নিত্যানন্দ-কর্তৃক তিন খণ্ডে মহাপ্রভুর দণ্ডভঙ্গ—
এত বলি’ বলরাম পরম প্রচণ্ড।
ফেলিলেন দণ্ড ভাঙ্গি’ করি’ তিন খণ্ড।
বিবৃতি। কেবলাদ্বৈতী পরমহংসব্রুব একদণ্ডিগণ ত্রিদণ্ডিগণের চিরদিনই অবজ্ঞা করে। শ্রীগৌরসুন্দর একদণ্ডগ্রহণ-ছলনা লীলা প্রদর্শন করায় শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু সেই দণ্ডকে ত্রিভাগে বিভক্ত করিয়া উহাকে ত্রিদণ্ডরূপে পরিণত করিলেন এবং এ দণ্ডবহন-ভার ভগবৎসেবকগণের নিকট ন্যস্ত করিলেন। তজ্জন্যই অতি প্রাচীনকালে মহাভারতে যে হংস-গীতি আছে; তন্মধ্যস্থ “বাচো বেগম্” শ্লোকটি ত্রিদণ্ডগ্রহণের নিদর্শন ও যোগ্যতা সূচনা করে এবং ত্রিদণ্ডিগণেরই যে শ্রীরূপানুগত্ব, ইহা শ্রীরূপগোস্বামী
প্রভু “উপদেশামৃতে” লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। অপ্যয়দীক্ষিত প্রভৃতি প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধমতাবলম্বী মায়াবাদিগণ ত্রিদণ্ডের বিরুদ্ধে “পরিমল” নামক টীকায় প্রচুর গালিগালাজ করিয়াছেন। ভাবি-কালে মায়াবাদী অপ্যয়দীক্ষিত “ন্যায়রক্ষামণি’’, “শিবার্ক-মণিদীপিকা” প্রভৃতি গ্রন্থের অভ্যন্তরে যে সকল ভক্তি-বিরোধী মতবাদ লিখিবেন, তাহার অযোগ্যতা-প্রদর্শনকল্পে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু শ্রীগৌরসুন্দরের একদণ্ডকে ত্রিদণ্ডে পরিণত করিলেন। অভেদবাদী যেরূপ মায়াবাদচিহ্ন একদণ্ড গ্রহণ করেন এবং শুদ্ধদ্বৈতমতাবলম্বিগণের শিষ্য-পারম্পর্যে যে একদণ্ড গ্রহণ প্রথা প্রচলিত ছিল ও আছে, তাহা শ্ৰীমাধ্বগৌড়ীয়-সম্প্রদায়ের অনুমোদিত নহে—ইহা জানাইবার জন্যই শ্রীবলদেব প্রভু সন্ন্যাস-বেষী শ্রীচৈতন্যদেবের একদণ্ডকে ত্রিদণ্ডে পরিণত করিয়াছেন; ইহাই শ্রীমদ্ভাগবতের সম্মত ও গৌড়ীয়-বৈষ্ণবগণের একমাত্র বিচার। ‘ত্রিদণ্ডী’ না হইলে কেহই আত্মসংযম করিতে সমর্থ হন না। কর্মকাণ্ডীয় ত্রিদণ্ডে ইন্দ্রদণ্ড, বজ্ৰদণ্ড ও ব্রহ্মদণ্ডের সহিত জীবদণ্ডের সমাবেশ আছে। শ্রীরূপগোস্বামী প্রভু ত্রিদণ্ড-ব্যাখ্যায় কায়-মনোবাক্-দণ্ডের কথা পারমার্থিক ত্রিদণ্ডিগণকে জানাইয়াছেন। ত্রিদণ্ডের সহিত জীবদণ্ডের সংযোগে ত্রিদণ্ডের বহিঃপ্রজ্ঞা-চালিত-বিচারে পারমহংস্যধর্মে একদণ্ডই পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু যে একদণ্ডে জড়গুণত্রয়ের সম্মেলনে “গুণবিধৌত অবস্থা’ নামক একদণ্ড, উহা একায়ন-পদ্ধতিতে কলঙ্ক আরোপ করে বলিয়া ত্রিদণ্ড সম্মেলনে একদণ্ডই একায়ন-পদ্ধতিতে স্বীকৃত হইয়াছে। ব্রহ্মসম্প্রদায়ে, ব্রহ্ম-মাধ্ব-সম্প্রদায়ে ও ব্রহ্ম-মাধব-গৌড়ীয় সার্বজনীন-বৈষ্ণব-সমাজে সেই প্রথা চিরদিনই ব্যক্ত ও অব্যক্তভাবে অবস্থিত। সুতরাং শ্রীগৌরনিত্যানন্দের আম্নয়-বিচারে শ্রীব্রহ্ম-মাধ্বগৌড়ীয়-বিচার হইতে পার্থক্য স্থাপিত হইতে পারে না। এই সময় হইতে শ্রীচৈতন্যদেবের আশ্রিত জনগণ “গৌড়ীয় ত্রিদণ্ডিস্বামী” বলিয়া কথিত শ্ৰীপ্রবোধানন্দ সরস্বতীপাদের বৈধ বিচারে মর্যাদাপথে সন্ন্যাসগ্রহণ—শ্রীরূপানুগ –গণের পারমহংস্যবিচারে পরস্পর বৈষম্য উৎপাদন করে নাই। গৌড়ীয়গণ মর্যদা-পথে ত্রিদন্ড গ্রহণ করিলেও তাঁহারা শ্রীরূপানুগ বা শ্রীসনাতনানুগ পারমহংস্যধর্মের বিরোধী নহেন। পারমহংস্য ধর্মে বৈধ চিহ্নসমূহের বৈষম্য বহিশ্চিহ্নরূপে গৃহীত হইলেও বহিশ্চিহ্নধারণে পারমহংস্যধর্মের যাজন তদতিরক্তি নহে। শ্রীসনাতনের অনুগমনে অপর পাঁচজন ব্রজবাসী গোস্বামী পরমহংসবেষ গ্রহণ করিলেও শ্রীপ্রবোধানন্দ সরস্বতী গোস্বামী মর্যাদা-পথে ত্রিদণ্ড সংরক্ষণপূর্বক ‘শ্রীচৈতন্যচন্দ্রামৃত’ -নামক গ্রন্থে গৌড়ীয়-বিচার সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ করিয়াছেন। অধুনা আচারভ্রষ্ট পরমহংসব্রুব পতিত জনগণের আচরণ সংশোধন-কল্পে এবং শিষ্টাচার ও সদাচার সংরক্ষণ মানসে অনুরাগ-পথের পথিকগণের অসদ্বিচারে আক্রান্ত হইবার দুর্যোগ-পরিহারার্থ মর্যাদা-পথের প্রবর্তনাবরণে শ্রীরূপানুগ বিমলভজন-চেষ্টা অর্বাচীনগণের নিকট অনাদরের ও বিরোধের বিষয় হইয়া পড়িয়াছে। যুগে যুগে ভগবৎপ্রকাশের মর্যাদা অতিক্রম করিয়া আকর-বস্তুর উপাসনায় ও তদনুষ্ঠানে নানা প্রকার বিপত্তি উপস্থাপিত হইয়াছে। মর্যাদাপথের তাৎপর্য না বুঝিয়া লঙ্ঘন-জনিত অমঙ্গলকেই মর্যাদাপথের উন্নত উদ্দেশ্য বলিয়া বিচারিত হয়। আবার, মর্যাদাপথের কেবল আবাহনে উন্নত পথ রুদ্ধ হয়। শ্রীল প্রবোধানন্দ ত্রিদণ্ডীপাদ বৃন্দাবনবাসী গোস্বামি ষট্কের বিরোধী ছিলেন না; কিন্তু গোস্বামিগণের অনুগতব্ৰুব স্বল্পদৃষ্টিসম্পন্ন জনগণ শ্রীপ্রবোধানন্দের বিচারকে প্রতিদ্বন্দ্বি-বিচার জানিয়াছিল; তাহাতে তাদৃশ আধস্তনিকগণের দ্বারা সাম্প্রদায়িক বিপত্তি উপস্থিত হইয়াছে।