হেনমতে দুই সখা ভাসেন সন্তোষে।
রাত্র-দিন না জানেন কৃষ্ণকথারসে।
তথ্য। বয়ন্তু ন বিতৃপ্যাম উত্তমঃশ্লোক বিক্রমে। যচ্ছৃণ্বতাং রসজ্ঞানাং স্বাদু স্বাদু পদে পদে।। -(ভাঃ ১/১/১৯); নিগমকল্পতরোর্গলিতং ফলং শুকমুখাদমৃতদ্রবসংযুতম। পিবত ভাগবতং রসমালয়ং মুহুরহো রসিকা ভুবি ভাবুকাঃ।। —(ভাঃ ১১/৩); কো নাম তৃপ্যেদ্রসবিং কথায়াং মহত্তমৈকান্তপরায়ণস্য। নান্তং গুণানামগুণস্য জগ্মুর্যোগেশ্বরা যে ভবপাদ্মমুখ্যাঃ ।।-- (ভাঃ ১/১৮/১৪); ব্রহ্মন্ কৃষ্ণকথাঃ পুণ্যা মাধ্বীর্লোকমলাপহাঃ। কোন নু তৃপ্যেত শৃণ্বানঃ শ্রুতজ্ঞো নিত্যনূতনাঃ ।।—(ভাঃ ১০/৫২/২০; ন কাময়ে নাথ তদপ্যহং ক্বচিন্ন যত্র যুষ্মচ্চরণাম্বুজাসবঃ । মহত্তমান্তর্হৃৰ্পয়ান্মুখচ্যুতো বিধৎস্ব কর্ণাযুতমেষ মে। বরঃ।। (ভাঃ ৪/২০/২৪); যশঃ শিবং সুশ্রব আর্যসঙ্গমে, যদৃচ্ছয়া চোপশৃণোতি তে সকৃৎ । কথং গুণজ্ঞো বিরমেদ্বিনা পশুং, শ্ৰীৰ্যৎ প্রবব্রে গুণসংগ্রহেচ্ছয়া। —(ভাঃ ৪/২০/২৬); নিবৃত্ততর্ষৈরুপগীয়মানাবৌষধাচ্ছ্রোএমনোঽভিরামাৎ।ক উত্তমঃশ্লোক গুণানুবাদাৎ, পুমান্ বিরজ্যেত বিনা পশুঘ্নাৎ।।—(ভাঃ ১০/১/৪); সতাময়ং সারভৃতাং নিসর্গো, যদর্থবাণীশ্রুতিচেতসামপি। প্রতিক্ষণং নব্যবদচ্যুতস্য যৎ, স্ক্রিয়া বিটানামিব সাধুবার্তা ।।—(ভাঃ ১০/১৩/২); তুল্যশ্রততপঃশীলাস্তুল্যস্বীয়ারিমধ্যমাঃ । অপি চক্রুঃ প্রবচনমেকং শুশ্রুষবোহপরে।। (ভাঃ ১০/৮৭/১১); তথা বৈষ্ণবধর্মাশ্চ ক্রিয়মাণানপি স্বয়ম্। সংপৃচ্ছেত্তদ্বিদঃ সাধূনন্যোন্যপ্রীতিবৃদ্ধয়ে।। তব কথামৃতং তপ্তজীবনং, কবিভিরীড়িতং কল্মষাপহম্ । শ্রবণমঙ্গলং শ্রীমদাততং, ভুবি গৃণন্তি তে ভূরিদা জনাঃ—(ভাঃ ১০/৩১/৯)।
অর্থাৎ যাঁহার লীলা শ্রবণ করিতে রসিকগণের আস্বাদন প্রতিপদে উত্তরোত্তর স্বাদু হইতেও স্বাদু হয়, সেই উরুক্ৰম শ্রীকৃষ্ণের গুণ-লীলা-কথাদিতে অধিক আস্বাদন পাইবার আশায় আমরা বিশেষভাবে তৃপ্ত হইতেছি না, অর্থাৎ হরিকথা শুনিয়া যথেষ্ট বা পর্যাপ্ত বোধ করিতেছি না, বরং উত্তরোত্তর আমাদের কৌতূহল ও আগ্রহ বৃদ্ধি পাইতেছে। হে ভগবৎপ্রীতিরসজ্ঞ অপ্রাকৃত রসবিশেষভাবনা-চতুর ভক্তবৃন্দ! শ্ৰীশুকমুখ হইতে নিঃসৃত হইয়া শিষ্যপ্রশিষ্যাদি-পরম্পরাক্রমে স্বেচ্ছায় পৃথিবীতে অখণ্ডরূপে
অবতীর্ণ পরমানন্দরসময়, ত্বক্-অষ্টি প্রভৃতি কঠিন হেয়াংশরহিত তরলপানযোগ্য এই শ্রীমদ্ভাগবত নামক বেদকল্পতরুর প্রপক্ব ফল আপনারা মুক্ত অবস্থায়ও পুনঃ পুনঃ পান করিতে থাকুন। পরমমুক্ত পুরুষগণও স্বর্গাদি-সুখের ন্যায় ইঁহাকে উপেক্ষা না করিয়া নিত্যকাল সেবা করিয়া থাকেন । পরম-শ্রেষ্ঠ মহাত্মগণের একমাত্র আশ্রয়স্থান প্রাকৃত গুণ রহিত। যে ভগবানের গুণসমূহের শিব-ব্রহ্মাদি যোগেশ্বরগণও ইয়ত্তা করিতে পারেন নাই, সেই ভগবানের কথায় কোন্ রসজ্ঞ ব্যক্তি তৃপ্তির শেষ লাভ করিতে পারেন! হে ব্রহ্মান্! কৃষ্ণকথা মহাফলদায়িনী, শ্রুতিসুখকরী, লোকদিগের অনর্থনাশিনী এবং নিত্য নূতন নূতনরূপে প্রতীয়মানা; অতএব কোন্ শ্রুতসারজ্ঞ ব্যক্তি উহা শ্রবণপূর্বক তৃপ্তির শেষ করিতে পারেন ? হে নাথ যে মোক্ষপদে মহত্তম ভাগবতগণের অন্তর্হৃদয় হইতে মুখমার্গদ্বারা বিনিঃসৃত ভবদীয় পাদপদ্ম-সুধার যশোগান শ্রবণ করিবার সম্ভাবনা না থাকে, আমি সেই মোক্ষপদও প্রার্থনা করি না। আমার প্রার্থনা এই যে, আপনার গুণ কীর্তন ও শ্রবণ করিবার জন্য আমাকে অযুত কর্ণ প্রদান করুন,—ইহাই আমার একমাত্র প্রার্থনীয় বর, আমি অন্য কিছুই চাই না। হে মঙ্গলকীর্তে, যে ব্যক্তি মহাজনগণের সাহচর্যে আপনার মঙ্গলপ্রদ যশ একবারও কোনপ্রকারে শ্রবণ করেন, তিনি যদি একেবারে পশু না হইয়া একটুও সারগ্রাহী হন, তাহা হইলে তিনি আর তাহা হইতে বিরত হইতে পারেন না; কারণ, লক্ষ্মীদেবীও নিখিলগুণ সংগ্রহ করিবার ইচ্ছায় আপনার যশোশ্রবণকেই প্রকৃষ্টরূপে আশ্রয় করিয়াছেন। উত্তমঃশ্লোক শ্রীহরির গুণানুকীর্তন শ্ৰৌতপারম্পর্যে সাধিত হয় অর্থাৎ শ্রীগুরুমুখ হইতে শ্রুত হইয়া পশ্চাতে কীর্তিত হইয়া থাকে, সেই শ্রীহরির গুণকীর্তন কৃষ্ণেতর-বিষয় তৃষ্ণারহিত মুক্তকুলের দ্বারা সুষ্ঠুভাবে কীর্তিত হয়। এই সঙ্কীর্তন (মুমুক্ষুগণের) ভবরোগের ঔষধস্বরূপ, ইহা (রুচিপর ভক্তের) হৃৎকর্ণ-রসায়ন। পশুঘাতী ব্যাধ অথবা আত্মঘাতী অপরাধী ব্যতীত আর কোন বুদ্ধিমান্ ব্যক্তিই বা এই হরিকীর্তন হইতে বিরত হন? একমাত্র হরিকথাই সারগ্রাহী সজ্জনগণের বাক্যের, শ্রবণেন্দ্রিয়ের ও মনের বিষয়। স্ত্রৈণ ব্যক্তিরা যেমন রমণীবার্তায় নব নব জ্ঞানে আনন্দবোধ করে, তদ্রূপ দেবদেব হরির কথাই সারগ্রাহিগণের নিকট মূহূর্তে মুহূর্তে নূতন বলিয়া জ্ঞান হয়। তত্ৰত্য মুনিগণ তুল্য-শাস্ত্রজ্ঞান তপস্যা ও সৎস্বভাবসম্পন্ন এবং শত্রু-মিত্রে উদাসীন—সকলের প্রতি সমভাবযুক্ত বলিয়া প্রত্যেকেই প্রবচন-সমর্থ হইলেও এক সনন্দনকেই প্রবক্তা অর্থাৎ ব্যাখ্যাকর্তৃরূপে নির্ণয় করিয়া অপর সকলে শ্রবণাভিলাষী হইলেন। স্বয়ং বৈষ্ণবধর্মের অনুষ্ঠান করিলেও পরস্পর প্রীতিবর্ধনার্থ তদ্ধর্মবিদ্ সাধুদিগের নিকট প্রশ্ন করিবে। তোমার কথামৃত ত্বদীয় বিরহকাতর জনগণের জীবনস্বরূপ, প্রহাদাদি ভক্তগণও তাঁহার স্তব করেন। উহা প্রারব্ধ ও অপ্রারব্ধ পাপবিনাশক, শ্রবণমাত্রে মঙ্গলপ্রদ, প্রেমসম্পত্তিদায়ক এবং কীর্তনকারিগণ কর্তৃক বিস্তৃত। সুতরাং হরিকথাকীর্তনকারীই সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা।
মর্যাদা-পথে শ্রীকৃষ্ণচরণামৃত-বোধে কতিপয় ভক্ত গঙ্গায় অবগাহন করেন না, গঙ্গাজলে পদবিক্ষেপ না করিয়া গঙ্গাজল পান ও দর্শন করেন মাত্র।
শ্রীগৌরসুন্দর-বর লীলা তাঁ’র মনোহর
নিত্যানন্দস্বরূপ প্রকাশ।
আচার্য অদ্বৈত আর গদাধর শক্তি তাঁর
পঞ্চতত্ত্ব ভক্ত শ্রীনিবাস।।
বৃন্দাবন সুত তা’র। করুণার পারাবার’
‘শ্রীচৈতন্যভাগবত’ যাঁ'র।।
নিত্যানন্দ-শেষভৃত্য হরিজনসেবা-কৃত্য
বুঝ’ল যে সর্বসার-সার।।।
বৈষ্ণব-মহিমা যত বর্ণিলেন সুসঙ্গত
তাহার তুলনা কোথাও নাই।।
বৈষ্ণব-বিরোধি জন সতত তাপিত মন ।
মূল্যহীন সেই ভস্ম ছাই।।
নিতাই-বিমুখজনে দয়া-পাত্র তা’রে গণে
পদাঘাত করে তা’র শিরে।।
এহেন দয়াল বীর নাহি ত্রিভুবনে ধীর
লয়ে যায় বিরজার তীরে।।
মূঢ়জন না বুঝিয়া অহঙ্কারে মত্ত হিয়া।
‘ক্রোধী’ বলি করয়ে স্থাপন।।
বৈষ্ণবের দয়া-দণ্ড কভু না বুঝয়ে ভণ্ড
নীচচিত্ত করিয়া গোপন।।
‘শ্রীগৌড়ীয়-ভাষ্য’-নাম ভক্তজন-সেবা-কাম
লিখি, ছাড়ি’ কপটাদি ছল।
ভাগবত-ব্যাখ্যা- কালে প্রভু মোরে সদা পালে,
চিত্র দেয় যথোচিত বল।।
শ্রীচৈতন্যভাগবত গ্রন্থ শুদ্ধভক্তিমত
কহে সদা শ্রীভক্তিবিনোদ।।
নিরন্তর পাঠফলে কুবুদ্ধি যাইবে চ’লে।
কৃষ্ণপ্রেমে লভিবে প্রমোদ।।
পতিতপাবন-শ্রেষ্ঠ শ্রীগৌরকিশোরপ্রেষ্ঠ
পতিতজনের তা’রা গতি।।
শ্রীবাসের ভ্রাতৃসুতা নারায়ণী নামে মাতা
বিশ্বম্ভরপদে যাঁ’র মতি।।
নিজেন্দ্রিয়-প্রীতিকাম নহে কভু ভক্তিধাম,
বৈষ্ণব-সেবায় নাহি ভোগ।।
ভক্তসেবা-ফলে প্রেম সেই মূল্যবান্ ক্ষেম
বিগত হইবে সর্বরোগ ।।
লীন হইবার আশা চালিলে কপটপাশা,
দূরে যা’বে সকল মঙ্গল।।
স্থূল সূক্ষ্ম দেহদ্বয় ভক্তি-বলে হয় ক্ষয়
ভাগবত-ভজন-কৌশল।।
শ্রীবার্ষনবী-আশ তাঁহার দয়িতদাস
ভাষ্য লেখকের পরিচয়।।
ভকতিবিমুখ জন বিষয়েতে ক্লিষ্টমন।
তবু যাচে প্রভুপদাশ্রয়।।
শ্রীগৌড়মণ্ডল-মাঝ নবদ্বীপ তীর্থরাজ
মায়াপুর গৌরজন্মস্থল।।
তথায় চৈতন্যমঠ নাহি বসে যথা শঠ
গৌরজনে করিয়া সম্বল।।
ভকতিবিনোদ-দাস সঙ্গে মোর সদা বাস।
তা’দের অনুজ্ঞা শিরে ধরি’।।
চারিশত ছ’চল্লিশে সমাপিনু জ্যৈষ্ঠশেষে
উটকামণ্ডের শৈলোপরি।।
ভাষ্যচনার কালে ভক্তগণ মোরে পালে
গৌরব-সম্রমে মোরে ছলে।।
অবকাশ সদা দিয়া ভক্তিপথে চালাইয়া
স্নেহের ডোরিকা দিয়া গলে।।
শ্রীগৌরাঙ্গভক্তগণ শ্রীভক্তিবিনোদন- জন-
তা’দের চরণে মোর গত।।
ভাষ্যলিখলের ব্যাজে ত্রিদন্ডীসেবক সাজে
রহু যেন নিত্যসেবা মতি।।
শ্রীচৈতন্যভাগবত গ্রন্থের “গৌড়ীয়-ভাষ্য” সম্পূর্ণ।