযাত্রার সময় এখানে শ্রীঅনন্তবাসুদেবের বিজয়মূর্তি আগমন করেন। মন্দির-পার্শ্বস্থ ফোয়ারা হইতে নির্গত জলদ্বারা ভগবানের অভিষেকোৎসব হয়। এই বিন্দুসরোবর স্নানযাত্রার সময়ে অর্থাৎ বর্ষাকালে বড় বড় কুম্ভীরের বাসভূমি হয়।
ষ্টার্লিং, হান্টার, কনিংহাম প্রভৃতি পাশ্চাত্য ঐতিহাসিক এবং রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রভৃতি প্রাচ্য প্রত্নতত্ত্ববিদ্গণ ভুবনেশ্বরকে বৌদ্ধগণের একটী প্রধান স্থান বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। কিন্তু অন্যান্য প্রাচ্য প্রত্নতত্ত্ববিদ্গণ নানাপ্রকার যুক্তি, প্রমাণ, ভুবনেশ্বরের নানা পুরাণ-গ্রন্থের প্রমাণ হইতে দেখাইয়াছেন যে, বুদ্ধদেবের সময়ে এই ভুবনেশ্বর যে বৌদ্ধদিগের প্রধান স্থান ছিল বলিয়া
অনুমান, তাহার কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। খণ্ডগিরি ও উদয়গিরিতে বৌদ্ধ-কীর্তির যে নিদর্শন পাওয়া যায়, তাহা বুদ্ধদেবের অনেক পরবর্তী। যে সকল পুরাবিদ্গণ ‘হাথিগোফা’কে বৌদ্ধ কীর্তি বলিয়া প্রচার করিয়াছিলেন, তাঁহাদের সেই উক্তি বিপর্যস্ত হইয়াছে। কারণ, এখন উহা জৈন-কীর্তি বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে। ‘হাথিগোফা’র উৎকীর্ণ শিলালিপিতে জৈন ধর্মাবলম্বী কলিঙ্গরাজ খারবেল ভূপতির প্রশস্তি কীর্তিত হইয়াছে। কিন্তু এই জৈনরাজ খারবেল কোন সময়ে ভুবনেশ্বরে রাজধানী স্থাপন করিয়াছিলেন, তাহার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। মহাভারত বনপর্ব ১১৪ অধ্যায়ে যে বিবরণ আছে, তাহাতে জানা যায়, গঙ্গাসাগর-সঙ্গমের পরে কলিঙ্গদেশের অন্তর্গত বৈতরণী তীর্থ এবং তাহার তীরে ব্রহ্মার যজ্ঞস্থান যাজপুর, তৎপরে স্বয়ম্ভু-বন, তৎপরে লবণসমুদ্রের সমীপস্থ মহাদেবী—যাহা ‘পুরুষোত্তমক্ষেত্র’ বলিয়া প্রসিদ্ধ। তৎপরে মহেন্দ্ৰাচল; এই পর্বত গঞ্জামপ্রদেশে অবস্থিত এবং পরশুরামের স্থান বলিয়া খ্যাত। উপরে যে স্বয়ম্ভুবনের কথা উক্ত হইয়াছে, সে ‘স্বয়ম্ভু’ —শব্দের অর্থ--শাম্ভু বা মহাদেব, ইহাই ‘দুর্ঘটার্থপ্রকাশিনী’ প্রভৃতি প্রাচীন মহাভারতের টীকার অভিমত। বহু পূর্বকাল হইতে এই স্বয়ম্ভু-বন তপস্বিগণের তপস্যার স্থান ছিল। উৎকলখণ্ডে (১৩শ অঃ) বর্ণিত আছে,--
ইথমেতৎ পুরা ক্ষেত্ৰং মহাদেবেন নির্মিতম্।
তত্র সাক্ষাদুমাকান্তঃ স্থাপিত পরমেষ্টিনা।
যদেতচ্ছাম্ভবং ক্ষেত্রং তমসো নাশনং পরম্।।
প্রাচীনকালে মহাদেবের দ্বারা এই ক্ষেত্র নির্মিত হইয়াছিল। তথায় ব্রহ্মা সাক্ষাৎ পার্বতী-পতিকে স্থাপন করিয়াছেন। সেই সময় হইতেই এই স্থান তমোবিনাশক শ্রেষ্ঠ শাম্ভবক্ষেত্র বলিয়া উক্ত হইয়াছে। এই শাম্ভবক্ষেত্র ‘একাম্রকবন’ বা ‘একাম্রকক্ষেত্র’ বলিয়াও পরিচিত।
স্কন্দপুরাণের উৎকলখণ্ডে বর্ণিত আছে,—
স বর্ততে নীলগিরির্যোজনেঽত্ৰ তৃতীয়কে।
ইদন্ত্বেকাম্রকবনং ক্ষেত্ৰং গৌরীপতের্বিদুঃ।।
চতুর্দেহস্থিতোঽহং বৈ যত্ৰ নীলমণিময়ঃ ।
তস্যোওরস্যাং বিখ্যাতং বনমেকাম্রকাহ্বতুয়ম্।।
উৎকল দেশে নীলাচলের দুই যোজন উত্তরে পার্বতীপতির ক্ষেত্র একাম্রকানন বিরাজিত। মহাভারত বনপর্বে কথিত স্বয়ম্ভ-বনই একাম্রকক্ষেত্র এবং উহা বৌদ্ধযুগের বহু পূর্ববর্তী বলিয়া, অনেক মনীষী বিচার করিয়াছেন।
কপিলসংহিতায় শ্রীভুবনেশ্বরদেবের একটা বিবরণ পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে কাশীধামস্থ বিশ্বেশ্বর দেবর্ষি নারদকে বলিয়াছিলেন। যে, তিনি আর কাশীতে থাকিবেন না, এই কাশী শীঘ্রই বিনষ্ট হইবে, যেহেতু এই স্থানে অভিজ্ঞানবিহ্বল নাস্তিকগণ উপদ্রব করিতেছে; যথার্থ ধর্ম আর এখানে থাকিবে না, সকলেই অধর্মাচারী হইয়া পড়িবে। আর এই স্থান ক্রমশই জনাকীর্ণ ও তপোবিঘ্নকর হইয়া উঠিতেছে। মহাদেব পার্বতীর জন্য যত্নসহকারে এই পুরী স্থাপন করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু জ্ঞানবিহ্বল নাস্তিকগণের উপদ্রবে তাহার কিছুতেই এই স্থানে থাকিবার অভিলাষ হইতেছে না। এমন পরম স্থান কোথায়—যেস্থানে অবস্থিত হইয়া ভগবান্ পুরুষোত্তমের নিত্য আরাধনা করা যায় ? বৈষ্ণবরাজ শম্ভুর এই উক্তি শ্রবণ করিয়া দেবর্ষি নারদ তদুত্তরে বলিয়াছিলেন যে, লবণজলধির তীরে নীলশৈল নামে একটী প্রসিদ্ধ পর্বত আছে; তাহারই উত্তরে পরমরম একারককানন।
সেই বিজন বনে অনন্তের সহিত সর্বেশ্বরেশ্বর রমানাথ ‘বাসুদেব’ নামে বিঘোষিত হইয়া বিরাজিত রহিয়াছেন। সেই স্থান পরম গুহ্য। মহাদেব নারদের বাক্য শ্রবণ করিয়া কাশী পরিত্যাগপূর্বক পার্বতীর সহিত একাম্রককাননে গমন করিলেন এবং সেই পুণ্যক্ষেত্রে গমন করিয়া শ্রীহরিকে সম্বোধনপূর্বক কহিলেন, “আমি তোমার আশ্রয়ে আসিয়াছি, তোমার এই প্রিয়স্থানে, তোমার এই পাদপদ্ম-সন্নিধানে আমায় বাস প্রদান কর।’’ শ্রীবাসুদেব বৈষ্ণবরাজ শম্ভুর এই আর্তি শ্রবণ করিয়া বলিলেন, “হে শম্ভো, আমি সানন্দচিত্তে তোমাকে এই স্থানে থাকিতে দিব, কিন্তু তুমি শপথ করিয়া বল যে, আর কখনও কাশী যাইবে না।’’ তখন শঙ্কর বলিলেন,—“আমি কিরূপে কাশীধাম একেবারে পরিত্যাগ করিতে পারি? সেখানে যে আমার প্রিয়জাহ্নবী ও সর্বতীর্থময়ী মণিকর্ণিকা রহিয়াছে। বাসুদেব কহিলেন,—“হে শম্ভো, আমার সম্মুখে এই স্থানে “পাপনাশিনী” নামে মণিকর্ণিকা বর্তমান আছে, আমার অগ্নিকোণে আমারই পদনিঃসূতা ‘গঙ্গা-যমুনা’ নাম্নী জাহ্নবী নদী প্রবাহিতা হইতেছে, এখানে আরও অনেক গুপ্ত তীর্থ রহিয়াছে।’’ তখন শঙ্কর বলিলেন,—“আমি ত্রিসত্য করিয়া বলিতেছি, আমি আপনার পাদপদ্ম পরিত্যাগ করিয়া বারাণসী অথবা অন্য কোন ক্ষেত্রেই যাইব না।’’ ইহা বলিয়া শম্ভু বিষ্ণুর দক্ষিণ পার্শ্বে লিঙ্গরূপে অবস্থান করিলেন। এই লিঙ্গ স্ফটিকসঙ্কাশ মাণিক্যাভ মহানীলমূর্তি ‘ত্রিভুবনেশ্বর’ বা ‘ভুবনেশ্বর’——নামে প্রসিদ্ধ।
কার্তিক মাসে পঞ্চক্রোশী ভুবনেশ্বর পরিক্রমা হয়। বরাহদেবী হইতে ধবলগিরি ধরিয়া খণ্ডগিরি, উদয়গিরি ও ভুবনেশ্বর রেলওয়ে স্টেশনের পশ্চাদ্ভাগ দিয়া পুনরায় বরাহদেবীতে পরিক্রমাকারিগণ উপস্থিত হন।
হাওড়া হইতে বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ে লাইনে ভুবনেশ্বর ২৭২ মাইল। ভুবনেশ্বর ষ্টেশন হইতে ভুবনেশ্বরের মন্দির এক ক্রোশ। রাস্তা অতি সুন্দর, দুই ধারে পার্বত্যভূমি-জাত বৃক্ষ, বিশেষতঃ কুঁচিলা ফলের গাছ অত্যধিক পরিমাণে দেখিতে পাওয়া যায়। গো-যান ব্যতীত অন্য কোনরূপ যানের ব্যবস্থা সর্বদা থাকে না, তবে মোটরবাস বা মোটরগাড়ী চলিতে পারে। ভুবনেশ্বরে দুইটি ধর্মশালা আছে। বিন্দুসরোবরের তীরে কলিকাতার মাড়োয়ারী হাজারিমলের একটী নূতন বৃহৎ ধর্মশালা নির্মিত হইয়াছে।
পূর্বের ধর্মশালাটি রায়বাহাদুর হরগোবিন্দ বিশ্বেশ্বর লালের ধর্মশালা। ধর্মশালাতে যাত্রিগণ তিন দিন থাকিতে পারেন।এখানে একটী দাতব্য চিকিৎসালয় এবং টেলিগ্রাফ ও পোষ্টাফিস আছে। প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবারে হাট হয়। জগন্নাথের প্রসাদের মত এই স্থানেও শ্রীঅনন্তবাসুদেব এবং ভুবনেশ্বরের প্রসাদ বিক্রয় হইয়া থাকে।।৩০৮।।
গৌড়ীয়-ভাষ্য
‘স্বর্ণাদ্রিমহোদয়ে’ ষষ্ঠ ও সপ্তম অধ্যায়ে মহাদেব বলিতেছেন;—“হে ব্রহ্মন্, একাম্রক- কাননে দেবতাগণের সহিত উপস্থিত হইয়া দিব্যবস্তুসমূহের দ্বারা সযত্নে সেই পুরাণলিঙ্গের অর্চন করিবে এবং অর্চনান্তে শ্রদ্ধার সহিত সেই প্রসাদ-নির্মাল্য ভোজন করিবে।’’
মহাদেবের এই আদেশ শ্রবণ করিয়া ব্রহ্মা জিজ্ঞাসা করিলেন,—“হে মহেশ্বর, আমরা তোমার মাহাত্ম্য জানি না। মুনিগণ কিন্তু লিঙ্গ-নির্মাল্য ‘অভক্ষ্য’ বলিয়া থাকেন, অতএব সেই নৈবেদ্য কিরূপে গ্রাহ্য হইতে পারে ?’’
ব্যাস বলিলেন,—“লিঙ্গ- নির্মাল্য অভক্ষ্য বটে; কিন্তু শ্রীভুবনেশ্বর লিঙ্গ নহেন; ইনি সনাতন ব্রহ্ম। শিবনির্মাল্য-দূষণ বাক্যগুলি। ভুবনেশ্বরে প্রযোজ্য নহে। দেবগণ ভবসাগর উত্তীর্ণ হইবার জন্য এই ভুবনেশ্বরনৈবেদ্য গ্রহণ করেন। ভুবনেশ্বরে অর্পিত অন্ন ব্রহ্মবুদ্ধিতে সেবন করিবে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং অধম জাতিও ভুবনেশ্বরের প্রসাদে পংক্তিভেদ করিবে না, অন্যথা। নিশ্চয়ই নরকে যাইবে। ভুবনেশ্বরের প্রসাদ প্রাপ্তিমাত্রেই ভোজন করিবে; ইহাতে কোনও স্পর্শদোষ হয় না। দেবতা, পিতৃগণ ও ব্রাহ্মণগণকে এই প্রসাদ দান করিবে। কুরুক্ষেত্রে চন্দ্ৰসূর্যোপরাগে মহাদানে যে ফল লাভ হয়, ভুবনেশ্বরের উচ্ছিষ্ট অন্নদানে সেই ফলপ্রাপ্তি ঘটে। শুষ্ক, পর্যুসিত, দূরদেশাহৃত ভুবনেশ্বর-প্রসাদসেবনেও অনর্থমুক্তি ঘটে। ভুবনেশ্বর-প্রসাদ-সেবনে বিষ্ণুর দর্শন, পূজন, ধ্যান, শ্রবণাদির ফল উৎপন্ন হয়। অমৃতভক্ষণে বরং পুনর্জন্ম সম্ভব, কিন্তু ভুবনেশ্বর নির্মাল্যসেবনে পুনর্জন্ম হয় না। ভুবনেশ্বরের নির্মাল্য-দর্শনে কামদ, শিরে ধারণ পাপঘ্ন, ভক্ষণে অমেধ্য-ভোজন দোষের নিবারক, আঘ্রাণে মানসপাপনিষেধক, দর্শনে দৃষ্টিজ পাপনাশক, গাত্রলেপে শারীরপাপবিনাশক, আকণ্ঠভোজনে নিরম্বু-একাদশীব্রতপালনের ফলদায়ক এবং সর্বতোভাবে। সেবায় বিষ্ণুভক্তিপ্রদায়ক।
পুনর্বার ঋষিগণের দ্বারা জিজ্ঞাসিত হইয়া ব্যাস বলিলেন,---“ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে ব্রহ্মা নারদকে বলিয়াছিলেন, —মানুষের কথা কি,ব্রহ্মাদি-দেবতাগণ নরদেহ ধারণপূর্বকভিক্ষুরূপে ভুবনেশ-নির্মাল্য যাচ্ঞা করেন। ভুবনেশ নির্মাল্য-ভক্ষণে শৌচাশৌচবিচার,
কালনিয়মাদি বিচার কিছুই নাই। অত্যন্ত নীচ ব্যক্তির দ্বারাও ভুবনেশ্বর প্রসাদ সৃষ্ট হইলে সেই প্রসাদগ্রহণে বিষ্ণুলােক-প্রাপ্তি ঘটে। যাহারা ভুবনেশ্বরের প্রসাদনির্মাল্যকে লিঙ্গনির্মাল্যসামান্যে বিচার করিয়া তাহার নিন্দা করে, তাহারা নরকগামী হয়। ভুবনেশ্বরের নৈবেদ্যের পাচিকা--স্বয়ং বৈষ্ণবীশ্রেষ্ঠা গৌরী এবং ভােক্তা সনাতন ব্রহ্ম; সুতরাং ইহাতে স্পর্শদোষের বিচার নাই। ইহাকে সাক্ষাৎ ব্রহ্মবৎ জানিবে। শ্রীঅনন্তবাসুদেবের উচ্ছিষ্ট-ভুবনেশ-মহামহাপ্রসাদ-নির্মাল্য কুকুরের মুখভ্রষ্ট এবং অমেধ্যস্থানগত হইলেও ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠগণেরও ভােজনীয়। বৈকুণ্ঠ-লিঙ্গরাজান্নভােজনে ব্রহ্মেন্দ্রাদির অপ্রাপ্য শ্রীবিষ্ণুর অনাময়পদ। প্রাপ্ত হওয়া যায়। সেই অন্নভােজনকারীকে যাহারা নিন্দা করে, তাহারা যতকাল চন্দ্রসূর্য থাকিবে, ততকাল নরকবাস করিবে। স্নাত বা অস্নাত অবস্থায় প্রাপ্তিমাত্র ভুবনেশ্বরের মহাপ্রসাদ-সেবনে বাহ্যাভ্যন্তর পবিত্র হয়। শ্রীঅনন্তবাসুদেবের উচ্ছিষ্টের উচ্ছিষ্ট স্বরূপ এই মহামহাপ্রসাদের মাহাত্ম্য অনন্তদেবও সহস্ৰবদনে বর্ণন করিতে পারেন না। এই প্রসাদ-মাহাত্মশ্রবণে ভুবনেশ প্রসন্ন হন; ভুবনেশ প্রসন্ন হইলে গােবিন্দও প্রসন্ন হইয়া থাকেন।” । | প্রত্যহ শ্রীশ্রীঅনন্তবাসুদেবের পূজা ও ভােগ সমাপ্ত হইলে শ্রীভুবনেশ্বর স্বীয় পূজা ও ভােগাদি গ্রহণ করিয়া থাকেন। এই বিধি এখনও শ্রীভুবনেশ্বরে প্রচলিত রহিয়াছে। এতদ্ব্যতীত তিনি নিজেরথাদিতে অরােহণ না করিয়া এবং চন্দন্যাত্রা, নৌকাবিলাস প্রভৃতিতে বহির্গত না হইয়া তাহার নিত্যপ্রভু শ্রীশ্রীঅনন্তবাসুদেব ও শ্রীশ্রীমদনমােহনকে ঐ সকল যান ও নানাবিধ বিলাসপরিচর্যাদি প্রদান করিয়া স্বীয় আচরণের দ্বারা কৃষ্ণপ্রীতে ভােগত্যাগের আদর্শ প্রদর্শনপূর্বক জগদ্বাসীকে বিষ্ণুভক্তি শিক্ষা প্রদান করেন। পূর্বে যে যে স্থানে শ্রীভুবনেশ্বরের বিমান ও রথাদিতে আরােহণ প্রভৃতি বিষয় উল্লেখ করা হইয়াছে, তত্তস্থানেও শ্ৰীশ্ৰীমদনমােহন ও শ্রীঅনন্তবাসুদেবের বিজয়বিলাসই বুঝিতে হইবে। | ভুবনেশ্বরের পাণ্ডাগণ শ্রীশ্রীমদনমােহনকে ‘ভুবনেশ্বরের প্রতিনিধি’ বলিয়া থাকেন। এখানে প্রতিনিধি’ শব্দের অর্থ অধীন পুরুষ নহে; যেমন সাধারণতঃ ‘রাজা’ ও ‘রাজপ্রতিনিধি’ প্রভৃতি শব্দে অর্থপ্রতীতি হয়। শ্রীভুবনেশ্বর ভৃত্য বা শক্তিতত্ত্ব বিচারে যাবতীয় ভােগবিলাস নিজে গ্রহণ না করিয়া একমাত্র প্রভু, শক্তিমত্তত্ত্ব, সকল ভােগের মালিক, স্বরাট পুরুষ মদনমােহনকেই ভােগ করাইয়া থাকেন অর্থাৎ নিজে ভােগ না করিয়া প্রভুকে ভােগ করান বলিয়া প্রতিনিধি’ অর্থাৎ বদলী’ বলা হইয়াছে। ভুবনেশ্বর নিজ পূজার পরিবর্তে তৎপ্রভু শ্রীমদনমােহন ও শ্রীঅনন্ত-বাসুদেবের পূজাই বরণ করেন। তিনি যখ