তবে প্রভু আইলেন শ্রীভুবনেশ্বর।
গুপ্তকাশীবাস যথা করেন শঙ্কর।
তথ্য। শ্রীভুবনেশ্বর—‘স্বর্ণাদ্রিমহোদয়’, ‘একাম্র-পুরাণ’, ‘স্কন্ধপুরাণ’ প্রভৃতি সংস্কৃত পুরাণগ্রন্থে শ্রীভূবনেশ্বর-তীর্থের বিবিধ বিবরণ পাওয়া যায়। ঐ সকল গ্রন্থে এই স্থানকে ‘ভুবনেশ্বর’, ‘একাম্রক্ষেত্র’, ‘হেমাচল’, ‘স্বর্ণাদ্রিক্ষেত্র’ প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হইয়াছে।
ঋষিগণের দ্বারা অনুরুদ্ধ হইয়া ভগবান্ ব্যাস সমগ্র জগতে দুর্লভ একাম্রকক্ষেত্রের বিবরণ প্রচার করেন। অতি প্রাচীন কাল হইতে এই স্থানে একটী বিস্তৃতশাখ আম্রবৃক্ষ বিরাজিত ছিল বলিয়া এই স্থানের নাম একাম্রকক্ষেত্র’ হইয়াছে। এই স্থানে কোটী লিঙ্গমূর্তি ও অষ্টতীর্থ বিরাজমান। এই স্থান বারাণসী অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ এবং বৈষ্ণবরাজ শম্ভুর অধিকতর প্রিয়।
দক্ষিণসমুদ্রের তীরে উৎকল প্রদেশে ‘গন্ধবতী’ নাম্নী এক পূর্ববাহিনী নদী আছে। সেই নদী সাক্ষাৎ জাহ্নবীস্বরূপা। সেই পরম পবিত্র নদীর তটদেশেই এই ব্রহ্মক্ষেত্র একাকতীর্থ বিরাজিত। এই স্থান কৈলাস অপেক্ষাও রমণীয়।
এই স্থান ত্রিযোজন-বিস্তৃত। তন্মধ্যে এক যোজন স্থান দেবপূজিত এবং ক্রোশপরিমাণ আম্রছায়ায় পরিব্যাপ্ত। ধর্মাত্ম ব্যক্তিগণ প্রাচীন কাল হইতে এই স্থানে স্নান, জপ, হোম, তর্পণ, অভিষেক, পূজা, স্তব, নির্মাল্যসেবন, পুরাণশ্রবণ, ভগবদ্ভক্তের। চরণাশ্রয় এবং নববিধা ভক্তি যাজন করিয়া থাকেন।
‘স্বর্ণাদ্রিমহোদয়’আরও বলেন, —শ্রীভগবান্ পুরুষোত্তমই এই ক্ষেত্রের পালক । সনাতন পরব্রহ্ম লিঙ্গরূপে ‘ত্রিভুবনেশ্বর’-নামে প্রসিদ্ধ হইয়া এই স্থানে নিত্য বিরাজমান। ‘লিঙ্গ্যতে জ্ঞায়তে যক্ষ্মাৎ’—এই ব্যুৎপত্তিক্রমে পরব্রহ্মাই লিঙ্গরূপে উৎকল-প্রদেশে সর্বতীর্থময় স্বর্ণকূটগিরিতে দেবগণের দ্বারা পরিবৃত হইয়া বাস করিতেছেন। স্বয়ং নারায়ণ চক্র ও গদা হস্তে ধারণপূর্বক এই ক্ষেত্র পালন করেন বলিয়া তিনিই ‘ক্ষেত্রপাল’।
‘স্বর্ণাদ্রিমহোদয়’ আরও বলেন,—এই ক্ষেত্রে ভগবান্ শ্রীঅনন্তবাসুদেব চক্র ও গদা হস্তে ধারণপূর্বক ক্ষেত্র রক্ষা করেন। শ্রীঅনন্তবাসুদেব দর্শনের পূর্বে অন্যান্য পুণ্যকর্মসমূহ নিস্ফল হয়। যাঁহাদের শ্রীঅনন্তবাসুদেব ভগবানে বিশুদ্ধ ভক্তি বিরাজমান, তাঁহারাই বাসুদেবপ্রিয় শ্রীভুবনেশ্বরের কৃপা লাভ করিতে পারেন।
ভুবনেশ্বরী ভগবতী শম্ভুর শ্রীমুখে বারাণসী হইতেও শ্রেষ্ঠ একাম্রকতীর্থের কথা শ্রবণ করিয়া সেই স্থান দর্শনের অভিলাষ প্রকাশ করিলে শম্ভু ভুবনেশ্বরীকে বলিলেন,-—‘তুমি অগ্রে একাকিনী সেই স্থানে গমন কর, পশ্চাৎ আমি তোমার সহিত মিলিত হইব।’পতির অনুমতি প্রাপ্ত হইয়া সিংহবাহিনী অবিলম্বে স্বর্ণাদ্রিতে আসিয়া পৌঁছিলেন। তথায় আসিয়া দেখিলেন, সেই স্থান সত্যসত্যই কৈলাস হইতে মনোরম। আরও দেখিতে পাইলেন, সেখানে সিতাসিতবর্ণপ্রভ এক মহালিঙ্গ বিরাজমান।
র সেই মলিল, জি করিতে লাশিলন। ভাগবতী পুষ্পচয়নের জন্য একদিন বনান্তরে গমন করিয়াছেন, এমন সময় দেখিতে পাইলেন, এক হ্রদমধ্য হইতে কুন্দ-কুসুম-শুভ্র সহস্র গাভী নির্গত হইয়া সেই মহালিঙ্গের মস্তকোপরি অজস্র ক্ষীরধারা বর্ষণ করিয়া লিঙ্গ প্রদক্ষিণান্তর যথাস্থানে চলিয়া গেল। আরও একদিন ঐ প্রকার দর্শন করিয়া ‘ভগবতী গোপালিনীবেশে সেই গাভীগণের অনুসরণ করিতে লাগিলেন। এইরূপে পঞ্চদশবর্ষ অতিবাহিত হইয়া গেল।
একদিন ‘কৃত্তি’ ও ‘বাস’ নামক তরুণবয়স্ক অসুর ভ্রাতৃদ্বয় সেই বনে পর্যটন করিতে করিতে গোপালিনীর অপরূপ সৌন্দর্য। দর্শন করিয়া আত্মবিনাশের সূচনাস্বরূপ গোপালিনীর নিকট তাহাদের দুষ্ট অভিসন্ধি ব্যক্ত করিল।
তৎক্ষণাৎ সতী অসুরদ্বয়ের সম্মুখ হইতে অন্তর্হিতা হইয়া শম্ভুর পাদপদ্ম স্মরণ করিলেন। মহাদেব ভগবতীর স্মরণমাত্রেই গোপালবেশে গোপালিনী-বেশধারিণী সতীর সম্মুখীন হইলেন।। গোপালিনী-বেশধারিণী সতী গোপালবেশী শম্ভর পাদপদ্ম বন্দনা করিলেন। মহাদেব বলিলেন,—“সতী, আমি তোমার স্মরণের কারণ অবগত আছি। তোমার ব্যস্ত হইবার কোন কারণ নাই। ভগবদিচ্ছায় অসুরদ্বয় উহাদের বধ বরণ করিবার জন্যই তোমার নিকট দুষ্ট প্রস্তাব করিয়াছে। তোমাকে ঐ অসুরদ্বয়ের আনুপূর্বিক ইতিহাস বলিতেছি। ‘দ্রুমিল’ নামে এক নরপতি বহু মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া দেবতাগণের প্রসন্নতা বিধানপূর্বক এক বর লাভ করেন যে, তাহার ‘কৃত্তি’, ও ‘বাস’ নামক পুত্রদ্বয় শাস্ত্রের অবধ্য হইবে। অতএব ভগবদিচ্ছাক্রমে তোমাকেই সেই দুর্বৃত্ত অসুরদ্বয়কে বধ করিতে হইবে।’’
সতী পতির এইরূপ আদেশ লইয়া গোপালিনীবেশেই বনে বনে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন এবং অল্পকাল-মধ্যেই সেই দুর্বৃত্ত অসুরদ্বয়কে দেখিতে পাইলেন। সতী উক্ত অসুরভ্রাতৃদ্বয়কে বঞ্চনাপূর্বক বলিলেন, “আমি তোমাদের মনস্কাম পূর্ণ করিতে পারি; কিন্তু আমার একটী প্রতিজ্ঞা আছে। যে আমাকে স্কন্ধে বা মস্তকে বহন করিতে পারিবে, আমি তাহারই পত্ন হইব।’’
সতীর এই কথা শুনিয়া বিমুগ্ধ অসুরভ্রাতৃত্বয় পরস্পর প্রতিদ্বন্দী হইয়া পড়িল। তখন গোপালিনী-বেশধারিণী সতী উভয় ভ্রাতারই স্কন্ধে পদস্থাপন করিয়া দণ্ডায়মানা হইলেন এবং বিশ্বম্ভরীরূপ ধারণ করিলেন। বিশ্বম্ভরীর গুরুভার বহন করে কাহার সাধ্য ? অসুরদ্বয় সতীর গুরুত্বে দলিত হইয়া বিনষ্ট হইল। পৌরাণিক আখ্যায়িকা এই যে, তদবধি সতী ও সতীনাথ শম্ভু কাশীর সুবর্ণমন্দির পরিত্যাগ করিয়া একাত্ৰ-কাননে বাস করিতেছেন।