আত্মারামোপাস্য শ্রীবলদেবের রাস—
যে স্ত্রীসঙ্গ মুনিগণে করেন নিন্দন।
তাঁরাও রামের রাস করেন স্তবন ॥২৯॥
তথ্য। স্ত্রীসঙ্গ ও স্ত্রীসঙ্গীর নিন্দা, (ভাঃ ২/১/৩-৪) শ্লোকে পরীক্ষিতের প্রতি শ্ৰীশুকদেবের উক্তি—) “হে রাজন! গৃহমেধী স্ত্রীসঙ্গিগণের বয়স বা আয়ুষ্কালের মধ্যে রাত্রিভাগ নিদ্রাতে অথবা স্ত্রীসঙ্গে এবং দিবাভাগ অর্থচেষ্টায় অথবা কুটুম্বভরণকার্যে বৃথা ব্যয়িত হয়। দেহ, পুত্র ও কলত্র প্রভৃতি বস্তু অসৎ বা অনিত্য হইলেও, তাহাতে প্রমত্ত ব্যক্তি উহাদের বিনাশ দেখিয়াও দেখে না।’’
(ভাঃ ৩/৩১/৩২-৪২) শ্লোকে মাতা-দেবহূতির প্রতি ভগবান্ শ্রীকপিলদেবের উক্তি—) “উপস্থ ও উদরের প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিতে উদ্যত অসাধুগণের সহিত অবস্থান করিয়া জীব যদি তাহাদের পথেই বিচরণ করে, তাহা হইলে সে নিশ্চয়ই নরকে প্রবেশ করে। সত্য, শৌচ, দয়া, মৌন, বুদ্ধি, লজ্জা, শ্রী, যশ, ক্ষমা, শম, দম ও ভগ ইত্যাদি যাবতীয় সদ্গুণরাশি সমস্তই অসৎসঙ্গ প্রভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়; ঐ সকল অশান্ত, মূঢ়, দেহাত্ম-বুদ্ধিবিশিষ্ট, ক্রীড়ামৃগের ন্যায় কামিনীকুলের বশীভূত, ঘৃণ্য অসদ্ব্যক্তিগণের সঙ্গ জীবের কখনও কর্তব্য নহে। যোষিৎ (স্ত্রী) ও যোষিৎসঙ্গী (স্ত্রীসঙ্গী) ব্যক্তির সংসর্গফলে জীবের যে রূপ মোহ ও বন্ধন উপস্থিত হয়, অন্য কোন বস্তুর সংসর্গে সেইরূপ (সর্বনাশ) হয় না। দেখ, অন্যের কথা দূরে থাকুক, স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মাও স্বীয় দুহিতাকে দেখিয়া তাঁহার রূপে মোহিত হইয়া নির্লজ্জের ন্যায় মুগ-রূপ ধরিয়া মৃগীরূপধারিণী সেই কন্যার পশ্চাদ্ধাবন করিয়াছিলেন। এক শ্রীনারায়ণ-ঋষি ব্যতীত সেই ব্রহ্মাদি দেবতা, তৎসৃষ্ট মরীচ্যাদি প্রজাপতি, মরীচ্যাদি-সৃষ্ট কশ্যপাদি, কশ্যপাদি-সৃষ্ট দেব মনুষ্যাদির মধ্যে এমন কোন্ ধৃতিমান্ পুরুষ আছেন, যিনি এই প্রমদারূপিণী মায়ায় বিমুগ্ধা না হন? হে মাতঃ ! আমার স্ত্রীরূপা মায়ার প্রভাব দেখ, সে একটীমাত্র ভ্রূভঙ্গে দ্বিগ্বিজয়ী বীরগণকে পর্যন্ত পদাবনত করিয়া থাকে। যিনি সাধনভক্তিযোগের পরপার (সাধ্য-কৃষ্ণপ্রেমা) লাভ করিতে ইচ্ছুক, তিনি কখনও কামিনীর সঙ্গ করিবেন না; কারণ, তত্ত্ববিদ্গণ এই যোষিৎকুলকে সাধকের পক্ষে নিরয়দ্বারস্বরূপ বলিয়া অভিহিত করেন। স্ত্রীরূপা দৈবী মায়া শুশ্রুষাদি-ছলে ধীরে ধীরে পুরুষের নিকট গমন করে, কিন্তু বুদ্ধিমান্ সাধক তাহাকে তুণাচ্ছাদিত কুপের ন্যায় অবলোকন করিবেন। স্ত্রীসঙ্গ-ফলে স্ত্রীত্ব লাভ করিয়া জীব গৃহস্বামিনীর ন্যায় আচরণকারিণী স্ত্রীরূপা আমার মায়াকেই মোহবশতঃ বিত্ত, পুত্র ও গৃহদাতা স্বামী বলিয়া মনে করে। স্ত্রীত্ব-প্রাপ্ত জীবের এই মায়াকে পতি, পুত্র ও গৃহরূপী মৃত্যু বলিয়া জানা কর্তব্য।’’
(ভাঃ ৪/২৫/৬ শ্লোকে রাজা প্রাচীনবৰ্হির প্রতি শ্ৰীনারদের উক্তি—) “হে রাজন্! স্ত্রীসঙ্গী মূঢ় ব্যক্তি অনিত্য পুত্র-কলত্র ধনাদিতেই, ‘পরমার্থ’-বুদ্ধিরূপ ভ্রান্তি-চালিত হইয়া স্বীয় ইন্দ্রিয়সুখসাধক গৃহ ও কাম্যকর্মাদিতে এবং জন্মমরণময় সংসার-মার্গে ভ্রমণ করিতে থাকে, বিষ্ণুর পরমপদ কখনও লাভ করিতে পারে না।’’
ভাঃ ৪/৫/১০—৪/২৯/৫১ পর্যন্ত, বিশেষতঃ ৪/২৮/৫৯ শ্লোকে পুরঞ্জন ও পুরঞ্জনীর উপাখ্যানদ্বারা রাজা প্রাচীনবর্হিকে শ্রীনারদের স্ত্রীসঙ্গের (ইন্দ্রিয়তর্পণের) কুফল ও শ্রীহরিতোষণের সুফল-বৰ্ণন দ্রষ্টব্য॥
পুনরায়, (ভাঃ ৪/২৯/৫৪-৫৫ শ্লোকে রাজা প্রাচীনবৰ্হির প্রতি শ্রীনারদের উক্তি—) “হে রাজন! পুষ্পের ন্যায় প্রথমে সরস ও পরিণামে বিরস-ধর্মযুক্তা স্ত্রীগণের আশ্রয়স্থল গৃহে থাকিয়া যে ব্যক্তি জিহ্বা ও উপস্থাদি ইন্দ্রিয়লভ্য পুষ্প-মধুগন্ধসদৃশ অতি তুচ্ছ কাম্যকর্মফলস্বরূপ কামসুখলেশ অন্বেষণ করিতে করিতে স্ত্রীগণের সহিত সহবাস করিয়া তাহাদের প্রতি স্বীয় চিত্ত সন্নিবেশ করিয়া ফেলিয়াছে, ভ্রমর গুঞ্জন ধ্বনির ন্যায় পত্নী ও স্বজনাদির অতি মনোহর আলাপে যাহার কর্ণ অতিশয় প্রলোভিত হইয়াছে, অহোরাত্র পর্যন্ত প্রতি মুহূর্ত, প্রতি ক্ষণ, প্রতি নিমেষাৰ্দ্ধ, প্রতি পল ইত্যাদি কালের ক্ষুদ্রতম অংশসমূহ মৃগের সম্মুখস্থিত ব্যাঘ্ৰযুথের ন্যায় তাহার আয়ু হরণ করিতেছে দেখিয়াও উহাতে দৃক্পাত না করিয়া যে ব্যক্তি স্বভোগ্য গৃহকলত্রাদিতে বিহার করিতেছেন, ব্যাধতুল্য কৃতান্ত পৃষ্ঠদেশে থাকিয়া দূর হইতে অলক্ষিতভাবে যাহার অন্তঃকরণে গুপ্ত শরদ্বারা আঘাত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে, সেই হরিতোষণ-বিমুখ স্ত্রীসঙ্গী সংসার-মরণাহত-হৃদয় জীবের অবস্থা বিচার করুন্। অতএব হে রাজন! ....আপনি নিতান্ত কামুকদলের অসদ্বাৰ্তা-মুখরিত, (ইন্দ্রিয়-তর্পণপর) যোষিৎসঙ্গমূলক আশ্রম পরিত্যাগ করিয়া, শুদ্ধমুক্তজীবগণের একমাত্র আশ্রয়স্থল শ্রীহরির প্রীতি বিধান করুন। এইরূপে ক্রমে ক্রমে অসৎসঙ্গ হইতে বিরত হউন।’’
(ভাঃ ৫/১/২৯ শ্লোকে সার্বভৌম-নৃপতি গৃহস্থ-বৈষ্ণব শ্রীপ্রিয়ব্রতের সম্বন্ধে পরীক্ষিতের প্রতি শ্ৰীশুকদেবের উক্তি—) .মহারাজ প্রিয়ব্রতের গার্হস্থ্যলীলাভিনয়ও যথেষ্ঠ ছিল; তৎপত্নী বিশ্বকর্মা-তনয়া সম্রাজ্ঞী বর্হিষ্মতীর পতিদর্শনে হর্ষ ও অভ্যুত্থান, অঙ্গাবরণ-চেষ্টা, ললিতগমনাদি চালচলন, স্ত্রীসুলভ কটাক্ষনিক্ষেপাদি শৃঙ্গারবিলাস-প্রকাশ, লজ্জা-সঙ্কোচ-নিবন্ধন হাস্য, কটাক্ষ ও মনোহর পরিহাস-বাক্যাদি অনুদিন বৃদ্ধি প্রাপ্ত হওয়ায়, তদ্দ্বারা প্রিয়ব্রতের সদসদ্বিবেক-জ্ঞান যেন পরাভূত হইতেছিল; সুতরাং বিষয়াসক্তিবশতঃ তিনি যেন আত্মবিস্মৃত অর্থাৎ স্বরূপোপলব্ধিহীন ব্যক্তির ন্যায় রাজ্য ভোগ করিতেন।’’
ঐ ৩৭ শ্লোকে ঐ প্রিয়ব্রতের বিষয়ভোগে ধিক্কারোক্তি—“অহো! আমি কতবার অসৎ কার্য করিয়াছি! ইন্দ্রিয়বর্গ এতদিন ধরিয়া আমাকে অবিদ্যা-বিরচিত বিষয়ান্ধকূপে অভিনিবিষ্ট করিয়া রাখিয়াছিল। বিষয়ভোগ ত’ যথেষ্টই হইল, আর নয়; হায়! আমি এই কামিনীর ক্রীড়ামৃগ (মর্কট) তুল্য হইয়া পড়িয়াছি; আমাকে ধিক্, শত ধিক!’’
(ভাঃ ৫/৫/২ ও ৭-৯ শ্লোকে আত্মজগণের প্রতি ভগবান্ শ্রীঋষভদেবের উক্তি—) “তত্ত্ববিদ্ পণ্ডিতগণ শুদ্ধভক্ত বা মহাজনের সেবাকেই স্বরূপাবস্থিতি-রূপা মুক্তির দ্বার এবং স্ত্রীসঙ্গিগণের সঙ্গকেই তমোরূপ নরকের দ্বার বলিয়া অভিহিত করেন। জ্ঞানী, পণ্ডিত হইয়াও জীব যখন ইন্দ্রিয়-তর্পণ-চেষ্টা বা ভোগময়ী প্রবৃত্তিকে ‘অনর্থ’ বলিয়া দর্শন না করে, তখন সে স্বরূপবিস্মৃত, প্রমত্ত ও মূঢ় হইয়া মৈথুনসুখ-প্রধান গৃহ লাভ করিয়া তাপত্রয় ভোগ করে। তত্ত্ববিদ্গণ স্ত্রী-পুরুষের এই মিথুনীভাবকেই তাহাদের পরস্পরের হৃদয়গ্রন্থি বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। যেহেতু উহা হইতে জীবের দেহ-গেহ-পুত্র-ধনাদিতে ‘আমি’ ও ‘আমার’-বুদ্ধিরূপ মোহ উৎপন্ন হয়। যখন তাহার কর্মফলজনিত মনোরূপ হৃদয়গ্রন্থি শিথিল হয়, তখনই সেই পুরুষ স্ত্রীসঙ্গ হইতে বিরত হইয়া সংসারমূল অহঙ্কার ত্যাগ করিয়া মুক্তি ও পরমপদ লাভ করেন।’’
(ভাঃ ৬/২/৩৬-৩৮ শ্লোকে বিষ্ণুদূতগণের কৃপায় যমদূতগণের পাশ মুক্ত অজামিলের আত্মগ্লানিবাক্য—) “দেহাদিতে আত্মবুদ্ধি হইতেই বিষয়ভোগ-কামনা; এই ভোগকামনা হইতেই জড়ীয় শুভাশুভকর্মে আসক্তি, ইহাই জীবের বন্ধন; এই বন্ধন আমি মোচন করিব। রমণীরূপিণী যে বিষ্ণুমায়া ক্রীড়াপশুর ন্যায় অধম আমাকে লইয়া যথেচ্ছভাবে ক্রীড়া-রঙ্গ করিয়াছে, সেই মায়াগ্রস্ত স্বীয় মনকেও আমি মোচন করিব। পরমার্থ বাস্তব-বস্তুতে বুদ্ধি স্থির হওয়ায় ‘আমি’ ও ‘আমার’ বলিয়া জ্ঞান পরিত্যাগ করিয়া শ্রীনাম কীর্তনাদিপ্রভাবে শোধিতচিত্তকে ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের প্রতি নিয়োগ করিব।’’
(ভা ৬/৩।২৮ শ্লোকে স্বীয় দূতগণের প্রতি ধর্মরাজ যমের উক্তি—) “নিষ্কিঞ্চন, স্ত্রীসঙ্গবর্জনকারী ভাগবত পরমহংসকুল ভগবান্ মুকুন্দের যে পাদপদ্মামকরন্দ-রস নিরন্তর সেবন করেন, তাহাতে পরাঙ্খুখ হইয়া যে-সকল অসাধু ব্যক্তি নরকের দ্বারস্বরূপ স্ত্রীসঙ্গাগার গৃহেই একান্ত লোলুপ, হে দূতগণ! তোমরা তাহাদিগকেই আমার নিকট আনয়ন করিও।’’
(ভাঃ ৬/৪/৫২-৫৩ শ্লোকে প্রবৃত্তিমার্গপরায়ণ, স্ত্রীসঙ্গ-দক্ষ, মায়াবশ প্রজাপতি দক্ষ এবং তদনুগামী ভাবি-জীবগণকে ভগবান্ শ্রীহরি অনন্তকালের জন্য স্ত্রীসঙ্গরূপ অভক্তিমার্গ বা বিষয়-ভোগে নিক্ষেপ করিলেন বলিয়া উল্লেখ আছে)।
(ভাঃ ৬/১৭/৮ শ্লোকে পরমহংস ও অবধূতাগ্রগণ্য ঈশ্বর শ্রীমদ্গিরিশকে পার্বতীর সহিত আলিঙ্গনাবদ্ধ দেখিয়া বিদ্যাধরাধিপতি চিত্রকেতুর উক্তি—) “প্রাকৃত বদ্ধজীবই প্রায়শঃ নির্জনে স্ত্রীলোকের সহিত বিহার করে।’’
(ভাঃ ৭/৬/১১, ১৩ ও ১৭ শ্লোকে অসুর-বালকগণের প্রতি শ্রীপ্রহ্লাদের উপদেশ—) “স্বীয় অনুকষ্পিতা প্রিয়তমার সঙ্গ, রহস্য ও মনোহর আলাপাদি স্মরণ করিয়া গৃহব্রত গো-দাস কিরূপে তাহাকে পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হইবে? সে জিহ্বা ও উপস্থেন্দ্রিয়-জাত সুখকেই বহুমান করায়, দুরস্ত মোহগ্রস্ত হইয়া কিরূপে বৈরাগ্যযুক্ ভক্তির অনুষ্ঠান করিবে?’’
(ভাঃ ৭/৯/৪৫ শ্লোকে শ্রীনৃসিংহদেবের প্রতি শ্রীপ্রহ্লাদের উক্তি-) “গৃহমেধিগণের স্ত্রীসঙ্গাদি যে সুখ, তাহা নিতান্ত তুচ্ছ, হস্তদ্বয়ের কন্ডূয়নের ন্যায় উহাতেও দুঃখের পর দুঃখই বৃদ্ধি পাইতে থাকে; কিন্তু কামুক দীন ব্যক্তিগণ তৎফলে বহু দুঃখ পাইয়াও তাহাতে তৃপ্ত বা বিরত হয় না; কেবলমাত্র আপনার কৃপাপ্রাপ্ত ধৃতিমান্ ব্যক্তিগণই এই কামের বেগ সহ্য (দমন) করিতে পারেন, অন্য নহে।’’
(ভাঃ ৭/১২/৬-৭, ৯-১১ শ্লোকে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের প্রতি শ্রীনারদের আশ্রম ধর্ম বর্ণন—) “স্ত্রীলোক ও স্ত্রীসঙ্গী ব্যক্তিগণের সহিত যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু মাত্রই ব্যবহার কর্তব্য। সকলেরই কামিনী-গাথা (গ্রাম্যকথা) বর্জন কর্তব্য; কেননা, প্রবল ইন্দ্রিয়বর্গ ত্যক্তগৃহ সন্ন্যাসীরও মন হরণ করে। নারী সাক্ষাৎ অগ্নি, এবং পুরুষ—ঘৃত কুম্ভতুল্য, অতএব নির্জনে স্বীয় ঔরসজাত কন্যার সহিতও একত্র অবস্থান চেষ্টা পরিত্যাগ করিবে। যে-কাল-পর্যন্ত জীব স্বরূপ সাক্ষাৎকারদ্বারা দেহেন্দ্রিয়-সুখ প্রভৃতিকে (বিকৃত) সুখাভাস বিবেচনা করিয়া অনর্থমুক্ত হইতে না পারিয়াছেন, কালাবধি (সাধনাবস্থায়) স্ত্রীপুরুষ-ভেদজ্ঞান হইতে বিরত হইয়া ভোক্তৃ-বুদ্ধিতে (পরম্পর সম্ভোগার্থ) ঐক্যবুদ্ধি করিবে না; যেহেতু সেই জড়ীয় ভোক্তৃবুদ্ধি হইতেই বুদ্ধিবিপর্যয় অর্থাৎ ভোক্তৃ-অভিমানে ভোগ্য-বুদ্ধি জন্মে, (সুতরাং অদ্বয়অনানুশীলন-দ্বারা ক্রমশঃ জড়ীয় দ্বৈত বা ভোগ্য-বুদ্ধি দূর করিবে) —কি গৃহস্থ, কি ত্যক্তগৃহ যতি সকলের পক্ষেই এইসকল ধর্ম কথিত হইয়াছে।’’
(ভাঃ ৭/১৪/১২-১৩ শ্লোকেও যুধিষ্ঠিরের প্রতি শ্রীদেবর্ষির উক্তি—) “যে ব্যক্তি প্রাণাধিক প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রতি ভোক্তৃবুদ্ধি পরিত্যাগ করেন, তিনি নিশ্চয়ই ভগবান্ শ্রীঅজিতকে জয় করেন। অন্তিমে কৃমি, বিষ্ঠা ও ভস্মে পর্যবসান-যোগ্য এই তুচ্ছ দেহ কোথায়, এই দেহের নিমিত্ত যাহার সহিত সঙ্গ হয়, সেই স্ত্রীই বা কোথায়, আর পরম-মহান্ সত্য, সনাতন আত্মাই বা কোথায়?
(ভাঃ ৭/১৫/১৮শ শ্লোকেও যুধিষ্ঠিরের প্রতি শ্ৰীনারদের উক্তি---) “জিহ্বা ও উপস্থেন্দ্রিয়-বেগবশে কামুক ব্যক্তি কুকুরের ন্যায় ইতস্ততঃ ছুটিয়া বেড়ায়।’’
(ভাঃ ৯/৬/৫১ শ্লোকে সৌভরি-মুনির প্রচুর স্ত্রীসঙ্গের পর মনে মনে অনুতাপোক্তি— ) “মুমুক্ষু অর্থাৎ নিঃশ্রেয়স লাভেচ্ছু সাধক মৈথুনধর্মী জীবগণের সঙ্গ পরিত্যাগ করিবেন; অসমর্থতা-নিবন্ধন তিনি বহিরিন্দ্রিয়গুলিকে সর্বান্তঃকরণে একেবারে পরিত্যাগ করিতে পারিবেন না; সুতরাং সৎসঙ্গাভাবে নির্জনে একাকী থাকিয়া ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণে চিত্তনিয়োগ করিবেন, আর যদি প্রকৃষ্ঠরূপে সল করিতেই হয়, তবে সেই ভগবদ্ধর্মপরায়ণ বিষ্ণুব্রত সাধুগণেরই সঙ্গ কর্তব্য।’’
(ভাঃ ৯/১১/১৭ শ্লোকে পরীক্ষিতের নিকট শ্রীরামসীতা চরিত্রবর্ণনপ্রসঙ্গে শ্ৰীশুকদেবের উক্তি) “স্ত্রী ও পুরুষের পরস্পর প্রসঙ্গ বা আসক্তি সর্বত্রই এইরূপ ভয় আবাহন করে, জিতেন্দ্রিয় মুক্ত পুরুষগণের পক্ষেও যখন উহা—ভয়াবহ, তখন গ্রাম্যধর্মপরায়ণ গৃহাসক্ত ব্যক্তির ত’ কথাই নাই।’’
(ভাঃ ৯/১৪/৩৬-৩৮ শ্লোকে পরীক্ষিতের নিকট শ্ৰী শুকদেব-কর্তৃক উর্বশী ও পুরূরবার বৃত্তান্তবর্ণন-প্রসঙ্গে স্ত্রীজিত পুরূরবার প্রতি উর্বশীর উক্তি-) “হে রাজন! তুমি মরিওনা, এই সকল ব্যাঘ্রী যেন তোমাকে ভক্ষণ না করে, অর্থাৎ তুমি কাম-বশ হইও;না ব্যাঘ্রীর হৃদয়তুল্য স্ত্রীলোকের সখ্য কোথাও স্থায়ী হয় না; রমণীগণ-প্রিয়তমের নিমিত্ত সর্বকার্যে সাহসিনী; বিশেষতঃ, যাহারা---নব নব পরপুরুষে অভিলাষবতী, পুংশ্চলী ও স্বেচ্ছাচারিণী, তাহারা সম্পূর্ণরূপে সৌহার্দ বিসর্জন করিয়া স্বীয় বশীভূত মূঢ় (লোকগণের নিকট অলীক বিশ্বাস উৎপাদন করে।’’
শ্রীমদ্ভাগবতে নবম-স্কন্ধে সমগ্র ১৯শ অধ্যায়ে অর্থাৎ ১-২০ ও ২৪-২৮ শ্লোকে ছাগ-দম্পতির দৃষ্টান্তদ্বারা রাজা যযাতি কর্তৃক দেবযানীর নিকট স্ত্রীসঙ্গ নিন্দা-বৰ্ণন দ্রষ্টব্য॥
(ভাঃ ১১/৩/১৯-২০ শ্লোকে বিদেহরাজ শ্রীনিমির প্রতি নব-যোগেন্দ্রের অন্যতম অন্তরীক্ষের উক্তি—) “দুঃখনাশ ও সুখলাভের নিমিত্ত কর্মপরায়ণ মৈথুনচারী স্ত্রীসঙ্গী মানবগণের কর্মফলের বৈপরীত্য সর্বদা দর্শন করিবে; নিত্য দুঃখপ্রদ, মৃত্যুকারণ, অতিকষ্টলভ্য বিত্তদ্বারা লব্ধ অনিত্য গৃহ ও যোষিৎ, প্রভৃতির সঙ্গের দ্বারা কতদূরই বা প্রীত হয় ? ’’
(ভাঃ ১১/৫/১৩ ও ১৫শ শ্লোকে ঐ নিমির প্রতি শ্ৰীচমসের উক্তি—) ‘ইন্দ্রিয়তপর্ণার্থ স্ত্রীসঙ্গ না করিয়া শাস্ত্রবিহিত স্ত্রীসঙ্গ দ্বারাই যে ব্রহ্মচর্য হয়,---এই বিশুদ্ধ বৈধধর্ম অবৈধ-স্ত্রীসঙ্গিগণ জানে না। যাহারা স্ত্রীপুত্রাদির ভোগ্য দেহের সহিত স্নেহপাশে বদ্ধ হয়, তাহারা অধঃপতিত হয়।’’
ভাঃ ১১/৭/৫২-৭৪ শ্লোকে শ্রীউদ্ধবের নিকট ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণকর্তৃক তত্ত্ববিৎ অবধূত ও রাজর্ষি-যদুর সংবাদ-বৰ্ণন-প্রসঙ্গে কপোত-পতির বৃত্তান্ত আলোচ্য।
(ভাঃ ১১/৮/১, ৭-৮, ১৩-১৪, ১৭-১৮শ শ্লোকে রাজর্ষি যদুর প্রতি অবধূত ব্রাহ্মণের উক্তি) “স্বর্গ বা নরক, উভয়স্থলেই জীবগণের ইন্দ্রিয়সুখ-লাভ অবশ্যম্ভাবি দুঃখের ন্যায় ঘটিয়া থাকে, অতএব বুদ্ধিমান পণ্ডিত ব্যক্তি ভোগে অভিলাষ করিবেন না। ... পতঙ্গ যেমন অগ্নিতে পুড়িয়া মরে, অজিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিও তাদ্রূপ বিষ্ণুমায়ারূপিণী স্ত্রীমূর্তি-দর্শনে তদীয় হাবভাবে প্রলোভিত হইয়া অন্ধতামিস্রে পতিত হয় নষ্ট প্রজ্ঞ মুর্খ ব্যক্তি মায়া-বিরচিত যোষিৎ, হিরণ্য, ও অলঙ্কার-বস্ত্রাদিতে উপভোগ-বুদ্ধিদ্বারা প্রলোভিতচিত্ত হইয়া আগ্নিতে পতিত পতঙ্গের ন্যায় বিনষ্ট হয়।...সন্ন্যাসী কাষ্ঠনিৰ্ম্মিত যুবতী মূর্তিকে পদদ্বারাও স্পর্শ করিবেন না; কিন্তু স্পর্শ করিলে, করিণীর অঙ্গসঙ্গ ফ লে কবীর ন্যায় বন্ধনদশ প্রাপ্ত হইবেন। প্রাজ্ঞ ব্যক্তি স্বীয় মৃত্যুরূপা স্ত্রীতে কখনই আসক্ত হইবেন না; আসক্ত হইলে এক গজীতে আসক্ত নিজাপেক্ষা বলবত্তর অন্যান্য গজগণকর্তৃক গজের দশা-লাভের ন্যায় নিধনপ্রাপ্ত হইবেন।... বনচারী ব্যক্তি (স্ত্রীসহ-সম্বন্ধি গ্রাম্য) গীত কখনও শ্রবণ করিবেন না। মৃগীপুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিও স্ত্রীগণের গ্রাম্য (ইন্দ্রিয়তর্পণমূলক) নৃত্যগীতবাদ্যাদি ভোগ করিয়া ক্রীড়নকের ন্যায় তাহাদিগের বশীভূত হইয়াছিলেন।’’
(ভাঃ ১১/৮।৩০-৩৩ শ্লোকে শ্রীউদ্ধবের নিকট ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের পিঙ্গলা-বেশ্যার নির্বেদোক্তি-বর্ণন—) “হায়, অতি মূর্খা আমি আত্মরমণ, চিদ্রতিপ্রদ, জীবহৃদয়ে অন্তর্যামিরূপে বর্তমান, সনাতন, ভগবান্ শ্রীঅধোক্ষজাকে পরিত্যাগ করিয়া, যথেষ্ট ভোগসম্পাদনে অশক্ত, তুচ্ছ-শোক-মোহ-ভয়-প্রদ এই নশ্বর স্ত্রী-পুরুষ-দেহের সেবা করিতেছি! হায়, এই আমিই আবার স্ত্রী সঙ্গী অর্থগৃধ্নু ঘৃণ্য পুরুষের নিকট হইতে তাহার ইচ্ছামত এবং আমার ইচ্ছামত (সহজে) বিক্রয়যোগ্য এই দেহদ্বারা অর্থ ও রতি ইচ্ছা করিতেছি! হায়, ওতপ্রোতভাবে নিহিত বংশস্তম্ভাদির ন্যায়, পৃষ্ঠাস্থি, পঞ্জরাস্থি ও হস্তপদাস্থি প্রভৃতি অস্তিসমূহে নির্মিত, চর্ম, লোম ও নখাদিদ্বারা আবৃত, ক্লেদনিঃসরণশীল নবদ্বারযুক্ত বিষ্ঠামূত্রপূর্ণ এই স্ত্রী-পুরুষ-দেহরূপ গৃহকে আমি ব্যতীত আর অন্য কোন যোষিৎ সেবা করিয়া থাকে? হায়, এই বিদেহপুরে আমিই একমাত্র মূঢ়বুদ্ধি, যেহেতু আমি অতি অসতী, এই জন্যই আত্মপ্রদ ভগবান্ শ্রীঅচ্যুত ব্যতীত অন্য কামভোগে ইচ্ছা করিতেছি!' ঐ অধ্যায়েরই ৩৪, ৩৫, ৩৯ ও ৪২ শ্লোকও দ্রষ্টব্য।
(ভাঃ ১১/৯/২৭ শ্লোকে রাজর্ষি-যদুর প্রতি অবধূত ব্রাহ্মণের উক্তি –) “বহু সপত্নী মিলিয়া যেমন একজন গৃহস্বামী (পতি) কে ছিন্ন ভিন্ন করে, তদ্রূপ জিহ্বা, শিশ্ন, ত্বক্ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়বর্গ বদ্ধজীবকে স্ব-স্ব বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ করিয়া ধ্বস্ত বিধ্বস্ত করে।’’
(ভাঃ ১১/১০/৭, ২৫ ও ২৭-২৮ শ্লোকে উদ্ধবের প্রতি ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের উক্তি—) “আমার ভক্ত দেহ, গেহ ও স্ত্রী প্রভৃতির প্রতি উদাসীন হইবেন।... ভক্তিবিমুখ পুণ্যবান্ ব্যক্তি পুণ্যপ্রভাবে দেবক্রীড়াস্থলে নন্দনকাননাদিতে স্ত্রীগণের সহিত বিহার করিতে থাকিলেও স্বীয় অধঃপতন জানিতে পারে না।... যদি বা অসতের সঙ্গবশতঃ কেহ অধর্মরত, অজিতেন্দ্রিয়, কামাত্মা ও স্ত্রীলম্পট হইয়া প্রাণিগণের হিংসা করে, তাহা হইলে সে-ব্যক্তি অন্তিমকালে ভীষণ তমোগতি লাভ করে।’’
(ভাঃ ১১।১৪।২৯ শ্লোকে উদ্ধবের প্রতিশ্রীকৃষ্ণের উক্তি—) “বুদ্ধিমান্ ব্যক্তি যোষিৎসঙ্গ ও যোষিৎসঙ্গীর সঙ্গ দূর হইতে পরিত্যাগপূর্বক সৎসঙ্গে নিরন্তর আমার চিন্তা করিবেন।’’
(ভাঃ ১১/১৭/৩৩ ও ৫৬ শ্লোকে উদ্ধবের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের উক্তি—) “ত্যক্তগৃহ ব্যক্তি স্ত্রীগণের দর্শন, স্পর্শন, আলাপ ও পরিহাসাদি এবং মিথুনীভূত প্রাণীর দর্শন অগ্রেই পরিত্যাগ করিবেন।... যে-ব্যক্তি—গৃহে আসক্ত-বুদ্ধি, পুত্ৰবিত্ত -কামনা ক্লিষ্ট এবং স্ত্রী-লম্পট, সেই মূঢ়ই ‘আমি’ ও ‘আমার’, এই অহঙ্কারে বদ্ধ হয়।’’
(ভাঃ ১১/২১/১৮-২১ শ্লোকে উদ্ধবের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের উক্তি “যে যে ভোগ্যবিষয় হইতে মানব নিবৃত্ত হইবে, সেই সেই বিষয়ের বন্ধন হইতে সে মুক্ত হইবে; এই নিবৃত্তি লক্ষণ ভক্ত্যাত্মক ধর্মই মানবগণের চরমকল্যাণপ্রদ ও শোক-মোহ-ভয়নাশক। যোষিৎ প্রভৃতি বিষয়ে ভোগবুদ্ধি বশতঃই তাহাতে ভোক্তা পুরুষাভিমানীর ‘আসক্তি’; তাহা হইতে ‘কাম’ এবং সেই কাম হইতেই মানবগণের ‘কলি’ অর্থাৎ বিবাদ জন্মে; কলি হইতে দুর্বিসহ ‘ক্রোধ’ জন্মে; ‘মোহ’ উহার অনুগমন করে এবং ঐ মোহ হইতে পুরুষের কর্তব্যাকর্তব্য-স্মৃতি নষ্ট হয়। তদ্বিরহিত মানবই অসাধুতুল্য এবং তজ্জন্য সেই মোহগ্রস্ত মৃত-তুল্য ব্যক্তি ভগবজনরূপ একমাত্র স্বার্থ হইতে ভ্রষ্ট হইয়া পড়ে।’’
(ভাঃ ১১।২৬/৩ শ্লোকে উদ্ধবের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের উক্তি) “কখনও শিশ্নোদর-তর্পণরত অসাধু ব্যক্তিগণের সঙ্গ করিবে না। ঐরূপ একজনের সহকারী ব্যক্তিও অন্ধের অনুসরণকারী অন্ধের ন্যায় অন্ধতামিস্রে পতিত হয়।’’
ঐ অধ্যায়ের ৪র্থ-২৪শ শ্লোকে ইলা-তনয় পুরূরবার স্ত্রীসঙ্গ-পরিণামসূচক আখ্যান বর্ণিত হইয়াছে।
(ভঃ রঃ সিঃ, দঃ বিঃ, ৫ম লঃ—) “যদবধি মম চেতঃ কৃষ্ণপদারবিন্দে নব নব রসধামন্যুদ্যতং রন্ধমাসীৎ। তদবধি বত নারীসঙ্গমে স্মর্যমাণে ভবতি মুখবিকারঃ সুষ্ঠু নিষ্ঠীবনঞ ॥’’
অর্থাৎ ‘যে অবধি নিত্য নব-নব-চিদ্রসনিলয় শ্রীকৃষ্ণপাদপদ্মে আমার চিত্ত অনুরাগোদ্যত হইয়াছে, অহো , সেই অবধি স্ত্রীসঙ্গের স্মরণ হইলেই আমার অতিশয় মুখবিকৃতি ও নিষ্ঠীবন-ত্যাগ হইতে থাকে।’
(ভঃ রঃ সিঃ, উঃ বিঃ “ঘনরুধিরময়ে ত্বচা পিনদ্ধে পিশিত-বিমিশ্রিত-বিশ্র-গন্ধভাজি। কথমিহ রমতাং বুধঃ শরীরে ভগবতি হন্ত রতের্লবেঽপ্যুদী দীর্ণে ॥’’
অর্থাৎ, ‘অহো, ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণে লেশমাত্র রতি উদিতা হইলে পণ্ডিতব্যক্তি গাঢ়রুধিরময়, চর্মাবৃত, মাংসময়, আমগন্ধি (দুর্গন্ধযুক্ত) এই দেহে কেনই বা আর রমণ করিবেন?’ ঐ ৮ম লঃ-১) “অহমিব কফ-শুক্র শোণিতানাং পৃথু কুতুপে কুতুকী রতঃ শরীরে। শিব শিব পরমাত্মানো দুরাত্মা সুখবপুষঃ স্মরণেঽপি মন্থরোঽস্মি॥’’
অর্থাৎ, ‘হায়, ‘আমি কফশুক্ৰশোণিতাধার চর্মময়-কোষরূপ এই স্থূলদেহে বিচিত্র জড়রসাস্বাদনাৰ্থ পরম উৎসাহভরে রত হইয়াছি! রাম !! রাম !!! দুরাত্মা আমি চিদানন্দ-বিগ্রহ পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের স্মরণেও অলস হইলাম!’
(2) “হিত্বাস্মিন্ পিশিতোপনদ্ধরুধিরক্লিন্নে মুদং বিগ্রহে প্রীত্যুৎসি মনাঃ কদাহমসকৃদ্দুস্তর্কচর্যাস্পদম্ । আসীনং পুরটাসনোপরি পরং ব্রহ্মাম্বুদশ্যামলং সেবিষ্যে চলচারুচামরমরুৎসঞ্চার-চাতুর্যতঃ ॥’’
অর্থাৎ, ‘কবে আমি এই মাংস-ব্যাপ্ত ও রক্তক্লেদময় দেহে প্রীতি পরিহার করিয়া প্রেমার্দ্রচিত্তে কুতর্কাগোচর স্বর্ণ সিংহাসনোপরি উপবিষ্ট নবঘনশ্যাম পরব্রহ্ম শ্রীহরিকে চঞ্চল-চারু-চামরের সমীরণসঞ্চালন-নৈপুণ্যদ্বারা পুনঃ পুনঃ সেবা করিব?’
(৩) “স্মরন্ প্রভুপদাম্ভোজং নটন্নটতি বৈষ্ণবঃ। যস্তু দৃষ্ট্যা পদ্মিনীনামপি সুষ্ঠু হৃণীয়তে॥’’
অর্থৎ, ‘যিনি সর্বলক্ষণযুক্তা পদ্মিনী-নারীগণকেও দেখিবামাত্র অত্যন্ত ঘৃণা করেন অর্থাৎ দুঃসঙ্গ জ্ঞান করেন, সেই বিষ্ণুভক্ত (সর্বদা) স্বীয় প্রভুর পাদপদ্ম স্মরণপূর্বক নৃত্য করিতে করিতে সর্বত্র ভ্রমণ করিয়া থাকেন।’
(৪) “তনোতি মুখবিক্রিয়াং যুবতীসঙ্গ-রঙ্গোদয়ে ন তৃপ্যতি ন সর্বতঃ সুখময়ে সমাধাবপি। ন সিদ্ধিষু চ লালসাং বহতি লভ্যমানাস্বভি প্রভো তব পদার্চনে পর মুপৈতি তৃষ্ণাং মনঃ ॥’’
অর্থাৎ ‘যুবতীসঙ্গ-রঙ্গের (স্মৃতির) উদয় হইবামাত্র আমার মন মুখবিকৃতি বিস্তার করে, নির্বিশেষ-ব্রহ্ম-সমাধির নিমিত্ত যে সব শ্রবণ-মননাদির অনুষ্ঠান, তাহাতেও আমার অতৃপ্তি (পুনরাগ্রহ) হইতেছে না অর্থাৎ উহাকে যথেষ্ট জ্ঞানে ঘৃণা করিতেছে এবং সিদ্ধিসমূহের প্রতিও আমার আর লালসা হইতেছে না; হে প্রভো! (ভগবন্!) কেবলমাত্র তোমার পাদপদ্মার্চনেই আমার মন পরম তৃষ্ণা লাভ করিতেছে।’
বিবৃতি। নিত্য-বিষয়বিগ্রহ স্বয়ং ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণও এবং শ্রীবলদেব-মধুর-রসের আশ্রয়বিগ্রহ গোপীগণের ভোক্তৃস্বরূপে অবস্থিত হইবার যোগ্য; বদ্ধ জীবের ন্যায় তাঁহাদিগের কোনও অচিৎ-সুলভ দোষের কথা নাই; অর্থাৎ প্রপঞ্চে নিত্য বশ্যতত্ত্ব আশ্রয়জাতীয় জীবগণ আপনাদিগকে ‘পুরুষ’ যা ভোক্তাভিমানে যে স্ত্রীলোকের বা প্রকৃতির সঙ্গ করে, তাহাই দূষণীয়; কিন্তু যাবতীয় বিষ্ণুতত্ত্বের মূল পুরুষ ভগবান্ শ্রীবলরাম স্বীয় রাসস্থলীতে যে ক্রীড়া করিয়া থাকেন, তাহাতে প্রাপঞ্চিক হেয়ত্বের বা অবৈধ ব্যবহারের কোনই সম্ভাবনা নাই। তাই, শ্রীবলদেবতত্ত্ববিং পরম-সৌভাগ্যবান্ মুনিগণও দিব্যদর্শনে নিখিলসত্তার অধীশ্বর পরমেশ্বর শ্রীবলরামের লীলা দর্শন করিয়া করযোড়ে স্তব করিতে করিতে আনন্দ প্রকাশ করেন॥২৯॥