(খ) পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য —
তবে বন্দোঁ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহেশ্বর।
নবদ্বীপে অবতার, নাম—‘বিশ্বম্ভর, ॥৭॥
শ্রীচৈতন্যের বন্দনার প্রাগ্ভাগে সাধারণভাবে শ্রীচৈতন্যপ্রিয়-গোষ্ঠীর চরণে দণ্ডবন্নতি দ্বারা মঙ্গলাচরণ করিতেছেন। শ্রীগুরুদেবই সেই শ্রীচৈতন্যপ্রিয়-গোষ্ঠীর সর্বপ্রধান নায়ক। সাক্ষাৎ শ্রীনিত্যানন্দপ্রভুই গ্রন্থকারের সেই গুরুদেব।
‘গোষ্ঠী’,—“নানাশাস্ত্রবিশারদৈ রসিকতা সৎকাব্যসংমোদিতা নির্দোষঅইঃ কুলভূষণৈঃ পরিমিতা পূর্ণা কুলজ্ঞৈরপি। শ্রীমদ্ভাগবতাদি কারণ-কথা শুশ্ৰষয়ানন্দিতা গত্বাভীষ্টমুপৈতি যদ্গুণিজনো ‘গোষ্ঠী’ হি সা চোচ্যতে॥’’
দণ্ড, —দণ্ডবৎ; পরণাম,—প্রণাম। সেই ‘প্রণাম’—-চতুর্বিধা ; যথা—(১) অভিবাদন, (২) অষ্টাঙ্গ, (৩) পঞ্চাঙ্গ, (৪) করশিরঃসংযোগপূর্বক প্রণাম ॥৬॥
গুরু প্রণামের পর অর্থাৎ শ্রীনিত্যানন্দপ্রভুর বন্দনার পর শ্রীচৈতন্যদেবের বন্দনা করিলেন। ইহাই শিষ্টাচার ও সজ্জনপদ্ধতি; এইজন্য ‘তবে’ শব্দের প্রয়োগ।
যদিও শ্রীবিষ্ণুস্বামি-সম্প্রদায় দশনামী ও অষ্টোত্তরশতনামী ত্রিদণ্ডি-বৈদিকসন্ন্যাসিগণ শ্ৰীশঙ্করপাদের বহুপূর্ব হইতে অবস্থান করিতেছিলেন, তথাপি নির্বিশেষ-বিচারপ্রিয় বৈদান্তিক শঙ্করের অভ্যুদয়ে চিজ্জড়-সমন্বয়-বাদমুলে ভারতে পঞ্চোপাসক-সমাজ পুনর্গঠিত হওয়ায় শ্রীমহাপ্রভু শ্ৰীশঙ্করাচার্য সম্প্রদায়ের দশনামী দণ্ডিন্যাসিগণের প্রথামত বৈদিক সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। আর্যাবর্তে বৈদিকাভাস অর্থাৎ “বেদানুগব্রুব’ আর্যসমাজের অনেকেই শঙ্করাচার্যের অনুবর্তী এবং শাঙ্কর-সম্প্রদায়ের শাসনানুসারে পঞ্চোপাসক।
দশনামী সন্ন্যাসী—যথা “তীর্থাশ্রমবনারণ্যগিরিপর্বতসাগরাঃ । সরস্বতী ভারতী চ পুরী নামানি বৈ দশ॥’’ প্রত্যেক সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারীর উপাধি ও স্থানের নাম যথাক্রমে লিখিত হইতেছে—
তীর্থ এ আশ্রম—সন্ন্যাসোপাধি, স্থান- দ্বারকা, ব্ৰহ্মচারি-নাম—স্বরূপ। বন ও অরণ্য—সন্ন্যাসোপধি,স্থান—পুরুষোত্তম, ব্রহ্মচারি-নাম—প্রকাশ। গিরি, পর্বত ও সাগর সন্ন্যাসোপাধি, স্থান-বদরিকাশ্রম, ব্রহ্মচারি-নাম—আনন্দ। সরস্বতী, ভারতী ও পুরী-সন্ন্যাসোপাধি, স্থান—শৃঙ্গেরী, ব্রহ্মচারি-নাম—চৈতন্য (মঞ্জুসা—২য় সংখ্যা দ্রষ্টব্য)।
শ্ৰীশঙ্করাচার্য সমগ্র ভারতের পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ-প্রদেশে চারিটী মঠ স্থাপন করিয়া তাহার চারিটী শিষ্যকে মঠাধিপ করেন। এই চারিটী মূলমঠের অধীন অসংখ্য শাখা-মঠ ক্রমশঃ উদ্ভুত হইয়াছে। দেশভেদে মঠের বাহ্য সাদৃশ্য নির্দিষ্ট থাকিলেও অনেক ক্ষেত্রে বিপর্যয় লক্ষিত হয়। এই চারিমঠে আনন্দবার, ভোগবার, কীটবার, ভূমিবার-ভেদে চতুর্বিধ সম্প্রদায় দৃষ্ট হয়। কাল-বশে এই সম্প্রদায়ের ধারণারও বিপর্যয় দেখা যায়। মঠ-ভেদে চারিটী মহাবাক্যেরও বিভাগ আছে। সন্ন্যাস গ্রহণ করিতে হইলে পূর্বে মঠাধীশ সন্ন্যাসি-গুরুর নিকট গমন করিয়া ‘ব্রহ্মচারি’ হইতে হয়। তিনি যে-প্রকার সন্ন্যাসী, তদনুসারে ‘ব্রহ্মচারি’ নাম দিয়া থাকেন। আজও এই সম্প্রদায়ে এই প্রথা বিশেষভাবে চলিয়া আসিতেছে।
শ্রীমহাপ্রভু কেশব-ভারতীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করিবার অভিনয় করায় তাঁহার নাম ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ হইয়াছিল। সন্ন্যাস গ্রহণ করিবার পরও ভগবান স্বীয় ‘ব্রহ্মচারি’-নামই প্রচার করেন। ‘ভারতী’-সংজ্ঞা গ্রহণ করিয়া স্বীয় পরিচয় দিবার কথা তাঁহার লীলা লেখক গণ কেহই বলেন না। সন্ন্যাস-নামের সহিত ঈশরাভিমান সংশ্লিষ্ট থাকায়, বোধ হয়, জীববান্ধব জগদ্গুরু শ্রীমন্মহাপ্রভু স্বয়ং কৃষ্ণ হইয়াও আপনাকে কৃষ্ণদাসাভিমানে বশ্য-জীবকূলের নিকট শুদ্ধাকৃষ্ণভক্তি প্রচারপূর্বক তাহাদের নিত্যহিতসাধনেচ্ছায় তাদৃশ একদণ্ড সন্ন্যাসোপাধিদ্বারা সদম্ভে পরিচয়-প্রদান আদর করেন নাই। ‘ব্রহ্মচারি’-নামে গুরুদাস্যাভিমানই অনুস্যূত; উহা ভক্তির প্রতিকূল নহে। মহাপ্রভু দণ্ড ও কমণ্ডলু প্রভৃতি সন্ন্যাসের চিহ্নসমূহ গ্রহণ করিয়াছিলেন বলিয়া উল্লেখ আছে।
‘মহেশ্বর’— (শ্রেঃউঃ ৪/১০/৬৭)–“মায়ান্তু প্রকৃতিং বিদ্যাম্মায়িনন্তু মহেশ্বরম্,” ও “তমীশ্বরাণাং পরমং মহেশ্বরম্’’। (ভাঃ ১১/২৭/২৩ শ্লোকে শ্রীধরস্বামি-কৃত ‘ভাবার্থদীপিকা’য় ধৃত পাদ্মোত্তরখণ্ডস্থ ৯ অঃ-বাক্য)—“যো বেদাদৌ স্বরঃ প্রোক্তো বেদান্তে চ প্রতিষ্ঠিতঃ । তস্য প্রকৃতিলীনস্য যঃ পরঃ স মহেশ্বরঃ ॥ যোঽসাবকারো বৈ বিষ্ণুর্বিষ্ণুনারায়ণো হরিঃ স এব পুরুষো নিত্যঃ পরমাত্মা মহেশ্বরঃ॥’’ (ব্রঃ বৈঃ প্রকৃতিখণ্ডে ৫৩ অঃ)—“বিশ্বস্থানাঞ্চ সর্বেষাং মহতামীশ্বরঃ স্বয়ম্ মহেশ্বরঞ্চ তেনেমং প্রবদন্তি মনীষিণঃ ॥’’
নবদ্বীপ, —ভাগীরথীর পূর্বকূলে নবদ্বীপ নগর। বহুপূর্ব হইতেই তথায় সেনরাজগণের রাজধানী অবস্থিত ছিল। সেই স্থান সম্প্রতি নবদ্বীপ-নামে পরিচিত না হইয়া ভিন্ন ভিন্ন পল্লী-নামে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। যে-স্থলে শ্রীজগন্নাত মিশ্রের গৃহ, শ্রীবাসের অঙ্গন, শ্রীঅদ্বৈতের ভবন, শ্রীমুরারিগুপ্তের স্থান প্রভৃতি অবস্থিত ছিল, তাহা সম্প্রতি ‘শ্রীমায়াপুর’-নামে খ্যাত। গঙ্গার বিভিন্ন গর্ভের পরিবর্তনে শ্রীমন্মহাপ্রভুর প্রকটকালীয় নবদ্বীপ-নগরের অধিকাংশই জলমগ্ন হইয়াছিল, সুতরাং উহার অধিবাসিগণের অনেকেই নিকটবর্তিস্থানে উঠিয়া যাইতে বাধ্য হয় প্ৰভুর প্রকটকালীন কুলিয়া-গ্রামে বা ‘পাহাড়পরে’ই আধুনিক নবদ্বীপ সহর বসিয়াছে এবং সেইস্থলেই বর্তমান নবদ্বীপ-মিউনিসিপ্যালিটী স্থাপিত হইয়াছে। কিন্তু, খৃষ্টীয় অষ্টাদশ-শতাব্দীতে নবদ্বীপ-নগর ‘কুলিয়াদহ’ বা ‘কালীয়-দহে’র বর্তমান চড়ায় অবস্থিত ছিল। আবার খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে নদীয়া-নগর বর্তমান ‘নিদয়া, ‘শঙ্করপুর’, ‘রুদ্রপাড়া’ প্রভৃতি স্থানে লক্ষিত হয়। তৎপূর্বে ষোড়শ-শতাব্দী পর্যন্ত শ্ৰীমন্মহাপ্রভুর সমকালীন নবদ্বীপ-নগর শ্রীমায়াপুর, বল্লালদীঘি, বামনপুকুর, শ্রীনাথপুর, ভারুইডাঙ্গা, গঙ্গানগর, সিমুলিয়া, রুদ্রপাড়া, তারণবাস, করিয়াটী, রামজীবনপুর প্রভৃতি স্থানে ব্যাপ্ত ছিল। তখন বর্তমান বামুনপুকুর পল্লীর নাম ‘বেলপুকুর’ ছিল, পরে ‘মেঘার চড়ায় প্রাচীন বিল্বপুষ্করণী-গ্রাম স্থানান্তরিত হওয়ায় উহা সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে বর্তমান ‘বামুনপুকুর’-নাম লাভ করিয়াছে। রামচন্দ্রপুর, কাকড়ের মাঠ, শ্রীরামপুর, বাব্লা-আড়ি প্রভৃতি স্থান গঙ্গার পশ্চিমপারে অবস্থিত। উহার কিয়দংশ কোলদ্বীপ ও কতকটা মোদদ্রুম-দ্বীপের অন্তর্গত ছিল। চিনাডাঙ্গা, পাহাড়পুর প্রভৃতি নাম সম্প্রতি বিলুপ্ত হইলেও ‘তেঘড়ির কোল’, ‘কোল-আমাদ’, ‘কুলিয়ার গঞ্জ’ প্রভৃতি বর্তমান নবদ্বীপ সহরের স্থানসমূহ আজও সেই প্রাচীন কোলদ্বীপের সংস্থান নিদের্শ করিতেছে। গঙ্গার পশ্চিম-পারে বিদ্যানগর, জান্নগর, মাম্গাছি, কোব্লা প্রভৃতি স্থান নবদ্বীপের উপকণ্ঠে বা সহরতলীরূপে অবস্থিত ছিল। শ্ৰীমন্মহাপ্রভুর সময়ে ও তৎপূর্ববর্তিকালে প্রাচীন নবদ্বীপ সম্বন্ধে বহুবিধ যুক্তিহীন কুতর্কমূলক-ধারণা এক্ষণে নানাকারণে ভীষণমূর্তি ধারণ করিবার অবসর পাইলেও ঐগুলি প্রকৃতস্থান-নির্ণয়বিষয়ে কোন প্রতিষ্ঠা লাভ করে নাই বা করিবে না। চাঁদকাজীর সমাধির কিছু দূরে শ্রীমায়াপুর-যোগপীঠেই শ্রীজগন্নাথমিশ্রের গৃহ বা শচীর প্রাঙ্গণ (‘প্রভুর জন্মভিটা’) অবিসম্বাদিতভাবে দিব্যসূরি শ্রীল জগন্নাথদাস বাবাজী প্রভৃতি সিদ্ধভক্তগণের নির্দেশমতে পুনঃ প্রকাশিত হইয়াছে। সমস্ত নিরপেক্ষ যুক্তিপুষ্ট ঐতিহাসিক ও অলৌকিক প্রমাণাবলী অবিতর্কিত ভাবে শ্রীমায়াপুরের সন্নিহিত স্থানগুলিকেই ‘প্রাচীননবদ্বীপ’ বলিয়া স্থির সিদ্ধান্ত করে।
ভক্তিরত্নাকরে, ১২শ তরঙ্গে— “ইথে যে বিশেষ বিষ্ণুপুরাণে প্রচার। সর্বধামময় এ মহিমা নদীয়ার॥’’ যথা বিষ্ণু পুরাণ ২য় অঃ, ৩য় অঃ, ৬-৭ শ্লোক—“ভারতস্যাস্য বর্ষস্য নব ভেদান্নিশাময়। ইন্দ্রদ্বীপঃ কশেরুমাস্তাম্রবর্ণো গভস্তিমান্ ॥ নাগদ্বীপস্তথা সৌম্যো গান্ধর্বস্ত্বথ বারুণঃ অয়ং তু নবমস্তেষাং দ্বীপঃ সাগরসংবৃতঃ । যোজনানাং সহস্রং তু দ্বীপোঽয়ং দক্ষিণোত্তরাৎ ॥’’
ইহার শ্রীধরস্বামি-টীকা—“সাগরসংবৃতঃ ইতি সমুদ্রপ্রান্তবর্তী; নবমস্যাস্য পৃথঙনামাকথনাৎনাম্নাপি নবদ্বীপোঽমিতি গম্যতে॥’’ তথা ( গৌরগণোদ্দেশদীপিকায় ১৮শ সংখ্যা) “রসজ্ঞাঃ শ্রীবৃন্দাবনমিতি যমাহুর্বহুবিদো যমেতং গোলোকং কতিপয়জনাঃ প্রাহুরপরে । সিতদ্বীপং চান্যে পরমপি পরব্যোম জগদুর্নদ্বীপঃ সোঽয়ং জগতি পরমাশ্চর্য-মহিমা ॥’’
নবদ্বীপ-নাম ঐছে বিখ্যাত জগতে। শ্রবণাদি নববিধা ভক্তি দীপ্তি যা’তে॥ শ্রবণ- কীর্তন আদি নববিধা ভক্তি। দেখহ শ্ৰীভাগবতে প্রহ্লাদের উক্তি॥’’ তথা হি (ভাঃ ৭/৫/২৩-২৪)–“শ্রবণং কীর্তনং বিষ্ণোঃ স্মরণং পাদসেবনম্। অর্চনং বন্দনং দাস্যং সখ্যমাত্মনিবেদনম্॥ ইতি পুংসার্পিত বিষ্ণৌ ভক্তিশ্চেন্নবলক্ষণ। ক্রিয়েত ভগবত্যদ্ধা তন্মনোঽধীতমুত্তমম্॥’’
“অথবা শ্রীনবদ্বীপে নবদ্বীপ নাম। পৃথক্ পৃথক্ কিন্তু হয় এক গ্রাম॥ সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলির আরম্ভেতে। নহিল সে নামের ব্যত্যয় কোন-মতে॥ যৈছে কলি বৃদ্ধ, তৈছে নামের ব্যত্যয় । তথাপি সে সব নাম অনুভব হয়॥ ব্রজে বজ্রনাভ তৈছে কৃষ্ণের ইহাতে। বসাইলা গ্রাম কৃষ্ণলীলানুসারেতে ॥ কথো কাল পর কাথো গ্রাম লুপ্ত হৈল। কাথো গ্রাম-নাম লোকে অস্ত ব্যস্ত কৈল॥ তৈছে নবদ্বীপে অন্তর্ভূত যত গ্রাম। প্রভু-তক্ত-লীলামতে ব্যক্ত হইল নাম। কথো অস্ত-ব্যস্ত, কথো লুপ্ত সেইমতে। কিন্তু নবদ্বীপ-নাম জানাই ক্রমেতে ॥ ‘দ্বীপ’ নাম-শ্রবণে সকল দুঃখ-ক্ষয়। গঙ্গা-পূর্ব-পশ্চিম-তীরেতে দ্বীপ নয়॥ পূর্বে অন্তর্দ্বীপ, শ্রীসীমন্তদ্বীপ হয়। গোদ্রুমদ্বীপ, শ্রীমধ্যদ্বীপ, চতুষ্টয় ॥ কোলদ্বীপ, ঋতু, জহ্ন, মোদদ্রুম আর। রুদ্রদ্বীপ, এই পঞ্চ পশ্চিমে প্রচার॥ এই নবদ্বীপে নবদ্বীপাখ্যা এথায়। প্রভুপ্রিয় শিবশক্ত্যাদি শোভে সদায়॥’’
(ত্রিদণ্ডিগোস্বামি শ্রীল প্রবোধানন্দ-সরস্বতীপাদ-কৃত ‘নবদ্বীপশতকে’ ১-২ সংখ্যা)—“নবদ্বীপে কৃষ্ণং পুরটরুচিরং ভাববলিতং মৃদঙ্গাদ্যৈর্যন্ত্রেঃ স্বজনসহিতং কীর্তনপরম্। সদোপাস্যং সর্বেঃ কলিমলহরং ভক্তসুখদং ভজামস্তং নিত্যং শ্রবণমননাদ্যৰ্চন-বিধৌ॥শ্ৰুতিশ্ছান্দোগ্যাখ্যা বদতি পরমং ব্রহ্মপুরকং স্মৃতির্বৈকুণ্ঠাখ্যং বদতি কিল যদবিষ্ণুসদনম্। সিতদ্বীপং চান্যে বিরলরসিকো যং ব্রজবনং নবদ্বীপং বন্দে পরমসুখদং তং চিদুদিতম্॥’’
অবতার, (শ্রীল জীবপ্রভু-কৃত শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভে ২৮শ সংখ্যায়—) “অবতারশ্চ প্রাকতবৈভবেঽবতরণমিতি” ! শ্রীরূপ প্রভু কৃত শ্রীলঘুভাগবতামৃতে পূঃ খঃ অবতারবর্ণন প্রসঙ্গোক্ত-শ্লোকের টীকায় শ্রীবলদেব-বিদ্যাভূষণোক্তি— “অপ্রপঞ্চাৎ প্রপঞ্চেঽবতরণ খল্ববতারঃ” অর্থাৎ প্রপঞ্চাতীত পরব্যোম বা বৈকুণ্ঠ-ধাম হইতে মায়াতীত তত্ত্বে প্রাকৃত বৈভবরূপ এই প্রপঞ্চে অবতরণই অবতার’।
(চৈঃ চঃ আদি ২য় পঃ ৮৮-৯০ সংখ্যায়—) “যাঁর ভগবত্তা হৈতে অন্যের ভগবত্তা। ‘স্বয়ং ভগবান্’-শব্দের তাহাতেই সত্তা॥ দীপ হৈতে যৈছে বহুদীপের জ্বলন। মূল একদীপ তাঁহা করিয়ে গণন॥ তৈছে সব অবতারের কৃষ্ণ সে কারণ॥ ২৮-৩০ সংখ্যায়) “তাতে আপন ভক্তগণ করি’ সঙ্গে। পৃথিবীতে অবতরি’ করিমু নানা রঙ্গে। এত ভাবি’ কলিযুগে প্রথম সন্ধ্যায়। অবতীর্ণ হৈলা কৃষ্ণ আপনে নদীয়ায়॥ চৈতন্যসিংহের নবদ্বীপে অবতার। সিংহগ্রীব, সিংহীবীর্য, সিংহের হুঙ্কার॥’’ (ঐ ১০৯ সংখ্যা--) “চৈতন্যের অবতারে এই মূখ্য হেতু। ভক্তের ইচ্ছায় অবতার ‘ধর্মসেতু’ ॥’’ (ঐ আদি ৫ পঃ ১৪-১৫ সংখ্যা—) “প্রকৃতির পারে “ পরব্যোম’-নামে ধাম । কৃষ্ণবিগ্রহ যৈছে বিভূত্যাদি গুণবান্॥সর্বগ অনন্ত, ব্ৰহ্ম বৈকুন্ঠাদি ধাম॥ কৃষ্ণ, কৃষ্ণবতারের তাঁহাঞি বিশ্রাম ॥ব্রহ্মাণ্ডে প্রকাশ তাঁর কৃষ্ণের ইচ্ছায়। একই স্বরূপ তাঁর, নাহি দুই কায়॥’’ (ঐ ৭৮-৮১ সংখ্যায়) “যদ্যপি কহিয়ে তাঁরে (কারণার্ণবশায়ীকে) কৃষ্ণের ‘কলা’ করি’ মৎস্যকূর্মাদ্যবতারের তেঁতো ‘অবতারী’ ॥ সেই —পুরুষ-সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের কর্তা। নানা অবতার করে, জগতের ভর্তা॥ সৃষ্ট্যাদি-নিমিত্ত যেই অংশের অবধান। সেই ত’ অংশেরে কহি ‘অবতার’-নাম॥ আদ্যাবতার, মহাপুরুষ, ভগবান্। সর্বাবতার-বীজ, সবাশ্রয়-ধাম॥’’ (ঐ ১৩১, ১৩২ ও ১২৭, ১২৮ এবং ১৩৩ সংখ্যায়—) “কৃষ্ণ যবে অবতরে সর্বাংশাশ্রয়। সর্বাংশ আসি’ তবে কৃষ্ণেতে মিলয়॥ যেই যেই রূপে জানে, সেই তাহা কহে। সকল সম্ভব কৃষ্ণে, কিছু মিথ্যা নহে॥ ** অথবা ভক্তের বাক্য মানি সত্য করি’ । সকল সম্ভবে তাঁতে, যাতে ‘অবতারী’ ॥ ‘অবতার্’, ‘অবতারী’—অভেদ, যে জানে। পূর্বে যৈছে কৃষ্ণকে কেহো কাহো করি’ মানে॥ ** অতএব শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য-গোসাঞি। সর্বাবতার লীলা করি’ সবারে দেখাই॥’’
(চৈঃ চঃ মধ্য ২০শ পঃ ২৬৪ সংখ্যায়—)
‘সৃষ্টি-হেতু যেই মূর্তি প্রপঞ্চে অবতরে।
সেই ঈশ্বরমূর্তি ‘অবতার’-নাম ধরে॥
মায়াতীত পরব্যোমে সবার অবস্থান।
বিশ্বে অবতরি’ ধরে ‘অবতার’ নাম॥’’
বিশ্বম্ভর,—পূর্ববর্তী ১ ম শ্লোকের বিবৃতি দ্রষ্টব্য।