লীলা-পরিকরাদি-যুক্ত অনাদি আদি শ্রীজগন্নাথ-মিশ্র-নন্দন শ্রীগৌর-সুন্দরের বন্দনা —
নমস্ত্রিকাল-সত্যায় জগন্নাথ-সুতায় চ।
স-ভৃত্যায় স-পুত্রায় স-কলত্রায় তে নমঃ ॥২॥
অন্বয়। ত্রিকালসত্যায় (বিশ্বসৃষ্টেঃ অগ্রে, মধ্যে, অন্তে ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যদিতি সর্বেষু কালেষু সত্যায় নিত্যায় সনাতনায়,—ইত্যনেন শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেবস্য অদ্বয়-ভগবত্তাসর্বকারণকারণত্বং চ সূচ্যতে) জগন্নাথসুতায় (নিত্যঃ অজঃ অপি তেন জগন্নাথমিশ্রস্য পুত্ৰত্বেন বৈকুণ্ঠে ঐশ্বর্যলীলায়া অপি মথুরায়াং জন্মদিলীলায়া উৎকর্যঃ প্রদর্শিতঃ তাদৃশ ভক্তবৎসলায়) সভৃত্যায় (সপরিকরায় সাঙ্গোপাঙ্গাস্ত্রপার্ষদায় ইত্যর্থঃ) সপুত্রায় (শিষ্য-পারম্পর্যক্রমেণ তদাশ্রিতত্যক্তগৃহভক্তবৃন্দসহিতায়, শৌক্রপারম্পর্যেণ তস্য বংশাভাবাৎ; যদ্বা, ‘সংকীর্তনৈকপিতরৌ’ ইতি বচনাৎ কৃষ্ণসংকীর্তনমেব তস্য পুত্রঃ, তেন সহিতায়) সকলত্রায় (রাগমার্গে শ্রীগদাধর স্বরূপ-রামানন্দাদি-স্বশক্তিভিঃ, বিধিমার্গে তু শ্রীলক্ষ্মীপ্রিয়াবিষ্ণুপ্রিয়াভ্যাং সহ বর্তমানায়) তে (তুভ্যং ভগবতে) নমঃ॥
অনুবাদ। হে প্রভো! আপনি—ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান, এই তিন কালেই সত্য, আপনি—জগন্নাথমিশ্রের নন্দন; আপনার পরিকর বা ভৃত্যরূপী ভক্তগণের, আপনার পুত্রগণের (‘পুত্র’-পর্যায়ে গৃহীত ‘ত্যক্তগৃহ গোস্বামী’ প্রভৃতি শিষ্যগণেব, অথবা ‘কৃষ্ণসংকীর্তন’-নামক অভিধেয়বিশেষে) এবং আপনার কলত্রগণের (বিধিবিচারে—‘ভূ’—শক্তিস্বরূপা শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া, ‘শ্রী’শক্তিস্বরূপা শ্রীলক্ষ্মীপ্রিয়া এবং ‘লীলা, নীলা বা দুর্গা’-শক্তিস্বরূপ শ্রীনবদ্বীপ-ধাম, এবং রুচি-বিচারে—শ্রীগদাধরদ্বয়-নরহরি রামানন্দ-জগদানন্দ প্রভৃতি শক্তিবর্গের) সহিত আপনাকে পুনঃ পুনঃ নমস্কার করিতেছি॥২॥
বিবৃতি। বন্দনার দ্বিতীয়-শ্লোকে শ্ৰীমন্মহাপ্রভু এই রূপে বন্দিত হইয়াছেন। তিনি—ত্রিকাল-সত্য বাস্তব বস্তু, অর্থাৎ অনাদিনিধন নিত্য-তত্ত্ব। ভৃত্য, পুত্র ও কলত্রাদি অঙ্গোপাঙ্গাস্ত্রপার্ষদরূপ বিলাস-পরিকরগণের সহিত সেই জগন্নাতসুত শ্রীগৌরসুন্দরকে নমস্কার।
‘জগন্নাথসুত’ বলিতে একবচনে শ্রীগৌরসুন্দরই লক্ষ্যস্থল; জগন্নাথের অপর পুত্র শ্রীবিশ্বরূপ বা শঙ্করারণ্য-স্বামী লক্ষিত হন নাই; যেহেতু তিনি বাল্যেই সন্ন্যাস গ্রহণ করায়, এবং কোন উদাসীন শিষ্যের দীক্ষাগুরু না হওয়ায়, তৎপ্রতি পরিবর্তি-বিশেষণদ্বয় ‘সকলত্র’ ও ‘সপুত্র’ প্রযুক্ত হইতে পারে না।
যদি বল, শ্রীগৌরসুন্দরের প্রতিই বা কিরূপে ‘সপুত্র’ পদটী প্রযুক্ত হইতে পারে? তদুত্তরে জানিতে হইবে যে তদীয় উদাসীন ‘গোস্বামী’ শিষ্যগণই তাঁহার ‘পুত্র’-পর্যায়ে গৃহীত হইয়াছেন; আর ‘গৃহস্থ’ শিষ্যগণই তাঁহার ‘ভৃত্য’ পর্যায়ভুক্ত হইয়াছেন। পুত্র-পর্যায়ে অচ্যুত-গোত্রীয় ত্যক্তগৃহ ত্রিদণ্ডিগণের স্থান; শ্রীরূপপ্রভু স্ব-কৃত ‘উপদেশামৃতে’র আরম্ভে শ্রীরূপানুগ-সম্প্রদায়কেই ‘ত্রিদণ্ডি’-সম্প্রদায় বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। ইঁহারাই প্রকৃতপক্ষে শ্ৰীমন্মহাপ্রভুর নিজবংশ। শ্রীঅদ্বৈত-সন্তান শ্ৰীঅচ্যুত প্রভুই অচ্যুত গোত্রীয়গণের মূল পিতৃপুরুষ-সূত্রে স্বীয় ‘অচ্যুতানন্দ’-সংজ্ঞা গ্রহণ করিয়াছেন। শ্রীনিত্যানন্দ ও শ্রীঅদ্বৈত-প্রভুদ্বয়ের অধস্তনগণ—তাঁহাদের প্রভুদ্বয়েরও প্রভু শ্ৰীমন্মহাপ্রভুর ‘ভৃত্য’ মাত্র।
বিধি বিচারে,—‘ভূ’শক্তিস্বরূপা বিষ্ণুপ্রিয়া ও ‘শ্রী’শক্তি স্বরূপা লক্ষ্মীপ্রিয়া-নাম্নী শ্রীগৌর-নারায়ণের পত্নীদ্বয় এবং লীলা, নীলা বা দুর্গা শক্তিস্বরূপ শ্রীনবদ্বীপ-ধাম; আর, রুচি বিচারে,—শ্রীগদাধরদ্বয়, শ্রীনরহরি, শ্রীজগদানন্দ, শ্রীবক্রেশ্বর, শ্রীরামানন্দ ও শ্রীরূপসনাতনাদি গোস্বামিগণ, সকলেই শ্রীগৌর-গোবিন্দের ‘কলত্র’-পর্যায়ে গৃহীত হইয়াছেন।
শ্রীল কবিরাজ গোস্বামী (চৈঃ চঃ আদি ৭ম পঃ ১৪ শ সংখ্যা) লিখিয়াছেন,—“এক মহাপ্রভু, আর প্রভু দুই জন। দুই প্রভু সেবে মহাপ্রভুর চরণ”।